অনেকের মতোই আমিও "আমি কে" - এই বিষয় বা প্রশ্নটা নিয়ে ভাবতাম ও ভাবি। এই ভাবনা বা প্রশ্ন আবার অনেক ভাবনা ও প্রশ্নের জন্ম দেয়, যেমন, "আমি"র আরেক নাম হতে পারে "জীবন" । জড় বস্ত যেমন টেবিল-চেয়ার, দালান-কোঠা ভাবতে পারে না যে, তারা কে? তাহলে, যার বা যাদের জীবন আছে তারাই কেবল ভাবে - আমি কে? এটা ভাবতে গিয়ে আবার ভাবলাম, তাহলে বুঝতে হবে - জীবন কি? আমার মনে পড়ে যায়, আমি যখন আমার নানাভাইয়ের সাথে দার্শনিক আলাপ করতাম, তখন তাকেও প্রশ্ন করেছিলাম, জীবন কি?
তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, জীবন মানে হল "জীব + অন" অর্থাৎ জীবের ভেতরে একটা সুইচ আছে, সেটা অন করে দেয়া হয়েছে। যতোক্ষন সুইচ অন আছে, ততোক্ষণই জীবন। আমার মনে পড়ে যায় এন্ড্রু কিশোরের সেই গানটির কথা, "হায়রে মানুষ, রঙ্গিন ফানুশ, দম ফুরাইলে ঠুস"। সেই মূহুর্তে পৃথিবীকে আমার বিভ্রম অনুভূত হয়, মনে হয় পৃথিবীটা হল মায়ার জগত।
আমার "জীবন" নিয়ে ভাবনা সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি বা যায়না। কারণ এই মায়ার জগতকেই আমি ভালোবাসি। এই মায়ার জগতেই আমি সহস্র, লক্ষ বছর বেঁচে থাকতে চাই। তাছারা এটা মায়ার জগত হলেও "জীবন" আসলেই কি - এই রহস্যের সন্ধান আমি এখনও পাইনি । তাই আমি আবারও জীবন নিয়ে ভাবি। "জীবন" রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করি। জীবনের সংজ্ঞা কি ? বা কি কি বৈশিষ্ট্য বা গুণাগুণ থাকলে জীবন বলা যেতে পারে? সাধারণত যে বৈশিষ্ট্য বা গুণাগুণ দিয়ে জীবনকে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে তা হল, বিপাক (মেটাবলিজম), প্রজনন (রিপ্রডাকশন), জীনতথ্য (জেনেটিক ইনফর্মেশন) ও অভিযোজন (এডাপটেশান)। কোন সিস্টেমে এই বৈশিষ্ট্য বা বৈশিষ্ট্যগুলো থাকলে তাকে জীবন সম্পন্ন জীব বলা যেতে পারে । আসলেই কি তাই? এখানেও আবার ভেজাল আছে যেমন, গাধা ও ঘোটকী হতে যে সন্তান তৈরি হয় তাকে বলা হয় অশ্বতর বা Mule । এই মিউলের কিন্তু প্রজনন ক্ষমতা নেই কারণ এরা শুক্রাণু বা ডিম্বাণু তৈরি করতে পারে না। তাই বলে কি এদের জীব বলা যাবে না? এদের অবশ্যই জীবন আছে, এদেরকে জীব বলা যায় যদিও এদের প্রজনন ক্ষমতা নেই। আবার ভাইরাস জেনেটিক তথ্য বহন করলেও এদের বিপাকক্রিয়া নেই। ভাইরাসের নিজস্ব জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল থাকলেও বংশবৃদ্ধি করার জন্য নিজস্ব মেশিনারি নেই। তারা হোস্টসেল ব্যবহার করে বংশবৃদ্ধি করে ও হোস্টসেলকে ভাইরাস ফ্যাক্টরিতে পরিণত করে। এরা জীবিত কিন্তু এদেরকে কি জীব বলা যায়? এদের বিপাকও নেই, নিজস্ব প্রজনন প্রক্রিয়াও নেই। জীবিত থাকলেই জীব নাও হতে পারে। জীবনের সংজ্ঞা নিয়ে এখনও বিজ্ঞানী মহলে বিতর্ক আছে। জীবনের সংজ্ঞাটি সবচে বেশি দরকার এস্ট্রোবায়োলজিস্টদের কারণ তারা মহাশূন্যে "জীবন" খুঁজে বেড়ান।
