১।
“ধর তুই একটা বয়লার মুরগির বাচ্চা কিনে আনলি কিন্তু ভাবছিস সেটাকে বড় করবি দেশী মুরগির মত । বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিবি, ইচ্ছেমত বড় হবে। তা কিন্তু তুই করতে পারবি না। কারন বাচ্চাটা মরে যাবে। তার বাচার জন্যে ঠিক খাবারটা তার মুখের সামনে চাই, মাথার উপরে সবসময় একি তাপমাত্রার সূর্য চাই, দৌড়তে পারবেনা বলে জীবন বাচাঁতে পাঁচিল চাই, আরো কতকি। সবকিছুর একটা নিয়ম আছে, নিয়মটা মেনে চল। দেখবি সে নিয়মটা তোকে নিয়ম ভেঙে নতুন নিয়ম গড়ার কাছে নিয়ে যাবে।”
দেবুদার কথা শুনতে বেশ লাগে। দেবুদা, আমার ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই, দু’বছরের সিনিয়র। ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই এবং একই এলাকায় বাসা হওয়ার সুবাদে আমাকে খুব স্নেহ করেন। মাঝেমাঝে দিশে খুঁজে না পেলে এইখানটাতে ছুটে আসি। দেবুদা কিছু না কিছু একটা ধরিয়ে দেন, বেশ কিছুদিন তাতেই চলে যায়। হোস্টেলে বসে আর ভালো লাগছিল না। সামনে ফোর্থ সেমিস্টার ফাইনাল, একদম অন্তিমপর্বে এসে মন উঠে গেল। আর পড়ব না বলে যখন একপ্রকার ঠিক করে ফেলেছি দেবুদা কেমন করে যেন খবর পেয়ে ছুটে এলেন। কাল পরীক্ষা, আমি পড়ার টেবিল ছেড়ে হোস্টেলের পেছনে জংলার ধারে পাঁচিলের ওপর শুয়ে দাতে ঘাস কাটছি। দেবুদা পাঁচিলে ওঠার আগ পর্যন্ত টের পাইনি তার এসে পড়া। পড়ে যেতে যেতে শব্দ করে কোনমতে সামলে নিয়ে হাঁফ ছেড়ে বসলেন আমার পাশে। এতক্ষণ বয়লার মুরগির লেকচারের সাথে আমার স্থাপত্য পড়ার মিলটা কোথায় সেটা ধরার চেষ্টা যখন জোরেশোরে চলছে, দেবুদা চুপচাপ চলে গেলেন। ভাবতে ব্যস্ত থাকায় ঠিক টের পেলাম না। চোখ তুলে হোষ্টেলের কোনায় তার ঢোলাঢালা নীল ট্রাউজারের সরে যাওয়া অংশটুকু দেখতে পেলাম মাত্র। আর কিছুক্ষণ থেকে ঘরে ফিরে এলাম। মার মুখখানা মনে পড়ছে। মায়া মায়া মুখে বিন্দু ঘাম। সহ্য হয় না, অগত্যা পড়তে বসতে হল। দেবো আমি পরীক্ষা। সুলিভান মশায় ভাল গন্ডগোল রটিয়ে দিয়েছেন স্থাপত্যবিদ্যায়। তার আঁকাশছোয়া বিল্ডিং এর বদৌলতে বইয়ের চ্যাপ্টার বেড়েছে চারটে। কি দরকার ছিল ভাই এত সব আঁকাশছোয়া ভবন তৈরী করার। আবার গালভরা নাম দেয়া হয়েছে স্কাই স্ক্রেপার। আধুনিক স্থাপত্যবিদ্যার জনক হয়ে মাথা কিনে ফেলেছেন সবার। ভদ্রলোকের ওপর ক্ষোভ ঝেড়ে মাথাটা বেশ ঠান্ডা হয়ে এল। পরক্ষণেই কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগল ।
অনিকে কাছে পেল বেশ ভাল হত। অনিন্দিতা, ছোট্ট করে অনি। ওর হাতে চুপটি করে দু হাত গুজে দিয়ে বসে থাকার আনন্দ পৃথিবীর অন্যসব আনন্দময় মুহুর্তগুলোকে ঝাপসা করে দিতে পারে নিমিষেই। অনি বুঝত আমার ব্যাপারটা, হয়তো সাপোর্ট দিত কিংবা বলত ঠিক আছে চল কাল নদীর ধারে যাই, না না ঝাউবনে যাবো, তুমি কাশফুল তুলে এনো। অনি পারেও বটে। মাথায় পড়াশুনো ঢুকছে না, বারবার মা, অনি নয়তো দেবুদা ঘোরাফেরা করছে । আনিস কোথা থেকে যেন ফ্লাক্সভর্তি কফি নিয়ে এল। জিঙেসের তোয়াক্কায় না গিয়ে গোটা এক মগ কফি ঢেলে দিয়ে নিজের টেবিলে বসে গেল । আনিসটা এমনি, যা মনে হবে করবে। কিচ্ছুটি ভাববে না। ও পিছুটান ভুলে যেতে পারে, ক্ষণিকের জন্যে হলেও পারে । আমারটা নাইলনের সুতোয় বাধা, ওদিকে ঢিল দেবার নাম নেই আর আমার হাতে কাটবার জন্যে কাচি নেই।
২।
-পরীক্ষা কেমন হলো?
