‘পথটা বন্ধুর’- হয়তবা তার জীবনের মতই।
পথিক। কোন এক অজানা অন্মেষায় চলছে সে। অজানা অন্মেষাটুকু এবং তার প্রাপ্তির মাঝে যে ব্যবধান, সে ব্যবধানের সর্পিল দূরত্বটুকু অতিক্রান্তে তার আজকের অবস্থান- যেখানে, পৃথিবীর সে নগ্ন দুয়ারে প্রসারিত দৃষ্টিতে সুধু ধরা দেয় অচেনা অথচ এক উদ্ভাসিত মমতা মাখা নতুন পৃথিবী। নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে, চাউনিতে তার একটাই অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলে- প্রকৃতির দুয়ারে নিজেকে সমর্পণ।
অথচ, এই সমর্পণের ব্যাপ্তিকাল সময়টুকু যখন সে অতিক্রম করে- সে অতীতীয়তা কতটা আমন্ত্রিত- পথিক জানে না। সে সুধু জানে তার চেনাজানা পল্লব গৃহাঙ্গনের সদর দরজা পাড়ি সে দিয়েছে অনেক আগেই। চোরাবালির অতল গহ্বরে ডুবে যেতে যেতে নিশ্বাসের শেষ বিন্দু ফুরবার আগেই তার আত্বসত্তা চিৎকার করে উঠে। নতুন করে প্রেরণা পায় সে পথ চলার।
পথিকের গন্তব্য ?
দিগন্ত যেখানে ভূমির সাথে মিশে গেছে- সেখানেই তার গন্তব্য।
শহর গ্রাম পেড়িয়ে একবার সে উপস্থিত হয়েছিল এক মরূদ্যানে। নির্লিপ্ত বালুকাবেলায় যখন তার জীবনের ছন্দের রেশটুকু ধ্বনিত হচ্ছিলো খেজুরপাতার ছন্দ হিল্লোলের মত করুন সুরে- তখন সে মরূদ্যান ক্ষণকালের জন্য হলেও পথিক কে আবারও আমন্ত্রণ জানায় তার জীবনের পথে- প্রাপ্যতার অন্মেষায়।
জীবনের এ আমন্ত্রণে আমন্ত্রিত হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে পথিকের মন। বালুকাবেলায় সূর্যের স্বর্ণাভার ‘পরে আকাশ ছোঁয়া সবুজ প্রকৃতিরাজ বেষ্টিত এক স্বপ্নিল মায়াভিরাম সে মরূদ্যান। স্বর্ণাভার আলিঙ্গন ছাড়িয়ে তার ক্লান্ত দেহাবয় নিয়ে বসে পরে সে বৃক্ষের নিচে। বৃক্ষরাজি তার সমস্ত ভালোবাসার পরশ দিয়ে পথিককে নিয়ে গেল এক স্বপ্নিল রাজ্যে।
সেখানে এক রাজকন্যার হাত ধরে পথিক চলছে সূর্যের শেষ আভার পিছু পিছু।
যখন নয়ন মেলে তাকাল পথিক- তৃষ্ণায় তার বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে।
মুহূর্তেই পথিকের মন ব্যাকুল হয়ে উঠে। তার ক্লান্ত দেহাবয়, তৃষ্ণার্ত প্রতিটি দেহ কণা চিৎকার করে উঠে জলের জন্য। পথিকের মনও ডুব দেয় জলের অভ্যন্তরে। সেখানে পদ্মপাতার রক্তিম পল্লব ছাড়িয়ে এক ভালোলাগার অবসাদ ঘিরে ধরে পথিককে। নিজেকে আবার আবিষ্কার করার প্রয়াস নেয়- তপ্ত মরুভূমির জীবন-বাঁকে এক পশলা শীতল জলধারার বইয়ে চলা স্রোতের মত।
হ্যাঁ, জলধারার বুকের এক আঁচল হলেও জীবন-সুধা তার চাইই চাই।
কিন্তু পথিক বিমোহিত হয়ে নিজের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলে আবারও- যখন দেখে জলধারার পাশে একমাত্র গোলাপ বৃক্ষে একটি মাত্র রক্তাভ পুষ্প ফুটে আছে।
