somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটু নিঃশ্বাস নেব, প্লিজ...

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বৈষয়িক হিসেবে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী জায়গা সম্ভবত ম্যানহাটান। যেখানে কোন প্রাইভেট পার্কিংয়ে দুই ঘন্টার বেশি গাড়ি পার্ক করলে গুনতে হয় প্রায় ৫০ ডলার। জমি মাপা হয় যেন নিক্তির হিসেবে। সেই ম্যানহাটানের গা ছুঁয়ে পড়ে আছে নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্ক। যে পার্কের পুরোটা হেঁটে দেখতে গেলেও কয়েকদিন লাগে। তার কথা নাই বা বললাম। অথবা সেন্ট্রাল লন্ডনের হাইড পার্ক। গাছে ঢাকা গুল্মে ছাওয়া অর্ধেক অংশ পেরিয়ে যাবার পর আদিগন্ত সবুজ গালিচার মতো খোলা প্রান্তর। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তিরতিরে হ্রদে ভেসে থাকা রাজহাঁসদের গল্পও বরং না বলি। এড়িয়ে যাই ব্যস্ত টোকিওর বুকের মধ্যে বড়সড় বানিজ্যিক এলাকা সিনজুকুর ঠিক হৃদয় ঘেঁষেই শিনজুকু কোয়েন নামের বিশাল বাগিচার কথা। যে বাগিচার এক পাশে বিশাল দিঘীতে ফোঁটে পদ্ম। সেই পদ্ম, আমাদের কবিদের কবিতা ভরে থাকে যার রুপে, গুনে। পুতুল নাচের ইতিকথায় শশী কুসুমের পদ্ম দীঘির বর্ণণা পড়ে আমরা বড় হই। সেই রকম একটা দীঘি পড়ে আছে শিনজুকু কোয়েনে। শুয়ে বসে চেরি ব্লোজম বা খোলা আকাশ দেখার জন্য আছে পিঠ খোলা বিশাল মাঠ। যাই হোক তার কথাও তো বলতে চাইনি।

এমনকি বলতে চাইনি মুঘলদের হাতে গড়া দিল্লী শহরের লোদী গার্ডেনের কথাও। যেই গার্ডেনের খোলা মাঠে এক সন্ধ্যায় শিলংয়ের সুপর্ণাদি শুনিয়েছিলেন বুদ্ধগয়ার গল্প। ভর সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত এক পার্কের ঘাসের জমিনে দুই দেশের দুইটা মেয়ের বসে বসে নির্ভয়ে চাঁদ দেখার আদিখ্যেতার গল্পতো এটা নয়ই। এর চেয়ে বরং ময়দানের কথা বলি। খুব বেশি দূরে নয়। এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে বেঁচে থাকা একটা প্রজন্মের বড় অংশ কেটেছে যেই শহরে। আমাদের বঙ্গীয় বদ্বীপে শহর বলতেই আগে যাকে বোঝানো হতো, সেই একদম নিপাট মধ্যবিত্ত কলকাতা শহরের শরীর জুড়ে শুয়ে আছে ময়দান। ময়দান মানে যেন আক্ষরিক অর্থেই খোলা মাঠ। উদোম মাঠ। কোন ঘেরা নেই, বেড়া নেই। যার যখন খুশি যেমন খুশি আসছে, যাচ্ছে। কাকডাকা ভোর বা কালি সাঁঝ, ময়দানে মানুষ আছে। নির্দি¦ধায়। কেউ ব্যায়াম করছে, কেউ দৌড়চ্ছে। কেউ বসে আছে। কোথাও দলে দলে ফুটবল খেলছে, কোথাও ক্রিকেট। ছেলে মেয়ে নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ সবাই আছে। সেই কবে থেকে এই অভ্যাস চলছেতো চলছেই। সত্যজিতের সিনেমায়, টেনিদার গল্পে, সুমনের গানে সবখানে ময়দান আছে। যেন কলকাতা শহরের মানুষের জীবনের সাথে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়ানো ময়দান।

কলকাতা মানে সেই শহর যেখানে লোক দেখানো আদিখ্যেতা নেই। যেখানে গাড়ি মানে মারুতি আলটো, ট্যাক্সি মানে শক্তপোক্ত পিঠ বাঁকানো নন এসি হলুদ এ্যাম্বাসেডর। যেখানে বাড়ি মানে এখনও তিনপুরুষ পুরনো ভবনে যৌথ পরিবার। সেই না বিলাসী শহরের মানুষের শ্বাস নেবার বিলাসিতার জন্য আছে ময়দান। অথচ এই ঢাকায় আমরা মধ্যবিত্তরা গাড়ি মানে বুঝি আমদানী করা টয়োটা, হোন্ডা বা নিশান। উপরওলাদের জন্য ভলভো বা বিএমডাব্লিউ। এক বাড়িতে কয়েক পরিবারের বসবাসে ক্রমেই অবিশ্বাসী হয়ে ওঠা আমাদের জন্য আছে স্কয়ার ফিটের হিসেব। কার অংক কত বড় সেটা ভেবেই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি। আমাদের বিলাসিতা বাড়িতে, গাড়িতে, পোশাকে, খাবারে। বিলাসিতা নেই শিক্ষায়। বিলাসিতা নেই স্বাস্থ্যে। সবচেয়ে বড় কষ্ট আমাদের শ্বাস নেয়ার একটা জায়গা নেই।