-ঐ আর কি? তোমার?
-মোটামুটি । কাল সুলিভান সাহেবকে অযথাই টানা হেছড়া করালাম। তার সমন্ধে কিছুই আসেনি পরীক্ষায়।
-কি হল কি ভাবছ এত? অনি উতলা হয় ।
-না তেমন কিছু না। শোন আজ ঝাউবনে যাবে? আমি তোমায় কাশফুল তুলে দেব ।
অনি আমার দিকে চেয়ে হেসে ফেলল ।
“বন্ধু এ তো শরৎ নয়
শীত এসেছে
তুমি বলেছ, এই ঢের
মনবাগানে হাজারো কাশফুল ফুটে গেছে”
অনি সুন্দর ছন্দ বাঁধতে পারে। আমিও অনির দিকে চেয়ে হেসে ফেললাম। মাঝে কি এমন ছেলেমানুষী দানা বেঁধে ওঠে !
চল তবে নদীর ধারে যাই। বাতাস পাবে, তোমার পাগলাটে ভাবটা দূর হোক। অনির ঠোঁটে তখনও মৃদ্যু হাসি। অনির খুব নিজের কিছু সময় আছে, আমি বুঝতে পারি। এইযে আমার কাঁধে মাথা রেখে কোন অজানায় যে হারিয়ে গেছে অনি, তার ছায়াও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ।
-অনি, অনিই।
-উউ, কাঁধ থেকে মাথা তোলে অনি ।
-চলো যাই, সন্ধ্যে হয়ে এল।
-হুম চল।
বেশ শীত পড়ে গেছে। অনিকে চাদরে টেনে নি। অনি বাঁধা দেয় না। দূর থেকে দেখে আমাদের চেনার উপায় নেই। মনে হবে কেউ একজন হাটছে, একপায়ের সাথে অন্যপায়ের তাল মিলছে না, বোধহয় হাটতে ভুলে গেছে ।
কাল ক্যাম্পাস-চত্বরে বেশ হাঙ্গামা হয়ে গেছে। সকাল সকাল হোষ্টেল সার্চপার্টি চলে এলো। সামনে থেকে ক্যাম্পাসের নেতা-গোত্রীয় রাজনদা ছাড়া আর কাউকে ঠিক চেনা গেল না। রাজনদা এসবে থাকবে সে জানা কথা। উপরমহলের কোন এক সরকারদলীয় নেতার বেশ সুদৃষ্টি আছে বলে কানাঘুষো শোনা যায়। সে এসবে থাকবে না তো কে থাকবে। দুটো দল ওপরতলায় উঠে গেল । মিনিটখানেকবাদেই নেমে এল, দেখা শেষ । রাজনদা সব্বাইকে নিয়ে ডানদিকে এগুলেন। আমার কেন যেন মনে হতে লাগল এসব নেহায়েৎ লোক-দেখানো। তারা বেশ ভালভাবেই জানে কাকে ধরতে হবে, কিংবা কোথায় গেলে পাওয়া যাবে। সবকটা সোজা আমার রুমে ঢুকে আনিসের কলার চেপে নিয়ে গেল। যেতে যেত আনিস আমার দিকে একটিবার তাকাল। আনিসের চোখে ভয়ের ছায়া দেখতে পেলাম না অথচ আমার ভয় করতে লাগল। আমি জানি, আনিস আর যাই করুক ওসব হাঙ্গামা তার কাজের মাঝে পড়ে না। সে যেটা করেনি সেটা স্বীকারও করবে না। আনিস হচ্ছে ভাঙ্গবে কিন্তু মচকাবে না প্রকৃতির। আর জন্যেই বেশি ভয় করতে লাগল আমার। স্বীকার করলে হয়ত এ যাত্রা লঘু শাস্তি পেয়ে বেঁচে যাবে নয়ত খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে । রাজনদার বেশ বদনাম রটে আছে এ বিষয়গুলোতে। ঘরে ঢুকেই ফ্লাক্সভর্তি কফি পেলাম। আনিসের রোজকার অভ্যেস । খাওয়া যেতে পারে, শুধু শুধু নষ্ট হবে। পাশের রুম থেকে দু-একজন উকিঝুকি দিচ্ছিল, গা করলাম না । বাঙালী কৌতুহলী তবে কৌতুহলে ক্ষতি আছে দেখলে