ধর্ম বলে, মানবপ্রজাতির একটা পরকাল আছে এবং সেখানে আমার, আমাদের বিচার হবে। চেয়ার-টেবিল, থালা-বাসন, দালান-কোঠার বিচার হবে না কারণ তাদের জীবন নেই। জীবন থাকাটাই যেন মস্তবড় অপরাধ! জীবন থাকলেই যদি বিচার হয় তাহলে কি সেই মিউল-এর ও বিচার হবে? মিউল তো খোদার উপর খোদকারী অর্থাৎ জেনেটিক এক্সপিরিমেন্টের ফসল। নাকি, খোদার উপর খোদকারী করে যে মিউল তৈরি করলো,তার বিচার হবে? সেই ভাইরাস যাকে জীব বলা যায় না, তারও কি বিচার হবে? আবার অনেক ধর্মে বলা হয় যে, শাস্তি হিসেবে আমাদের দেহ আগুনে পুড়তেই থাকবে যতক্ষণ না শাস্তির মেয়াদ শেষ হয়। ধর্ম আবারও বিভ্রম তৈরি করে কারণ একটি দেহ পুড়তেই থাকতে পারে না, একটি পূর্নবয়ষ্ক মানুষ ২ থেকে ৩ ঘন্টার মধ্যে সম্পূর্ণ পুড়ে গড়ে প্রায় ৩ থেকে ৯ পাউন্ড ছাই তৈরি করে। সেই ছাই থেকে পুনরায় মানুষ তৈরি করা যায় না। দেহ পুড়ে নিঃশ্বেষ হয়ে ছাই হয়ে গেলে জীবনের আর অবশিষ্ট কিছু থাকে কি? অনেকে আবার বলে দেহের ভেতরে "রুহ" আছে, সেই রুহ-ই নাকি পুড়তেই থাকবে। জীবন কি তাহলে রুহ? এখানেও জীবনের সংজ্ঞা মেলে না।
মলিকুলার বায়োলোজিস্টরা সেলুলার লাইফ বা কোষভিত্তিক জীবনের কথা বলে থাকেন। সেটা হতে পারে এককোষী বা বহুকোষী। কোষের প্রাণশক্তি আসে প্রোটিন থেকে, জীবনের বিল্ডিং ব্লক বলা হয় প্রোটিনকে। আবার এই প্রোটিন হল আম্যাইনো এসিডের লম্বা একটি চেইন, তাই প্রোটিনের বিল্ডিং ব্লক হল আম্যাইনো এসিড। সুতরাং জীবনের বিল্ডিং ব্লক হল আম্যাইনো এসিড। সেই অ্যামাইনো এসিড তৈরি হয় কীভাবে? পুঙ্খানুপূর্ণ নির্দেশনা বা কোড দেয়া আছে কোষের ভেতরের নিউক্লিয়াসের ভেতরে থাকা ডিএনএ-তে । ডিনএনএ থেকে আরএনএ, আরএনএ থেকে তৈরি হয় অ্যামাইনো এসিডের লম্বা চেইন যা হল প্রোটিন। এই প্রোটিন তৈরির ফ্যাক্টরি হল কোষের ভেতরের রাইবোজোম। তাহলে কি সেই জেনেটিক কোডই জীবন? সেই চারটি অক্ষর যা দিয়ে জেনেটিক কোড লেখা হয়েছে, সেই চারটি অক্ষর ATCG ই কি জীবন? আমার জীবন, তার জীবন থেকে ভিন্ন কারণ আমার জীবনের জেনেটিক কোড, তার জীবনের জেনেটিক কোড থেকে কিছুটা ভিন্নভাবে লেখা হয়েছে। জেনেটিক কোড যদি সমষ্টিগত জীবন হয়, তাহলে জেনেটিক কোডের কিছুটা ভিন্নতাই হল আমাদের প্রত্যেকের একক জীবন। কেনইবা জেনেটিক কোডের এই ভিন্নতা? নাকি কোটি কোটি বছরের কোন এক এক্সপিরিমেন্টের ফসল এই জেনেটিক কোডের ভিন্নতা, এই জীবন, এই সম্পুর্ণ আমি?
