somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মনোযোগ অর্থনীতি পুরো মানবজাতিকে ধংস করতে পারে

২৫ শে জুন, ২০২৫ রাত ১২:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মনোযোগ অর্থনীতি পুরো মানবজাতিকে ধংস করতে পারে

প্রথমে ব্যক্তি দিয়েই শুরু করি। যেহেতু আপনাদের অভিজ্ঞতাকে আপনাদের অনেকেই ব্যক্তির অভিজ্ঞতাই মনে করেন, ভাবতে চাননা যে অভিজ্ঞতা নির্মাণ করা হয়। ভাবতে চান না যে অভিজ্ঞতা নির্মাণের পেছনে বিপুল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। আর ভাবনা; সেতো খুব পরিশ্রমের কাজ, এ কাল-এ। মর্মান্তিক একটা সময়ে আমাদের বসবাস। একটি জৈবিক বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজন্ম হিসেবে আমরা সম্ভবত শেষ সময় পার করছি। এর পরের দশক থেকেই অজৈবিক বুদ্ধিবৃত্তিক কাল শুরু হবে। অনুমানটা আমার একার নয়, ওয়ান অফ দি গড ফাদারস অফ এ. আই. জেফ্রী হিনটনেরও।

এবারের আলাপে আমার ফোকাস এ.আই. না। তবে কিছু কিছু বিষয় সে সম্পর্কে থাকবে। আমি যে বিষয়টা সম্পর্কে বলতে চাইছি তা হল মানুষ হিসেবে আমাদের আচরণ এবং তথ্যপ্রযুক্তিময় হাইব্রিড সমাজে আমাদের বসবাস বিষয়ে সমাজ বিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থীর কিছু পর্যবেক্ষণ।

মানুষের কর্মকান্ডের একটা বড় অংশ এখন তথ্যপ্রযুক্তিময়। নির্ভর শব্দটা ইচ্ছা করেই ব্যবহার করলাম না; যাতে এমনটা মনে না হয় যে আমরাই কতৃত্ব করছি এবং ইচ্ছেমত তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করছি। আলাপটা বরং উল্টো তথ্যপ্রযুক্তি কীভাবে আমাদের ব্যবহার করছে।

আমরা ফেইসবুকের প্রোডাক্ট। আমাদেরকে বিক্রী করা হয়। আমাদের মনোযোগ হল কমোডিটি বা পণ্য। এই বিজনেস মডেলটি শুরু হয়েছে আমাদেরকে এই ভ্রান্ত ধারণা দেবার মাধ্যমে আমরা অনেকবেশি নিয়ন্ত্রণ পেয়েছি। যেমন আগে নিজের কথা বাকীদের বলতে আমাদের গণম্যাধমের দরকার হত। এখন আমরাই এক একটি গণমাধ্যম। এক একজন উদ্যোক্তা, একই সাথে প্রোডিউসার, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর, কন্টেন্ট, বিক্রেতা সবকিছুই। এক ব্যক্তি এক একটি প্রতিষ্ঠান। আসলে যতবড় প্রতিষ্ঠান তত বড় বিক্রয় পণ্য। ফলে ১০/২০ মিলিয়ন সাবসক্রাইবার নিয়ে এক একজন নিজেদের যতবড় ইনফ্লুয়েন্সারই ভাবুন না কেন তিনি আসলে মূল কোম্পানীর যেমন-মেটা-র একটি পণ্য। কারণ তিনি আরো বহু লোককে পণ্য বানাতে সক্ষম হয়েছেন। কীভাবে? তাদের মনোযোগ সুনির্দিষ্ট করার মাধ্যমে।

এখন যে ব্যক্তি মনযোগ বিক্রী করছেন তারা খুব কম। গোটা বিশ্বের ইনফ্লুয়েন্সারা অতটা বেশি হবেন না। আর যারা প্রায় কোন বিনিময় ছাড়াই মনোযোগ দিয়ে দিচ্ছেন তারা আরো সস্তা পণ্য। দুই পক্ষই পণ্য। যদিও দুই পক্ষই খুব মনে করছেন তারা ব্যক্তি হিসেবে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। সফল বা ব্যর্থ হচ্ছেন। আসলে আরো পণ্য হচ্ছেন।

এখন আসি মনোযোগ বিষয়ে। জৈবিক বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণী হিসেবে মানুষের জন্য মনোযোগ খুব জরুরি বিষয়। কিন্তু মানুষ মনোযোগ দেয় কোথায়? সে তার মনোযোগ দেয় যুদ্ধে, রক্তে, আতংকে, রগরগে সেক্স এ, নগ্ন শরীরে, গসিপে, স্বার্থে। অর্থাৎ তার যে প্রাথমিক তাড়ণা সেই অংশে। যেমন আপনাকে অর্থাৎ ব্যক্তিকে যদি আলাদা একা স্ক্রীণের সামনে নিয়ে এসে দুটি কন্টেন্ট দেয়া হয়, ১. আপনার রাস্তায় কোপাকুপি হচ্ছে ২. আপনার রাস্তায় ফ্রীতে বই দেয়া হচ্ছে আপনারা কি মনে করেন কোন কন্টেন্ট বেশি মনোযোগ পাবে?

