এক
যে ট্রাইবুনালের আইন দেশীয়, বিচারক দেশীয়, আইনজীবি দেশীয় এমনকি ট্রাইবুনালের অবস্থানও নিজেদের দেশেই সেখানে নামের আগে আন্তর্জাতিক সাইনবোর্ড দেওয়ার মানেটা আসলে কী? আবার যাদেরকে বিচার করা হচ্ছে তাদের কর্মকান্ড গুলোকে ট্যাগ দেওয়া হয়েছে যুদ্ধাপরাধ হিসাবে যদিও বিচার হচ্ছে মানবতা বিরোধী অপকর্ম করার দায়ে। শুরুতেই সব যায়গায় কেমন যেনো একটা চাতুরতার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে এখন।
কারণ আপনি যদি দেশীয় আইনে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার করে সারা বিশ্ব বাসীর কাছ থেকে এর কৃতিত্ব নেওয়ার প্রয়াসে আন্তর্জাতিক ও যুদ্ধাপরাধ সাইনবোর্ড লাগান তাহলে সেক্ষেত্রে এটা খুবই স্বাভাবিক বিদেশীরা এই ব্যাপারে নাক গলাবে। সেটা পক্ষ ও বিপক্ষ উভই ক্ষেত্রেই হতে পারে। তারপর যদি আবার আসামী পক্ষের প্রবল আপত্তি থাকে বিচারের নিরপেক্ষতা নিয়ে।
আন্তর্জাতিক ট্যাগ যেমন কোন কিছুকে স্রেফ ভৌগলিক সীমারেখার বাঁধন ছিন্ন করে একটা বৈশ্বয়িক রূপ দেয় ঠিক তেমনি মানবতা বিরোধী অপরাধ বুঝাতে যুদ্ধাপরাধ ট্যাগ শুধু অপরাধের বৃহত্তর মাত্রাকেই বুঝায় না দেশীয় সীমানার বাইরের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির দৃষ্টি এদিকে নিবদ্ধ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে এবং স্বভাবতই সেটিই ঘটে চলেছে।
দুই
এরপর বলা যেতে পারে স্কাইপি কেলেংকারীর ব্যাপারটি। আমার দেশ পত্রিকার ফাটানো স্কাইপি বোমা এই বিচারে বিদেশীদের মনোনিবেশের নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। তবে স্কাইপি কেলেংকারীর ব্যাপারটা এতটা আন্তর্জাতিক রূপ পেতনা যদি ঘটনার নায়ক বিচারপতি নিজামুল হক আগে থেকেই বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকনোমিস্টকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করতো। কেননা এই বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার আগেই আন্তর্জাতিক ঐ পত্রিকাটির নিষেধাজ্ঞার খবরটি সারা বিশ্বের ৭০ থেকে ৮০ টির ও বেশী প্রভাবশালী মিডিয়াই চাওর হয়ে গিয়েছিল। নিজামুল হকের সততার শপথ ভঙ্গ হওয়ার কোন কারণ না থাকলে ইকনোমিস্টের হুমকীতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কোন যুক্তিই ছিলোনা। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তিনি নিজের অনৈতিক ও অসৎ অবস্থানকে চেপে রেখে বাঁচতে তো পারেনইনি বরঞ্চ সেটার মাধ্যমে নিজের এই অসদাচরণের ককটেল সদৃশ রূপকে পারমাণবিক বোমার রূপ দিয়ে নিজের অপমৃত্যুকে আন্তর্জাতিক ভাবে জানান দিয়ে গেছেন আর সেই সাথে ট্রাইবুনালের গায়ে লেপন করে গেছেন চির বিতর্কের গভীর ক্ষতচিহ্ন। আর এসব কারণেই বিচারের ক্ষেত্রে যে বিদেশীদের অবাধ হস্তক্ষেপের ক্রমবর্ধমান সুযোগ তৈরী হয়েছে সেটা বলাই বাহুল্য।
তিন
বিচারের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান বিদেশী উপস্থিতির সম্ভাব্য ফলাফল কী হতে পারে সেটি বুঝতে সরকারের পদ্মা সেতুর দুর্নীতির সন্ধানে প্রবৃত্ত দুদকের অনুসন্ধান কার্যক্রমটি আমাদের সামনে একটা জ্বলন্ত উদাহরণ হতে পারে। যেমনটি বিশ্বব্যাংকের চাপে পড়ে প্রধানমন্ত্রীর দেশপ্রেমিক উপাধি দেওয়া আবুলকে এখন দুদক গভীর নজরদারীতে রেখেছে। গ্রেফতার করেছে অন্যান্য রাঘব বোয়ালদের।
