somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ আকুতি-পত্র আর লাস্ট গ্রেট এস্কেপ

২২ শে জুন, ২০১৩ বিকাল ৫:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


তার রুমের সিলিঙ ফ্যান বিকট শব্দ করে ঘুরে। শব্দের তুলনায় বাতাস কম। ফ্যান বন্ধ করে রাখলেও কোন সমস্যা নেই। তবে একঘেয়ে ঘরঘর শব্দটাও জীবনের একটা অংশ হয়ে গিয়েছে। এই জন্যেই সে ফ্যান চালু করে রাখে। তিনতলায় ছোট একটা রুমে সে থাকে। রুমের সাথে লাগোয়া একটা বারান্দা। এই বারান্দা দিয়ে দুপুর বেলা গরম রোদ ঢুকে রুমটাকে গরম করে দিয়ে যায়। রাতের বেলা জ্যোৎস্না কখনো ঢুকে কিনা তা কখনো সে খেয়াল করে দেখেনি। রুমের আসবাবপত্রও সামান্য। একটা পড়ার টেবিল, একটা বিছানা আর একটা বাক্স মত আসবাব যেটার মধ্যে মশারী, কাঁথা থেকে শুরু করে জামা কাপড় এমনকি পুরনো খবরের কাগজও থাকে।

ফ্লোরে শুয়ে সে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। ফ্যানের মত করেই অনেক ভাবনা চিন্তা ঘোরপাক খাচ্ছে। এমন একটা অবস্থা ইচ্ছা করলেই চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়া যায় আবার উঠে বাইরেও চলে যাওয়া যায়। সে কোনটা করবে বুঝে উঠতে পারছেনা।


মহাখালী ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে বাস ছুটছে। ঘাম টপটপ করে এসে চশমায় জমছে। সে চশমাটা খুলে হাতে নিলো। বাসে উঠার পর তার একটু ঘুমঘুম লাগছিলো। এখন অবশ্য সে ভাবটা নেই। দোতলা বিআরটিসি বাস থেকে সে বাইরে তাকালো। বাইরে উষ্ণ স্বর্ণালী গ্রীষ্মের রোদ। হঠাৎ তার কোলে কেউ এক টুকরো কাগজ ফেললো। আর্থিক সাহায্য চাওয়া ছাপানো আকুতি। এই ধরণের কাগজের সাথে ১-২টা সস্তা লজেন্স থাকে। আজকের সাহায্যের কাগজের সাথে লজেন্স নেই। একটু খেয়াল করে দেখলো যে ৫-৬ বছরের ছোট একটা বাচ্চা কাগজগুলো বিলি করছে। সাধারণত এভাবে কাগজ বিলি করে সাহায্য চায় কোন মেয়ে বা মহিলা। সামনে গিয়ে বিলি করা শেষ করে টাকা উঠানোর জন্যে ছেলেটা ফেরত আসছে। বাসের সম্মুখগামী গতির জন্যে পেছনে আসতে ছেলেটাত কষ্ট হচ্ছে। এক পা সামনে দিলেই টলে উঠছে বাচ্চাটা; হাত দিয়ে সিট আঁকড়ে ধরে সামনে এগুচ্ছে। চশমা চোখে নেই বলে সে বাচ্চাটাকে একটা অবয়ব হিসেবে দেখছে। বাচ্চাটা কাছাকাছি আসার পর সে মানিব্যাগ খুলে কতগুলো ২টাকার নোট ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিলো। অন্য কোনদিন হলে সে ছেলেটার নাম জিজ্ঞেস করতো। আজকে কিছুই করতে তার ইচ্ছা হচ্ছেনা। জীবনের কোন না কোন অংশে কারো না কারো সাহায্য-সহযোগীতা লাগে আমাদের সবার। সাহায্য ভিন্ন ভিন্ন ভাবে এসে ধরা দেয় আমাদের কাছে। বন্ধুত্য, অনুপ্রেরনা, ভালোবাসা এগুলো সব কিছুই সাহায্য-সহযোগীতার ভিন্ন ভিন্ন রূপ। এই বাচ্চাটার যেমন জীবনের একদম খুব শুরুতেই আর্থিক সাহায্যের দরকার পড়েছে ঠিক তেমনি বাস যাত্রী সবারও কারো না কারো কাছ থেকে কিছু না কিছু সাহায্য দরকার। অনেকেই যেমন বাচ্চাটাকে ফিরিয়ে দিয়েছে, ঠিক তেমনি তারাও সাহায্য না পেয়ে ফেরত আসবে।



