ওয়াজদা ১০ বছরের একজন মেয়ে। অতি রক্ষণশীল দেশের মধ্যে উন্নতম সৌদিতে তার বাড়ি। যেখানে মেয়ে মানুষের অর্থ সারা পৃথিবীর সাথে মিলে না। এই ছোট বয়সেই তাকে নানা সামাজিক ধর্মিয় নিয়ম কানুন বদ্ধ করে রেখেছে। মেয়েদের জোরে কথা বলা যাবে না, মেয়েরা সাজুগুজু করতে পারবে না, পুরুষ মানুষ যেন কোনমতেই মেয়েদের ছায়া পর্যন্ত না দেখতে পারে এই রকম নানা ধরনের নিয়ম কানুনে আবদ্ধ। কিন্তু ওয়াজদা একটু অন্য ধরনের মেয়ে। ধর্মের চোখ রাঙ্গানো বা সামাজিক নিয়ম কানুন গুলা ও থোরাই কেয়ার করে। ও চলে নিজের ইচ্ছা মত।কৈশোরের চঞ্চলতা তার স্বাভাবিক প্রকাশ করে চলছে ওয়াজদার ভিতরে। ফুর্তিবাজ সদা চঞ্চল ওয়াজদা একদিন তার বন্ধু আবদুল্লার সাথে ঝগড়ার পরে তাকে চ্যালেঞ্জ করে বসে যে সে আব্দুল্লাহকে সাইকেল রেসে হারিয়ে দিবে। জবাবে আব্দুল্লাহ হেসে বলে মেয়েদের সাইকেল চালানোর নিয়ম নাই। ওয়াজদা দমে যাওয়ার পাত্র না, সে তার মাকে জানায় সাইকেল কেনার কথা। মায়ের মুখেও আব্দুল্লার কথার প্রতিফলন ঘটে। মনে যখন সুপ্ত বাসনা সাইকেল চালানোর ঠিক তখনই একদিন ওয়াজদা একটা সবুজ সাইকেল দেখে এবং ওই সাইকেলটাই যে তার লাগবে তা একেবারে নিশ্চিত হয়ে যায়। শুরু হয় সাইকেল কেনার জন্য টাকা জমানো। কত উপায়ে যে ওয়াজদা সাইকেল কেনার টাকা জমাতে থাকে তার কোন হিসাব নেই। দোকানদার যেন সাইকেলটা না বিক্রি করে তার জন্য দোকানদার কেউ আবার ঘুষ দিয়ে আসে। সব শেষে ওয়াজদা কোরআন প্রতিযোগিতায় নাম লেখায় যার প্রথম পুরস্কার ১০০০ রিয়েল। সাইকেলের দাম ৮০০ রিয়েল। প্রতিযোগিতায় নাম লেখাতে আর কোন কিছু দরকার ছিল না ওয়াজদার।
এমনই অদ্ভুত সুন্দর এক গল্প নিয়ে ছবি ওয়াজদা। সৌদি আরবের প্রথম নারী পরিচালক (এখন পর্যন্ত এক মাত্র কিনা আল্লাই জানে!!) হাইফা আল মনসুরের প্রথম ছবি এটা। যে সৌদি আরব আমাদের চোখের সামনে থেকেও আসলে চোখের আড়ালে তা অনেকখানিই তুলে এনেছেন তিনি। ওই রকম পরিবেশ থেকে এমন একটা সিনামা এক কথায় অকল্পনীয়। যেহেতু প্রকাশ্যে পুরুষদের সাথে সিনামার কাজ করা যাবে না তাই পরিচালক রাস্তার দৃশ্য গুলো শুট্য করার জন্য এক ভ্যানে বসে মনিটরে দেখতেন এবং ওয়াকিটকিতে নির্দেশ দিতেন। কতটা কষ্টসাধ্য ছিল শুটিং করা তা সহজেই অনুমেয়। ওয়াজদা চরিত্রে অভিনয় করেছেন ওয়াদ মোহাম্মদ এবং তার মা চরিত্রে অভিনয় করেছেন রিম আব্দুল্লাহ। দুজনেই এত চমৎকার অভিনয় করেছেন যে বোঝার উপায় নেই এটা তাদের প্রথম সিনামা। ওয়াজদার বন্ধু আব্দুল্লাহ চরিত্রে অভিনয় করেছে আব্দুল্লাহ রাহমান আল গোহানি। ওয়াজদা এবং আব্দুল্লাহ চরিত্রে অভিনয় করা এই দুই বাচ্চার অভিনয় ছিল এই ছবির প্রান। অদ্ভুত সুন্দর অভিনয় করেছে দুইজনই। বিশেষ করে ওয়াদ মোহাম্মদ ওয়াজদা চরিত্রের সাথে মিশে গেছে যেন। তেমন প্রান প্রাচুর্যে ভরপুর সে যেমন ওয়াজদা চরিত্রটি।
