somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শেষের কবিতা : আরেকবার ফিরে পড়া

০৬ ই মে, ২০১৫ সকাল ১০:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাঝে মাঝে যেমন পানির তৃষ্ণা পায়। হঠাৎ করে কিছু অস্পষ্ট প্রশ্নের না মেলা উত্তর খুঁজতে গিয়ে এরকম প্রবল একটা তৃষ্ণা পেয়ে গেল। শুধু চক্ষের তৃষ্ণা নয়, বক্ষ জুড়ে তৃষ্ণা। খুব করে কেন যেন শেষের কবিতা পড়তে ইচ্ছে করলো, আরো একবার। সেই কবে প্রথমবার পড়েছিলাম, তখন মনে হয় এইট বা নাইনে পড়ি। প্রথমবার পড়ার পর রাগ হয়েছিল অমিতের উপর। ধরেই নিয়েছিলাম লোকটা খারাপ। আমার এ অভিমত শুনে আমাদের দীর্ঘদিনের প্রতিবেশি, বাংলা সাহিত্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করা এক দিদি সংশয় প্রকাশ করেছিলেন যে আদতেই শেষের কবিতা আমি বুঝেছি কিনা। তো তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি কি বুঝেছেন। তার ব্যাখ্যা মানুষের জীবনে একাধিক সম্পর্ক বা প্রেম আসতেই পারে, এটাই দেখায় শেষের কবিতা। দ্বিতীয়বার পড়ি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কলেজ কর্মসূচীর পাঠ্য হিসেবে। স্পষ্ট মনে আছে, সায়ীদ স্যারের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল, কিছু কলেজ পড়–য়া কিশোর তরুনের। কিন্তু আমার কাছে তখন লাবন্য অমিত ছাড়িয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল শিলং, চেরাপুঞ্জি। অতঃপর অনেক অনেক দিন বাদে আমার নতুন করে আবার অমিতকে, লাবন্যকে, কেতকিকে জানতে মন চাইলো, বুঝতে মন চাইলো।
কাল সন্ধ্যায় তাই তুমুল সমর্পণ। একেবারে নিরপেক্ষ পাঠকের মতো। সন্দেহ নাই, রবীন্দ্রনাথ যেভাবে অমিতকে এঁেকছেন, তাকে তাই ভালো না লেগে যায়না। এমন বুদ্ধিদীপ্ত, বাকপটু, সুদর্শন একজন তরুনকে ভালো লাগতেই হবে। তার চেয়ে বড় কথা অমিত মনোযোগ কাড়বেই। নিজেকে অমিত তৈরিই করেছে এমনভাবে যেন অন্যের মনোযোগ তার উপর পড়ে। এমনকি অন্যের মনোযোগ, সুদৃষ্টি পাওয়ার জন্য আলাপচারিতায় পক্ষপাতের সুর লাগানো অভ্যাস। অনেক দেবতার পূজারীর মতো সেও আড়ালে সব দেবতাকেই সব দেবতার চেয়ে বড় বলে স্তুব করে। যে স্তব বুঝেও দেবতারা খুশী হন, এ ধরার রমনীরাতো খুশী হবেই। অনেক লেখাপড়া জানা, অন্তরালের কবি অমিত কিন্তু প্রচন্ড ভাবে অস্থিরচিত্ত। এই অস্থিরচিত্ত অমিত আসলে লাবন্য নামের মেয়েটিকে কি ভালোবেসেছিল? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে মনে হয়েছে, লাবণ্যের প্রতি অমিতের ছিল একধরণের ঘোর, একে ঠিক প্রেম বা ভালোবাসা বলে কিনা প্রশ্ন রয়ে যায়। যে ঘোরে অমিত আচ্ছন্ন ছিল, তার পেছনে কারণ হিসেবে ছিল লাবন্যের ব্যক্তিত্ব, শিক্ষা, রুচি এবং সর্বোপরি এমন একটা পরিবেশ। যেখানে অমিতের আসলে আর কিছু করার ছিলনা। সেই পরিবেশে লাবন্যর মতো সম্পূর্ণ একটা মেয়েকে পেয়ে ঘোর জাগা স্বাভাবিক। যাকে অমিত পেতে চায়, আবার চায়না। এক হতে চায় কিন্তু একটা দূরত্ব রেখে দিতে চায়। লাবন্যকে অমিত যেভাবে অনুভব করে, যেভাবে স্বপ্ন দেখে কেন যেন মনে হয়, এটা শুধুই লাবন্যের জন্য নয়। হয়তো অন্য যেকোন মেয়ের জন্যই অমিত একই ভাবে ভাবতে পারতো। একই ভাবে মিলনতত্ত্ব বানাতে পারতো। অমিতের চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা । সে চায় তার সঙ্গী হোক তার মনের মতো। সে যেভাবে চাইবে সেভাবেই সঙ্গী পাবে। যা কিনা করেছে সে শেষ পর্যায়ে কেতকীর সঙ্গে। যতির ভাষ্যমতে উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে জানা যায় কেতকী বদলে গেছে। কেটি থেকে আবার কেতকী হয়েছে। নিশ্চয়ই অমিত চেয়েছে বলেই কেতকী বদলেছে। কিন্তু অনেক বেশি শক্তিশালী চরিত্র লাবন্যর পক্ষেতো বদলানো সম্ভব নয়। লাবণ্যর মতো আমারো আশঙ্কা রয়েই যায় যে এক সময় অমিতের কাছে একঘেয়ে লাগবে লাবন্যকে।
ফিরে আসি মূল প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে। কে কাকে ভালোবাসলো। আরেকবার শেষের কবিতা পড়তে গিয়ে আরেকবার যেটা মনে হলো ভালোবাসা বলে যদি কিছু থেকেই থাকে তাহলে সেটা নিজের প্রতি ভালোবাসা। মানুষ আসলে অন্যকে ভালোবাসেনা, অন্যকে তার প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন হয় সঙ্গীর, প্রয়োজন হয় কিছু অভ্যাস জিইয়ে রাখার। কিছু ভালোলাগার সূচক মিলিয়ে বেছে নেয় তার সঙ্গীকে। আর এই পুরো প্রক্রিয়াটা দেখতে গিয়ে আমরা যে শব্দটা ব্যবহার করি তার নাম ভালোবাসা। সবকিছুর মধ্যে দিয়ে বোঝা যায়, অমিত আসলে নিজেকেই ভালোবাসে। নিজের চেয়ে মহৎ আর কেউ নেই। অন্য অনেককেই তার ভালো লেগেছে অথবা লাগেনি। সময়ের প্রয়োজনে বদলে গেছে। অন্যদিকে অমিতের প্রতি লাবন্যর ছিল মুগ্ধতা। এমন নিবিড়ভাবে কোন পুরুষের সঙ্গে আগে মেশেনি লাবন্য। তাই অমিতকে কাছ থেকে দেখা জানার সুযোগে মুগ্ধ হয়েছে। আরেকদিকে শোভনলাল। নিভৃতচারী শোভনলাল । লাবণ্যের প্রতি ছিল তার সম্ভ্রম মেশানো আকাঙ্খা। অমিতের প্রকাশ বেশি। কিন্তু শোভনলাল অন্তর্মূখী । তাই লাবন্যকে না পেয়েও তার আকাঙ্খা সে পুষে রেখেছে ভেতরে ভেতরে। কোনদিন কাওকে জানতেও দেয়নি। পাছে লাবন্যর অসন্মান হয়। আর কেতকি? যে কিনা অমিতকে পুরোপুরি বুঝতেই পারেনি। কিন্তু আরো অন্য দশটা শহুরে মেয়ের মতোই অমিতকে পাওয়ার জন্য মরিয়া।
হয়তো শেষ পর্যন্ত বলা যায় লাবন্যর সিদ্ধান্ত সঠিক। অমিতের চেয়ে শোভনলাল শ্রেয়তর পছন্দ। বাইরের চাকচিক্য বা প্রকাশ হয়তো কম। কিন্তু ভেতরটা তার পুরোই লাবন্যময়। আর অমিত লাবন্যর রসায়নটাও দরকার ছিল, অন্ততঃ লাবন্যর জন্য। অমিতের সাহচর্য লাবন্যকে সঙ্গীর প্রয়োজন শিখিয়েছে, কাউকে আকাঙ্খা করার মূল্য চিনিয়েছে। তাইতো সে শোভনলালকে বিয়ে করতে পারছে। নৌকায় সহযাত্রী হিসেবে অমিত অসাধারণ। কিন্তু কোনকারণে হাল বাইতে হলে শোভনলাল নির্ভরযোগ্য। তবে একটা ছোট চরিত্র, কিন্তু ভালোলাগার মতো। সে হলো লিলি গাঙ্গুলী। অমিতের মতো মানুষকেও যে এড়িয়ে যেতে পারে। এরকম স্তাবক সুদর্শনকে এড়িয়ে যাওয়ার বিদ্যাটা জানা থাকলে শেষ চালে সেটা মেয়েদের জন্যই ভালো।
যাই হোক সেই প্রথম পড়া আর এবারকার পড়ার মধ্যে তফাৎ হলো তখন ধরেই নিয়েছিলাম অমিত খারাপ। রাগ হয়েছিল খুব। এখন বুঝি কেউ খারাপ না, বেঠিক না। যার যার অবস্থানে সবাই সঠিক। ভুল চলে আসে তখনই, যখন একজনের সঙ্গে আরেকজনকে মেলাতে যাওয়া হয়। রসায়নের সূত্রে না মিললেই উপসংহার দাঁড়িয়ে যায়। বাস্তব থেকে সাহিত্য কেউ এর থেকে নিস্তার পায় না।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০১৫ সকাল ১১:৩৬
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×