somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বুঝি না রাজনীতির ফের: এক দেশের মুসলমান অন্যদেশে হয় কাফের--মামুন আল মোস্তফা

৩০ শে মার্চ, ২০১৪ রাত ১:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভারতের কেরালাবাসী এক মুসলমান কোনো কারণে একবার সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি আহমদিয়া বা কাদিয়ানি মতাদর্শ অনুসারে জীবন যাপন করবেন। কথাটা শোনামাত্র প্রতিবেশীরা এসে তাঁকে জানিয়ে গেলেন যে তিনি আর মুসলমান পদবাচ্য নন এবং নিজের স্ত্রীর সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তাঁর তালাক হয়ে গেছে, কারণ মুসলমান ও অমুসলমানের মধ্যে বিবাহ অসম্ভব! বিষয়টি আদালতে গড়ালে নিম্ন আদালত ফরিয়াদীকে অমুসলিম বলে রায় দেন। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হলে কেরালা হাইকোর্ট রায় প্রদান করেন যে আহমদিয়া বা কাদিয়ানি সম্প্রদায় অবশ্যই মুসলিম হিসেবে গণ্য হবেন। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ-টাউনের একটি আদালতও একটি মামলায় কাদিয়ানিদের মুসলমান হিসেবে ঘোষণা দিয়ে তাঁদের বিরোধী পক্ষকে সকল মসজিদ, কবরস্থান ইত্যাদি স্থানে কাদিয়ানিদের প্রবেশ ও সেসব স্থান ব্যবহারে তাদেরকে বাধা প্রদান করা থেকে বিরত থাকতে আদেশ দিয়েছে। সুতরাং আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার কাদিয়ানিরা (আহমদিয়া সম্প্রদায়) মুসলমান।

পাকিস্তানের প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই সেদেশের মুসলমানরা (বিশেষত সুন্নীরা) আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করার জন্য আন্দোলন করতে থাকেন। এ নিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও সংঘঠিত হয়েছে বেশ কয়েকবার। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৪ সালে সাংবিধানিকভাবে আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তানের সংবিধানের ২৬০(৩) অনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে কারা মুসলমান এবং কারা মুসলমান নন।

“যাঁরা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করার সঙ্গে সঙ্গে মুহম্মদ (সা) কে চূড়ান্ত এবং সর্বশেষ নবী হিসেবে বিশ্বাস করেন এবং অন্য কাউকে নবী বা ধর্ম-সংস্কারক হিসেবে (সেটা যে অর্থেই হোক) বিশ্বাস করেন না শুধু তাঁরাই মুসলমান। অন্যদিকে যাঁরা খ্রিস্টান, হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, পারসিক সম্প্রদায় এবং কাদিয়ানি বা লাহোরি বা আহমদিয়া সম্প্রদায়, বাহাই সম্প্রদায় ও শিডিউল কাস্ট হিসেবে পরিচিত বা তাঁরা নিজেরা সে রকম দাবি করেন তাঁরা সবাই অমুসলিম।”

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ভারতের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে অবস্থান করলে একজন কাদিয়ানি মুসলমান হিসেবে গণ্য হবেন, কিন্তু মানবসৃষ্ট রাষ্ট্র-সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানের ভূমিতে পা রাখা মাত্রই তাঁর মুসলমানত্ব খারিজ হয়ে যাবে। আরেকটু পশ্চিমে এগিয়ে গিয়ে দক্ষিণ-আফ্রিকায় প্রবেশ করা মাত্র আবার তিনি মুসলমান বলে গণ্য হবেন। এর মানে হচ্ছে, কাদিয়ানি বা আহমদিয়া সম্প্রদায় একই সঙ্গে মুসলিম ও অমুসলিম, কারণ জাতীয়তা বা আবাসস্থল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের ধর্মীয় পরিচয়েরও পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু কোনো লোক কি একই সাথে মুসলিম ও অমুসলিম হতে পারে, বা মুসলমান হওয়ার শর্ত কি একেক দেশে একেক রকম হতে পারে? যে কোন কান্ড-জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ এ বিষয়ে একমত হবেন যে, মুসলমান হওয়ার মাপকাঠি দেশে দেশে ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার কথা নয় এবং হওয়া উচিতও নয়।

তবুও এহেন অনুচিত এবং অদ্ভুত ঘটনা বাস্তবে কেন ঘটে? এ ধরণের ঘটনা তখনই ঘটে যখন ধর্মীয় পরিচয়ের ব্যাপারে চূড়ান্ত মতামত দেবার জন্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষ রাষ্ট্রের শরণাপন্ন হয়। কোন বিশেষ ধর্মের অনুসারী নাগরিকেরা তাঁদের ধর্মের বিশ্বাস বা বিধি-বিধান অন্য নাগরিকদের উপর চাপিয়ে দেবার জন্য রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব এবং শক্তিকে ব্যবহার করতে চান। এই ঘটনার দুই রকম প্রভাব পড়ে সমাজে। প্রথমত, জনমনে এই সত্যটা প্রতিষ্ঠিত হয় যে ধর্মীয় বিশ্বাস বা বিধি-বিধান চর্চা [এবং প্রচার] রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছাড়া হয় না এবং দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় ব্যাপারে রাষ্ট্রই চূড়ান্ত রায় দেবার ক্ষমতা রাখে।

মনে রাখা দরকার যে রাষ্ট্র এবং ধর্ম উভয়েরই সৃষ্টি, বিকাশ ও লয় আছে। অতীতের বহু ধর্ম অপ্রচলিত হয়েছে, বহু রাষ্ট্রও বিলুপ্ত হয়েছে (উদাহরণ: জৈন ধর্ম, পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানী)। এর পরেও প্রশ্ন করা যায়: রাষ্ট্র আগে, নাকি ধর্ম আগে? বর্তমানে প্রচলিত প্রধান ধর্মগুলোর উদ্ভবের অনেক অনেক পরে আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। যখন রাষ্ট্র ছিল না তখন ধর্মীয় বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মানুষ কীভাবে পেত? ভবিষ্যতে রাষ্ট্র যখন থাকবে না, তখন ধর্মের বিধানের ব্যাপারে শেষ কথাটি কে বলবে? ইসলামের বিধান যদি রাষ্ট্রীয় ও সরকারি স্বীকৃতির উপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে ইসলাম ধর্মের যে শ্বাশ্বত রূপের কথা আমরা বলি সেটা কি কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ হয় না?