আমার পছন্দের একটা দৃশ্যের কথা না বলে পারছি না। দৃশ্যটা হচ্ছে ওয়াজদা যখন শিষ দিয়ে আবদুল্লার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, আবদুল্লাহ তাকাতে ওয়াজদা মুখের দারুন একটা ভঙ্গি করে বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে পিছনের সাইকেলটা দেখায়, জবাবে আবদুল্লাহ টাকা আছে কিনা বোঝানোর জন্য দুই আঙ্গুল ঘষা দিয়ে ইশারা দেয় আর ওয়াজদা তখন দারুন একটা হাঁসি দিয়ে পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে আবদুল্লাহ কে দেখায়!! অপুর্ব দৃশ্য একটা। দুইটা বাচ্চা এত চমৎকার করে অভিনয় করেছে তা ভাষায় প্রকাশ কষ্টকর।
আধুনিকতার সাথে সৌদির যে সংঘর্ষ তাই এই ছবির মূল বক্তব্য। ওয়াজদার মাধ্যমে পরিচালক সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছে সৌদি ঐতিহ্যের প্রতি, অপ্রয়োজনীয় নিয়ম কানুনে প্রতি। ওয়াজদার বাবা আরেক বিয়ে করতে যাচ্ছে শুধু মাত্র ছেলে সন্তানের আশায় বা ওয়াজদাদের বাসায় যে পারিবারিক বংশ নামের তালিকার যে বৃক্ষ আছে তাতে কোন মেয়েদের নাম না থাকায় ওয়াজদা নিজেই নিজের নাম লিখে ওই বংশ তালিকায় বসিয়ে দেওয়া সৌদি সমাজকে এবং এর পরিবর্তনকে দারুন ভাবে তুলে ধরেছে।
ছবির শেষে ওয়াজদা আব্দুল্লাহ কে হারিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে দূরে, বহুদুরে।তিন রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ায় ওয়াজদা এবং ছবি শেষ হয়ে যায়। নারীর যে এগিয়ে চলা বা সৌদিতে পরিবর্তনের যে স্বপ্ন এই ছবিতে দেখানো হয়েছে তা সম্ভবত এই ছবির পরেই শেষ হয়ে গিয়েছে। কারন ২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবির পরে এখন পর্যন্ত হাইফা আল মনসুর দ্বিতীয় ছবি বানাতে পারে নাই। রিম আবদুল্লাহ দারুন অভিনয় করলেও এটাই এখন পর্যন্ত তার এক মাত্র সিনামা।ওয়াজদা চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করার পরেও ওয়াদ মোহাম্মদ কে আর কোন ছবি করতে দেখা যায়নি। তবে শুরু তো হয়েছে! যে সৌদিতে আজ পর্যন্ত সিনামা তৈরি হয়েছে মাত্রে ১৩ টা আর তার মধ্যে ওয়াজদা হচ্ছে ১২ তম ছবি। সৌদির ইতিহাসে ওয়াজদা প্রথম সিনামা যা পুরোপুরি সৌদিতে শূট্য করা হয়েছে। এই যখন অবস্থা তখন ওয়াজদার মত সাহসী ছবি তৈরির জন্য পরিচালক কে কুর্নিশ করা ছাড়া অন্য কিছু করার থাকে না আর।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ৩:৪৭