অপূর্ব মোহময়ী গোলাপটি যেন পথিককে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। গোলাপটি তাই চাইই চাই।
মরূদ্যানের শেষ প্রান্তে বিশাল এক ধূসর অট্টালিকা । সেখান থেকে ভীষণ দর্শন এক দানব পথিকের সামনে এসে দাঁড়াল। পথিক অনেকটা ভয়, অনেকটা করুণার দৃষ্টিতে চাইল দানবের প্রতি।
দানব বলল, ‘হে পথিক ! তোমার মনের সবই আমি অবগত। কিন্তু তুমি দুটো জিনিস এক সাথে চাইতে পার না। যে কোন একটি চাইতে হবে তোমাকে। বল, কি চাই তোমার ? ঐ পুষ্পক-ধারার জল নাকি ঐই একমাত্র রক্তাভ গোলাপটি ? বল পথিক। না হয় আর একটু চিন্তা করে বল কোনটা চাই তোমার’।
পথিকের ভাবনার তলে হারিয়ে গেল জলধারা। যে জলধারার প্রবাহ ক্ষণকাল পূর্বেও প্রবাহিত হচ্ছিলো পথিকের সমস্ত দেহ-মনে। এখন সেখানে, শুষ্ক মরুভূমির বুকে যেন গজিয়ে উঠেছে একটি গোলাপ বৃক্ষ এবং সেখানে একমাত্র রক্তাভ গোলাপ।
পথিক তাৎক্ষনিক উওর দিল, ‘হে দৈত্যরাজ ! আমি এই জল চাইনে। জল পেলে হয়তবা প্রাণে রক্ষা পাব। কিন্তু আমি আমার বহুদিনের প্রতীক্ষা-লালিত স্বপ্ন রক্তাভ ঐই গোলাপটি সামান্য জলের বিনিময়ে পারবনা হারাতে। না হয় ঐ পুষ্পের কোলে মাথা রেখে চলে যাব মৃত্যুর রাজ্যে’ । দৈত্যরাজ সামান্য বিচলিত হল। বলল, ‘পথিক ! তুমি ঠিক ভেবে বলছ ঐই কথা ? না হয় তুমি আরও একবার ভাবো’।
পথিক বলল, ‘হে দৈত্যরাজ ! আমি ঐই পুষ্পটাই চাই’।
‘হে মূর্খ পথিক, তবে তাই হোক। কিন্তু সাবধান। ঐই জলের দিকে ঘুণাক্ষরেও চাইবে না। যদি আমার আদেশ অমান্য কর, তবে তোমার ঐই মস্তক আমি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এ জলধারায় নিক্ষেপ করব’।
দানব তার অট্টালিকায় চলে গেলে পথিক পা বাড়াল গোলাপটির উদ্দেশ্যে।
এখানে পাথর তুল্য সক্ত মৃত্তিকা। সেখানে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছে পথিক, আবার উঠে চলছে দ্বিগুণ উৎসাহে।
এতদিনের লালিত স্বপ্ন, পথিকের সেই রুপতা- সেই ভালোবাসা যখন আজ মুখোমুখি। আজ সেই প্রাপ্তি- সেই পথচলার।
পথিক আদিম উন্মাদনায় হাত বাড়াল সে পুষ্পের কোমল পাপড়িতে। কিন্তু ছলনাময়ী গোলাপ তার বিষের কাঁটায় ক্ষত বিক্ষত করে তুলল পথিকের সমস্ত শরীর। তার শিরা উপশিরায় বইয়ে চলল বিষের নীল স্রোত।
মুখ থুবড়ে পথিক পড়ে রইল সে গোলাপ বৃক্ষের নিচে- পাথর তুল্য মৃত্তিকার কঠিন আলিঙ্গনে।
যখন হুঁশ ফিরল পথিকের- নিজেকে আবিষ্কার করে মরুভূমির বুকে, ক্লান্ত দেহাবয় নিয়ে সে হেঁটেই চলছে।
তারপর, সে হেঁটেই চলছে-
চলছে দিগন্ত সমীরণের যাত্রায়।
(রচনাকাল: ২০০৫)