somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যুগল মৃত্যু: এমন ভালোবাসা এখনো মানুষ বাসে?

২২ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, ত্রিস্তান-ইসল্টা, রোমিও-জুলিয়েট নামের পাশে কী অক্ষয় হয়ে থাকবে রিফা ও আনোয়ারের নাম? কুমিল্লার রিফা আক্তারের মৃত্যুর খবর শুনে মারা গেছে তার স্বামী আনোয়ার। রূপকথার শুক ও শারির মতো একজোড়া তরুণ হৃদয়, আহা! কোনো কোনো পাখির জোড়া মরে গেলে নিঃসঙ্গ অপর পাখিটিও মরে যায়। রিফা ও আনোয়ারও কি ছিল তেমন এক জোড়া, যাদের একজন মারা গেলে অপরজনের আত্মা আপনা থেকেই নিশ্বাস নিতে ব্যর্থ হয়? কোনো কোনো শোকও কি বোমার শেলের মতো—তার আঘাত সইতে পারে না কোনো কোনো প্রেমিক মানুষ?

মজনুর মৃত্যু হয়েছিল লাইলীর কবরে মাথা রেখে—শোকে। তবুও শোকের পাথর বুকে বেঁধে লাইলীর কবর পর্যন্ত আসতে পেরেছিল মজনু, একা একা খুঁজে বের করেছিল তার সমাধি। কিন্তু আমাদের আনোয়ার তাঁর স্ত্রী রিফার লাশটিও দেখতে পারেননি। স্ত্রীর মরণের খবর পেয়ে বাড়ি আসার পথে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। পাশের জমিতে থাকা কৃষকেরা হাসপাতালে নিয়ে গেলে জানা যায়, হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে আনোয়ার। বুধবারের প্রথম আলোর ছাপা সংস্করণে এই করুণ কাহিনিটি ছাপা হয়েছে।

সবার মৃত্যুই হয় হৃদ্‌যন্ত্র বন্ধ হয়ে। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানে যার নাম হৃদ্‌যন্ত্র, কেবল সেটাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে না। মানুষকে বাঁচায় ভালোবাসা। যদি প্রেম হয় এমন : তোমার মধ্যে আমি আর আমার ভেতরে তোমার বসবাস, তাহলে তুমিই যদি না থাক, তাহলে তোমার মধ্যে থাকা আমার আপন আমি তো নিঃসহায় হয়ে যাবে! কোথায় সে তখন ঠাঁই খুঁজবে? ভালোবাসার ধনকে হারিয়ে মরে যেতে পারে কারও হৃদয়। সেই হৃদয় যদি আবার ভালোবাসায় ভরে না ওঠে, তাহলে ক্রমশ বাতাস ফুরিয়ে আসা বেলুনের মতো তা চুপসে যায়—এগিয়ে চলে ধীর মৃত্যুর দিকে। আবার চরম বিচ্ছেদ কারও হৃদয়কে পাথর করে দিতে পারে। শরীরে পক্ষাঘাত হলে অঙ্গ অবশ হয়, হৃদয়ে চরম আঘাত হলে মনটাই অবশ, অনুভূতিহীন হয়ে যেতে পারে। তখন কি তাকে আমরা বলব পাষাণহৃদয়? যার প্রতি ভালোবাসায় কারও হৃদয় ভরে থাকে, সেই মানুষটার মৃত্যুতে ফেটে যেতে পারে রঙিন বেলুনের মতো হৃদয়—তৎক্ষণাৎ তার মৃত্যু হয় আনোয়ারের মতো।

আনোয়ার অসাধারণ কেউ নন। কুমিল্লার এই ২৮ বছর বয়সী তরতাজা যুবক কাজ করতেন ঢাকার রামপুরার এক পোশাক কারখানায়। চাচাতো বোন রিফা আক্তার খানম তার চেয়ে চার বছরের ছোট। দুজনের জানাজানি ভালোবাসাবাসি দীর্ঘদিনের। সংবাদদাতা নৈর্ব্যক্তিক ভাষায় লিখেছেন, ‘একজনের প্রতি আরেকজনের দরদ ছিল অনেক।’ তাঁদের বিয়ে হয় বছর খানেক আগে। গার্মেন্ট শ্রমিক ছেলেটি বউকে রেখে ঢাকায় কাজ করতেন। ধারণা করি, একাই সে দুজনের পরিশ্রম করতেন, যাতে বউকে তাঁর মতো পোশাকশ্রমিক হতে না হয়।