টিকিটির ছায়াও পড়তে দেবে না। আনিসকে নিয়ে গেছে আজ সাতদিন । এরমাঝে ওর বড়ভাই এসেছিল। রাজনদার কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম, ভেতরে তিনি একাই গিয়েছিলেন। আধা ঘন্টা বাদে বেড়িয়েই হনহন করে রুমে ঢুকেই আনিসের বাক্সপেটরা বের করে চলে যেতে উদ্যত হলেন। আমি আটকাতেই বললেন, ভুলে যাও আনিসকে। আমি চিনিনা, তুমিও চেননা, মনে রেখ। আমি স্তম্ভিত। সে রাতে ঘুম হল না। বারবার চোখ আনিসের ফাকা বিছানাটায় চলে যেতে লাগল। সে থেকে দেবুদাকে খুঁজছি, তার দেখা নেই। একবার পুরনো আস্তানায় গিয়েও দেখে এলাম। এমন সময়ে দেবুদাকেই দরকার। বেশ খবর-টবর দিতে পারতেন।
প্রকৃতি শুন্যস্থান পছন্দ করে না। আনিসের শুন্যস্থান পূরণ হয়ে গেল। বেশ মেয়েলি স্বভাবের একটি ছেলে এসে সে জায়গা পূরণ করে দিল। আমার বিশ্ববিদ্যালয়য়েরই ছেলেটা, নিটোল নাম, ফ্রেশার, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ে। আনিসের সাথে নিটোলের মিল বলতে ঐ যখন-তখন চা-কফি খাওয়া ছাড়া কিছুই দেখতে পেলাম না। ক্যাম্পাসে সবাই এমন ভাব করতে লাগল যেন আনিস নামে কাউকে চেনে না। ছন্দাকে দেখলাম হেসে হেসে গা দুলিয়ে রাজনদার সাথে ঘুরছে। তা দেখে অনু বেশ মন খারাপ করল। আনিস আর ছন্দার প্রেম ওর হাতে শুরু কিনা। অনু বেশ কাটা-কাটা কথা বলতে যাচ্ছিল। আমি আটকালাম, বেশ বুঝতে পারছি আনিসের অন্তর্ধানের ব্যাপারটা। কি ভাগ্য করেই না আনিস ছন্দাকে জীবনসংগী করে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অনু বুঝতে পারেনি, বুঝিয়ে বলতেই অবাক হয়ে গেল। চোখের কোনে জলের ছোঁয়া। অনিকে নিয়ে নদীর পাড়ে গেলাম। অনি বেশ শক্ত করে হাত জড়িয়ে ধরল। কেমন যেন অসহায় ভংগী পুরো মুখ জুড়ে। ওকে কাছে টেনে নিলাম। মেয়েটা বোধহয় প্রচন্ড ভরসায় বুকে মুখ গুঁজল।
৩।
-“আমার পুরোনাম সৌমিক পাল। সৌমিক বলে ডাকে সবাই। বাসা পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার হাজীপাড়া গ্রামে। বাবা নেই আমার, গত হয়েছেন বছর সাতেক হবে। মা প্রাইমারি স্কুলটিচার। ছোট দুটো বোন আছে আমার, একটা ক্লাস সিক্সে, আরেকটা ক্লাস থ্রিতে পড়ে। এইতো আমার পরিবার। আমি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত আছি। থাকি ক্যাম্পাসের পিছনেই এক হোস্টেলে।”
নিজের জীবনবৃত্তান্ত একটানা বলে কিছুক্ষণ দম নিলাম। আমার বিপরীতপাশে সোফায় বসে থাকা লম্বা সুশ্রী মাঝবয়সী ভদ্রমহিলার তীক্ষ্ণ চক্ষুদ্বয় খানিকটা শীতল হল।
-আমার মেয়ের অংকে খানিকটা দূর্বলতা রয়েছে। তুমি ওকে গণিত আর পদার্থবিজ্ঞান পড়াবে। সপ্তাহে তিন দিন পড়াতে হবে। তাহলে আগামীকাল থেকে পড়ানো শুরু করো?