কোম্পানীগুলি আপনাকে দুটি চেহারা দেখায়। একটি দেখতে পান এবং বিভ্রান্ত হন ও দ্বিতীয়টি অনুমানও করেন না। কেমন? প্রথম চেহারা হল ব্যক্তির শক্তি, ইচ্ছা, পছন্দ অপছন্দের গল্প। আরে আপনারই ফলোয়ার, আপনি-ই নিয়ন্ত্রণে। আসলে আপনাকে ব্যক্তি বা সুপার ইন্ডিভিজুয়ালের ছদ্ম আবরণ দিলে ফাঁদটা বেশি কার্যকর হয়। মূলত কোম্পানী আপনাদের ট্রিট করে একপাল মনোযোগ প্রদানকারী শ্রমিক হিসেবে। যে নাচতে নেংটা হয়ে যাবে, কিন্তু ভাববে সে খুব স্বাধীন। আমরা নেংটাই। আমাদের সকল ডিজিটাল যাপণের সকল ইতিহাসের একটি বিন্দুও কোম্পানীগুলি থেকে লুকানো নেই। এরপর আসি মধ্যবর্তী কিছু দলগুলির বিষয়ে যেমন রাষ্ট্র, যেমন তার গোয়েন্দা বাহিনী। ব্যক্তির নেচে নেচে শ্রম দেবার বিষয়টি নিশ্চিত রাখতে আইন এবং রেগুলেশনের একটি আবরণ দরকার। কারণ তাতে খরচ কম। কিন্তু বাংলাদেশের একটু সচেতন মানুষই জানেন কারো ইনবক্স বা চ্যাটই এই মধ্যবর্তী দলের নজরদারীর বাইরে নয়।

তাহলে আপাতত দুই দল পাওয়া গেল গ্লোবালিস্ট জায়ান্ট কোম্পানী আর তারপর রাষ্ট্র এবং তার দল। দুই দলের নিজস্ব ভালোবাসাবাসি আছে এবং থাকবে। কিন্তু তৃতীয় যে দল অর্থাৎ মনোযোগ শ্রমিক যারা তারা তো জানেই যে তারা উপনিবেশিত। এ এক নতুন উপনিবেশ যাতে উপনিবেশিত লোকজন মনেই করেনা যে উপনিবেশিত। বরং উপনিবেশিত না থাকতে পারলে, ট্রেন্ডে না থাকতে পারলে, ভাইরাল না হতে পারলে নিজেকে আর যথেষ্ট ব্যক্তি মনে করেনা।

মনোযোগের অথর্নীতিতে দাস মনে করে সে ইনফ্লুয়েন্সার। ব্রাভো। আর পূর্বের সমাজে মনোযোগের যে রাখঢাক ছিল, যা জরুরিও বটে সেটির আর কোন দূরত্ব, আড়াল আর নেই। অর্থনৈতিক লাভের জন্য পাল পাল ব্যক্তির মনোযোগের মান যদি বিচার করি তাহলে দেখবেন যে সেটি অত্যন্ত মর্মান্তিক।

