somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাবাকা 'জো'

২০ শে মার্চ, ২০০৯ সকাল ১০:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

{রুশ ভাষায় সাবাকা'র বাঙলা অর্থ কুকুর। সাবাকা 'জো' আমার ভীষন প্রিয় বন্ধু আনিসের অতি প্রিয় কুকুরের নাম। শিক্ষিত সেই কুকুরটা সারাজীবন ছিল বাধ্য হয়ে ব্রহ্মচারী(সে কোন নারী কুকুরের সান্নিধ্য পায়নি)। লেখার শেষ ভাগের কিছুটা অংশ প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য। লেখাটা আনিসের সেই কুকুরকে উৎস্বর্গীকৃত।}- রিপোস্ট
একরুমে থাকে ওরা গাদাগাদি করে সাত আটজন। গেস্ট আসলে কখনো সে সংখ্যা গিয়ে বেড়ে দাড়ায় বার কিংবা চৌদ্দজনে।
কারোই তেমন কাজ কর্ম প্রায় নেই বলতে গেলে।সবাই তাদের দেশ থেকে পাঠানো টাকা কিংবা গচ্ছিত কিছু অর্থ বা অন্যের ঘাড়ে বসে খায়। বাড়িখানা অনেকটা বারোয়ারি হোস্টেলের মত।লতায় পাতায় পরিচিত মস্কো কিংবা মস্কোর বাইরের কেউ সমস্যায় পড়লেই কোন অগ্রিম তার বার্তা নাদিয়েই এখানে এসে দু চার পাচ দিন থেকে শুরু করে কয়েক মাস অব্দি থেকে যায়। কেউ আসে আড্ডার লোভে দুয়েকজন আসে অর্থাভাবে কেউ আসে ভিসার জন্য কেউ আসে প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে আবার কেউবা আসে অসতর্ক মুহুর্তের সামান্য ভুলের জন্য অকালে সন্তানের দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বাচার জন্য।
সারাদিন কাটে তাস খেলে রকমারি রান্না করে টেলিফোনে গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করে- কখনো মদ খেয়ে মাতলামী হৈ চৈ হুল্লোড় আর কিঞ্চিৎ হাতাহাতি মান অভিমান বাদানুবাদ আর ভবিষ্যত পরিকল্পনায়।প্রতিদিন নতুন নতুন গেস্ট আসে আর আড্ডা জৌলুস বাড়ে।অতিথি যখন বিদেয় হয় তখন কখনো হাঁফ ছেড়ে বাচে কিংবা কষ্টের ছায়া নামে চোখে মুখে।সেখানে ঘুমোনো আর খাওয়া দাওয়ার পর্ব চলে ভীষন আগোছালো আর বিস্মৃঙ্খল ভাবে। যার যখন খুশি খাচ্ছে-যার ইচ্ছে দু দন্ড জিরিয়ে নিচ্ছে।
এভাবে মোটামুটি উত্তাপবিহীন কিছুটা একঘেয়ে এই দিনগুলিতে বেশ অন্য রকম এক আমেজ আনল তাদের এক বন্ধুর বিয়ে। সে থাকে মস্কো থেকে বেশ ক’শ কিলমিটার দুরে। দেশ থেকে বহুদুর রুশ দেশে এই প্রথম কোন বন্ধুর বিয়ে তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল সদলবলে বিয়েতে যাবে।রুশ বিয়েতে মজা বলতে সারারাত পান উৎসব আর নাচের অছিলায় জড়াজড়ি লেপ্টলেপ্টি।
কুকুরের প্রতি এমনিতে আনিসের তেমন আকর্ষন কখনোই ছিলনা।সদলবলে বাইরে ঘুরতে গিয়ে কোন এক সকালে সেই শহরেই রাস্তার ধারে বসে এক বৃদ্ধার কিছু কুকুর ছানা বিক্রি করতে দেখে কেন যেন ঝোকের মাথায় আগপিছু না ভেবে কিনে ফেলেছিল একখানা।
বন্ধুরা তার এই পাগলামি দেখে ঠাট্টা মস্করা করেছিল খুব-যেখানে মানুষের থাকার জায়গারই অভাব সেখানে সে কুকুরছানা রাখবে কোথায়? আনিস হয়ত হয়ত সেই কুকুরছানাটাকে সেখানেরই ফেলে আসত কিংবা কারো উপহার দিয়ে দিত। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই একগুয়ে একরোখা বন্ধু আমার বন্ধুদের ইয়ার্কি ঠাট্টার জবাব দিতে পণ করল সেটাকে নিজের কাছেই রাখবে।
অবশেষে সেই কুকুরছানা দীর্ঘ পথ ট্রেনে চেপে মস্কোতে এল আনিসের সেই ডেরায়।
কুকুরের বাচ্চা কোন নিয়ম নীতি মানেনা-এত ছোটযে সে কোন প্রশিক্ষন দেয়ার প্রশ্নই আসেনা। সারাদির ঘর জুড়ে ছুটোছুটি করে খাবার যতটুকু খায় ছড়ায় তার থেকে বেশী। যেখানে সেখানে ঘুমোয়-প্রাকৃতিক কর্ম গুলো লেপ কাথা কিংবা কার্পেটের উপরেই অবলীলায় সারে।সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার! সবাই দুদিনেই ত্যাক্ত বিরক্ত!
