ঈদের কিছুদিন পর, রাতে মেঝ ভগ্নীপতি ফোন করে সিলেটে ঘুরতে যাবো কিনা জানতে চাইলেন। প্রশ্ন করলাম কখন যাবেন? তিনি বললেন আজ রাতেই যেতে হবে। বন্ধু-বান্ধবের সাথে শর্ট নোটিসে যেকোন স্থানে ঘুরতে যেতে আমার বাধেনা। কিন্তু পরিচিত ও অপরিচিত আত্মীয়দের সাথে হঠাৎ করেই ঘুরতে যেতে মন চাইল না। মোট কথা মানষিক কোন প্রস্তুতি না থাকায় ভগ্নীপতিকে সরাসরি না করে দিলাম। এতে অবশ্য লাভ হয়েছে আমার। সিলেট থেকে আসার পথে তাদেরকে যে সমস্যার মাঝে পড়তে হয়েছিলো সেই অস্বস্থিকর পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেলাম। দুলাভাইকে না করেদিতে কিছুটা দ্বধান্বিত ছিলাম কারন এ পর্যন্ত সিলেটে আমার যাওয়া হয়নি। এখন একটা সুযোগ এসেছে তাই না গেলে অনেক কিছুই মিস করবো। কিন্তু এদিকে যখন তখন বৃষ্টি পড়ার এই মৌসুমে ঐ পাহাড়ি এলাকায় যেতে মন সায় দিচ্ছিলনা। তাছাড়া মানুষ ঘুরতে যায় শীতের সময় তখন কুয়াশা আর ঠান্ডায় আলাদা একটা আমেজ তৈরী হয়। বৃষ্টি হবার কোন সম্ভাবনাও থাকেনা। তাছাড়া মাধব কুন্ডের এতদিনে মৃতপ্রায় ঝর্না দেখার ইচ্ছেটা আগের তুলনায় অনেকটা মৌনই থেকে গেল। সব মিলে ভগ্নীপতিকে না বলে দেয়টা সহজই হলো আমার জন্য।
সিলেট থেকে ফিরেই আশুলিয়ায় বড় একটা টীম নিয়ে নৌবিহারে বের হবার প্ল্যান আগে থেকেই করে রেখেছিলেন মেঝ ভগ্নীপতি। সেখানে যাবো কিনা তা জিজ্ঞেশ করলেন, আর বললেন আমি গেলে আপু, ছোট বোন আর বড় বোন তনয়া দুই ভাগ্নী ও ভাগ্নেটাও যেতে পারবে। শুধ শুধু আমার জন্য বাকী সবাইকে মাহরুম করার চেয়ে যেতে রাজি হয়ে গেলাম। তাছাড়া বর্ষার অকৃপন বরষনে দু-কুল ছাপিয়ে ওঠা ভরা নদী দেখার খায়েশটাও জেগে উঠছিলো কেমন যেনো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি তৈরী হয়ে গেলাম। বড়বোনের ঘরের কনিষ্ঠ ভাগ্নীকে নিয়ে রওনা হলাম মেঝ বোনের বাসা বাড্ডায়। সেখানে পৌছে আমরা একটি ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে ছুটে চললাম উত্তরা ইস্ট ওয়েষ্ট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। ওখানে রাস্তার পাশ থেকেই নৌকায় আমাদের তুলে নেবে বাকীরা। কুড়িল বিশ্ব রোডের অশহনীয় জ্যাম আর দুপুরের তাল পাকা রোদে আমাদের প্রায় সিদ্ধ হবার যোগাড়। জানটা মনে হচ্ছিলো জিহবার একেবারে আগায় এসে ঠেকলো। জ্যাম ছাড়েই না। ঢাকার এই উত্তরার সাইডে আমার এর আগে কখনও আসা হয়নি। সর্বোচ্চ বিমান বন্দর, এর এপাশে আমার এই প্রথম আসা। উত্তরার প্রায় রাস্তা গুলোই বড় বড় পুকুর বিশিষ্ট। অন্তত আমরা যে পথ দিয়ে গেলাম তার অবস্থা হয়তো একটু বেশী করুন ছিলো। গাড়িতে চড়ে বসলে মনে হয় ফ্যান্টাসি কিংডমের রোলার কোষ্টারে চড়ে বসেছি।