কোন এক রেষ্টুরেন্ট এর ছোট একটা টেবিলে সে বসে আছে। রেষ্টুরেন্টের এসির বাতাস অনেক ঠান্ডা। কাঁপুনি ধরানোর মত ঠান্ডা। বাইরে বিকালের সোনালী রোদ। এই সময়টাতে বদ্ধ কোন রুমে না বসে থেকে বাইরে হাঁটতে ইচ্ছে করে তার অথবা খোলা কোন জায়গায় বসে আড্ডা দিতে। তার সামনে চারিদিক আলো করে বসে থাকা মেয়েটার সাথে তার দেখা হয়েছিলো এমনি কোন এক খোলা জায়গায়। পরিচয় পর্বের পরের দিনগুলোও অনেক রঙ্গিন ছিলো। কিন্তু একটা সময় মানুষ আসতে আসতে মুগ্ধতা প্রকাশ করা বন্ধ করে দেয়। তারা দুজনেই মুগ্ধতা প্রকাশ করা বন্ধ করে দিয়েছে। মুগ্ধতার সাথে চাওয়া-পাওয়া, রাগ-ক্ষোভ, অভিমান-নির্লিপ্ততা যখন যোগ হয় জীবন সমীকরণে তখন বিষন্নতা, বিরক্তি এসে যোগ হয়। বাইরে সোনালী আলো থাকলেও আজ একটা বিষন্ন দিন।

উৎকণ্ঠার চেয়ে বেশী বিরক্তি নিয়ে মেয়েটা জিজ্ঞেস করলো, “তিন দিন ধরে তোমাকে ফোনে পাচ্ছিনা। করো কি তুমি?”
“ফোনটা হারিয়ে গিয়েছে।”
“তো একবার জানাবে তো?”
“জানাবো না কেন? একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই সময় করে উঠতে পারিনি।”

মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে সে অবলীলায় মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছে। মুখের কোণে মেকী একটা হাসি। ইচ্ছা করলেই কথার পিঠে সে অনবরত মিথ্যা কথা বলতে পারে। সব সময় সত্য কথার বড় রাস্তায় না গিয়ে সে মিথ্যা কথার শর্টকাটগুলো ব্যবহার করে। এতে দোষের কিছু নেই। সবাই শর্টকাট পছন্দ করে আর ব্যবহারও করে। আজকের কথোপকথন সংক্ষিপ্ত করার জন্যে বললো, “আচ্ছা আমি উঠি এখন”

সে উঠে বাইরে বের হয়ে আসলো। সোজা হাঁটা দিলো। মেয়েটার সাথের ভাব-ভালোবাসা থেকে, পরিবার-পরিজন, সব কিছু থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।



রাত বারোটা অনেক আগেই বেজেছে। পড়ার টেবিলে বসে সে কাগজ কুচি কুচি করে কাটছে। বাসের বাচ্চা ছেলেটার মত সেও আকুতি-পত্র লিখবে। তবে তারটা ছাপানো হবে না। হাতে লিখা আকুতি-পত্র। এখানে সে লিখবে তার কি সাহায্য লাগবে। কার থেকে কি সে চায় তা লিখে রাখবে, পাওয়ার জন্যে পরম আকুতি জানাবে। কারো কাছ থেকে আরেকটু স্নেহ, কারো কাছ থেকে এক চিলতে ভালো লাগার হাসি, আরো অনেক কিছু আছে আছে তার আকুতি পত্রে। মানুষের মন পড়ে, মুখে বলে চাওয়া-পাওয়া আকাঙ্ক্ষা বুঝা বা বুঝানো যায়না। তাই সে প্রতিদিন আকুতি-পত্র গুলো নিয়ে যাবে তার কাছের মানুষজনের কাছে। সবাই হয়তো সায় দিবেনা। ফিরিয়ে দিবে ওই ছেলেটাকে যেভাবে ফিরিয়ে দিয়েছে। তারপরও কেউ হয়তো দিবে। যার কাছ থেকেই সে যা পাবে নিয়ে আসবে জমা করে রাখবে তার ছোট রুমটাতে।

