রুম গোছানো বাদ দিয়ে ম্যাগাজিনটা নিয়ে বসে পরি।মনে পড়ে যায় ৫ বছর আগের সেই নবীন বরণের কথা যেদিন নটরডেম কলেজের ছাত্র হিসেবে প্রথম কলেজ ক্যাম্পাসে পা রাখি।আইডিয়াল স্কুলে পড়ার সুবাদে এর চারপাশে অনেক আগে থেকেই আসা-যাওয়া ছিল। বিভিন্ন বিজ্ঞান উৎসবে আগে এখানে আসলেও সেদিনের অনুভূতি ছিল ভিন্ন।নিজেকে এই কলেজের অংশ ভাবতেই মনটা খুশিতে নেচে উঠছিল।নিজের অজান্তেই পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে একটা পৃষ্ঠাতে এসে স্থির হই।চোখে পড়ে আমার এবং বন্ধুদের ছবিগুলো।
ছবিগুলো দেখে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে ওঠে।কারণ কি নিষ্পাপ দেখাচ্ছিল মুখগুলো!বাস্তবে যা ছিল সম্পূর্ণ উলটো।আমাদের গ্রুপটাকে বলা হতো কলেজের বদ গ্রুপগুলোর একটা।কলেজে যার সাথে প্রথম বন্ধুত্ব হয় তার নাম শাওন।গ্রুপে একাধিক শাওন থাকার কারণে তাকে আমরা এফরান বলে ডাকতাম(আমি নিজেও এই সমস্যার একজন ভুক্তভোগী)
।একসাথে বসার কারণে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই খাতির জমে ওঠে আয়াজ(দেখতে একটু বয়স্ক মনে হওয়ায় অনেকে “চাচা” বলেও ডাকত),উপল,হিসু(আসল নাম হিশাম,ক্ষ্যাপানোর জন্য এই নামে ডাকত অনেকে),রানা,নাফিজ,নাভিদের সাথে।আমাদের কলামে আরো ছিল পল্লব,শিব্বির,পারি,সজিব,আরিক,রাশ,তাফিম,সানি,আজমির,অনিমেষ,ফাহিম।রানা,উপল,হিশামের অন্যতম কাজ ছিল সবার একটা করে নাম দেয়া যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল হ্যারী (আমি),গোফি(শাওন),গনেশ/ম্যান (অনিন্দ্য),আলী (নাভিদ)।
আমাদের মধ্যে শাওন ছিল একটু বোকা-সোকা।তাকে নিয়ে একটি মজার ঘটনা মনে পড়ে যায়।
সেদিন ছিল এইচএসসির ফরম রেজিস্ট্রেশন।আমাদের সবার ফরম পূরণ করা শেষ।জমা দেয়া বাকি।সবাই আড্ডা দিচ্ছিলাম।আমি,আয়াজ আর শাওন --- আমাদের তিনজনের মধ্যে শাওনের সিট ছিল জানালার পাশে।শাওন পিছন ফিরে গল্প করতে থাকে।ওর ফরমটা ছিল বেঞ্চের উপরে।হঠাৎ আসা এক দমকা হাওয়ায় ওর ফরমটা জানালা দিয়ে উড়ে পাশের ড্রেনে পড়ে যায়।বেচারার চেহারাটা ওইদিন ছিল দেখার মতো।আমি আর আয়াজ অনেক চেষ্টা করেও হাসি আটকাতে পারিনি।
পরবর্তী রেজিস্ট্রেশনের দিন ফরম পূরণে ভুল করায় ওইদিনও তার রেজিস্ট্রেশন হয় না।এই কাজের জন্য তাকে তিন দিন দৌড়াদৌড়ি করতে হয়।আরো অনেক মজার ঘটনা আছে ওকে নিয়ে, এতোদিন পরে সব মনেও পড়ে না।
সেকেণ্ড ইয়ারে অবশ্য শাওন আর আমাদের সাথে থাকে না,পল্লব চলে আসে ওর জায়গাতে।তারপরেও আমাদের শয়তানি কমে না।হাসি পায় কুইজ আর পরীক্ষার সময় আমাদের দেখাদেখির কথা মনে করে।আমাদের ৫-৬ জনের জায়গাটা ছিল পুরো রুমের মধ্যে “Red Alert Zone”।একটা পরীক্ষাতে আয়াজ,শাওন আর আমাকে স্ট্যানলি স্যারের কাছে খাতাও হারাতে হয়।
