রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে সামান্য যা পরিচয় নিজের কাছে আছে, তা বাংলা, সংস্কৃতি এবং এ মাটির যাপিত জীবন৷ নিজের কাছে বললাম এ জন্যে, বাইরে পরিচয় দেয়ার মতো আমার কিছু নেই, আমার "মা"-কে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই, ছোটবেলা থেকেই আমাকে বিশ্বাস করে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছেন। ছোটবেলা থেকে একটা অভ্যাস আছে অন্যের কথাগুলো শোনার চেষ্টা করি, কোথাও বলি আবার কোথাও চুপই থাকি কিন্তু শুনি। বিশ্বাস করি মানুষের মহামূল্য রয়েছে, মানুষ বিরাট বড় একটা মহান খেলার জায়গা। সে হোক হাত-পা ছাড়া রাস্তায় ভিক্ষা করা কেউ।
ছোট এ জীবনে বহু বড় বড় মানুষ চিন্তার মানুষ পেয়েছি। যাদের অহমিকা নেই,চাহিদা নেই; জীবনের প্রাণখেলা আছে। অতি সাধারণ তাদের ছাপোষা জীবন। কোন মানুষের ভেতর কি আছে; আপনি বহিরাঙ্গ দিয়ে বিচার করতে পারবেন না। ধীরে ধীরে এ বোধটুকু হইছে।
কাজী নজরুলের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু বেড়ে উঠা ভাটি বাংলায়। পরাধীন দেশে। এ অঞ্চলের শিল্প,সাহিত্য ও জীবনের বৈশিষ্ট্য হলো কথকা,গীতগান,দৈনন্দিন জীবনের সাথে আপন শব্দ আওড়ানো। আরোপিত শব্দের চেয়ে আপন শব্দ বেশি৷ কিন্তু এ অঞ্চলের শিক্ষিত মানুষ সব সময় তার উল্টো। অহংবোধ বেশি। তাই এ অঞ্চলে সংস্কৃতির বড় বোধ ও সমন্বয় কম হয়েছে। এটি আধুনিককালের সমন্বয়ের কথা বলছি। ব্রিটিশ আগমন পূর্বে তা ছিলো। সবকিছুর একটা ঐক্য ছিলো, ঐক্যসূত্র ছিলো। বলছিলাম অতি যারা সাধারণ, অতি যারা আপন; তাদের কথা কেউ জানে না, কেউ শুনে না, বলে সবাই।
কাজী নজরুল মিলেছিলেন ভাটিতে। কলকাতার নগরজীবনের বাইরে তিনি এ ভাটিরও সন্তান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়ার ফলে আধুনিক নানা বাদ্যযন্ত্রের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। নাত-গান-কবিতার সাথে যোগ ছিলো, ছিলো ভাটির স্পর্শ। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অনেক বিষয় মাথায় ঢুকে গিয়েছিলো। পারস্য জীবন-চিন্তা তো ছিলোই।
পরাধীন দেশে ভাঙ্গার গান --- কারার ঐ লৌহ কপাট.......... একটি আপন সুর, আপন শব্দ এবং আপন সংগ্রাম।
এ নিয়ে আর বলার তেমন কিছু নাই প্রত্যকেই পরিচিত।
এবার আসি এ আর রহমানে; যিনি বিশ্বজয়ী সঙ্গীত শিল্পী।
হিন্দি এবং বাংলার যোগ থাকলেও পরাত্মীয়। এটি যদি মাথায় থাকে তবেই বোঝা যায়। এখানে ক্রিয়াশীল ভাষা হিসেবে হিন্দির বাড়ি কখনো বাংলা বেড়াতে যায়নি, ব্রাহ্মণ্য বলে। বাংলার বাড়িতেও হিন্দি তেমন আসেনি গরীব ও অজপাড়াগাঁয়ের বলে! তাই এদের আত্মীয়তা কম। জেলে-ধূপা-কোল-মুন্ডা-চামার-মুচি-কৃষক-মালি-বাউল
-কথক-গাড়িয়াল-মজুরের নিত্যকার এ বাংলা; কত যে আপন, কত আদরের, কত পরানের এটি এ আর রহমানের জানার সুযোগ কমই হইছে। উনার ভাষা হলো দক্ষিণ ভারতীয়। সেখানেও যোগ কম আমাদের। এমন কি পশ্চিম বাংলার শোষিত আত্মীয় আমরা। তাই আমাদের ভাষায়, যোগে,বিলাপে, আক্ষেপে এবং আনন্দ-হাসিতে মারাত্মক একটা আপনগত ব্যাপার আছে। যার সাথে অন্যদের মিল নাই। যারা পশ্চিম বাংলা দ্বারা প্রভাবিত হয়নি তাদের সে বোধ আছে।
এ আর রহমান সেই নজরুলকে চেনেন না, আমরা চিনি। কারার ঐ লৌহ কপাট; হাজার বছরের দ্রোহ ও বিদ্রোহ।
এ সুর আরোপ করতে হতে হবে এ মাটির সন্তান। অস্কার বিজয়ী হয়ে নয়। এটি আমরা পারবো, অন্যরা নয়। আমাদের সাধারণ মানের শিল্পীকে দিলেও এটির ভিন্ন আবেদনসহ সুর করতে পারবে। বড় বড় অস্কারজয়ীরা পারবে না।
এখানে প্রেম মানেও " নদীতে ঘর ভেঙ্গে যেতে পারে। তাই হারানোর বেদনায় ভরপুর। তাই তো বাউল গিয়াসউদ্দিন দরদ দিয়ে আপন সুরে গায়,
..... কারো ভাঙ্গলো ঘর বাড়ি, কারো ভাঙ্গলো জমিদারি,
কারো ভাঙ্গলো নতুনো পীরিতি...... ।
এখানে মানুষ মহামূল্যবান, মানুষ মানে খাঁটি সোনা, পোড়ামাটির তৈজসপত্র। এখানে নারী মানে মহাজীবন। বড় দুঃখের বিষয় এ অঞ্চলে যারা মানুষগুলো চিনে ব্রিটিশ পরবর্তী তাঁরা নিগৃহীত। তাই এ আর রহমান যাদের সাথে আলাপ করেছেন সুর করার আগে, তারা বোঝাতে পারেনি বাংলা ভাটির সুর কি?
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৪:০৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


