সারাটা দিন মানুষ দেখি
এবার একটু আকাশ দেখতে চাই,
ও আমার সন্ধ্যা রাতের তারা
আমার জন্য জ্বলে উঠ ভাই......
তুমুল কাল বৈশাখি শেষে আকাশ এখন ঝকঝকে পরিষ্কার । গুন গুন করতে করতে আকাশের দিকে তাকিয়ে শানু দেখতে পেল আসলেই অনেকগুলো তারা যেন তার দিকে তাকিয়েই জ্বল জ্বল করছে । রুমে থাকা ফোল্ডিং প্লাস্টিকের চেয়ারটা নিয়ে খোলা ছাদে বসতে বসতে এই চেয়ারটি কেনার কথা মনে পড়ল তার । প্লাস্টিকের চেয়ার ও যে ফোল্ডিং এর হতে পারে শুরুতে এটা তার মাথায়ই ঢুকছিলনা, একসময় বিয়ে বাড়ি কিংবা নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে দেখা যেত ডেকোরেটরের কাঠের ফোল্ডিং চেয়ার । প্লাস্টিকের চেয়ার কিনতে গিয়ে এটা দেখার পর আর অন্য কোন চিন্তা না করে সোজা কিনে ফেলেছিল । ব্যাচেলরের বাসায় এটাই সবচেয়ে ভাল ব্যবস্হা, দরকার হলে ফোল্ড করে রাখা যাবে । আকাশের দিকে তাকিয়ে তার মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠল, তার উপর মনমাতানো একটা বৃষ্টি শেষের হিমেল বাতাস তো আছেই সাথে ।
এই বাসায় উঠেছে প্রায় একমাস হয়ে গেছে । যে আকর্ষনে সে এই বাসায় উঠেছে তা করার সুযোগ পেল আজকে , এই যুগে জীবন জীবিকার ব্যস্ততায় বাকি সবকিছু আসলে ধরাশায়ি, কিছু করারও যেন নেই । অনেক দিন ধরে সে এমন একটা বাসা খুঁজছিল যেখানে সে শুয়ে শুয়ে আকশ দেখতে পারবে, চাইলে খোলা ছাদে হাঁটতে পারবে , সোজাকথায় চিলেকোঠার একটা বাসা। একেত এই টাইপের বাসা সহজে খালি পাওয়া যায়না, আর খালি থাকলেও বাড়ি ওয়ালার মর্জির উপর, তিনি ব্যাচেলর দিবেন কিনা ।
মেস ছেড়ে দিয়ে নিজে একা একা থাকবে, এই ভেবে সে প্রায়ই বাসা খুজতে বের হয়, বাসাতো না আসলে চিলে কোঠার ঘর । দারোয়ানের কাছ থেকে এই বাসার খবর পাবার সাথে সাথে সে উপরে উঠে তাকে নিয়ে বাসাটা দেখার জন্য । বাসাটা দেখে শানুর যে অবস্হা হয়েছিল তা কে সোজা বাংলায় বলে মাথা নস্ট অবস্হা । ছয় কাঠার উপর মূল বাড়ি, তার অর্ধেক ছাদ খালি আর বাকি অর্ধেকে দুই রুমের দুটি করে মিনি ফ্ল্যাট । বাড়ি ওয়ালা রাজউকে পাস করা প্ল্যান ফাঁকি দিয়ে কি করে ছাদের উপর এটা বানাল সে চিন্তা বাদ দিয়ে চারপাশের খোলা আকাশ তার মুগ্ধতা কেড়ে নিল । চারপাশ ঘুরে দেখল সে , আশেপাশের বাসাগুলোকে ছাপিয়ে উপরে উঠার কারনে দিগন্ত একদম পরিষ্কার তার সামনে, কাছাকাছি এয়ারপোর্ট হওয়ায় বিমানের উঠানামাও দেখা যাবে মাঝে মাঝে । এটা একটা মজার জিনিস মনে হয় তার কাছে, এখনও মাথার উপর দিয়ে বিমান গেলে সে শৈশবের মতনই একবার গলা উঁচু করে চেয়ে দেখে, বিমান দেখার মুগ্ধতায় একটুও কমতি হয়নি তার ।