-জ্বী আন্টি।
ড্রয়িংরুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় ভিতরদিকের দরজার কোণে চোখ আটকে গেল। ফর্সা করে দুই বেণী করা চপল এক কিশোরীর অবয়ব সরে গেল আমাকে দেখে। তিথী মনে হয়, আমার নতুন ছাত্রী। ক্লাস নাইনে পড়ে। উঁকি মেরে নতুন গৃহশিক্ষক দর্শন করলো। কাল থেকে ওকে পড়ানো শুরু হচ্ছে তাহলে। ছয় নাম্বার টিউশনি এটা আমার। কিভাবে যে সময় মেইন্টেইন করবো বুঝতে পারছি না।
চিন্তা করতে করতে রাস্তায় বের হয়ে এলাম। বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত ক্লাস, তারপর টিউশনি - প্রতিদিন তিনটা করে, এরপর হোস্টেলে ফিরে নিজের পড়াশোনা, এসাইনমেন্ট, প্রজেক্ট – উফফ আর ভাবতে পারছি না! স্রষ্টাই জানেন একমাত্র, কিভাবে সামলাবো সব। অনির কথা মনে পড়লো। পকেট হাতড়ে মোবাইলটা বের করলাম, পাওয়ার বাটন বারবার চাপার পরেও স্ক্রিনের কালোপর্দাটার পরিবর্তন হলো না। ফোনটা বন্ধ হয়ে গেছে, পকেটে পুরে পরের টিউশনির উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলাম। এই ফোন হোস্টেলে ফেরার আগ পর্যন্ত আর খোলা হচ্ছে না, অর্থাৎ রাত সাড়ে দশটা পার হবে। বেচারি অনির জন্য মায়া হচ্ছে খুব। মেয়েটার সাথে পরশু ঝগড়া করার পর আর ফোন দেয়া হয়ে ওঠেনি। পুরো দুদিন হতে চললো কথা বলিনা ওর সাথে। হোস্টেলে ফিরে কল দিতে হবে। অভিমান ভাঙাতে ভাঙাতে হয়ত আজকের রাতটা চলে যাবে।
ইদানিং অনির সাথে খুব ঝগড়া হচ্ছে। সম্পর্কের তৃতীয় বছর চলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ব্যাচ জুনিয়র ও আমার। আমার ডিপার্টমেন্টেরই জুনিয়র। ওর ভর্তি হবার মাস পাঁচেক পর থেকে আমাদের প্রেম শুরু হয়। আগ বাড়িয়ে প্রেমের প্রস্তাবটা আমিই দেই, কিছুদিন চুপ থেকে তারপর তাতে সারা দেয় অনি। ব্যস, শুরু হয় আমাদের পথচলা। তবে চলতে চলতে পথটা কি করে জানি হঠাৎ বন্ধুর হয়ে উঠছে ইদানিং। প্রায়ই খুব ছোটখাট বিষয়ে ঝগড়া হচ্ছে আমাদের দুজনের। অনি ইদানিং আমাকে সহ্য করতে পারছেনা। বস্তুত, এর জন্য আমিই দায়ী। ওর পরিবারের সবার ছোট ও। ওর বৃদ্ধ বাবা-মা আর বড় তিন ভাই মিলে বেশ কয়েকমাস ধরে ওকে বিয়ের জন্য প্রেশার দিচ্ছে। আর অনি প্রেশারটা পাস করছে আমার উপর। আমার আরো দেড় বছর লাগবে স্নাতক শেষ করতে। এরকম অবস্থায় কিভাবে ওকে বিয়ে করি – সেটা ওকে বোঝাতে পারিনা। অবুঝ অনি মাঝেসাঝে পালিয়ে বিয়ে করার কথা বলে। প্রত্যুত্তরে আমি হেসে ফেলি – নির্লিপ্ত হাসি। বাস্তবতার কষাঘাতে মস্করার ন্যায় লাগে ওর এই কথাগুলো – দু’বছর আগেও নদীপাড়ে কাশবনে কাটানো মূহুর্তগুলোয় যে কথাগুলো খুব সহজ লাগতো। যেখানে টিউশনি করিয়ে নিজের খরচ চালাচ্ছি, বাসায় দিচ্ছি বাদবাকিটা, সেখানে অনিকে নিয়ে সংসার পাতার স্বপ্ন এখন নিছক কৌতুক ছাড়া কিছু মনে হয়না আমার কাছে। তবুও ওকে বরাবরের ন্যায় আশ্বাস দেই আমি। নতুন দিনের আশ্বাস, ভবিষ্যতের সোনালী দিনের আশ্বাস, বেলা বোসের আশ্বাস। এটাই এখন একমাত্র সম্বল আমার।
