হেফাজতে ইসলামের ঢাকায় সমাবেশের এক বড় অংশ যে কওমি মাদ্রাসার সঙ্গে যুক্ত ছাত্র-শিক্ষকেরা ছিলেন, তা বিভিন্ন গণমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে। আপাতদৃষ্টেও বোঝা যায়, সংগঠনটির ভিত্তি দেশের সেসব কওমি মাদ্রাসায়, যেগুলো দেওবন্দ ধারার শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে থাকে। এ সমাবেশে এবং সংগঠনে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ অনেককেই বিস্মিত করেছে। কিন্তু ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত দারুল উলুম দেওবন্দের ইতিহাস কমবেশি যাঁদেরই জানা আছে, তাঁদের জন্য এটি মোটেই বিস্ময়কর হওয়া উচিত নয় যে, এ ধারার আলেম ও শিক্ষার্থীরা রাজনীতিতে এতটা প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হবেন। ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেবল যে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পুরোনো, পরিচিত ও সম্মানিত ইসলামি ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তা-ই নয়; এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ভারতে সিপাহি বিপ্লবের পটভূমিকায় মুসলিম সমাজের ভেতরে আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন সামনে রেখেই।
এ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মওলানা মুহাম্মদ কাসিম নানুতুভি (১৮৩৩-১৮৭৭) এবং মওলানা রশিদ আহমেদ গাঙ্গোহি (১৮২৯-১৯০৫) সিপাহি বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন এবং মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের আকাঙ্ক্ষা থেকেই দেওবন্দের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দেওবন্দ ছিল সে সময়ের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে রক্ষণশীল আলেমদের প্রতিক্রিয়া। তদুপরি দেওবন্দের প্রথম শিক্ষার্থী মাহমুদ-উল হাসান (১৮৫১-১৯২০) যখন এ মাদ্রাসার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন এ মাদ্রাসা রাজনৈতিক কার্যক্রমে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘সামারাতুত তারবিয়া’ (প্রশিক্ষণের ফলাফল), যা ছিল জামিয়াত-উল আনসারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। জামিয়াত-উল আনসার ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ের সূচনা করেছিল।
দেওবন্দের প্রচেষ্টা কেবল ব্রিটিশদের শাসনের বিরুদ্ধেই ছিল না, ছিল মুসলিম সমাজের সংস্কারের বিরুদ্ধেও। দেওবন্দের আলেমরা মনে করতেন, এসব সংস্কারপ্রচেষ্টা ইসলামকেই বিপন্ন করে তুলেছে। ফলে তাঁরা সে সময়কার অন্যান্য সামাজিক ও শিক্ষা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন, অনেককেই চিহ্নিত করেছেন ‘কাফের’ বলে এবং তাঁদের প্রচেষ্টাকে ‘অনৈসলামিক’ বলে বর্ণনা করেছেন। যেমন সৈয়দ আহমেদ খানের আলীগড় মোহামেডান-অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ, যা দেওবন্দিদের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্যবস্ত ছিল।
মুসলিম সমাজের মধ্যে দেওবন্দের আলেমদের কঠোর মনোভাবাপন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, তাঁদের ব্যাখ্যাকে একমাত্র গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা বলে দাবি করা, তাকলিদ (অন্ধ অনুকরণ) বিষয়ে তাঁদের আপসহীন অবস্থান নিয়ে আপত্তি ও অসন্তোষের সূচনা হয়। এ পটভূমিকায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে মুসলিম সমাজে উদ্ভব হয় আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আত নামের চিন্তাধারার। বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশের বারেলভির মওলানা আহমেদ রিজা খানের (১৮৪৪-১৯২১) নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এ চিন্তাধারার মূল কথা হচ্ছে, তাঁরাই সুন্নাহর প্রকৃত অনুসারী এবং সেই সূত্রে তাঁরাই প্রকৃত সুন্নি ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বকারী। মওলানা রিজা খানের জন্মস্থানের সূত্রে এ ধারাকে বারেলভি বলেই বলা হয়ে থাকে। দেওবন্দি আলেমরা ভারতে প্রচলিত বহু ইসলামি ঐতিহ্য ধারা—যেমন পীর-দরবেশ অনুসরণ, সুফিদের মতবাদ, মিলাদ মাহফিলের আয়োজন ইত্যাদি—অনৈসলামিক বলে বাতিল করে দেন; বিপরীতক্রমে বারেলভি বা আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আতের অনুসারীরা তাঁকে অতীন্দ্রিয়বাদী বা মিস্টিক ধারার অংশ বলে মনে করেন। এসবকে কেন্দ্র করে এ দুই ধারার মধ্যে সূচনা হয় তীব্র বিতর্কের। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় এ বিতর্ক ফতোয়াযুদ্ধে পরিণত হয়।
এ সময়কার বিভিন্ন ধারার চিন্তার মধ্যকার পার্থক্যগুলো বিভিন্ন মাসলাকের মধ্যে এক অন্তহীন বিরোধের সূচনা করেছে ঊনবিংশ শতাব্দীতে, যারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি আজকের বাংলাদেশে একদিকে দেওবন্দি ধারার প্রতিনিধি হিসেবে হেফাজতে ইসলামের সংগঠিত রূপের মধ্যে এবং তার বিপরীতে এ দেশের প্রচলিত ইসলামের প্রতিনিধি হিসেবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আতের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে। ভালো করে লক্ষ করলে এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই যে, কেন মাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, বিভিন্ন তরিকার গদিনসীনরা আহলে সুন্নাতের পতাকাতলে একত্র হয়েছেন।
দেওবন্দি ধারার আলেমরা ভারতে, পাকিস্তানে ও বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৪৭-পরবর্তী সময়ে জমিয়তে উলেমায়ে ইসলাম নামের রাজনৈতিক দলের মধ্য দিয়ে তাঁদের কার্যক্রম পরিচালনা অব্যাহত রেখেছেন। ভারতে এ সংগঠনের নাম জমিয়তে উলেমায়ে হিন্দ, যারা প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়। যদিও দেওবন্দি ধারার আলেমরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার গোড়ায় বারেলভি চিন্তাধারার অনুসারীরাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কালক্রমে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেওবন্দি ধারার আধিপত্য। আহলে সুন্নাতের অনুসারীদের রাজনৈতিক দল হলো জমিয়তে উলেমায়ে পাকিস্তান।
দেওবন্দিদের প্রভাব বিস্তারের কাজটি প্রধানত ঘটে ১৯৭৯ সালে ক্ষমতায় সেনাশাসক জিয়াউল হক অধিষ্ঠিত হওয়ার পর। আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে দেওবন্দি ধারার আফগান ও পাকিস্তানি রাজনৈতিক দলগুলো। ১৯৮৯ সালের পর এগুলোর মধ্য থেকেই গড়ে ওঠে তালেবান। কিন্তু তার প্রভাব কেবল যে আফগানযুদ্ধের মধ্যেই সীমাদ্ধ থেকেছে তা নয়, পাকিস্তানে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ধরনের জঙ্গিগোষ্ঠী। পাকিস্তানের গত দুই দশকের ইতিহাস যাঁরা জানেন, তাঁদের কাছে এ কথা বলার প্রয়োজন নেই যে তার পরিণতি কী হয়েছে।
কিন্তু এ পরিস্থিতির পেছনে কাজ করেছে আরও একটি কারণ, তা হলো দেওবন্দি ধারাকে মোকাবিলা করার জন্য আহলে সুন্নাতের অনুসারী রাজনৈতিক দলের বিস্তার। একসময় এমনও মনে করা হতো যে, আহলে সুন্নাত ধারার অনুসারীরা দেওবন্দিদের মতো সহিংসতায় বিশ্বাসী নন। গত এক দশকে সেই ধারণা ভুল বলেই প্রমাণিত হয়েছে। দেওবন্দিদের উপর্যুপরি হামলার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার কারণেই হোক কি তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের প্রয়োজনেই হোক, এখন পাকিস্তানে বারেলভি মতানুসারীদের জঙ্গি সংগঠন সুন্নি তাহরিকের উদ্ভব ঘটেছে। তাদের শক্তি দেওবন্দি ধারার জঙ্গি সংগঠন সিপাহ-ই-সাহাবা, সিপাহ-ই-জংভি, তাহরিক-ই-তালেবানের চেয়ে বেশি না হলেও তাদের হাতেও প্রাণ দিতে হয়েছে বহু মানুষকে।