ওদিকে সবার যন্ত্রনা আর বিরক্তি দেখে আনিসের আনন্দ যেন ধরে না। এতদিন পরে সে একটা মনের মত কাজ পেয়েছে যেন। কুকুরের প্রতি তার আদিখ্যেতা দেখে সবারই গা জ্বলে যায়।
একঘেয়ে দিনগুলিতে সাঝে মধ্যে বৈচিত্র আনে মিলন ভাই।তিনি সবার বয়সে একটু বড়তো বটেই তারইপরে কিঞ্চৎ ধনবান। আসার পথে ব্যাগ ভর্তি করে খাবার আর মদ নিয়ে আসেন।বাসায় এলেই হুলস্থুল শুরু হয়ে যায় তাকে নিয়ে-সেই রাতটাতে সবাই মেতে ওঠে উৎসব আনন্দে।
একটু ধার্মিক শ্রেনীর কয়েক জন কুকুরকে করেছে অস্পৃশ্য আর মদকে হারাম বলে ছুয়ে দেখেনা। কিন্তু উৎসবে তারাও শামিল হয়-উপভোগ করে সবার মত করেই।
সেদিন গভীর রাত অব্দি চলল খানা পিনা আর গল্প গুজব-স্বভাবতই দুয়েকজন মাতাল তখন।স্পস্টভাষী রফিক(ছদ্মনাম)সেই তথাকতিথ ধার্মিক কুকুর বিরোধীদের প্ররোচনায় একটু বেশীই গিলেছিল সেদিন।আর মতাল হয়েই নেশার ঘোরে কখন কিভাবে যেন আনিসের সাথে শুরু হল তর্ক বিতর্ক-অনুঘটক সেই কুকুর ছানা!
প্রথমে মৃদু উত্তেজনা-দুয়েকজনের উস্কানীতে লেগে গেল হাতা হাতি।এমন ঘটনা এখানে বিরল নয় কিন্তু। মাতাল হয়ে হাতাহাতি প্রায়শই-সবারই এটা গা সওয়া হয়ে গেছে। আচমকা ওরে বাবারে মারে বলে শহিদের বিকট চিৎকার।প্রথমে আঁতকে উঠল সবাই-কিন্তু পরক্ষনেই হাসাহাসি গড়াগড়ি।
ঘটনাটা এমন;উত্তেজনার এক ক্ষনে আনিসের সাথে হাতাহাতি শুরু হতেই কোত্থেকে সেই কুকুর ছানা দৌড়ে এসে কামড়ে ধরেছে শহিদের অন্ডকোষ!শহিদ চিৎকার চেচামেচি করছে আর আর ঘরময় দৌড়াচ্ছে কিন্তু তখনো সেই পিচ্চি কুকুর সেইখানটায় কামড়ে ধরে ঝুলে আছে আর রাগে গড় গড় করছে।অবশেষে সবার অনুরোধে আনিস-ই গিয়ে ছাড়িয়ে আনল তাকে।
সেই থেকে আনিস বা তার কুকুরকে কেউ কিছু বলে না ভয়ে।ওদিকে সেই কুকুরছানার প্রতি আনিসেরও আদর ভালবাসা আদিখ্যেতা উত্তর উত্তর বেড়েই চলছিল।
ওদিকে জাতে জার্মানী শেফার্ট সেই কুকুর ছানাও তার আদরে আর প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠছিল তরতর করে।আনিস কুকুরটাকে দুবেলা রান্না করে নিজের হাতে খাওয়ায়,নিজে হপ্তায় দু হপ্তায় একবার গোসল না করেলেও কুকুরটাকে মাঝ মেধ্যেই শ্যম্পু সাবান ডলে সাফসুরোত করে।রান্না ঘরে চলে কুকুরের রান্না নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট।কুকুরের রান্নার জন্য বাসন কোসন আর রান্না ঘরের চুলার দখল থাকায় নিজেদের রান্না লাটে ওঠে। মাঝে মধ্যে গোসল খানায় কুকুরের পশমে সয়লাব আর সারা বাড়িতে তার ছড়ানো উচ্ছিষ্ট আর মল মুত্রের ছড়াছড়িতে বাকি সব হোস্ট গেষ্ট অল্প কদিনেই ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে উঠল। দুচারজন সকাল বিকেল ফন্দি আটে কি করে ওটাকে তাড়ানো যায়। তবে কেউ কেউ যে আদর করতনা তা কিন্তু নয়।আগেই বলেছি কিছুটা একঘেয়ে সেই প্রবাস জীবনে একটু অন্যরকম স্বাদ এনে দেবার জন্য তার হিতাকাঙ্খীও মিলে গেল দু’একটা।
