সন্দেহটা অবচেতনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কিছু একটা ঘটে চলেছে। যদিও ঠাহর করতে পারছিলাম না। মশার কামড়ে ঘুমাতেও পারছি না। আমি আসলে কথা বলতে চাইছি বিগত কয়েকদিনে ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যু বিষয়ে। এরমাঝে "মধু"র মৃত্যুর খবরটা নিশ্চয়ই এখনো মনে আছে। সেই বিষয়ক সহ-ফেইসবুকারের একটা স্ট্যাটাস মনে পড়ল। যদি খুব ভুল না হয় তাহলে তিনি বলেছিলেন, "বিগত কয়েকদিনে পরপর ছ'টি মৃত্যুর খবর, সামথিং ইজ সিরিয়াসলি রং।" (কোট একদম ঠিকঠাক, তা নাও হতে পারে । যিনি লিখেছিলেন তিনি দেখে থাকলে কারেক্ট করতে পারেন।)
আমার ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত অভিজ্ঞতায় ডেঙ্গু ঠিক শীতকালের প্রোকোপ বলে কখনো মনে হয় নি। আপনাদের অভিজ্ঞতা কি বলে? আমার যতখানি মনে পড়ে; গুমোট, ঘাম দেয়া গ্রীষ্ম-বর্ষার সাথে এর যোগাযোগ আছে। তারমানে আর সকল প্রাণীদের মতই ডেঙ্গু মশাদের সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রার সাথে সরাসরি যোগাযোগ আছে। খেয়াল করেছেন কি, যে এবারের শীতকালে শীতের দেখা পাচ্ছেন না? তারমানে উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আবহাওয়াতে বড় রকমের পরিবর্তন হচ্ছে। আমার মা, আজই দিনাজপুর থেকে ফিরলেন। যাবার আগে আমি বারবার করে বলছিলাম গরম কাপড় নিয়ে যেতে। দিনাজপুরের শীতের কথাতো পুরো বাংলাদেশে ওয়ার্ল্ড ফেমাস। তিনি ফিরে এসে অনুযোগ করে বললেন "কিসের শীত, শুধু শুধু আমার বাড়তি কাপড়গুলো নিতে হল"। যদিও আমার ছোটবেলায় অক্টোবরের মাঝামাঝিতেই শীতের কাঁপুনি বেশ টের পাওয়াতো দিনাজপুরে। আমরা বেশ গর্ব নিয়েই বলতাম, বাহে এটা দিনাজপুরের শীত, এটা ঢাকা নাকি!
একশ এফএম এ বিবিসি শুনছিলাম, তাতে কপ২৭ ক্লাইমেট সামিট নিয়ে প্রতিবেদন হচ্ছিল। সেখানে খুব স্পষ্ট করেই এবারে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা প্রমাণসহ দেখাতে পারলেন যে বিগত একবছরে জলবায়ুর কি ভয়াবহ পরিবর্তন হয়েছে। তখনি মনে হল, পাকিস্তানে ঢল, ইউরোপে বন্যা, উত্তর আমেরিকায় ঘুর্নিঝড়, আমাদের সেইন্টমার্টিনে ঝড় এগুলো আসলে কানেক্টেড।
সেই প্রতিবেদন থেকেই বলছি, শীত-প্রধান দেশ যুক্তরাজ্যেও ডেঙ্গু মশার উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। যা কিনা বিশ বছর আগে কল্পনাও করা যেত না। ডেঙ্গু মশার জন্য এই উষ্ণতা আসলে সহায়ক। তারমানে দাঁড়ায় যে শেষ অক্টোবর এবং নভেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ আসলে জলবায়ু পরিবর্তনেরই ইম্প্যাক্ট। আমার হাইপোথিসিথ হল ঢাকাতেই যে আমার ডেঙ্গুর কারণে এতগুলো মৃত্যু দেখছি তার মূল কারণ আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন। ঢাকা বিশ্বের নিকৃষ্টতম শহরগুলোর অন্যতম। এবং জলবায়ু নরকের পোস্টার বয় হয়েও আমাদের আচরণ হল পুরোপুরি উপেক্ষার।
এবারে "মধু"-র মৃত্যু, মায়ের কান্না; মেয়ের নিথর দেহ, পাশে পিতার ছবি আর বিজ্ঞান নিয়ে কয়েকটি কথা বলতে চাই। এই গল্পে বিজ্ঞান আছে তার কারণটি আমি স্পষ্ট করতে চাইবো। আসলে বিজ্ঞান বিরোধীতার বিপুল চেতনা আছে সে জায়গাটা আমি আলাপে আনতে চাইবো। বিষয়টি যে ভয়াবহ রাজনৈতিকও সে বিষয়টিও।
১. সোশ্যাল মিডিয়াতে "মধু"-র মৃত্যু-র ছবি আর সেটা নিয়ে বিতর্ক যখন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তারমানে হল মূল প্রসঙ্গ কেনো শিশুদের এত ডেঙ্গু হচ্ছে এবং তারা মারা যাচ্ছেন তা থেকে আপনারা কোটিখানেক আলোকবর্ষ দূরে। (আপনাদের লজ্জা পাওয়া উচিৎ)।
২. সমসাময়িক সময়ে “বেগুন” বিতর্কে আপনারা যে আলোচকের ছদ্মবেশে আক্রমণকারীদের থেকে খুব দূরে নন সেটিও মনে করিয়ে দিতে চাই। “বেগুন” নিয়ে রাজনৈতিক মুখোশ যাতে খসে না যায়/ ইমেজ যাতে নষ্ট না হয় সেটি নিয়েই তো এত আক্রমণ? তাই না? তো বিজ্ঞান কি বলছে সেটা ঠিকভাবে দেখেছেন? এই প্রচারকরা আসলে গবেষণার যে গুরুত্ব আছে সেটাকে মিথ্যা প্রমাণ করতে চাইছেন না? রাজনীতি-র বুট দিয়ে বিজ্ঞানকে লাত্থি মারতে চাইছেন তাইতো?