প্রথমে পদ্মাসেতুতে দূর্নীতি হয়নি মর্মে সরকার ও এর তল্পি বাহক অনেক লম্ফ ঝম্প করলেও পরে শুধু এটা স্বীকারই করেনি বরং নিজেদের আত্মসম্মানের মুখে চুনকালি মাখিয়ে এবং নির্লজ্জ ভোল পালটিয়ে পরবর্তি পদক্ষেপের মাধ্যমে জনগণকে বুঝিয়ে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক চাপ যে কি চিজ রে বাবা। এক্ষেত্রে এই চাপের বা হস্তক্ষেপের ব্যাপারে ক্ষিপ্ত হওয়ার আগে যাদের যেসব কর্মকান্ড এটা সৃষ্টির কারণ বা মূল ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করেছে তাদের প্রতিই জনরোষ জাগ্রত হওয়া যুক্তি সঙ্গত। এটা তাদেরই কর্মফলের প্রতিফলন। কিন্তু দুঃজনক হলেও সত্য যে এর ভূক্তভোগী হচ্ছে পুরো জাতি।
যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধ যেটাই বলেন না কেন এক্ষেত্রেও এধরণের বাইরের হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরী করে দিয়েছে ঐ একই চিহ্নিত গোষ্ঠিটি। প্রথমটি হয়েছিল জনগণের জন্য পদ্মা সেতু বিনির্মাণের নিবিত্তে আগত দানের টাকায় নিজেদের পকেট ভারী করার অবৈধ খায়েশ থেকে টাকা পাওয়ার আগেই খায়েশ পূরণের রাস্তা তৈরী করতে এদের গৃহীত কালো পন্থার মাধ্যমে। যার ফলশ্রুতিতে পদ্মাসেতু বঞ্চিত পুরো জাতি আজ বিশ্বব্যাংকের কাছে নিজিরবিহীনভাবে মাসের পর মাস নাকানি চুবানি খাচ্ছে। তবে জনগণ সেটা নীরবে হজম করে গেলেও যুদ্ধাপরাধী বিচারের গণ দাবী পূরণে জনগণের প্রকৃত সেন্টিমেন্ট কে পাশ কাটিয়ে নিজেদের সঙ্কীর্ণ ও অবৈধ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার তীব্র মনোবাসনার নিমিত্তে ট্রাইবুনাল ও বিচারকে যদি এভাবে চরম বিতর্কিত করে ফেলা হয় এবং এর মাধ্যমে যদি একইভাবে বিদেশী হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরী হয়ে জনগণকে আবার নাকানি চুবানি খেতে হয় তবে সেক্ষেত্রে জনগণ নিশ্চয় আর বসে থাকবেনা। আর জনগণের ধৈর্যের বাঁধ যে ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়ে গেছে সেটা বিদেশী মেহমানদের সম্মুখে নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের (যিনি চোখ উপড়ে ফেলার কুখ্যাত উক্তিতে একসময় বিখ্যাত হয়েছিলেন) উপর আপতিত জুতা বৃষ্টিই প্রমাণ করে। অতি হালকা মেঘে কখনোই ভারী বর্ষণ হয়না এটা সাধারণ জনগণ বুঝলেও ঐ চিহ্নিত গোষ্ঠিটি বুঝতে অক্ষম।
তাই বিচারের ক্ষেত্রে সরকার যদি রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি পরিত্যাগ করে বিচার কার্যক্রমকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না রাখতে পারে এবং সেই সাথে বিচারের সকল ক্ষেত্রে সত্য ও ন্যায়ের পথ অবলম্বন করতে অক্ষম হয় তবে সরকারের অবস্থানের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি কী হতে পারে তা জানার জন্য আর অপেক্ষার প্রয়োজন হবেনা। কারণ পদ্মার ঘোলা জলে হাবুডুবু খাওয়া জাতির সামনে বাঁকা আঙ্গুল দিয়ে ঘী উঠানো দৃশ্যের মঞ্চস্থ নাটক এখনো শেষ হয়ে যায়নি। এখন বিদেশী হস্তক্ষেপ বলে বলে চিৎকার করলেও পরে ঠিকই বিশ্বব্যাঙ্কের দেওয়া গরল নীরবে ঢপাঢপ গলাধঃকরণ করার মত গিলে যেতে হবে। এক্ষেত্রে এখন যেমন বর্হিবিশ্বের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে চিৎকারের নৈতিক অধিকারটুকু আছে পরে তাও থাকবেনা। যেমনটি পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির কথিত মিথ্যা অভিযোগের বিরুদ্ধে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ও তার তল্পি বাহকদের কণ্ঠ একসময়ে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে সরব থাকলেও এখন আর উচ্চবাক্য তো দূরের কথা সাপের মতো ফোঁস ফাঁসও করেনা। তাই আবার এধরণের পরিস্থিতি এড়াতে আগে থেকেই বিচারের ব্যাপারে নিজেদের নিরপেক্ষ অবস্থান পরিষ্কার করা উচিৎ বিশ্ববাসীর কাছে। এবং এটিই হবে সরকারের জন্য অপেক্ষাকৃত অধিক আত্মমর্যাদাকর এবং যুদ্ধাপরাধীর প্রকৃত বিচারের সাথে সামঞ্জস্যশীল।