জর্মন শেফার্ড নাকি নেকড়ের বংশধর। পূর্ব পুরুষের জাত মান রাখতে সে দাত নখের ধার শানাতে গিয়ে কত জনের চামড়ার জুতো আর পশমী কোট যে ছিন্ন ভিন্ন করল তার ইয়ত্বা নেই।
একটা জাত কুকুরকে কিভাবে ট্রেইন্ড করতে হয় সে বিদ্যে কারোই জানা ছিলনা। তবুও একে ওকে জিজ্ঞেস করে ঠেলা গুতো গাল মন্দ দিয়ে তাকে একটু লাইনে আনলেও-ওদের এই ছন্নছাড়া জীবনের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে সেও মাঝে মধ্যে উদ্ভট আচরন করে।
বেশ কদিন বে ওয়ারিস ঘুরে বেড়ানোর পরে অবশেষে কোন পূর্ব পুরুষের পদবি ছাড়াই তার একখানা নাম ঠিক হল ‘জো’। আমার ধারনা হয়তো চু চু শব্দ থেকেই জো নামের উৎপত্তি।সহজ নাম যখন তখন সবাই ডাকে। জো ও মহা উদ্যোমে এর ঘাড়ে ওর মুখে আচড় মেরে লাফ ঝাপ দিয়ে এলোমেল ছোটে। খাবারের প্লেট উন্মুক্ত থাকলেই চেটে পুটে স্বাদ নেয়-বেকুব কুত্তা তার উদরের ধারন ক্ষমতা আঁচ না করতে পেরে উল্টা পাল্টা খেয়ে অবশেষে বমিতে রুম ভাসায়।
মাস ছয়েক বাদেই বেকার আনিস একখান চাকরি পেল বেশ লোভনীয় বেতনে। রুমমেটরা তখন তাকে ইর্ষা করে সাথে ভক্তিও। এতগুলো বেকারের মাঝে সকার একা সে –সবাই তাকে তোয়াজ করে।কুকুরছানাও তার মনিবের এহেন দৈব পরিবর্তন আচ করতে পেরে হয়ে উঠল আরো বেয়াড়া আর বেপরোয়া! তবে দুর্ভাঘ্য ‘জো’র বছর না ঘুরতেই সেই নিস্কর্মা ছেলেগুলো ধীরে ধীরে নির্মম বাস্তবতার চাপে রুটি রুজির তাগিদে চলে গেল ভিন দেশে কিংবা মস্কোর অন্য প্রান্তে। ভেঙ্গে গেল সেই মিলন মেলা।আমিও ফিরে এলাম দেশে।
আমার ফিরে আসার কিছুদিন বাদে আনিসও দেশে আসল বেড়াতে মাস তিনেকের জন্য।আসার আগে ভীষন বিপদে পড়েছিল ‘জো’ কে নিয়ে। ওকে একলা রেখে যাবে কার কাছে?অবশেষে শুভাকাঙ্খীদের পরামর্শে ‘জো’কে ভর্তি করে দিয়ে এসেছিল মস্কোর নামকরা এর কুকুর প্রশিক্ষন বিদ্যালয়ে।
আমার ধারনার মধ্যেও ছিলনা শারমেয়রাও ইন্টার কিংবা গ্রাজুয়েশন করে। একবার শুনেছিলাম শিকাগোতে নাকি কুকুরের হোটেল আছে! এইটুকুতেই বিস্মিত হয়েছিলাম। কিন্তু কুকুরের বিদ্যালয় কিংবা বিশ্ব-বিদ্যালয় আছে সেটা শুনে শুধু বিস্মিত হইনি শুধু-বিশ্বাসও করিনি।
‘জো’অবশ্য অতটা শিক্ষিত হয়নি মাত্র ছ’মাসের ট্রেনিং এ সে উচ্চ বিদ্যালয় পাশ করেছিল মাত্র।তবে হিংস্রতার শিক্ষা মনে হয় আরেকটু উচু লেভেলে দেয়া হয় তাই সে বরাবরই ছিল একটু বোকা সোকা নরম মনের এক শিশু স্বভাবের কুকুর।
মতভিন্নতা থাকতে পারে, তবে শুনেছি কুকুরের এক বছর নাকি মানুষের সাত কিংবা আট বছরের সমান। সেই হিসেবে ওদের ছমাসের নিবির ট্রেনিং মানুষের কয়েক বছরের শিক্ষা দীক্ষার সমান।দশ বছর একটা কুকুর বেচে থাকা মানে মানুষের সত্তুর কিংবা আশি বছরের জীবন পাওয়া।