এখন সেসব শুধুই স্মৃতি, কারণ এখন পরীক্ষাতে দেখাদেখি তো দূরের কথা,পিছনে ঘাড়টা পর্যন্ত ঘোরাতে পারি না।
মনে পড়ে ফিজিক্স ল্যাবের আগে ক্যান্টিনে বসে ল্যাব রিপোর্ট লিখা,ল্যাবের দরজার সামনে বসে “রাফ শিট” তৈরী করা।আর ক্লাসে বসে ম্যাথ ল্যাব লিখা তো আছেই।মনে পড়ে পরীক্ষাতে দেখানোর জন্য আয়াজের দেয়া সেই “Treat” গুলো।
আয়াজ এখন ব্র্যাক এ বিবিএ তে পরছে,হিশাম আইবিএ তে, উপল ঢাকা ভার্সিটিতে ইকোনমিক্স আর নাভিদ কুয়েটে এবং পল্লব AIUB তে EEE তে পরছে।চোখের সামনে ভেসে ওঠে একত্রে প্রাইভেট পড়ার কারণে খাতির জমে ওঠা রবি,আন্দালিব,পিয়াল,বুলবুল,জামিল,সিয়ামের চেহারা।কতো মজাই না করতাম আমরা!অন্য গ্রুপের বন্ধুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বিপ্লব,পার্থ,প্রিয়ান।এদের মধ্যে শুধু রবি,বুলবুলের সাথে নিয়মিত দেখা এবং অন্য আরো ২-৩ জনের সাথে এখনো নিয়মিত কথাবার্তা হয়।বাকিদের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম Facebook।
আবারো পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকি।বের করি সেই পৃষ্ঠাটা যেখানে আছে শিক্ষকদের ছবিগুলো।আবারো নিজের অজান্তেই হেসে উঠি।কারণ সবার আগে চোখে পড়ে মুখতার স্যারের ছবিটা।কতো তফাৎ স্যারের এখনকার চেহারার সাথে ছবির চেহারার!স্যার এক দুর্ঘটনায় শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হারান যা সম্পর্কে প্রত্যেক নটরডেমিয়ান অবগত।সে সম্পর্কে নাহয় নাই বললাম।যেন কানে আসে ক্লাসে ঢোকার পর স্যারের সংলাপ “দরজাটা বন্ধ আছে তো?” এবং বের হওয়ার আগের সেই বিখ্যাত ডায়লগ “সর্বনাশ করে ছেড়ে দিব” (সাথে একটি চোখ টিপ)।মনে পড়ে স্যারের বলা সোহরাওয়ার্দী সাহেবের এবং সেই বিখ্যাত ধানক্ষেতের গল্প। স্যারকে নিয়ে অনেক মুখরোচক গল্প প্রচলিত রয়েছে।সেগুলো নাহয় আরেকদিন বলা যাবে।
মনে পড়ে যায় বিদ্যুৎ স্যারের সেই ভুবন ভোলানো হাসি আর আমাদের কটাক্ষ করে বলা কৌতুকগুলো।রেজা স্যারের ম্যাথের স্টাইল নিয়ে দেওয়া বিখ্যাত সেই সংলাপগুলো ছিল সেরা।আর স্ট্যানলি স্যারের ক্লাসের কথা মনে না করাই ভাল।ওই ক্লাসের কথা মনে হলে বুকের গভীরে বেদনা ছাড়া আর কিছু অনুভূত হয় না।চুল কাটা,ক্লাস থেকে বের করে দেয়া ছাড়া আর কিছু মনে পড়ে না।ম্যাথ ল্যাবের ওই ক্লাসটা ছিল আমাদের জন্য রীতিমতো এক আতংক। ফিজিক্স ক্লাস নিতেন বদরুল স্যার।ঘুমানো এবং ল্যাব রিপোর্ট লিখার জন্য এই ক্লাস ছিল সবচেয়ে উপযুক্ত।এই স্যারই একমাত্র ব্যাক্তি যিনি মুখে একটিও জোরে কথা বলবেন না।তার সব ধমক ছিল লিখিত, তাও ইংরেজিতে।মনে পড়ে স্যারের বাসায় আমাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া সেই চিরকুট “You have not paid your tuition fees this month.If you have any problem,then let me know,otherwise it will have adverse effect on your carreer.”