এদিকে সিলেট থেকে মেঝ ভগ্নীপতিরা আমাদের সাথে আশুলিয়ার নৌবিহারে যোগ দেবেন। কিন্তু বিপত্তি বেধে গেলো তখন যখন মাঝ পথে এসে তাদের ভাড়াকরা মাইক্রোটা নষ্ট হয়ে গেলো। অনেক চেষ্টা-তদবির করে প্রথম বারের মতো গাড়ী ঠিক করা গেলেও কিছুদুর যেতে না যেতেই আবারো গাড়ীটি নষ্ট হয়ে গেলো। এবার আর কোন কাজ হলো না। বেয়াড়া গাড়িটা আর ঠিক করা গেলই না। শেষ অবদি ঢাকা থেকে বিকল্প গাড়ী পাঠিয়ে তাদেরকে ঢাকায় আনতে হলো। তারা যখন ঢাকায় পৌছলেন তখন আমাদের নৌবিহার একেবারে শেষ পর্যায়ে। তাই তারা আমাদের সাথে আর যোগ না দিয়ে সোজা বাসায় চলে গেলেন।
অনেক চরাই উৎরাই পেরিয়ে আমরা উত্তরা ইস্ট ওয়েষ্ট মেডিক্যাল এর সামনে এসে পৌছলাম। সেখানে যোহরের নামাজ পড়ে নৌকায় উঠলাম। নৌকায় উঠে যাদের সাথে সাক্ষাত হলো তারা কেউ আমার চেয়ে বড্ড বেশী ছোট আর কেউ আমার বাবার বয়েসী। ছোট্ট ট্রলার। ছাদে ছাউনি টাঙ্গিয়ে পুরুষরা বসেছে আর নীচে মহিলারা বসেছে। উপরে অবশ্য কয়েকজন মেয়ে-ছেলে ছিলো। ট্রলারের ছাদে পুরুষের আধিক্য আর নীচে মহিলাদের একক উপস্থিতি দেখে আমি বোন ও ভাগ্নীদের নীচে পাঠিয়ে দিয়ে ছাদে গিয়ে বসলাম। ভাগ্যিস একজনের সাথে আমার পুর্ব পরিচিতি ছিলো। তিনি আমাকে সোৎসাহে সম্ভাষন জানালেন। অন্তত কেউ নই এমন ভাবটা কেটে গেলো। তবে যিনি আমাকে সম্ভাষন জানালেন তিনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক অনেক বড়। তার উপর তিনি এসেছেন সপরিবারে। তার বাচ্চা-কাচ্চাকে সামাল দিতেই ব্যাস্ত থাকতে দেখলাম সারাক্ষন। বাদ বাকি সবাই আমার অপরিচিত। হাই হ্যালো আর প্রাথমিক পয়-পরিচয় ব্যাতিত আর কিছুই হলো না। অগ্যতা আমি এক কোনে গিয়ে ঠায় বসে রইলাম আর প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগে মত্ত হলাম।
নদীর তীর ঘেষে গরে উঠেছে বিভিন্ন কল কারখানা। নদীর বুক জুড়ে আছে ড্রেজিং মেশিনের দৌরাত্ব, সাথে আছে অসংখ্য ইটের ভাটা। বর্ষার প্রবল বর্ষনের কারনে ইটের ভাটা গুলো ডুবে গেছে। মাঝে মাঝেই নৌকাগুলো ইট ভাটায় সাজিয়ে রাখা ডুবন্ত ইটের স্তুপের সাথে হোচট খাচ্ছে। এখানে সেখানে গজিয়ে ওঠা গাছ গুলো যেন গলা অবদি ডুবিয়ে রেখে আছে, এখুনি ডুব দেবে বলে। পানি চিরে এগিয়ে যাচ্ছে কাঠের নৌকা গুলো। সেই সাথে এদিক ওদিক দিয়ে ধীর লয়ে ছুটে যাচ্ছে অসংখ্য ট্রলার ও নৌকা। পানির নীচে ডুবে থাকা কয়েকটা পরিত্যাক্ত বাড়িকে দ্বীপের মতোই মনে হলো। কেমন যেন বিরান হয়ে পড়ে আছে ওগুলো।
আমাদের ট্রলারটি এগিয়ে চলছে আর আমি বোবা হয়ে বসে বসে উপভোগ করছি নদীর দুপাশের দৃশ্য গুলো। একপাশে বেড়ীবাঁধের উপর রাস্তা। সেখানে ছুটে চলছে যান্ত্রিক যানবাহন। পাল্লা দিয়ে চলছে ওরা। মাত্র দুই লেনের ঐ রাস্তায় কে কাকে পেছনে ফেলে যেতে পারে চলছে তারই প্রচেষ্টা। দেশে এতো এতো সড়ক দুর্ঘটনার একটিও আমাদের জন্য শীক্ষনীয় হতে পারেনি বলেই বুঝা গেলো। মিরসরাইয়ের ট্রাজেডী জাতির জন্য মোটেও কোন ট্রাজেডী ছিলো না। তা না হলে কেন এখনও ছোট ছট মিনি ট্রাক গুলোতে পঞ্চাশেক যাত্রী নিয়ে এখনও যান গুলো চলাচল করে?