দুই রুমের বাসা- একটা রুম একটু ছোট, সাথে ছোট একটা কিচেন, একটা বাথরুম । আহ শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখা যাবে ভাবতেই তার মনটা ভাল হয়ে গেল । দারোয়ানের কাছে ভাড়া শুনে একটু দমে গেল সে, তার ঘর ভাড়ার জন্য বাজেটের চেয়ে খানিকটা বেশী । এমন বাসা সহজে পাওয়া যায়না, এই ভেবে সে ঠিক করল এটা সে নিবেই, একটু বেশী হলে হউক । নানারকম বিধি নিষেধ আর নিয়মকানুন বলার পর বাড়িওয়ালাও তাকে বাসা ভাড়া দিতে রাজি হয়ে গেল। হাজার দুয়েক টাকা এডভান্স দিয়ে সেও সাথে সাথে কনফার্ম করে গিয়েছিল।
মেস ছেড়ে মালপত্র নিয়ে একদিন সে উঠেও গেল । আকাশ দেখা হলেও অফিসের ব্যস্ততায় শান্তিমত দেখা হয়ে উঠেনি । ছুটির দিন আজ, সারাদিন ঘুমিয়েছে সে, সন্ধ্যায় কাল বৈশাখির শব্দে তার ঘুম ভেংগে গিয়েছিল । রুমে বসে ঝড় দেখতে ভালই লাগছিল তার। ঝড় থামার পর সে ছাদে এসে বসল। দূর থেকে একটি বিমান এগিয়ে আসছে দেখতে পেল, বিমানটি তার সামনে খুব নিচু দিয়ে রানওয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কেবিন লাইটগুলো দেখা যাচ্ছে । যতক্ষন দেখা যাচ্ছিল , সে ঐদিকেই তাকিয়ে রইল । মনে মনে ঠিক করল সামনে সুযোগ করে একবার প্লেনে চড়ে ফেলতে হবে। কক্সবাজারতো প্রতিবছরই একবার সে যায়, আগামীবার প্লেনে করেই যাবে। প্লেনে চড়তে কেমন লাগে এই জিনিস এতদিন ধরে না জেনে থাকার কোন মানে নাই, এমন না যে চড়ার সামর্থ্য তার নেই । এমন সময় সিঁড়ি দিয়ে কেউ একজন উঠে আসার শব্দ তার কানে আসল। উল্টো ঘুড়ে তাকিয়ে দেখে বাড়িওয়ালি ।
শানু চেয়ার ছেড়ে উঠে সালাম দিল । এই বাসায় উঠার পর অলরেডি তার কয়েকদফা বাড়ি ওয়ালির সাথে কথা হয়ে গেছে । বাড়িওয়ালা ছিলেন সাবেক সরকারি কমকর্তা, যুগ্মসচিব লেভেলের , বর্তমানে নানা কনসালটেন্সি কাজে নিয়োজিত আছেন, এই তথ্য অবশ্য তাকে বাড়িওয়ালিই দিয়েছেন । সরকারি কর্তাদের নিয়ে তার নিজের একটা ব্যক্তিগত বিশ্লেষন আছে, তা হল- এরা সারাজীবন চাকরি করে যে টাকা ঘুষ খায় তা দিয়ে বাড়ি বানানো হচ্ছে প্রথম কাজ এবং সে বাড়ি অতি অবশ্যই বউ এর নামে হবে । সবার সামনে ভাব ধরবে এই বাড়ি আসলে তার শ্বশুরের দানের টাকায় হয়েছে । হঠাত করে বাড়িওয়ালি বনে যাওয়া ঐ মহিলার তখন পা আর মাটিতে পরবেনা । বাড়ির যাবতীয় বিষয় দেখভাল করার দায়িত্ব তিনি তার কাঁধে তুলে নিবেন অথচ যে আগে জানতোইনা বাজার কেমনে করে , আর গৃহকর্তাকে কেবল মসজিদেই খুজে পাওয়া যাবে বেশীরভাগ সময় । এই সমস্ত চোরগুলা ভাবে এতএত হারামের উপর ভর করেও তারা পরকালে মাফ পেয়ে যাবে। সবচেয়ে বাজে বিষয় হল এরা তখন মানুষকে ধর্মের ব্যাপারে , নামাজ রোযার ব্যাপারে ওসিহত করা শুরু করবে । যার সমস্ত শরীর জুড়ে হারাম তার ইবাদত যে মূল্যহীন এটা কে বোঝাবে এদের ।
