ঢাকায় আমি যেন হাপিয়ে উঠেছিলাম। প্রতিদিন ভোর ৫ টায় ঘুম থেকে উঠা। শাহজাহানপুর থেকে ৭.৩০/৪০ এ কারখানার গাড়ী ধরে মিরপুরে যাওয়া। ৫ টায় অফিস শেষ করে ৬/৭ টা বাজিয়ে বাসায় ফেরা। অফিসের সময়টাতে নিত্য-নতুন কাজ আর কেবলি কাজ। দীর্ঘ ২২ বছর সময় বিআইএসএফ-এ আমার এভাবেই কেটেছে। শুধু হাপিয়ে উঠা নয়; আমি প্রকৃতই ‘মানসিক ব্লকড’ হয়ে যাচ্ছিলাম! তবে এটা সত্য, কোন কাজের কাছেই আমি পরাভুত হইনি। চাকরীর শুরতে একজন প্রকৃত ও প্রভূত প্রশাসনিক জ্ঞানের অধিকারী, দক্ষ ও সৎ এবং ক্ষুরধার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সিনিয়র কর্মকর্তা, সৈয়দ নাজমুদ্দিন আহমেদ স্যারের অধীনে সরাসরি ৪ বছর প্রশাসনিক ও এস্টেট সম্পর্কীয় কাজ শেখার সৌভাগ্য ও সুযোগ আমার পেশাগত কর্মের ভবিষ্যত ভিত গড়ে দিয়েছিল । বিশেষতঃ সমস্যা চিহ্নিতকরন, আইনী পh©vলোচনা, এবং সিদ্ধান্ত প্রদানে ক্ষিপ্রতায় নাজমুদ্দিন স্যার ছিলেন অতুলনীয়। কি বাংলা, কি ইংরেজী- নোটিং এ তিনি ছিলেন শিক্ষকদের শিক্ষক। এ ছাড়া প্রশাসন বিভাগের অন্যান্য প্রাণবন্ত ও সুদক্ষ সহকর্মীদের সহযোগীতা আমাকে সব কাজে অনুপ্রানিত করতো (এখন আমি বিশাল কিছু, তা ভেবে কিন্তু এ লেখা লিখছিনা)।
পৌনে এগারটায় ঘুমিয়ে ভোর ৫ টায় ঘুম ভেঙ্গেছে। সিসিসি’র গেস্ট হাউজের শক্তি নিঃশেষিত ছাদের দিকে তাকিয়ে থেকে সদ্য ফেলে আসা সময়ের ওসব কথা হঠাৎ কেন আমার ভাবনায় এলো, বলতে পারবোনা। শুধু এটুকু মনে হচ্ছিল, অতীত কর্মক্ষেত্রে সাহচh© পাওয়া সব, স-ব মানুষের প্রতি আমি ভীষন কৃতজ্ঞ, ..!
বিছানা ছেড়ে পরিচ্ছন্নতার কাজ সেরে গেস্ট হাউজের একতলার খোলা ছাদে এলাম। এর প্রায় ৩০ গজ দূরে দক্ষিন দিকের চলাচলের রাস্তা দেখা গেল। পরে জেনেছি এ রাস্তা কুন্ড পাহাড়ের দিকে গিয়েছে।
অপরিচিত কিছু পাখির ডাক শুনছি। এর মধ্যে মাছরাঙার ডাকই বেশী শোনা যাচ্ছে। চারদিকে অনেক জঙ্গল। বোঝা যায়, সিসিসি’র বিশাল এলাকার তুলনায় দীর্ঘদিন লোকজনের বসবাস ও চলাচল না থাকায় প্রকৃতি ও এতে বসবাসকারীরা বেশ স্বাধীনভাবেই বেড়েছে। মাথার উপরে কট্-কট্ শব্দ আর গুড়ি গুড়ি কি যেন ছাদে পড়ছে। উপরে তাকালাম। অনেক উঁচু নারিকেল গাছের মাথায় দুই-তিনটি ইঁদুর জাতীয় প্রাণী। প্রথমে চিনতে না পারলেও পরে দেখলাম ওগুলো কাঠবিড়ারী! তবে এরা সম্পূর্ণটাই ছাঁই রঙের। সাদা-খয়েরী বাহারী সে লেজ এদের নেই। দিব্যি উপরে বসে ছোট ছোট ডাবের খোসা কাটছে। কয়েকটি ডাবে গর্তও দেখা গেল। ছেলেবেলায় বিদ্রোহী কবির ‘খুকী ও কাঠবিড়ালী’ কবিতা পড়ে এ প্রাণী সম্পর্কে যে সাধু-সুন্দর ধারনা মাথায় ছিল, পরে বাস্তবে সিসিসি-তে এদের নানা রকমের উৎপাত আর হিংস্র আচরন দেখে তা উবে গিয়েছিল।
চুপচাপ নিজ রুমে ফিরলাম। ডাক্তার এখনও ঘুমে নিমগ্ন। ৬.৩০/৭ টার মধ্যে নাস্তা খাওয়ার অভ্যাষ। ৭ টা বাজলো। ডরমেটরীতে নাস্তা হবে ৮ টায়।
গেস্ট হাউজের স্থাপত্যশৈলী এবং এরিয়া দেখে অনুমান করছি, এটি সে সময়ের অনিন্দসুন্দর ও রাজসিক এক স্থাপনা। কারখানা ও এর এলাকা ঘুড়ে দেখার খুবে ইচ্ছে করছিল। সিসিসি’র ‘ক্লোরো এ্যালকালি’ প্রজেক্ট এবং এর প্রডাক্ট সম্পর্কে আমার কোন ধারনাই নেই। শুধু শুনেছি ভয়ঙ্কর ‘ক্লোরিন’ গ্যাসের কথা। অবশ্য মানব সম্পদ সুরক্ষা, ব্যবহার, দল-ব্যবস্থাপনা, সিদ্ধান্ত গ্রহন, সংশ্লিষ্ট আইনী বিষয়াবলী, শৃঙ্খলামূলক কাজ ও প্রণোদনা ইত্যাদি ব্যতিত কারখানার টেকনিক্যাল/অন্যান্য ব্যাপারে আমি কখনই আগ্রহী হইনি। সবচেয়ে বড় বিষয়, আমি তত উঁচু পদেরও কেউ ছিলাম না। কিন্তু প্রতিটি ভিন্ন পেশাকে যথার্থ সম্মান দিয়ে এসেছি। আর সর্বাবস্থায়, নিজ দায়িত্ব সীমায় সর্বোচ্চ প্রাধিকার দিয়েছি কারখানার স্বার্থ ও কর্তৃপক্ষের নির্দেশনাকে।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, সুদীর্ঘকাল বিআইএসএফ-এ কাটিয়ে স্বল্প সময়ের কর্মস্থল সিসিসি’কে নিয়ে এত আবেগ আর লেখা কেন !? হাঃ হাঃ.. আসলে একঘেয়েমি ইট-পাথরের পরিবেশ পেরিয়ে, হঠাৎ কারও চোখের সামনে বিশাল সাগর পড়লে; তার পিছনের স্মৃতি সাময়িক আড়াল হয়ে যাওয়াই কি স্বাভাবিক নয় ? এমনকি পাশের মানুষটিও !
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২২ দুপুর ১২:৩৩