আপনার যে দেহ সেখানেই রাজনীতির শুরু। ফলে আলাপটা সেখান থেকেই শুরু করা যাক। দেহ নিয়ে যে আপনার “লজ্জা” বা “লজ্জাহীণতা” বা কৌতুহল বা টিটকারী সবই। জন্মেরও আগে এবং মৃত্যুর পর আপনার দেহ নিয়ে কি হবে তা কিন্তু সমাজসাংস্কৃতিক রাজনীতিটা ঠিক করে দেয়। জীবিত অবস্থায় আপনার দেহ নিয়ে আপনি কি কি করবেন বা করবেন না সেটা আপনার মৌলিক অধিকার। আপনার জন্মেরও আগে এবং পরে দেহ নিয়ে কি হবে সেটাও আপনার অধিকার।
ধর্ম, বিশ্বাস, বিজ্ঞান বা সংস্কৃতি যেই আইডিয়ার কথাই বলেন না কেন, আপনার দেহকে নিয়ে খেলা করে। আর দেহের স্বাধীনতা কেবল কোন জেন্ডারের স্বাধীনতা নয়, একজন অস্তিত্বশীল বুদ্ধিজীবি প্রাণী হিসেবে আপনার মূল স্বাধীনতার অংশ, আপনার মৌলিক অধিকার। দেহের উপর আইডিয়া আর ইমাজিনেশনের আরোপ এবং প্রভাব আপনার জন্মের আগেই নির্ধারিত। মানে আপনি জেনে বুঝে বা না-জেনেই দেহকে নিয়ে নানান কিছুর মোকাবিলা করেন। আরো একটি বিষয় মনে রাখা দরকার যে দেহের উপর নিয়ন্ত্রণ কেবল একটি বিশেষ জেন্ডারের গল্প না। যেমন পুরুষদের শিশ্নের খৎনা করতে হয়, কোন বিজ্ঞান চাপ দেয় আপনি সিজারিয়ান করবেন, টীকা নেবেন, কোন কোন বিশ্বাস আপনাকে কানে ফুটো, গলায় বিশাল গহনা পড়তে বলে, আপনাকে বিশেষ পোশাক পড়তে বলে। আপনার দেহ কখন কি করবে কি করবে না সেটার জন্য আপনাকে সারাক্ষণ কথা শুনতে হয়, যেমন ফেয়ার এন্ড লাভলি মাখেন, জীম করেন, ডায়েট করেন, মাস্ক পড়েন, কাশি ঠিকভাবে দেন ইত্যাদি। মানে দেহের উপর নিয়ন্ত্রণের দোষ কেবল ধর্মরে দিয়েন না। এখন দেহের উপর যে পোশাক পড়বেন সেটাও দেহ রাজনীতির অংশ। দেহের কোন অংশ কেমন ব্যবহৃত হবে সেটার নির্দেশনাও। জাপানীজদের বো করা থেকে শুরু করে সালাম বা নমষ্কার আপনার দেহের নিয়ন্ত্রণই তো। এখন সকল দেহ; গোত্রের বা সমাজের কিছু কনভেনশন মেনে চলে। সেই কনভেনশনের বা নর্মের নানান পরিবর্তন দেখতে পান যখন দেহ নিয়ে বোঝাপড়ার বিস্তৃতি ঘটে আবার এক অঞ্চলের দেহ অন্য অঞ্চলে যায়। ২য় অংশটা নিয়ে বলি, আপনারা খেয়াল করে দেখবেন নারী ও পুরুষেরা (আপাতত এই দুটো ডমিনেন্ট প্যাটার্ণ নিয়েই কথা বলি) যখন অন্য দেশে যান সেখানে যে দেহনিয়ম আছে সেটাকে আত্মস্থ করেন। কেমন? এই যে তিনি সেইসব পোশাক পড়েন যা তিনি পুর্বের দেহনিয়মে পড়তে হয়ত পারতেন না। আবার এরসাথে প্রকৃতিও খুব গুরুত্বপূর্ণ! যেমন কারো হয়ত শখ ছিল বরফের মাঝখানে ভরপুর শীতের পোশাক পড়বেন, এই গ্রীষ্ম অঞ্চলে তার সুযোগ হয়নি, তিনি সেখানে যেয়ে পড়েছেন। শর্টস, টি শার্ট জিন্স পড়তে চেয়েছেন সেটা পড়তে পেরেছেন। কিন্তু সবাই যে এটাই চাইবেন এমন কোন কথা নাই। ফলে ঢালাওভাবে এভাবে অনুমান করা রেসিজম।
সাদা শক্তিশালী বলে কালো হইছে খারাপ, দাঁড়িরে সন্ত্রাসী বানাইছেন বইলা দাঁড়ি হইল খারাপ, এইরকম আরকি। এখন দেখেন যে কোন সিস্টেম আপনার দেহের উপরে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ আনে। নিয়ম দিয়া, নীতি দিয়া, আইন দিয়া, সামাজিক কনভেনশন দিয়া, বিশ্বাস দিয়া, প্র্যাকটিস দিয়া। দেহ নিয়া আপনারা যখন সচেতন হওয়া শুরু করছেন তখনি এর নানান নিয়ন্ত্রণ সিস্টেম আপনারা দেখতে পান। যেমন, “বিয়া করছো দুই বছর বাচ্চা নেওনা কেন?” এই চাপ কিন্তু কেবল নারীদেহের উপর না, পুরুষের দেহের উপরও। আজকে একটু পুরুষ দেহের কথা বলি, “তাইলে কি পোলাটা ইম্পোটেন্ট, মেয়েটা কি সুখে নাই?” এইসব প্রশ্ন পুরুষরাও অহরহ ডিল করেন। এখন দেহ সিস্টেম আপনারে শিখাইছে যে পুরুষ একটা আলগা পাট নিয়া থাকবে সে “বীর” কিন্তু আসলে তো সে বন্দী। সামাজিক চাপের কাছে বন্দী। অন্য পুরুষের কাছে সক্ষমতা নিয়া বন্দী। আপনি মোটা? টাক? কালো? এই কারণে কত সম্ভাব্য সম্পর্ক যে নষ্ট হয় তার খবর আপনারা রাখেন? রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল মানুষের দেহ-কে স্বাধীন এবং দায়িত্বশীল রাখতে সহায়তা করা। সেটা সমাজের নৈতিক সিস্টেমের উর্ধে। দেহের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণের যে দাবী তা মানুষের মৌলিক অধিকার। তো সেটা নষ্ট হয় কীভাবে?