যায় হউক শানুর বিশ্লেষন এইখানেও সঠিক প্রমানিত হয়েছে । তার বাড়িওয়ালি কি করে একজন সচিব লেবেলের কর্তার বউ হিসেবে জীবন পার করেছে কোন মতেই তার মাথায় আসেনা । এই মহিলার পোশাক আশাক দেখলে কেউ বলবেনা যে এই বিশাল বাড়ির গৃহকর্ত্রী সে, তার কাজ কর্মের অবস্হা আরো খারাপ । গত একমাসে মোটামুটি এই মহিলার কাজকর্ম তার জানা হয়ে গেছে । সকালে উঠেই দারোয়ানের সাথে একদফা হাউকাউ করা চায় তার- না হলে সম্ভবত সকালের নাস্তা হজম হয়না । এরপর কিছুক্ষন বিরতি দিয়ে সে আবার দোতালা থেকে নিচে নেমে আসে কাজের মেয়ে সহ । এটা ওটা পরিষ্কার করায়, সেটা কোন সমস্যা না, সমস্যা হল ভাড়াটিয়াদের বাসায় আসা বুয়াদের সাথে তার বস্তির মহিলাদের মত হইচই করা। সে নিজেই দেখেছে দু তিনদিন, তার জন্য রান্না করতে আসা বুয়াও বলেছে এই কথা । বুয়ারা লিফট ব্যবহার করতে পারবেনা, তাদের স্যান্ডেল ময়লা থাকে - তাই সিড়ি দিয়ে উঠার সময় স্যান্ডেল হাতে নিয়ে উঠতে হবে । বুয়া বলেছে এমন হলে সে কাজ করতে আসতে পারবেনা । প্রথমে একবার ভেবছিল এই নিয়ে বাড়িওয়ালির সাথে কথা বলবে, পরে ভাবল কথা বলতে গলে না জানি উল্টা তাকেই বাসা ছেড়ে দিতে বলে বসে তার ঠিক নেই । ব্যাচেলর হিসেবে বাসা ভাড়া পাওয়ার যে ঝক্কি তার চেয়ে এক দুই বেলা না খেয়ে থাকায় বরং ভাল হবে। সে বুয়াকে সমাধান দিল এই ভাবে- তুমি যখন আসবা তখন নিচে যদি বাড়িওয়ালিকে দেখ তাহলে বাসায় না এসে চলে যাবা, কিছুক্ষন বাইরে ঘুরাঘুরি করবা । এরপর আসবা , আস্তে করে লিফটে উঠে যাবা, বাড়িওয়ালি যদি কিছু বলে বলবা আমি বলছি লিফট ব্যবহার করতে । আর আইসা যদি দেখ মহিলা তখনও দাঁড়িয়ে আছে তাহলে ঐদিন আর তোমার আসার দরকার নাই । আমি নিজে রান্না করে খেয়ে নিব !!
এই টাইপের মহিলারা যেমন হয় তার বাড়িওয়ালিও তার থেকে ব্যতিক্রম নয়। এরা সাধারনত কাউকে পেলে সেই যে কথা শুরু করে তার আর থামার নাম গন্ধ থাকেনা । শানুও অলরেডি কয়েকবার এই মহিলার খপ্পরে পড়েছিল। তার আর গল্পের শেষ নেই । তার জামাই এখন কেমন ইনকাম করছে এই গল্প থেকে শুরু করে কোন এলাকায় থাকার সময় তার কোন প্রতিবেশীকে সে কিভাবে পলিটিক্স করে অন্যদের চোখে খারাপ বানিয়েছিল , কোন গল্পই বাদ যায়না । কথায় কথায় শানু জানতে পারে এই বাড়িও নাকি মহিলার নিজের পছন্দমত ডিজাইনে করা। কারো বাড়ির বাড়ান্দা, কারো সিড়ি - যেখানে যেটা পছন্দ হয়েছে সবগুলার কম্বিনেশন দিয়ে নাকি তিনি এই বাড়ির ডিজাইন করিয়েছেন । মনে মনে সে হাসে আর ভাবে বড়ই কামেল মহিলা, আল্লাহই জানে বিল্ডিং এর ফাউন্ডেশনের কি অবস্হা । কথায় কথায় সে এও জানতে পেরেছে মহিলার কন্যা