গত সোমবারের ঘটনা। বিকেলে পুকুরঘাটে বসে স্বামীর সঙ্গে ফোনে কথা বলছিল মেয়েটি। ভুল করে ফোন পানিতে পড়ে যায়। তা তুলতে গিয়ে রিফাও নামে পুকুরের পানিতে। সেখান থেকে আর উঠে আসেনি সে। কোনো কোনো প্রেম আত্মঘাতী। গ্রিক উপকথার নার্সিসাস পানিতে নিজের রূপের প্রতিবিম্ব দেখে তাকে ছুঁতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল। আর রিফা আক্তার প্রেমিক স্বামীর সঙ্গে কথা বলার কার্যকারণে জড়িত হয়ে ডুবে মরলেন সেই পানিতেই।

পরে আত্মীয়স্বজন তাঁর নিথর দেহটি তুলে আনেন। আনোয়ার খবর পায় রাতেই। রাতেই সে রওনা হয়। কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার বামনিসাইর গ্রামে তাঁদের বাড়ি। মঙ্গলবার ভোরে অর্থাৎ পাঁচ-ছয় ঘণ্টার মধ্যেই সে পৌঁছে যায় বাড়ির কাছের বুড়িচং উপজেলার কংসনগর বাজারে। সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে সে হয়তো পৌঁছে যেত তার বাড়িতে। সেখানে প্রিয়তমা স্ত্রীর লাশ কোলে অপেক্ষা করছে তার স্বজনেরা। পাশাপাশি এটাই ভাবি, যদি তাঁরা বিবাহিত না হতেন, সমাজ কি তাঁদের প্রেম ও মৃত্যুর এই কদর করত?

কোনো কোনো শোক পাথরের মতো ভারী। কল্পনা করতে পারি, কত বিশাল পাথরচাপা মন নিয়ে এতটা পথ তিনি আসতে পেরেছিলেন। সে পথের ধুলায় কতটা অশ্রু তিনি ফেলেছিলেন, সেই দাগ কি স্রষ্টা দেখেছিলেন? গুনেছিলেন অসহ্য শোকভার নিয়ে চলা ওই যুবকটির পা-ফেলা? যদি তিনি পৌঁছাতে পারতেন মৃত স্ত্রী, তাঁর প্রেমের প্রতিমা রিফা আক্তারের নিথর দেহের কাছে, উকিল মুন্সীর গানের মতো সে কি বলতে চাইত না, ‘সূয়াচান পাখি, আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি’! সেটাই ছিল শেষ দেখার সময় উকিল মুন্সীর বিলাপ। কিংবদন্তি দার্শনিক কবি উকিল মুন্সী এই গানটি গেয়েছিলেন তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর, তাঁর লাশের সামনে বসে।

কী অদ্ভুত, উনিশ শতকের জার্মান কবি জর্জ হেইম তাঁর শেষ দেখা (last watch) কবিতায় একইভাবে বিলাপ করছেন, ‘কত ঘন তোমার ঘুম/ কত শীতল তোমার হাত
তুমি কি চলেই গেছ বহু দূরে?/তুমি কি আর আমাকে শুনতে পাচ্ছ না?’

কবি-গীতিকার রাধারমণও গেয়েছিলেন,

‘কারে দেখাব মনের দুঃখ গো
আমি বুক চিরিয়া
অন্তরে তুসেরই আগুন
জ্বলে রইয়া রইয়া
কথা ছিল সঙ্গে নিব
সঙ্গে আমায় নাহি নিল গো
আমারে একেলা থুইয়া
রইল কোথায় গিয়া
...ভাঙ্গিল আদরের জোড়া
কী যে গেল হইয়া।।’