পাকিস্তানে একসময় কারও কারও ধারণা হয়েছিল যে দেওবন্দি ধারা, যা পাকিস্তানের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে, তাদের মোকাবিলা করার জন্য দেশের অধিকাংশ মুসলমানের প্রতিনিধি ঐতিহ্যবাহী ধারার সমর্থক আহলে সুন্নাতের রাজনৈতিক ভূমিকা ইতিবাচকই হবে। কিন্তু তার পরিবর্তে যা ঘটেছে তা হলো, মুসলিম সমাজ সম্প্রদায়গতভাবে (সেক্টেরিয়ান) বিভক্ত হয়েছে এবং সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যকার এ বিরোধের পেছনে ধর্মের তত্ত্বগত ব্যাখ্যার কথা বলা হলেও রাজনৈতিক কারণই মুখ্য। তাদের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ সত্ত্বেও তারা শিয়া জনগোষ্ঠীকে অমুসলিম বিবেচনা করার প্রশ্নে একমত; তাতে করে শিয়া ও আহমদিয়া সম্প্রদায়কে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের জীবন, তা ছাড়া ব্লাসফেমি আইনের প্রশ্নে তাদের মধ্যে কোনো রকম ফারাক নেই।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে হেফাজতে ইসলাম ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আতের উত্থানের মুখে তাদের ভবিষ্যৎ পথরেখা বোঝার জন্যই পাকিস্তানের ইতিহাসের এ দিকগুলো তুলে ধরা। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যা ছিল দেওবন্দি-বারেলভি ফতোয়াযুদ্ধ, গত কয়েক দশকে পাকিস্তানে তা রূপ নিয়েছে সংঘাত, সংঘর্ষে। তাদের উভয়েরই লক্ষ্যবস্তু হয়েছে সংখ্যালঘু মুসলিমরা, আক্রান্ত হয়েছে খ্রিষ্টানরা। বাংলাদেশে এ দুই পক্ষের মধ্যে সংবিধান পরিবর্তনের প্রশ্নে, কাদিয়ানিদের প্রশ্নে, ব্লাসফেমিবিষয়ক আইনের প্রশ্নে এবং কথিত নাস্তিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি বিষয়ে মতৈক্য অবশ্যই সবার মনোযোগের দাবিদার। দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক সমীকরণে দেশের ক্ষমতাসীন দল বা অন্য কেউ যদি দেওবন্দি ধারার উত্থানের পাশাপাশি আহলে সুন্নাতের সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শনকে সাময়িকভাবে হলেও ইতিবাচক মনে করে, একটি শক্তি অন্য শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করবে বলে আশা করে, তবে তাদের আরেকবার পাকিস্তানের দিকে তাকাতে অনুরোধ করব।
দেওবন্দি
ইসলাহ (ইসলামি সংস্কারবাদ): কোরআন ও হাদিসের সম্মান বৃদ্ধি করা, নিজের জীবনের ও সমাজের সংস্কার।
তাকলিদ (যেসব ঐতিহ্য অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক): হানাফি আইনশাস্ত্র (ফিকহ), ব্যক্তিগত পরামর্শদাতা
(বা মেন্টর), গোষ্ঠীর নেতাদের দেওয়া ফিকহের
ব্যাখ্যা (ফতোয়া)।
বিদ’আ (যেসব ঐতিহ্য আপত্তিকর বা মোকাবিলা করা জরুরি): সাধু/ঋষি/পীর, শায়েখ, সমাধিপূজা, অলৌকিক ঘটনায় বিশ্বাস, নবীর প্রতি অতিরিক্ত ভক্তি প্রদর্শন।
যেসব গোষ্ঠীর সঙ্গে বিরোধ: বারেলভি, আহমদিয়া, আহলে হাদিস, শিয়া।
বারেলভি
ইসলাহ (ইসলামি সংস্কারবাদ): মহানবী (সা.)-এর দেখানো পথ (সুন্নাহ) পুনরুজ্জীবন ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
তাকলিদ (যেসব ঐতিহ্য অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক): হানাফি আইনশাস্ত্র (ফিকহ), অতীন্দ্রিয়বাদী (বা মিস্টিক) ঐতিহ্য, সাধু/ঋষি/পীর, মাজার ও সমাধির প্রতি
শ্রদ্ধা প্রদর্শন; গোষ্ঠীর নেতাদের দেওয়া ফিকহের
ব্যাখ্যা (ফতোয়া)।
বিদ’আ (যেসব ঐতিহ্য আপত্তিকর বা মোকাবিলা করা জরুরি): মহানবী (সা.)-এর, অতীন্দ্রিয়বাদী (বা মিস্টিক) ঐতিহ্যের, মাজার বা সাধু/ঋষি/পীর ও তাকলিদের অবমাননা বা এসবের ওপর কলঙ্ক লেপন।
যেসব গোষ্ঠীর সঙ্গে বিরোধ: দেওবন্দি, তাবলিগ, আহমদিয়া, আহলে হাদিস, শিয়া।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