অনিকে নিয়ে চিন্তা করতে করতে হেঁটে ছাত্রের বাসার সামনে এসে পড়েছি। কলিংবেলে চাপ দিয়ে দরজা খোলার অপেক্ষা করতে থাকলাম। আমার কেমন যেন গা কাপতে লাগল দেয়ালে হাত রেখে নিজেকে সামলে নিলাম।
৪।
টিউশনি করে হোস্টেলে ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা বেজে গেল আজ। রুমে ঢুকে দেখি নিটোল টেবিলল্যাম্প জ্বালিয়ে গুণগুণ করে পড়ছে – পরীক্ষা আছে মনে হয় ওর। আমি মোবাইল ফোনটা বের করে চার্জে লাগিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালাম। গা ঘেমে নেয়ে একাকার – গোসল করতে হবে।
গোসল সেরে ফিরে এসে দেখি নিটোল বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ফোনটা অন করলাম। সাড়ে এগারোটা বাজে। অনিকে ফোন দিলাম।
-দুঃখিত। আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি এই মূহুর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা।
ফোন কেটে দিয়ে আবার কল দিলাম। একই উত্তর ভেসে এলো। আরো কয়েকবার চেষ্টা করলাম কিছুক্ষণ পর। লাভ হলো না – নাম্বার অফই। ফোন রেখে দিলাম। ঘুমিয়ে পড়েছে কি মেয়েটা, নাকি অভিমান ভাঙ্গেনি – ঠাওর করতে পারলাম না। খুব ক্লান্ত লাগছে, ঘুমানো উচিত আমার – বেশ বুঝতে পারছি। টেবিল ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিলাম। বালিশে মাথা গুঁজে চোখ বন্ধ করে আমার স্বপ্নের কথা ভাবা শুরু করলাম। ছোটবেলা থেকে অনেক স্বপ্নই লালন করেছি আমি। কয়টা বাস্তবায়িত হয়েছে? খুব কঠিন না বোধহয় হিসাবটা – অন্তঃত আমার ক্ষেত্রে! একটু ভালোমত ভাবলেই আর অংক কষলেই হিসাব পেয়ে যাবো। কিন্তু হিসাব মেলাতে ইচ্ছা করছে না। এরচেয়ে বরং অন্য জিনিস ভাবি। আমার বেশিরভাগ স্বপ্নই কেন বাস্তবায়িত হয় না? কারণ স্বপ্নগুলো নতুন স্বপ্ন দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়। নিত্য নতুন সব স্বপ্ন এসে পুরনো স্বপ্নগুলোকে সরিয়ে দেয়। ছোটবেলায় ইচ্ছে ছিল ক্রিকেটার হব, জাতীয় দলে খেলবো – ক্রিকেট ভালো খেলতাম কিনা। কিন্তু এই স্বপ্নটা কিছুদিন পরেই রিপ্লেস হয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশ হওয়ার স্বপ্ন দিয়ে। তখন সদ্য রকিব হাসানের অমর সৃষ্টি তিন গোয়েন্দা পড়ছি – বইয়ের ভিতর মুখ গুঁজে রহস্যের জাল খোলার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতাম। ক্রিকেটকে এভাবেই টেক্কা দিল আমার গোয়েন্দা পুলিশ হবার স্বপ্ন।
আচ্ছা ! আমার স্বপ্নগুলো কি দুর্বল – চিরস্থায়ী না? নাকি আমি স্বপ্নের পিছনে মরিয়া হয়ে ছুটি না – শুধু অভিভূত হয়ে লালন করি স্বপ্ন, আর হাতের নাগালে আসলেই খালি লুফে নেই সেগুলো? নাকি আমি আসলে দুর্বলচিত্তের মানুষ, তাই ভেঙে পড়ি, বারবার। আবার আস্তে আস্তে পায়ে ভর দিয়ে একটু একটু করে দাঁড়াই, আবার ভেঙ্গে পড়ি, দাঁড়াই। এভাবে চলতেই থাকে ভাঙ্গা-গড়ার খেলা।
আচ্ছা, আমার বর্তমান স্বপ্নগুলো কি কি?