ইংরেজির কথা মনে করতেই মনে পড়ে যায় বিখ্যাত ইংরেজি ক্লাসের কথা যেটা নিতেন J.K.(Jahangir Kabir)স্যার।কত হৈ-হুল্লোড়ই না করতাম এই ক্লাসে!শয়তানি আর ফাজলামির দিক দিয়ে এই ক্লাস ছিল এক নম্বরে।কোন কিছু না করেও উপস্থিতি হারানো যে ক্লাসে ছিল স্বাভাবিক ঘটনা।শুনতে পাই স্যারের সেই ডায়লগগুলো—“Hey,any absent?side-man stand up”,”এ্যাই ছেলে এ্যাই,আমি তোমার ৩টা Attendance কেটে রেখে দিব,তুমি কিছুই করতে পারবে না”,”you should follow my instructions”অথবা “you are disturbing the whole class”।
সেকেন্ড ইয়ারে অবশ্য J.K. স্যারের জায়গায় ওয়ালি স্যার ক্লাস নিতে আসেন যার ক্লাসে ঘুমানো ছাড়া আমাদের আর কোন কাজ ছিল না।
সবার শেষে মনে হয় কেমিষ্ট্রি ক্লাসের কথা।আর এতে অবধারিতভাবেই চলে আসে বিদ্যাসাগর স্যারের কথা।কানে বাজতে থাকে স্যারের সেই ঝাড়ি, “অই,এক্কেরে ফাডায় লামু”,”অই,দিমু নে একখান”,”কথা বুঝছি?”।
স্যারের অরবিটাল হাইব্রিডাইজেশনের ক্লাসটা ছিল সবচেয়ে মজার –“অই,কও দেখি,একটা s অরবিটাল আর একটা p অরবিটাল – দুইটা যখন একটা আরেকটার কাছে আইব,তখন কি আলাদা থাকব, না মহব্বত কইরা লাইজ্ঞা যাইব গা?””স্যার,মহব্বত কইরা লাইজ্ঞা যাইব গা”।“তাইলে কও,দুইডা মহব্বত কইরা লাইজ্ঞা গেলে কি আর আলাদা থাকব, নাকি নতুন আরেকটা কিছু হইব?””স্যার,নতুন আরেকটা কিছু হইব”।”Good,এই নতুন অরবিটাল উৎপন্ন হওয়ার process টাই হইতাছে sp হাইব্রিডাইজেশন।”
স্যারের ছবিটার দিকে চোখ পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে যায়।স্যার আজ নেই,তবু স্যারের কথাগুলো রেকর্ডের মতো কানে বাজতে থাকে।
সেকেন্ড ইয়ারে ক্লাস নিতে আসেন বিপ্লব স্যার যার কথা আমরা কিছুই বুঝতাম না,বলা ভালো যে বোঝার চেষ্টা করতাম না।খুব সম্ভবত এই কারণেই স্যারের প্রিয়পাত্র ছিলাম আমি।প্রতিদিন আমাকে দাঁড় করিয়ে ২-১ টা উলটাপালটা প্রশ্ন না করলে স্যারের ভাল লাগত না।এ নিয়ে আমরা বিস্তর হাসাহাসিও করতাম।
কানে বেজে ওঠে এক ম্যাডামের ধমক এবং সাথে মাথায় একটা গাট্টাও।এই পর্যায়ে একটু অবাক হই।কারণ কলেজে ২ বছরে কোন ম্যাডামের ক্লাস পাইনি।চমকে উঠে বাস্তবে ফিরে আসি।দেখি পাশে আম্মা দাঁড়িয়ে আছেন।ধমকটাও উনিই দিয়েছেন,”এতক্ষণ লাগে নাকি রুমটা পরিস্কার করতে?”অবাক চোখে ঘড়ির দিকে তাকাই।দেখি যে ১২টা বাজে।স্মৃতির পাতায় চোখ বুলাতে বুলাতে কখন যে দুই ঘন্টা পার হয়ে গেছে টেরই পাইনি।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্যাগাজিনটা রেখে আবার কাগজপত্র গোছাতে শুরু করি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০১০ রাত ১:২৪