কবি জসীমউদ্‌দীনের বিখ্যাত ‘নক্শীকাঁথার’ মাঠ কাহিনিকাব্যের শেষে যেমন সাজুর কবরের পাশে রুপাইকে নিথর পড়ে থাকতে দেখা যায়। রুশ ঔপন্যাসিক বরিস পাস্তারনাকের বিখ্যাত উপন্যাস ‘ডক্টর জিভাগো’র নায়ক ইউরি জিভাগোর শোক ছিল নিরুচ্চার, ‘যেন সে নয়, তার ভেতরে গুনগুন করে কাঁদছে কেউ।’

যারা শোক সয়ে নিয়ে স্বাভাবিক হতে পারে, তাদেরও অন্তরের গভীরে নীরব কান্না চলে। অনেকে হয়ে পড়ে চিরতরে বিষণ্ন। শোক ও বিষণ্নতাকে আলাদা ভাবতেন মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড। শোকের মাধ্যমে মানুষ প্রিয়জনকে বিদায় দিয়ে একপর্যায়ে শান্ত হয়। কিন্তু যার জন্য শোক করা যায়নি, যার শূন্যতার আসল ক্ষতি যখন মাপাও সম্ভব হয় না, তখন সেই ব্যক্তি হয়ে ওঠে ট্র্যাজিক। মুসলমানদের মধ্যে চল্লিশ দিনের শোকচল্লিশা পালনের রীতি আছে। বিপর্যয় থেকে স্বাভাবিকতায় ফেরার জন্যই শোকের কান্নাটা জরুরি। সব ধর্মরীতিতে শোক লাঘবের পথ বলে দেওয়া আছে। শোক পালন শেষে শোকার্ত মানুষ নতুন করে জীবন শুরু করতে পারে। শোককে তাই উদ্‌যাপন করতে দিতে হয়, কান্নাও তাই দরকার। একা পথে আনোয়ার হয়তো সরবে কাঁদতে পারেনি, তার বুকচাপা শোক তাই হয়তো তাকে মেরেই ফেলল।

তারপরও জীবন অফুরান। আমরা কেউই জীবনের শেষটা আগাম জানি না। তাই হয়তো জানি না, শোকে ধুয়ে ওঠা আত্মা কেমন বিষণ্ন সুন্দর, গভীর জীবনবাদী হতে পারে। আনোয়ার যদি তা জানতে পারতেন, সইতে পারতেন শোক, তাহলে হয়তো সেই শোকই তাঁকে বেঁচে থাকার শক্তিও জোগাত।

যে দুনিয়া থেকে নাকি প্রেম লোপ পাচ্ছে, সেই দুনিয়ায় আনোয়ার-রিফার প্রেমজীবন ও বিরহমৃত্যু অমর হোক। মানুষ জানুক, কী অদ্ভুত আর কী সন্দুর ও করুণ আমাদের প্রত্যেকের হৃদয়। এই কঠিন দুনিয়ায় সেই হৃদয়কে নরম করতে জানুক সবাই। জানুক, হাফ গার্লফ্রেন্ড আর হাফ বয়ফ্রেন্ডের আলগা-প্রেমের এ যুগে, বন্ধনহীন আমোদের উৎসবের বাইরেও অন্য একধরনের প্রেম আছে। সেখানেও রূপকথার শুক ও শারির মতো মানুষেরও জোড়া হয়, যার অর্ধেকটা মারা গেলে বাকি অর্ধেকটাও মরে যায়।

বিদায়ের সময়ই নাকি মানুষ বুঝতে পারে তার সত্যিকার ভালোবাসা। দুঃখ শুধু এই, রিফা ও আনোয়ারের ভালোবাসার গল্প, শোকের গান হিসেবেই আমাদের শুনতে হলো! এই করুণ শুক ও শারির প্রতি ভালোবাসা।( প্রথম আলো হতে সংগৃহীত)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:৪৭
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

সম্পর্ক

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২


আমারা সম্পর্কে বাঁচি সম্পর্কে জড়িয়ে জীবন কে সুখ বা দুঃখে বিলীন করি । সম্পর্ক আছে বলে জীবনে এত গল্প সৃষ্টি হয় । কিন্তু
কিছু সম্পর্কে আপনি থাকতে চাইলেও থাকতে পারবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×