এক, প্রথমেই স্বপ্ন ছিল ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট রেজাল্ট করে বের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে যাব। স্বপ্নটা ভূপতিত হতে সময় লেগেছিল এক বছর। প্রথম দুই সেমিস্টারের রেজাল্ট দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম – এ আশায় গুড়েবালি, আমার পক্ষে এ আর সম্ভব নয়। দুই, দ্বিতীয় স্বপ্নটা উঁকি মারে খুব মৃদুভাবে, এর স্থায়িত্বকালও মৃদুই ছিল। দেবুদা তখন উচ্চতর পড়াশোনার জন্য বিদেশে পাড়ি জমানোর পায়তারা করছেন। তার সাথে থেকে আমার গায়েও খানিকটা হাওয়া লাগে বিদেশের। মাস দুয়েক মজে থাকি এ নিয়ে, তারপরই এ স্বপ্নও ভূপতিত হয়। তিন, আমার জীবনে অনি আসে, ওর পিছেপিছে আসে আমার তৃতীয় স্বপ্ন। কম্বাইন্ড ঘরানার এ স্বপ্নে স্বপ্ন দেখি – অনিকে নিয়ে ঘর বাঁধার, যেখানে আমরা দুজনেই কর্মজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত দুই প্রখ্যাত স্থাপত্যবিদ। এর মাঝে দেবুদা ঠিকই তার স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটিয়ে আমেরিকা পাড়ি জমান – আর আমার তৃতীয় স্বপ্ন ভূপতিত হয় তার বছর খানেক পর। চার, চতুর্থ স্বপ্নটাই আঁকড়ে ধরে আছি এখন। সাদামাটা টিপিক্যাল বাঙালী তরুণ প্রেমিকের স্বপ্ন – কোনমতে স্নাতকটা শেষ করে একটা চাকরি ধরা, এরপর বেলা বোস-ন্যায় প্রেয়সীটার হাত বগলদাবা করে সোজা বিয়ের পিঁড়িতে বসে যাওয়া। বাস্তবতার মারপ্যাঁচে খাবি খেতে খেতে এ স্বপ্নটাও মলিন হতে চলেছে – খুব বুঝতে পারছি।
ঘুমঘুম ভাবটা গাঢ় হওয়ায় আমার চিন্তায় ছেদ পড়ছে। বিশাল কয়েকটা হাই তুলে ধীরেধীরে তীক্ষ্ণ চিন্তাগুলোকে আত্মসমর্পণ করে ভোঁতা করে দিচ্ছি, আর লুটিয়ে পড়ছি ঘুমের তলদেশে।
৫।
পরদিন ঘুম ভাংলো সকাল দশটায়। ঘুম থেকে উঠে ফোনের ঘড়ি দেখেই মেজাজটা গরম হয়ে গেল। রাতে ফোনে এলার্ম দিতে ভুলে যাওয়ার ফল এটা। সকাল ন’টার ক্লাসটা মিস হয়ে গেল, নেক্সট ক্লাস সাড়ে এগারোটায়। বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমের দিকে হাঁটা দিলাম।
হাত-মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে হোস্টেল থেকে বের হতে হতে মিনিট বিশেক লাগলো। পাশের টঙের দোকানে চা আর রুটি খেতে খেতে অনিকে ফোন দিলাম। কালকের মতই বন্ধ পেলাম ফোন। মনটা খচখচানো শুরু করলো। অনির সাথে এর আগেও ঝগড়া হয়েছে ওর – কিন্তু, তার জন্য ও ফোন বন্ধ করে রাখেনি কখনো। অনির রুমমেট নূপুর মেয়েটার নাম্বার খোঁজা শুরু করলাম কন্টাক্টলিস্টে। ফোন দিলাম – মিষ্টি মেয়েলি একটা গলায় রবীন্দ্রসংগীত শুনতে পেলাম। “মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না” – আজকাল কলারটিউন কেউ রাখেনা, নূপুর মেয়েটা একটু অদ্ভুত।
-দাদা, আদাব। ভালো আছেন?
-হ্যাঁ, তুমি কেমন আছো নূপুর?
-ভালো আছি। আপনার তো দেখাই পাওয়া যায় না ইদানিং।
-খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছে রে। অনি কি করে নূপুর?
-ওমা, আপনি জানেননা অনি বাসায় গেছে?
-না মানে, একটু মনমালিন্য চলছে তো আমাদের মাঝে – এরই জের ধরে ওর সাথে কথা হয়নি দু’দিন ধরে। গতকাল রাতে ফোন অফ পেলাম ওর, আজকেও দেখি একই ঘটনা – তাই তোমাকে ফোন দিলাম ওর খোঁজ নিতে।
-সৌমিকদা, অনির বাবা অসুস্থ – হাসপাতালে ভর্তি করেছে ওনাকে। অনি এই খবর পেয়ে পরশু দুপুরেই বাসায় রওনা দেয়।
-আচ্ছা, ধন্যবাদ তোমাকে নূপুর। ভালো থেকো।
ফোন রেখে দিলাম আমি। অনির নাম্বারে ফোন দিলাম আবার। আগের মত বন্ধই পেলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো বুক থেকে। দোকানদারকে খাবারের দাম দিয়ে ক্যাম্পাসের দিকে হাঁটা দিলাম – ক্লাসটা ইম্পরটেন্ট, ধরতে হবে।
৬।
“স্যার, অংক করা শেষ আমার।” তিথীর কথায় চমকে উঠলাম। হাতে ধরা মোবাইলটা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাকালাম ওর দিকে। বড় বড় একজোড়া কাজলটানা চোখ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওর হাত থেকে গণিত খাতাটা নিয়ে ওকে আরেকটা খাতা বের করতে বললাম।
-তাহলে পদার্থবিজ্ঞানে নিউটনের বলবিদ্যার সূত্র পর্যন্ত পড়া আছে তোমার?