মানুষের বিবেচনা বোধ তৈরির জন্য মনোযোগ লাগে। কারণ মানুষ একটি মোরাল প্রাণীও বটে। স্ক্রল এডিকশনের, বিন্জ ওয়াচের নাম হয়ত শুনেছেন। হয়তো ভেবেছেন কিছু মানসিক সমস্যা তৈরি ছাড়া ঠিকই আছে বিষয়গুলি। আসলে তা নয়। আপনার জৈবিক দুর্বলতাকে, কগনিটিভ বায়াসকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় সেটি কোম্পানীগুলি খুব ভালো জানে। ফলে যোগাযোগের নামে চূড়ান্ত বেযোগাযোগ এখন বাস্তবতা। সমাজেরে এর ইম্প্যাক্ট দেখুন। শিশুদের স্ক্রীণ আসক্তি তো কেবল শৈশব নষ্ট করছে না, পুরো জীবন নষ্ট করছে। কারণ তথ্যপ্রযুক্তি বুদ্ধিমত্তা যা অর্থনৈতিক লাভ দ্বারা চালিত যে এলগরিদম তা স্ক্রীণ দাস উৎপাদন করছে। মনোযোগ দেবার, পর্যবেক্ষণ করার, বিশ্লেষণ করার, জমায়েত হবার শক্তিকে খেয়ে ফেলছে। এটি বিরাট বিরাজনৈতিকীকরণ। তথ্যে আর এক্সাইটমেন্টে উত্তেজিত মস্তিষ্কের বিবেচনা বোধ নিয়ে কাজ করার শক্তি এমনিতেই থাকবেনা। নেইও। এরা হলেন জম্বি। এই অর্থনীতির জম্বি দরকার। আসলে জম্বি হয়েও গেছে। যে আসলে পালের দাস কিন্তু নিজেকে মনে করে ব্যক্তি তারমত জম্বি আর কে আছে বলেন।

জৈবিক বুদ্ধিমত্তার জৈবিক এক পদ্ধতি আছে। সেটি ডিজিটাল বুদ্ধিমত্তার পদ্ধতি নয়। জৈবিক বুদ্ধিমত্তার পদ্ধতিতে মনোযোগ খুব গুরুত্বপূর্ণ। আবেগ, জীবনের মানে, এসব জিনিসের জন্য তার মনোযোগ লাগে। কিন্তু ক্রমশ তার মনোযোগের ক্ষমতা তো তলানিতে। ফলে অচিরেই এমনকি মনোযোগ শ্রমিক হিসেবেও তার গুরুত্ব তলানিতে ঠেকবে। যখন মনোযোগ অর্থনীতি এ.আই. অর্থনীতিতে রুপান্তিরত হবে। ক্ষমা করবেন ভাষার জন্য। এ.আই. রাজনৈতিক অর্থনীতিতে বোকাচোদা মানুষের গুরুত্ব কেন থাকবে আপনি বলুন তো? ফলে মনোযোগ দিন সেই দিকে যখন গ্লোবাল জায়ান্টরা পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের জীবনকে অর্থহীন করে তুলতে বিনিয়োগ করছে। এ.আই. এজেন্টদের জীবনের অর্থ খুঁজতে হয় না। আপনার হয়। ফলে উৎপাদন শ্রমিক হিসেবে আপনি খরুচে, গুরুত্বহীন হয়ে পড়বেন না?

নিজেদের মনোযোগের মালিকানা নিজেদের কাছে ফিরিয়ে নিন। তাহলে প্রশ্ন করতে পারবেন, প্রতিবাদ করতে পারবেন, হয়ত পরিবর্তন করতে পারবেন। অনিয়ন্ত্রিত লোভ দ্বারা তৈরি এ.আই. অত্যন্ত মনোযোগের সাথে সুনিয়ন্ত্রিত না হলে বিশ্বের সমস্ত পারমানবিক বোমার চাইতেও ভয়ংকর হতে পারে। মনোযোগ আপনার আত্মরক্ষার শেষ কবজ। একটা কাজ দেই, খাতা কলম নিয়ে আগামী এক সপ্তাহ নিজেদের মনোযোগের হিসাব করুন। নিজে দেখুন কোথায় কোথায় কীভাবে মনোযোগ দিলেন আর কি পেলেন।

মনোযোগ অর্থনীতি এমনিতেই থামবে না। কানে ধরে থামাতে হবে। পারবেন? সেই মনোযোগ আছে আপনাদের?

শরৎ চৌধুরী, ২৫শে জুন ২০২৫। ঢাকা।

সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০২৫ রাত ১২:১৩
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শুধুমাত্র কিতাবের এলেমে কেউ আলেম হয় না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৪



সূরাঃ ৬২ জুমুআ, ২ নং আয়াতের অনুবাদ।
২। তিনিই উম্মীদের মধ্যে একজন রাসুল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য হতে, যে তাদের নিকট আবৃত করে তাঁর আয়াত সমূহ; তাদেরকে পবিত্র করে এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

দূরে কোথাও

লিখেছেন মোহাম্মদ সজল রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:১০



যদি দেখ ল্যাম্প পোস্টের গায়ে রঙিন
অক্ষরে লেখা নিখোঁজ সংবাদ
কিংবা লেখা আছে সন্ধ্যান চাই

মনে রেখো ততক্ষণে হারিয়েছ
রহস্যের অতল গহ্বরে
যেখানে আমি আগন্তুক
অজানা এক পরিচয়

পোষ্টারের বাম পাশে অস্পষ্ট -
ছবিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×