নাকি ভীষন রুপবতি, খালি বিয়ের প্রস্তাব আসতেই আছে , যদিও পড়ালেখা শেষ করার আগে তারা বিয়ে দিবেনা । শুনে আর শানু ভাবে , ঢাকা শহরে এমন বাড়ি থাকলে নিয়মিত বিয়ের প্রস্তাব আসারই কথা, তার জন্য বিশেষ রুপবতী না হলেও চলে। নিজের মেয়ে রুপবতী -এ কথা কোন মা এইভাবে বারবার বলতে পারে, তা এই মহিলার কাছ থেকে না শুনলে সে আসলে বিশ্বাস করতে পারতোনা । ছেলেও নাকি ভীষন পড়ুয়া , যদিও এই পুত্র কন্যা দ্বয়কে দেখার সৌভাগ্য এখনও তার হয়নি ।
কথায় কথায় সে এটাও জেনেছে সরকারি কর্মকর্তারা অন্য সরকারি কর্তাদের কাছ থেকেও বিশেষ করে অবসরে চলে গেলেত কথায় নেই, ঘুষ খেতে দ্বিধা করেনা। তার বাড়িওয়ালা নাকি বেশ ভাল পরিমান টাকা ঘুষ দিয়ে নিজের আয়কর রিটার্ন থেকে শুরু করে বাড়ির ট্যাক্স এর নানান বিষয়াদির ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে এসেছেন। লিফটের জন্য অপেক্ষা করছিল, এমন সময় বাড়িওয়ালি উপর থেকে নিচে নেমে এসেছিল। সালাম দিয়ে খালি জিজ্ঞাসা করেছিল, আন্টি কেমন আছেন। অমনি শুরু হল গল্প- আরে বলোনা, বিশাল টেনশন থেকে শেষমেষ মুক্তি পেলাম। তোমার আংকেলেরত গত কয়দিন যা দৌড়াদৌড়ি গেল। ইনকাম ট্যাক্স, বাড়ির ট্যাক্স, সে এক বিশাল ঝামেলার ব্যাপার। ওরা বলে এই বাড়িতে এত ইনকাম হয় , আপনাকে এত ট্যাক্স দিত হবে । শেষ মেষ কি আর করা, টাকা দিয়ে দফারফা করতে হল , ঘুষ খাবার চান্স পেলে কি আর এরা ছাড়ে। আংকেলকেও ঘুষ দিতে হল ! অবাক হবার ভাব নিয়ে সে প্রশ্ন করল , আর বুঝল কি ভুলটাই না করল, আরো দশ মিনিটের জন্য আটকা পড়ে গেল। এর মাঝে লিফট কয়েকবার উঠানামা করে ফেলেছে ।
অবশ্য গল্প শোনার মাঝে সে একটা কাজের কাজ করে ফেলেছে, তার বুয়ার জন্য লিফটে করে উঠা নামার অনুমতি আদায় করে নিয়েছে, নিজেই বলেছে, সে তার বুয়াকে বলে দিবে যেন আগে নিচে থেকে স্যান্ডেল পরিষ্কার করে নেয় । এই ধরনের বাচাল মহিলাদের কাছ থেকে মাঝে মাঝে গল্প শোনার বিনিময়ে কাজ আদায় করে নেয়া যায় ভেবে, নিজের নস্ট হয়ে যাওয়া সময়টাকে সে মেনে নিল। এই মহিলার কোথায় কোথায় জমি আছে, সেটা দখলে না বেদখলে সবই সে এখন জানে । আরো জেনে গেছে এই বাড়িতে নাকি কোন দারোয়ানই দুই মাসের বেশি টেকেনা, শানু বুঝে গেছে টেকার কথাও না । এই মহিলার আন্ডারে বেশি দিন কাজ করা কারো পক্ষে সম্ভব না, একেতো বাচাল, তার উপর বুয়া দারোয়ানদের সাথে সারাক্ষন খিচমিচ আর খারাপ ব্যবহারতো আছেই । যাই হউক তার বুয়াটা ঠিকমত আসতে পারলেই সে খুশি, রুমে এসে খাবার দাবার রান্না করা না থাকলে সে বিশাল পেইনের বিষয় ।
চলবে.............
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০২০ সকাল ১১:৫১