আমাদের মস্তিষ্ক বাম ও ডান দুই ভাগে বিভক্ত - এদেরকে বলা হয় লেফট হেমিস্ফেয়ার ও রাইট হেমিস্ফেয়ার। এই দুই অঞ্চল যুক্ত হয় corpus callosum দিয়ে। লেফট হেমিস্ফেয়ারে আছে বিশ্লেষণী ক্ষমতা, যুক্তি ইত্যাদি, অন্যদিকে রাইট হেমিস্ফেয়ারে আছে আবেগ, শিল্প, সৃষ্টিশীলতা ইত্যাদি। তবে আধিপত্য বেশি লেফট হেমিস্ফেয়ারের ও চূড়ান্ত সিধান্ত লেফট হেমিস্ফেয়ারই নেয়, তারপরে তার সিদ্ধান্তের কথা corpus callosum -এর মাধ্যমে রাইট হেমিস্ফেয়ারকে জানিয়ে দেয়। সবচে আশ্চর্যজনক হল, এদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেও মানুষ বেঁচে থাকে, ডক্তারেরা বরং এপিলেপ্সি রোগ ভালো করার জন্য অপারেশনের মাধ্যমে এই সংযোগটা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তবে অপারেশন বা অন্য কোন ভাবে এই দুই অঞ্চলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে আবার আরেক অদ্ভুত অবস্থার সৃষ্টি হয়। ধরা যাক, এরকম কেউ একজন সুপারমার্কেটে গেল কিছু কিনতে, রাইট হেমিস্ফেয়ারের নির্দেশে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা নিয়ে যেই শপিং কার্টে নিতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই লেফট হেমিস্ফেয়ার এসে বাঁধা দিচ্ছে। দেখা যায়, দুই-তিন-চার ঘনটা চলে যাচ্ছে, সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। একে বলে "স্প্লিট ব্রেইন প্যারাডক্স" । একই মানুষের ভেতরে "দুই আমি" -র বাস। বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট ভি এস রামাচন্দ্রন তার একজন স্প্লিট ব্রেইন-এর রোগীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সে স্রষ্টায় বিশ্বাসী নাকি অবিশ্বাসী। রোগী উত্তর দিয়েছিল, সে একজন নাস্তিক যখন তার লেফট হেমিস্ফেয়ার কাজ করছিল। আবার উত্তর দিয়েছিল, সে একজন আস্তিক যখন তার রাইট হেমিস্ফেয়ার কাজ করছিল। রামাচন্দ্রন বলেছিলেন, যদি রোগী মারা যায়, তাহলে কি তার একটা অঞ্চল যাবে স্বর্গে আর অপর অঞ্চল নরকে ! ("If that person dies, what happens? Does one hemisphere go to heaven and other go to hell? I don't know the answer to that") সাধু, সন্ন্যাসী, নবী, মহাপুরষেরা বলে থাকেন যে, তারা স্রষ্টার সন্ধান পেয়েছিলেন । কেউ কেউ স্রষ্টার সাথে বিভিন্ন ভাবে কথা বলতেন (গুহায় বা জংগলে ধ্যান, সাধনার সময়ে), আবার কেউ কেউ স্রষ্টাকে নিজের ভেতরে উপলব্ধি করতেন, আমি/আত্মা ও তুমি/পরমাত্মা (স্রষ্টা) মিলে "একাত্মার" কথা বলতেন। আসলেই কি তাই? নাকি তারা স্প্লিট ব্রেইনের রোগী ছিলেন? নিজের ভেতরে দুই "আমি"র এক "আমি" কে স্রষ্টা ভাবতেন?
জীবন রহস্যময়। এই রহস্যের জট কবে খুলবে জানি না, তবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আফসোস হয়, যদি এই রহস্যের সন্ধান পাওয়ার আগেই মারা যাই। আবার ভাবি, মৃত্যুও হতে পারে রহস্যের জট খোলার সূচনা !
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:০৩