জো’র সাথে দ্বীতিয়বার দেখা আমার ওর পাচ বছর বয়সে।তখন সে দুপায়ে ভর করে খাড়া হয়ে দাড়ালে পৌনে ছ’ফুট মাথাও ছাড়িয়ে যায়।প্রথম দর্শনেই তার সেই বিশাল আকৃতি দেখে আমি ভড়কে গিয়েছিলাম।আর কি তার বন্য সৌন্দর্য! আঃ চোখ জুড়োল দেখে আমাদের সেই ছোট্ট জো কে। তখন তার পূর্ন যৌবন তার উপরে সবার যত্ন আত্মি- সময় মত শ্যাম্পু ডলে গোসল খাওয়া চুল আচড়ানো আর ট্রেকিং জগিং করে তেমনি রুপবান হয়েছে সে।তার চকচকে বাদামী আর কালো পশমের আড়ালে সবল পেশীর আভাস মেলে বহুদুর থেকে।ততদিন সে পুরোপুরি ট্রেইন্ড। সময় মত খায় ঘুমোয়। প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারা আর ঘুরাঘুরি করারও সময় নির্ধারন করা আছে। একদিন একটু উল্টা পাল্টা হলেই সে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
ঝড় তুষারপাত কিংবা মুষলধারে বৃষ্টি হলেও জোকে নিয়ে প্রতি রাতে বাইরে বেরুতে হবেই।সেটা তার সাস্থ্যটাকে সুগঠিত করতে সেই সাথে প্রাকৃতিক কাজ সারতে।
আনিস যত রাতেই বাসায় ফিরুক না কেন সারাদিনের ব্যাস্ততায় হয়তো সে ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ছে কিংবা অতিরিক্ত পানে মাতাল হয়ে হাত পা টলছে তবুও সে দরজাটা খুলেই জলদ গম্ভীর কন্ঠে প্রথমেই জো’কে ডাকবে।
‘জো’কে অবশ্য এমনিতে ডাকার প্রয়োজন পড়েনা- কেননা মনিবের পদশব্দেই সে আগে থেকেই লম্ফ ঝম্ফ শুরু করে- আনিস ঢোকামাত্রই সে তার চারদিকে ঘুরে ঘুরে ট্রাউজারের সাথে ঘাড় ঘষে আদর চায়। একটু খানি আদর পেলেই সে সারাদিনের একঘেয়েমী ভুলে নিজের বিশাল শরির নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে তার গায়ে। কখনো হাত চাটে কথনো ঘাড়ে আদর করে কখনো সারাটা মুখে নিজের লালা লেপ্টে দেয়। আনিসও দারুন উপভোগ করে তার সেই আদর।
কখনো বিরক্তিতে জোঃ বলে একটা ধমকদিলে সে দুরে সরে গিয়ে অপরাধী চোখে তাকিয়ে থাকত কিছুক্ষন –আবার পরক্ষনেই চারিদিকে ঘুরে ঘুরে ঘাড় ঘষে আদর চাইত। পোষাক আশাক না খুলেই আনিস হাত বাড়াত ওর বেল্টের দিকে। সেও তার ঘাড়খানা এগিয়ে দিত শেকল পড়ানোর জন্য। মনিবের দাসত্বে তার কি আনন্দ তখন! অবশ্য আনিস বাইরে বেরুবার সময় নিজের খাবারের এন্তেজাম না করলেও কুকুরের রান্না ঠিকই চুলায় চাপিয়ে যেত।কমমতদিন গেছে কুকুরকে নিজের জন্য রাখা মাংসটুকু রান্না করে খাইয়ে নিজে একটু সব্জি দিয়ে ভাত খেয়েছে।
সে ফিরে আসতে আসতেই রান্না শেষ।‘জো’ তখন একাহারি। নিয়ম করে একবেলাতেই খেতে হয় তার। সারাদিন সে একবারও ছোক ছোক করেনা।কেউ খাবার সাধলেও সে খেতে চায়না। কখনো হয়তো লোভে পড়ে একটু এগিয়ে এসে আনিসের দিকে আড় চেখে তাকিয়ে সম্মতি পাবার আশায় কিছুক্ষন অপেক্ষা করে আবার মুখ ফিরিয়ে নেয়। তবে আনিস একবার অনুমতি দিলে আর রক্ষে নেই! তখুনি সে খাবারের উপর ঝাপিয়ে পড়ে।
