হাওড়ে ১৪ কিলোমিটার পথে হয়ে গেলো আলপনা। আলপনা আমাদের সংস্কৃতির গ্রামীণ অনুষঙ্গ। বিশেষ করে বাংলার নারীদের একটি সৌখিন অনুষঙ্গ, ঐতিহাসিক ভাবে কোঠা ঘর সাজাতে করা হতো। ইলামিত্রের চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের প্রায় প্রতিটি গ্রামে আলপনা আঁকা হয়। টিকইল, করমজা, গুনইর, বিশালপুর, হাটবাকইল, নেজামপুর, বকুলতলা, কলিহার, ডাঙ্গাপাড়াসহ বহু এলাকায় দেখা যায়।
এগুলো শিখেছে বংশপরম্পরায় মা অথবা শ্বাশুড়ি থেকে। বলা হয় আর্যদের সময় থেকে শুরু। মূলত বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাস হলো আলপনা আঁকা হয় এ অঞ্চলে আর্যদের আগমনেরও আগে। মাটির ঘরে এমন আলপনা চমৎকার দেখা যায়। কখন শুরু হইছে সেই সত্যাসত্য নির্ণয় করা যাবে গবেষণা করে। বাংলাদেশে মূলতই ঘর নির্মাণের সংস্কৃতির সুপ্রাচীন ঐতিহ্য হলো আলপনা, যা সৃষ্টি নারীদের দ্বারা। সৌন্দর্য এবং নন্দনের মানসে। এর সাথে পহেলা বৈশাখের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে হাল আমলে এবং স্মরণকালে। ঐতিহ্য তুলে আনার মানসে এটি দারুণ অবশ্যই। ৫২-র ভাষা আন্দোলনের মাহত্বেই এটি এসেছে প্রথম তারপর নানা সময় গড়িয়ে পহেলা বৈশাখে।
স্মরণকালে পহেলা বৈশাখে ইলিশে পান্তাও আনা হয়েছিলো। ব্যাপক প্রচার-প্রচারণায় সে বাড়াবাড়ি কমানো গেছে। কোথায় পিঁয়াজ আর কাঁচামরিচে পান্তা আর কোথায় ইলিশ। একটা প্রবাদ প্রচলিত ছিলো আমাদের গ্রাম বাংলায় যা আমাকে ব্যাপকভাবে স্পর্শ করে এবং রোমাঞ্চিতও করে---
"----এক বর্ষের ভাত আরেক বছর খাৎ----"
-----মানে চৈত্র মাসের শেষের দিন রাতে রান্না করে পহেলা বৈশাখে খাওয়া। এক বছরের ভাত আরেক বছর।
দাদীর কাছে অনেক উপকথা শুনতাম। একটি উপকথাকে তেভাগা অঞ্চলে সাঁওতাল এবং সাধারণ কৃষকের জীবনে দারুণ ভাবে সম্পর্কযুক্ত করা যায়,
-----" আমরা তো ভাদুইয়ের জাত শিকার-সকার করি
তোমরা ত রাইত পোহাইলেই ঊড়ি ঊড়ি "
সাঁওতাল সম্প্রদায় বেশিরভাগ শিকার করেই জীবন যাপন করতো, ভ্রাম্যমাণ তাদের জীবন, আর অন্য একটি সম্প্রদায় যারাই হোক বাস করতো কৃষিকাজ করেন। যারা ঘর করতো,ঘর সাজাতো, বিয়ে করে স্থায়ী জীবন যাপন করতো,কৃষিকাজ করতো। এরাই লৌকিক উৎসবে ঘর-দর সাজাতো। ঊড়ি মানে বিবাহিত জীবন-যাপন করা নারী। এই প্রচলিত শব্দযোগ খনারও পূর্বের মনে হয়, শব্দ গাঁথনীতে।
বলছিলাম বৈশাখে আলপনা টেনে আনা বাণিজ্য এবং হাজারো ব্যর্থতা ঢাকার টুটকা। এ টুটকা ব্যবহার নানাভাবে হইছে। স্মরণকালে বড় জাতীয় পতাকা করে স্কুল-কলেজের শিশুদের ভর রৌদ্রে ধরে রেখে, ধানের ক্ষেতে মুজিব ফুটিয়ে, মুজিবের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিপুল ব্যয় করে ; অনুষ্ঠানগুলুকে সার্বজনীন না করে, এমন কি চেষ্টাও না করে। সাংবিধানিক ভাবে ফাঁক-ফোকড় দিয়ে অনৈতিক ভাবে টিকে যাওয়া নির্বাচন। এসব মেনে মেনে স্বাভাবিক বনে গেলেও নীতির কাছে বৈধ নয় তোমার রঙ তামাশা।