সে জন্য আমাদের জেল-কে বুঝতে হবে। একটি দেহ যাতে বহু দেহের জন্য ক্ষতিকারক না হয় এজন্য যেমন জেল তেমনি অপছন্দের, লোকদের আটকাইয়া রাখাও জেল। একদল দেহকে আলাদা করে রাখা। আপনাদের সোশ্যাল ডিসট্যানসিংও তাই। কিন্তু কারণটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর এখানেই চিন্তা নিয়ন্ত্রণের মাইরপ্যাঁচ। নীতি নৈতিকতারে আইন বানানো বা আইনের মত করে ব্যবহার করা। সমাজের বহু দল তাদের বহু নীতি নৈতিকতা থাকবে কিন্তু সেটা আইনের সিদ্ধান্ত হতে পারেনা। আইনের এই সবার জন্য সমান হবার চেষ্টার কারণেই আইন,নাইলে আইন পাল্টাতে হবে।
কিন্তু দেখেন দেহের নিয়ন্ত্রণ তাতে কমেনা। একদল দেহকে দুইশো তিনশো মাইল হাঁটায়া কারখানায় আনান, কখনো কখনো সেই দেহগুলো পুড়ে যায়। তখন আপনাদের নীতি নৈতিকতা আইন কই যায়? এইটা আইনগত অপরাধ। ফলে এই মারপ্যাঁচে দেহের মুল্য কমে বাড়ে। কারো জানাজায় প্রচুর মানুষের ভীড় হয় কারোটাতে মানুষ দেখতেও যায়না। এই যেমন করোনা সংক্রমণের ভয়ে কত দেহ তাদের আত্মীয়দের মৃতদেহ ছেড়ে পালিয়ে গেল। এইটা নিন্দনীয় হইতে পারে কিন্তু আইনগত অপরাধ না। কত দেহে হাতকড়া পড়ল, নাই হয়া গেল কত মানুষ, তো কই আপনারা? আপনারাই ম্যানুস্ট্রেশন আর ম্যারিটাল রেইপ নিয়া সরগরম হইলেন। চিৎকার দিয়া বললেন কনসেন্ট কনসেন্ট। বাসে আটকা ঝুলন্ত হাত দেইখা বললেন নিরাপদ মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। তো আপনার দেহরে কে কোথায় কেমনে নিয়া যাবে ব্যবহার করবে তাতো আপনার মৌলিক অধিকার। কেউ চাইলেই আপনাকে খেদাইতে, গ্রেফতার করতে পারেনা। আপনার দেহের অধিকার আছে। আমি আপনি আমরা সবাই দেহকে বিক্রী করি। বিক্রী শব্দে ধাক্কা খাইলেন? খাইয়েন না। এই ঘন্টার পর ঘন্টা চেয়ারে বইসা অফিস করেন, এইটাতে দেহক্ষয় হয় না? হয়। এই যে ক্রিকটাররা সারাদিন দেহ খাটাইয়া কাজ করে বলেই তো আপনাদের বিনোদন হয়। যিনি সারাবছর লেফট রাইট করেন তিনিও দেহ বিক্রী করেন। মানুষ এই দেহকেই ব্যবহার করে লাভ করতে চায়। সেটা গার্মেন্টস শ্রমিক থেকে সিনেমার নায়ক নায়িকা সবই। ফলে দেহের হিসাবে সবাই সমান। সমান মর্যাদা পাবেন।
দেহ একটা মর্যাদা সত্তা। একাত্তরে যখন লুঙ্গি খুলে ধর্ম দেখছিল পাক বাহিনী সেই ছবি দেখে আপনার রক্ত গরম হয়ে যায় নাই? হইছে। দেহ ভীষণ রাজনৈতিক। কিন্তু মানবদেহেকে যখনি আপনি আলাদা আলাদা কইরা পকেটে পকেটে দেখবেন তখনি সমস্যা। এইটাও দেহ রাজনীতি। আপনারা আর দেহকে আলাদা করে মর্যাদা দেননা অথবা বিশেষ বিশেষ দলের দেহরে মর্যাদা দেন। এইটা হইতে পারেনা। ভিক্ষাবৃত্তি আপনার অপছন্দের হইতে পারে তাতে তার দেহের মুল্য ও মর্যাদা কমেনা। একজন সারাজীবন বিয়া না কইরা থাকতে পারেন,তাতে তার দেহের মুল্য ও মর্যাদা কমেনা, চোর যে; তারে