-জ্বি স্যার, স্কুলে পড়িয়েছে।
-নিউটনের বলবিদ্যার তিনটা সূত্র মনে আছে তো?
-জ্বি স্যার, বলবো?
-না, বলার দরকার নাই। আমি অংকগুলো দেখতে দেখতে তুমি তিনটা সূত্র খাতায় লিখে ফেল ঝটপট। তারপর আমি তোমাকে বোঝাচ্ছি।
দু’পাশে চুলবেণী করা মাথাটা ঝাঁকিয়ে লেখা শুরু করলো তিথী। আমি লাল কলম হাতে নিয়ে অংকগুলো দেখা শুরু করলাম।
পৃষ্ঠা উল্টিয়ে খসখস করে টিক দিয়ে খাতাটা রেখে দিলাম। তিথীর লেখা শেষ হয়নি এখনো। ফোনটা বের করলাম আবার পকেট থেকে। মেসেজ ফোল্ডারে যেয়ে অনির মেসেজটা ওপেন করলাম। দুপুর একটায় এসেছে মেসেজটা।
“সৌমিক, আমার বাবা খুব অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে – সম্ভবত উনি বাঁচবেনা আর। উনি মৃত্যুর আগে আমাকে একজনের হাতে তুলে দিয়ে যেতে চান। আজ রাতে আংটি বদল হবে বাবার সামনে। ছেলেটা ডাক্তার, বাবার বন্ধুর ছেলে, আমি সরি সৌমিক। তোমাকে কল করে কিছু বলার সাহস হলোনা আমার।”
মেসেজটার দিকে ঠায় চেয়ে আছি। কেন জানি আমার কিছুই মনে হচ্ছে না – অথচ কিছুটা কষ্টবোধ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু, আশ্চর্যের ব্যাপার, দুপুর থেকে এখন পর্যন্ত তেমন কোন অনূভুতি একবারের জন্যেও আসেনি। শুধু পেটটা গুড়গুড় করছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। দুপুরে খাওয়া হয়নি কিছু, তাই হয়তো এসিডিটির কারণে এমনটা লাগছে। তিথীর লেখা শেষ – খাতাটা হাতে নিয়ে দেখা শুরু করলাম। খসখস করে কলম দিয়ে দুটো টিক দিয়ে তিথীকে জিজ্ঞেস করলাম ওয়াশরুমটা কোন দিকে – তিথী দেখিয়ে দিল। ওয়াশরুমে ঢুকে খুব বমি হলো আমার। মুখে পানি ঝাপটা দিয়ে বেসিনের আয়নায় তাকালাম। চোখদুটো লাল হয়ে গেছে – মাথাটা একটু টলে উঠলো। টাওয়েলে মুখ মুছে ফিরে আসলাম তিথীর রুমে। তিথীর আমাকে দেখে খুব উদ্বিগ্ন হলো মনে হলো।
-স্যার, আপনাকে দেখে খুব অসুস্থ মনে হচ্ছে।
আমি শুকনো একটা হাসি দিলাম তিথীকে। “আমারও নিজেকে অসুস্থ মনে হচ্ছে তিথী। জ্বর আসছে মনে হয়। শোন, আজ এ পর্যন্তই থাক – কাল সন্ধ্যায় এসে বাকিটা পড়াবো তোমাকে।”
তিথী বেণীদুটো দুলিয়ে আবার আগেরমত মাথা ঝাঁকালো। আমি তিথীদের বাসা থেকে বের হয়ে আসলাম। বাইরে বেরিয়ে রাস্তায় আরেকদফা বমি হলো আমার। চোখদুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন। রাস্তার ধারে থাকা একটা টিউবওয়েলে হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম। খুব শীত-শীত লাগা শুরু হলো। আমার সামনেই রাস্তায় একটা রিকশা দাঁড়িয়ে ছিল। রিকশাওয়ালা বসেবসে আমার কান্ডকীর্তি দেখছিলো। লোকটার মুখের দিকে তাকাতেই বলে উঠলো, “মামা, ভাড়া যাবেননি?”
“হ্যাঁ, বাসস্ট্যান্ড চলো।” – কোনমতে বলে চেপে বসলাম রিকশায়।
৭।
রাজশাহী যখন পৌঁছালাম, রাত দেড়টা বাজে প্রায়। জ্বরে পুরো শরীর কাঁপছে আমার। কাঁপতে কাঁপতেই অনিকে ফোন দিলাম। চার-পাঁচবার রিং হবার পর ধরলো অনি।
-অনি, কোথায় তুমি এখন?