আমাদের ট্রলার ছুটে চলছে সেই আমিন বাজারের দিকে। তামান্না ফ্যামিলি পার্কের দিকে। যেতে যেতে আমাদের প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেলো। আসরের নামাজ ট্রলারের ছাদেই পড়ে নিলাম। আমিন বাজারের দিকে তামান্না ফ্যামিলি পার্ক যখন পেরুলাম ততক্ষনে বেলা গড়াতে শুরু করলো। কিছুক্ষন পরেই সন্ধ্যার আভা নেমে আসবে। তাই আর দেরি না করে ট্রলার ঘুরিয়ে আবার ছুটে চললাম বাড়ী ফিরবার পথে।
আমার এই নৌবিহারটা খুব একটা মজার না হলেও মজার কিছু জিনিস চোখে পড়লো। আসে-পাশের রেষ্টুরেন্ট গুলো একেকটি ডেটিং স্পটে পরিনত করে ফেলা হয়েছে। পানির উপর বানানো হয়েছে খোপ খোপ করা ছোট ছোট ঘর। কপোত কপোতিদের জন্য এক আদর্শ রেষ্টুরেন্ট ওগুলো। পুরো জায়গাটাই ইল্যিগ্যাল রিলেশনশীপের প্রোমোটার হিসেবে কাজ করছে বলে মনে হলো। এমন একটি স্থান যেখানে সমাজের পরিচিত জনের মুখোমুখি হবার ভয় নেই। দেদারসে প্রেমরসে আসক্ত হয়ে বুদ হয়ে যাওয়া যায় এখানে। চারিপাশের যারা লোকজন আছে তাদের সবাই একই মামলার আসামি। বাসা বাড়ি হতে অনেক দূরে এসে এরা লুকোচুরি করে প্রেমের লিলা খেলা খেলছে। অবশ্য এদের মাঝে যে সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ মানিক-জোড় নেই তা নয়। কিন্তু তাদের সংখ্যা খুবই নগন্য।
ফেরার পথে দেখলাম নদীর তীর থেকে কিয়ৎ দূরেই একটা ছোট কাঁশ বনে বরা দ্বীপ। দ্বীপটির অপর পাশে কয়েকটি ছাউনি ওয়ালা নৌকা ভেড়ানো। নৌকার ছাউনির দুপাশেই কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা। তাই ভেতরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না। এতোগুলো নৌকা একই ষ্টাইলে ওখানে বাঁধা দেখে স্বভাবতই কৌতুহল জাগলো। ব্যপারটা কি তা অনুধাবন করার জন্য এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। দেখলাম দুটি নৌকা তীরের দিক থাকে আসছে। নৌকাতে মাঝি এবং ছাউনির নীচে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। তারা নিজেদের ভুবনে এতটাই নিমগ্ন যে বাহিরে কেউ কি দেখছে না দেখছে তার কন বালাই নেই। নৌকা দুটি ঐ দ্বীপের আড়ালে থামলো। মাঝি নেমে ছাউনির খোলা দুই পাশ কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়ে কাঁশ বনে ঢুকে গেলো। ভেতরে রয়ে গেলো দুজন। এর পর ভেতরে কি হলো তা আমাদের চোখের অন্তরালেই থেকে গেলো। তবে বাকী নৌকাগুলোর একই ষ্টাইলে ওখানে দাঁড়িয়ে ভেসে থাকা আর মাঝির কাঁশ বনে হারিয়ে যাবার অর্থটা এবার খোলাশা হলো। মনে মনে ভাবলাম বদলাবার আর দরকার কি? বদলেই তো গেছে সব। বদলে দেয়া হয়েছে দেশের সব নৈতিকতা। দিন বদলের গান বুঝি সফল হলো।
বাংলাদেশ একটি দেশ যার কপালে নৈতিকতা সুদুর পরাহত, সেই কারনে সুসাশন আর সৎলোকের আবির্ভাব বহুদুর পিছিয়ে গিয়ে অশ্লিলতার জঞ্জালে জড়িয়ে গেছে। এখানে নীতি-নৈতিকতা, সৎ চরিত্র, সাহসী যুবকদের সত্য উদ্ঘাটনের পিপাসা টুটে গেছে। ওরা নিষিদ্ধ ও অনৈতিকতার মাদকতায় মাতাল হয়ে ধ্বংশের অতল গহ্ববরে তলিয়ে গেছে। তাদের যারা টেনে তুলবে তাদেরকে ইতিহাসের কারাগারে বন্দী করে রেখেছে দুর্বৃত্তরা। আগামীদিনের সুর্যটা তাই আলো বিকিরন করবে ঠিকই তবে তা আমাদের যুবসমাজের বুকের গহীনে জমেথাকা গুমোট অন্ধকারকে হটাতে অক্ষম। কারন নৈতিকতার রক্তিম সুর্যটাকে স্তিমিত করে রেখেছে এক শ্রেনীর বুদ্ধিজীবিরা ও মিডিয়া কর্মিরা যার থেকে আমাদের ঘুনে ধরা এ সমাজও দায় মুক্ত নয়। অনেকের মতে এটা ওপেন সোসাইটির দর্পন হতে পারে কিন্তু প্রকৃত অর্থে এটিই সামাজিক মুল্যবোধ ধ্বংশের অশনি সংকেত।