আপনার অপছন্দ হইতে পারে তাতে তার দেহের মুল্য ও মর্যাদা কমেনা। সবচেয়ে বড় প্রতারক যে, ধর্ষক যে তাতেও তার দেহের মুল্য ও মর্যাদা কমেনা, পাগল যে তাতেও দেহের মুল্য ও মর্যাদা কমেনা। যিনি বিকিনি পড়েন আর যিনি বোরখা পড়েন তাতেও দেহের মুল্য ও মর্যাদা কমেনা, যিনি প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন সম্পর্কে জড়ান, টাকা কামান তাতেও তার দেহের মুল্য ও মর্যাদা কমেনা। কিন্তু আপনারা যখনি আইনের প্রশ্নকে নীতি দিয়া ধরতে যাবেন তখন সমস্যা। এমন বহু পেশা আছে, ইন্ডাষ্ট্রী আছে যা আপনার দেহকে সবচেয়ে বেশি নষ্ট করতে পারে, কিন্তু আপনারা তাদের নিয়া উচ্ছসিত। বিজ্ঞানের বা বিজ্ঞান বিশ্বাসের একটা ভুল কোটি কোটি মানুষের দেহ নষ্ট করে, খাদ্যে দুর্নীতি, দুর্নীতি নিজেই, রোড এক্সিডেন্ট, আরো চিন্তা করেন, দেখবেন লিস্ট খালি বাড়বে। আবার যারা অন্যের দেহ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পাইছেন ভাবেন তাদের দেহও নিয়ন্ত্রিত, নির্দেশের নিয়ন্ত্রণে। উনারাও নিজেদের যতই বীর ভাবেন আসলে উনারা সংকটগ্রস্থ। এই বিষয়ক একটা জিনিস কল্পনা করতে বলি। যুদ্ধের পর পরাজিত দেহগুলা যখন বন্দী হয়, সেইটা একটা দেখার মত দৃশ্য হয়। কতনা বীর কতটা পাওয়ার তারপরই এনারা আবার নিজের দেহের বিষয়ে সদাতৎপর হয়ে উঠেন, সারাক্ষণ অধিকার আইনগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। আপনি যত নীতি নৈতিকতার কেন্দ্রে বা সামাজিক ক্ষমতার যে স্তরেই থাকেন না কেন দেহ প্রশ্নে আপনি মানুষ।
এই কারণেই আইন। আপনার সবচেয়ে পছন্দের বা সবচেয়ে অপছন্দের বিষয় এখানে কাজ করে না। আর এজন্যই আপনার এবং বিশেষভাবে যাদের আপনারা অপছন্দ করেন তাদের দেহকে নিয়া আপনাদের সচেতন হতে হবে। দেহের উপর যত ছাপই পড়ুক, যতই আপনার নীতি নৈতিকতার সাথে কনফ্লিংকটিং হোক সেটা পরে, আগে আপনার ও অপরের দেহ। নিজেরটা ও অপরেরটারে একভাবে সম্মান করতে হবে। তা না হইলেই আপনি রেসিস্ট। সচেতন হলেই আপনার দেহের মর্যাদা ও অধিকার বাড়বে। কারণ অপরেরটার মর্যাদা না দিলে আপনার দেহের মর্যাদা একা বাড়বে না। দুইটা পরস্পর নির্ভরশীল। এইটা হইল দেহরাজনীতি।
আরেকটা অপ্রিয় কাজ করি। রুদ্র-র যে কবিতা এখন ভাইরাল সেটার পরিবর্তনের সময় এসেছে। উনার কবিতা ভীষণ নীতি নৈতিকতার উপর ভর দেয়া।
রুদ্র যেখানে বলছেন,
“শরীর বেচি শরীর বেচি
শোনো ভদ্রলোক
রাতের নায়ক যারা
তারাই দিনের বিচারক”
আমি বলব, দেহের প্রশ্ন নীতি নৈতিকতার না, অধিকারের
“বাজারে থাকেন বাজারে ঘুমান
বাজারে তুলেন দেহ
দেহ নিয়াই খেলা করেন
নৈতিকতা মারাবেন না কেহ
দেহ আপনার মর্যাদা
দেহ আপনার অধিকার
এই দেহ রাজনৈতিক
এবং আপনার আমার সবার”
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০২১ সকাল ৯:১৩