আমরা সেন্ট্রাল পার্ক, হাইড পার্ক, শিনজুকু কোয়েন বা লোদী গার্ডেন চাইনা। নিদেন পক্ষে একটা ছোটখাট ময়দান তো চাইতেই পারি। অথচ আমাদের দুই কোটি মানুষের বসবাসের বিলাসিতার এই ঢাকা শহরে দুই হাজার স্কয়ার ফিটের একটা উন্মুক্ত জায়গা নেই। শহরটার একটা হৃদপিন্ড নেই। যেখানে গিয়ে একটা বিকেল কেউ বসতে পারি। সকালে হাঁটতে পারি। মন ভালো তো সবাই মিলে ঘুরতে গেলাম। মন খারাপ তো একা একা কাঁদতে গেলাম। এমন একটা নির্ভেজাল স্বাধীন নিরাপদ জায়গা আমাদের এই শহরে একটাও নেই। ভাদ্র মাসে ঘুড়ি ওড়াবার জন্য, অগ্রাহায়নে ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য। ভরা বর্ষায় ফুটবল নিয়ে দৌড়াবার মতো জায়গা একটা শহরে থাকা খুব দরকার। যারা টয়োটা নিশান গ্রুপের ইতিবাচক চিন্তা ভাবনার লোক, তারা রমনা পার্ক বা সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের নাম শুনিয়ে দিবেন। যারা ভলভো বিএমডাব্লিউ গ্রুপের তারা হয়তো বলবেন গুলশান বা বারিধারা পার্কের কথা। নাম শুনতে আমারো ভালো লাগবে। কিন্তু জানতে ইচ্ছে করবে এক সকাল ছাড়া অন্য সময় রমনা পার্ক বা সোহরাওয়ার্দি উদ্যান কতটা নিরাপদ? কতটা জন উপযোগী। গুলশান বা বারিধারা পার্কে গিয়ে কয়জন একটু ফুটবল প্রাকটিস করতে পারবে? ঠিক এইরকম নামে পার্ক বা অনিরাপদ জায়গা না।

প্রায় সব শহরে মানুষের জন্য একটা নিরাপদ ঠিকানা থাকে। শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে। আদর করে মানুষ বলে সিটি হার্ট। শ্রেণীর সব পেশার সব বয়সের মানুষের জন্য সমান নিরাপদ একটা গন্তব্য। যেখানে মানুষ অবসরে আড্ডা দেবে, মন চাইলে বই পড়বে, হেড ফোন কানে লাগিয়ে গান শুনবে। সময়ের প্রয়োজনে দাবি দাওয়া নিয়ে দাঁড়াবে। এমন একটা সচল, নিরাপদ খোলা জায়গা। একসময় আমাদের একটা সংসদ ভবন ছিল। যার সবুজ মাঠ, লাল সিড়ি ছিল সেসময় হাজার হাজার মানুষের অবসর কাটানোর জায়গা। আমাদের কৈশোরের দিনগুলোতে আমরা এই খোলা মাঠেই কারো চোখে তাকিয়ে প্রেমে পড়তাম। কারো সঙ্গে অভিমান হলে এই মাঠে এসেই প্রেম ভাংতাম। আমাদের তখন আড়াল দরকার হতো না। বড় খোলা মাঠ আমাদের মনকে বড় করেছিল। আমাদের জন্য কোনকিছু অপ্রকাশ্য বা গোপন ছিলনা।

অথচ এখনকার মাঠবিহীন শহরের ছেলেমেয়েরা প্রেমে পড়তে আড়াল খোঁজে। খোঁজে চারদেয়াল। কুঠুরি না মিললে অগত্যা রেস্টুরেন্টের আলো আঁধারি। সেই সময়ের শিশুরা উল্টেপাল্টে দৌড়ে বেড়াতো সেই এক খন্ড খোলা প্রান্তরে। এখনকার শিশুরা খেলার জায়গা মানে বোঝে রেস্টুরেন্টের এক কোণে রঙিন প্লাস্টিক বল দিয়ে সাজানো প্লে জোন নামের পরিহাস। আমাদের শিশুদের, আমাদের তরুনদের আমাদের নাগরিক মা বাবাদের রেস্টুরেন্টমুখী, চারদেয়ালমুখী করে দিয়ে কেড়ে নেয়া হয়েছে আমাদের সংসদ ভবন, আমাদের কাছ থেকে, গণমানুষের কাছ থেকে। সাড়ে তিনশ মানুষের নিরাপত্তার নামে দুই কোটি মানুষ তার নিঃশ্বাস নেবার শেষ সম্বলটুকুও দিয়ে দিয়েছে। বিনিময়ে পায়নি কিছুই।

রাজনৈতিক সুস্থতার কথা না হয় ভুলে যাই, বাদ দেই গনতন্ত্রের কথা, মনে করিয়ে দিতে চাইনা নদীতে ভাসা লাশ বা উধাও হয়ে যাওয়া মানুষদের কথা। মানসম্মত শিক্ষা, আস্থা রাখার মতো চিকিৎসা কোনদিন পাব কিনা জানতে চাইনা। কবে কোন সুদূর ভবিষ্যতে ৫টায় অফিস শেষ করে সাত কিলোমিটার দূরত্বের বাসায় পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চেপে ১৫ মিনিটে ফিরতে পারবো কিনা সেটাও ভাবিনা। কষ্টে উপার্জিত পয়সা দিয়ে খাবারের বদলে বিষ কিনে খাচ্ছি বলেও বিব্রত করতে চাইনা। মনে করিয়ে দিতে চাইনা আমাদের খাদ্যের মান নেমে গেছে কোন অন্ধকারে। কেবল একটা কথাই মনে করিয়ে দিতে চাই, আমাদের একটা নি:শ্বাস নেবার জায়গা লাগবে। একটা খোলা মাঠ। মাথার উপর নীল আকাশ। আর কিছু পাই বা না পাই নির্ভয়ে এক দন্ড বসে একটু নিঃশ্বাস নিতে চাই, আমাদের শেষ শ্বাসটুকু বের হয়ে যাবার আগে।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৯
১২টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×