৩. এবার বিজ্ঞান বিরোধীতা/জ্ঞানের রাজনীতি আর দার্শনিকত্ব নিয়ে বলি। হ্যা বিজ্ঞান রাজনৈতিক। আপনাদের চেতনা নির্মাণের রাজনীতি বরং আরো রাজনৈতিক। যেমন আপনারা, বিরাট স্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা, শাহবাগ পরবর্তী ডানপন্থার হাওয়ায় সাবল্টার্ণ ধর্মীয় বোধের কান্ডারীরা, দিক নির্দেশনাকারীরা, বিজ্ঞানের সমালোচনা করতে যেয়ে যে এন্টি বিজ্ঞান সমাজ তৈরি করছেন তা ভয়াবহ। কারণ সাত তলার ওপর থেকে আপনাকে লাথি দিলে আর আপনার প্রতিপক্ষকে লাথি দিলে আপনারা মাটিতেই পড়বেন। এটাকে মধ্যাকর্ষণ বলে। কোন চেতনাতেই এটার পরিবর্তন ঘটবে না।
৪. আপনারা যারা “শিশুদের এত ডেঙ্গু হচ্ছে কেন?”, “বেগুণের মাঝে ঝামেলাটা আসলে কি?” এগুলো বাদ দিয়ে চতুর্থ স্তরের তর্ক নিয়ে ব্যস্ত তারা নির্বোধ। আপনারা কান্ডারী তো ননই বরং বিভ্রান্তকারী এবং আত্মঘাতি। এখানে দর্শনের কিচ্ছুটি নেই। আছে কেবল বাহাস। এই যে বাহাসে নাড়ানাড়ি আপনাদের এটা বলে দেয় রাজনৈতিকভাবেও আপনারা কত দূর্বল। সোশ্যাল মিডিয়া, স্থানিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির উল্লসিত দাস, হাততালিতে বেঁচে থাকা ডোপেমিন আসক্ত সংখ্যামাত্র।
৫. বিজ্ঞানের নানান দোষ এবং সীমাবদ্ধতা, জলবায়ু পরিবর্তনের বিজ্ঞানও বিতর্ক উর্দ্ধ না। তবে একটা জিনিস নিশ্চিত জলবায়ু আপনাদের কোন চেতনা কোন রাজনীতিকে পুছে না। এই পৃথিবীর মতই জলবায়ু গ্লোবাল, সত্যিকারের গ্লোবাল। ভীষণ সংযুক্ত। সত্যিকার সাম্যবাদী। আপনাদের লীগ অফ নেশনস না; আপনাদের মস্কো বা ওয়াশিংটন-দিল্লী না। একখানে ঝামেলা করলে অন্যখানে বিপদ হয়। এক প্রজন্মে ঝামেলা করলে পরবর্তি প্রজন্মে আটকে দেয়। গরম বাড়লে দর্শনের নতুন মোটিভেশনাল স্পীকাররাও রক্ষা পাবেন না। তাদের সন্তানরাও বাদ যাবেন না। কোন কৌশল কাজে আসবে না। জলবায়ুর প্রতিটি কথা মেনেই চলতে হবে, নিজেদের পাল্টাতে হবে। এই পাল্টানো এবং বোঝাপড়ার জন্য এন্টিবিজ্ঞান হয়ে ঠিক চলবে না। প্রাণ-প্রকৃতির কাছেই ফিরতে হবে। কারণ আপনিই প্রাণ আপনিই প্রকৃতি।
আপনারা যতই তর্ক করেন পানির উচ্চতা বাড়বে, ভাইরাসরা ছড়িয়ে পড়বে, কয়লার মূল্য থাকবে না, রিনিউয়েবল এনার্জীতে যেতে হবে, কোটি কোটি প্রাণ বিনষ্ট হবে। লাখ লাখ “মধু” পূর্ণ বয়সই পাবে না। কোভিডকে ১৯কে আমরা মনে নাও রাখতে পারি, কিন্তু করোনা আপনাকে ভুলবে না। নতুন করোনা তার নিজের জীবন-সাইকেল অনুযায়ী চলবে, এই মহাবিশ্ব এই গ্রহ মানুষ কেন্দ্রীক না। মানুষ একটি প্রজাতি মাত্র। ফলে বাহাস বাদ দিয়ে মূল বিষয়ে মনোযোগ দেন। জিজ্ঞেস করেন, “শিশুদের এত ডেঙ্গু হচ্ছে কেন?”, “বেগুণের মাঝে ঝামেলাটা আসলে কি?”। এত এত ফেইসবুক অর্থনীতিবিদ আর চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মূল কথায় আসেন। এত আস্তিক এত নাস্তিক দিয়ে কিচ্ছু হবে না। অবিশ্বাস আর বিশ্বাস দিয়ে পৃথিবীর কিচ্ছু যায় আসে না। জলবায়ু সেনসেটিভ হন।
শরৎ চৌধুরী, ১০ই নভেম্বর ঢাকা।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০২২ রাত ১২:৪৯