একসময় কাগজ গুলো রেখে সে বারিন্দায় এসে দাঁড়ালো। কিছুক্ষন চুপচাপ নীচের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তার রুম থেকে দূরে বিজ্ঞাপণের বিলবোর্ড দেখা যায়। কি সুন্দর করে নর-নারীরা হেসে দাঁড়িয়ে আছে। এরাও হয়তো এতো সুখী না। বিজ্ঞাপনের ছবি তোলার পর হয়তো এরাও মুখ ভার করে পড়েছিলো নিজস্ব সমস্যা নিয়ে। তারপর আবার ভুলে গিয়ে যা করার ঠিক তাই করছে তারা। অভিনয়। হয়তো জীবন এরকমই। সেই আদিখ্যেতা করছে শুধু। তার আর ভাবতে ভাল্লাগছেনা।

৫.

রুমের ফ্যান বন্ধ। ঘরঘর শব্দটাও নেই তাই কেমন যেন আশ্চর্য্য নীরবতা নেমে এসেছে। ফ্যানের ঠিক নিচেই পড়ার টেবিলটা কাত হয়ে পড়ে আছে। এক কোণার পা ভেঙ্গে গিয়েছে। ফ্যানের গলায় একটা শক্ত দড়ি জড়ানো।

রুমের এক কোণায় সে বসে আছে। কাল রাতে কি ভেবে যেন দড়ি লাগাতে গিয়েছিলো ফ্যানে। পাতলা কাঠের টেবিল ভার নিতে পারেনি। হুড়মুড় করে সে ফ্লোরে পড়ে গিয়েছিলো।

চাপ, দায়িত্ব, চাওয়া-পাওয়া থেকে পালিয়ে বেরোবার কি পথ শুধুই মৃত্যু? দ্য লাস্ট গ্রেট এস্কেপ? অন্য কোন সমাধান কি নেই?

হঠাৎ কোন কান্ডজ্ঞানহীন মূহুর্তে সে কালকে আত্নহত্যাও করতে পারতো। টেবিল থেকে পড়ে যাওয়ার পর ভূতটা নেমে গেছে মাথা থেকে। জীবনের সুন্দর মূহুর্তগুলো মনে পড়তে লাগলো তার। পরিবারের মানুষগুলোর হাসিমুখ, রাতের বেলা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার মূহুর্তগুলো, মেয়েটার সাথে পথ ধরে হেঁটে যাওয়া। জীবনের সুখ-স্মৃতি হয়তো কম, কিন্তু এরা বিষন্ন, হতাশ করা হাজারো মূহুর্তের চেয়ে আরো অনেক বেশী তীব্র । আবার হয়তো বা না। তবে মানুষ হয়তো সুখ-স্মৃতি গুলো পুঁজি করে নিয়েই বেঁচে থাকছে। তাদের সবারই হয়তো আকুতি-পত্র আছে, কেউ গ্রহন না করলেও হতোদ্যম হয়ে পড়ছেনা। ঠিক যেমন বাচ্চা ছেলেটি হতোদ্যম হয়ে পড়েনি। আরেক বাসে উঠে আবার সাহায্যের আকুতি জানিয়েছে। মানুষও হয়তো বার বার আকুতি জানাতেই থাকে।

কাল রাত থেকে চিন্তা করছে। একবার বাইরে সুন্দর দিনের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার দড়ি লাগানো ফ্যানের দিকে। জীবন সমীকরণ মেলাতে পারছেনা।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৩ রাত ১০:০৩
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×