কেউ যদি হঠাৎ পরিবেশবাদী হয়ে যায়, আপনি যদি তাকে সাম্প্রদায়িক দেখেন,আপনিও টুটকা-র নামান্তর। হেভি মেটালের বেগুনে বাংলাদেশে ক্যান্সারে ভরে যাচ্ছে। হাওড়ে গিয়ে আপনাকে কেন আলপনা করতে হবে? আপনার যদি বৈশাখই অনুষঙ্গ হয় তাহলে আপনি আলপনা-র আতুড়ঘর নাচোলে যান, সেখানে বড় আলপনা করেন। প্রতিটি বাড়ীকে আপনি পরিচয় করে দিন, ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে আনুন।
সেখানকার জীবন-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আলপনার বিকাশ, জীবনে আলপনার স্বপ্ন, সৌখিনতা, অনুভব তুলে আনুন। একজন নারী কিভাবে যুগ যুগ এ আলপনার ঘর কল্পনায় সাজিয়েছে দেখান। এগুলো করতে তো প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে, বিশেষজ্ঞ লাগবে, দেশের একটি লালিত ঐতিহ্য উঠে আসবে অন্তত। তা তো করবেন না, আমরা যদি এসব বলি, আপনি আমাদের পরিবেশবাদের ভেতর সাম্প্রদায়িকতা খোঁজেন, অথচ আপনি কর্পোরেট ছোঁয়া দেখেন না। তা না দেখলেন, কিন্তু হাতি মাথায় পা, পায়ে মাথা, শুঁড়ে লেজ আর লেজে শুঁড় লাগাবেন?
এসব টুটকামি ছাড়েন। গুঁজামিলের সরকার আর গুঁজামিলের উন্নয়ন দিয়ে হবে না। মানুষকে বাঁচতে দিন। আপনি ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির কথা বলবেন। ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে বাঁচতে দিন। জায়গা মতো পরিচয় দিন, পরিচয় করিয়ে দিন।
আপনার দুইদিনের সংস্কৃতি আমরা জানি। আপনি হিন্দি গানের তালে বগল নাচান আমরা জানি। আপনি কোনকিছুই লুকাতে পারবেন না। আপনি পাকিস্তানিও নই, আপনি ভারতীয়ও নই। আপনি দেশের জলে-স্থলে একজন চেনা-জানা টুটকা। আপনার বর্ণ লুকাবার জায়গা নেই। ঐ রঙ আমরা ঘঁষে বের করতে পারি। আপনি চকচকে বর্ণ চোরা হলেও চেনাজানা টক্কা। আপনি সুযোগমতো ডেকে উঠেন।
আপনি উন্নতমানের সংস্কৃতির আড়ালে আমাকে আরোপিত জীবনধারা দিতে চান। আপনার আনন্দ শোভাযাত্রা কিভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়ে যায় আমরা জানি। আপনি কিসের বিভক্তি চান আমরা বুঝি। আপনি রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা করার শক্তি হারিয়ে আপনি ক্ষমতা দেখাতে চান, আমি সেই আপনাকে চিনি। জানি। চপনি কোনভাবেই নিজেকে লুকাতে ওারবেন না।
সলিল চৌধুরী বলেন,
--------চিনি তোমায় চিনি গো
জানি তোমায় জানি গো,
সাদা হাতির কালা মাহুত তুমি নও।।
তুমি যাদুমন্ত্রের আড়ালে একজন শোষক, সংস্কৃতির বালাই তোমার কাছে নেই। আজ তোমাকে কেউ নেংটি পড়তে বলে তুমি পড়বে, তাতে উলঙ্গ হলেও তোমার লজ্জা হবে না। তোমার ছেলে ভুলানোর মন্ত্র চাই।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১২:৫১