-হাসপাতালে আমি। সৌমিক, আমার বাবা মারা গেছেন।
অনির কান্নামাখা গলা শোনা গেল।
-অনি, আমি রাজশাহীতে। বাস থেকে নামলাম কিছুক্ষণ আগে। তুমি হাসপাতালের নাম বলো – আমি আসছি।
৮।
করিডোরে চেয়ারে বসে ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছি। অনি ফেসবুক প্রোফাইল পিক আপডেট করেছে। জাফলং এ নৌকায় চড়ে নদীর পানি ছুঁয়ে দিচ্ছে হাত দিয়ে। আগের চেয়ে মোটা হয়েছে মেয়েটা, গায়ের রঙটা উজ্জ্বল শ্যামলা থেকে ফর্সা হয়েছে। লম্বা পিঠ ছড়ানো কোঁকড়া চুলগুলো ছোট করে ফেলেছে। তবুও, বেগুনীরঙা সালোয়ার কামিজে ওকে আগের মতই সুন্দর লাগছে – কিছু কিছু মানুষ চিরযৌবনা হয়। অনিও তেমনই।
“সৌমিক, ব্রেড শেষ হয়ে গেছে। ডাউনটাউন গিয়ে নিয়ে আসো এক্ষণি। নাহলে কিন্তু ব্রেকফাস্ট না করেই থাকতে হবে।”
ঘরের ভিতর থেকে তিথীর গলা শোনা গেল। তিথী – আমার এক্স-স্টুডেন্ট কাম বেটার হাফ। চার বছর হতে চললো আমাদের বিয়ের। ওকে নিয়ে আমেরিকায় শিফট হয়েছি বছর তিনেক হচ্ছে। আমি আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব অরিগনে রিসার্চ এসিস্টেন্ট হিসেবে নিয়োজিত, তিথী ফুল হাউজওয়াইফ আর পার্টটাইম লেখিকা। ভালোই লেখে ও – গত একুশে বইমেলায় প্রথম বই প্রকাশিত হলো ওর। “ল্যাভেন্ডাররঙা দিনগুলো” – ভালোই সারা দিয়েছে পাঠকমনে।
রাজশাহীতে সে-রাতে অনিকে সাথে করে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। সারা দেয়নি তাতে অনি। রাজশাহী থেকে ফেরার পর স্বভাবতই খুব ভেঙ্গে পড়েছিলাম আমি। স্বাভাবিক হতে বেশ সময় লেগেছিলো। তিথীর ভালোবাসা না পেলে হয়তো কখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারতাম না। মেয়েটা আমার জীবনে এসে প্রত্যেকটা কষ্ট মুছে দিয়েছে নিজ হাতে, আর এক এক করে রিপ্লেস হয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলো পুনরায় সাজিয়েছে ল্যাভেন্ডার রঙে।
চেয়ার থেকে উঠে ঘরে ঢুকলাম। তিথী কিচেনে – পিছন থেকে ওর লম্বা স্ট্রেইট চুলগুলো আলগোছে সরিয়ে গালে একটা চুমু দিয়ে কেটে পড়লাম । দরজা খুলে বাইরে বেড়নোর আগে পিছন ঘুরে ওর লাজুক হাসিমুখটা আরেকবার দেখে নিলাম।
গ্যারেজ থেকে এসইউভিটা বের করে ডাউনটাউনের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি। রাস্তার পাশ দিয়ে চলে গেছে উইলিয়ামমেট নদী। নদীর দিক থেকে ভোরের ঠান্ডা বাতাস এসে চুল উড়িয়ে দিচ্ছে আমার। গাড়ির রেডিওতে K-Rose রেডিও স্টেশনের গান বাজছে –
“Hey Louisiana woman, Mississippi man
We get together every time we can,
The Mississippi River can keep us apart
There’s too much love in the Mississippi heart,
Too much love in Louisiana heart.”
মানুষের জীবনটাও মিসিসিপি নদীর মত এঁকেবেকে চলছে, চলবে – এঁকেবেকে, যার যার মতন নিজস্বগতিতে। অনির জীবন অনির মতন করে আর আমার জীবন তিথির পিছুপিছু। কোন এক গভীর রাতে দুঃস্বপ্নের ঘোরে হয়ত অনিকে ভেবে তিথিকে জড়িয়ে ধরা হবে, ছুয়ে ভুল ভাঙ্গলেও আফসোস করা হয়ে উঠবে না। মধ্যরাতের কোন এক প্রহরে তিথি অনি হয়ে উঠবে এই ছলনাটুকু বুকে পাথর হয়ে চেপে থাকবে।
শাহরিয়ার বিশাল ও মুস্তাকিম মোর্শেদ