রাজনৈতিক তাত্ত্বিকেরা মনে করেন, রাষ্ট্রের উদ্ভব মানুষের যুথবদ্ধতার সঙ্গে সম্পর্কিত। মানুষ যুথবদ্ধ হয়ে বসবাস করে কোন ধর্মীয় কারণে নয়, নেহায়েত জৈবিক অস্তিত্ত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে, নিতান্তই জাগতিক প্রয়োজনে। আধ্যাত্মিক প্রয়োজন মেটানো রাষ্ট্রের লক্ষ্য নয়। এই বিশেষ প্রয়োজনটি মেটাতে পারে ধর্ম। দার্শনিক রুশোর মত হলো: ধর্মবিশ্বাস ও পরকাল সম্পর্কিত বিষয়গুলোর যে কোন ধরণের বিহিত করার ব্যাপারে রাষ্ট্র একেবারেই অসমর্থ। ধর্মবিশ্বাস যখন তার স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রের শরণাপন্ন হয়, তখন রাষ্ট্র-পরিচালকেরা তাঁদের বিবেচনা ও স্বার্থ মোতাবেক কোন একটি ধর্মের পক্ষে বা বিপক্ষে একটি রায় দিতে বাধ্য হন এবং সঙ্গত কারনেই সে রায় একেক রাষ্ট্রে একেক রকম হয়। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের যুক্তিবোধ অনুযায়ী আহমদিয়া সম্প্রদায় হলো মুসলমানদের মধ্যে একটি উপদল। অন্যদিকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের নীতির্নিধারকদের যুক্তিবোধ আর স্বার্থবোধের যুগপৎ বিচারে তাঁরা মুসলমান বলেই গণ্য নন।

বাংলাদেশে একাধিক বার আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণার দাবি উঠেছে। সম্প্রদায়টির উপর বিভিন্ন সময়ে সরকারি-বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় জুলুম-নির্যাতনও কম হয়নি। সম্প্রতি হেফাজতে ইসলাম নামের একটি সংগঠন সম্প্রদায়টিকে অমুসলিম ঘোষণা করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। দেশের প্রধান বিরোধীদলসহ অন্তত আধডজন রাজনৈতিক দল হেফাজনের স্বপক্ষে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে। দলগুলোর ওয়াদা হলো: ক্ষমতায় গেলে হেফাজতের দাবিগুলো পূরণ করবে তারা। ক্ষমতায় যাবার পর নির্বাচন-পূর্ব ওয়াদার কথা তাঁদের মনে থাকলে বাংলাদেশের আহমদিয়া সম্প্রদায়ও কোনো এক সময় অমুসলিমের খেতাবটি পেয়ে যাবে যদিও আহমদিয়ারা অবশ্য সব সময়ের মতোই নিজেদের মুসলিম বলে দাবি করতে থাকবেন। লালন সাঁই গেয়েছিলেন, ‘একদেশে যা পাপ গণ্য/ অন্যদেশে পূণ্য তাই’। এখন বেঁচে থাকলে তিনি হয়তো সে গানে নতুন একটি পদ জুড়ে দিতেন: ‘বুঝি না রাজনীতির ফের: এক দেশের মুসলমান অন্যদেশে হয় কাফের’।

“যাহারা দীন (ধর্ম) সম্বন্ধে নানা মতের সৃষ্টি করিয়াছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হইয়াছে তাহাদের কোন দায়িত্ব তোমার নয়; তাহাদের বিষয় আল্লাহর ইখতিয়ারভুক্ত। আল্লাহ তাহাদেরকে তাহাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে অবহিত করিবেন” (কোরান; ৬:১৫৯)। [আল-কুরআনুল করীম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, জুন-২০০৮, ঢাকা]।

হেফাজতপন্থী আলেমদের কাছে প্রশ্ন: কোরানের উপরোক্ত বাণী কেন আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না? আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মতো যাঁরা ইসলামের ব্যাখ্যার ব্যাপারে মতভেদ তৈরি করে থাকেন তাঁদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যদি আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত হয়ে থাকে তবে সেই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যে আমরা কেন অনর্থক মানুষের, রাষ্ট্রের আদালতের শরণাপন্ন হচ্ছি? এতে কি প্রকারান্তরে ইসলামের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে না?

মামুন আল মোস্তফা (একজন সুন্নি মুসলমান), শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
http://www.notundesh.com/details.php?link=1778&& category=মত-মতান্তর
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিচার চাই? না ভাই, আমরা "উল্লাস" চাই

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৩৭





দীপু চন্দ্র দাস একটি পোশাক শিল্প কারখানায় চাকরি করতো। সম্প্রতি দীপু দাস তার যোগ্যতা বলে সুপার ভাইজার পদে প্রমোশন পেয়েছিলো।

জানা যায়, সুপারভাইজার পজিশনটির জন্য আরও তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×