বাইরে থেকে এসে আনিস পোষাক পাল্টে নিজের জন্য কিছু চুলোয় চাপিয়ে জো’কে খেতে ডাকে।জো’তো সারাদিন এই ডাকটার জন্যই অপেক্ষা করেছিল। সে কি খুশী তার।কালো টানা টানা চোখে সেই খুশীর ঝিলিক দেখে আমার কি যে ভাল লাগত।
জো'কে দেখে আমি সবচে বেশী অবাক হয়েছিলাম তার স্মরন শক্তি দেখে।!এত্তটুকুন বয়সে সে দেখেছে আমায়।তবুও কিভাবে মনে রেখেছে। আমি প্রথমবার এ বাসায় আসলে সে একবারও ঘুউ ঘেউ করেনি। প্রথম দেখাতেই আমার গা ঘষে আদর চেয়েছে। কিন্তু নতুন কেউ আসলে সে ঘেউ ঘেউ করবেই।
আদরতো চাওয়াতো দুরের কথা যতক্ষন পর্যন্ত সে কনফার্ম না হবে লোকটা আনিসের শুভাকাঙ্খী ততক্ষন পর্যন্ত তাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না। আনিস নিষেধ করলে কিংবা ধমকালেও সে একটু দুরে সরে ঘর ঘর ঘর ঘর শব্দ করে তার বিরক্তি প্রকাশ করে দাত খিঁচাবে।আর মাঝে মধ্যে অতিথির পিলে চমকে দিয়ে বিকট শব্দে ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠবে।
বন্ধু আনিস বলত,একবার আগুন্তক তার প্রিয় কেউ জেনে গেলে তাকে আর সে কখনোই বিরক্ত করবে না। হোকনা তার সাথে দু-চার বছর পরে দেখা।
কোনদিন আনিসের বাইরে থেকে ফিরতে দেরি হয়ে গেলে-সে চাপ সংবরন করতে না পেরে ঘরের এক কোনেই প্রাকৃতিক কাজ সেরে ফেলত। কিন্তু এই কুকর্মটি করে সেদিন তার সেকি অনুশুচোনা! কই যেত তার লম্ফ ঝম্ফ! আনিস ঘরে ফিরলেই সে এক কোনে গিয়ে লুকাতো।এতবড় শরিরটা পর্দার আড়ালে নিজেকে লুকানোর সংকোচিত করার ব্যার্থ ও হাস্যকর প্রয়াস করে দু থাবার আড়ালে মুখখানা লুকিয়ে থর থর করে কাঁপত। আনিস সেদিন বাসায় এসেই বুঝে যেত একটা অঘটন ঘটে গেছে।জানে সে ‘জো’ কে ধমক ধামক দিয়ে লাভ নেই তাই সে মুখ ভার করে রাগী রাগী মুখে বসে থাকত। ‘জো’ তখন তার থাবার আড়াল থেকে একটু খানি চোখ বের করে করুন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত অপলকে মনিবের দিকে। ভাব বোঝার চেষ্টা করত।আনিস তার দিকে তাকালেই সে সে ফের মুখ লুকাত। বহুক্ষন ধরে চলত এই খেলাটা। আবার কখনো অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে আনিসের সামনে দিয়ে ত্রস্ত পায়ে হেটে গিয়ে ডাদিকের দেয়ালের পাশে লুকিয়ে একটু খানি মুখ বের করে নিবিড় পর্যবেক্ষন করত তার মেজাজ মর্জি।দুয়েক ঘন্টা বাদে আনিসের রাগ কমলে-সে আড়াল থেকে শরিরটা বের করে অপরাধী দৃষ্টি নিয়ে চারিদিকে মুখ চুন করে ঘুরে বেড়াত। সর্বন্তকরেন প্রতিক্ষা করত আনিসের একটা মধুর ডাকের। একবার ডাক দিলেই হল। নিজের শরিরের বিশালতা ভুলে দৌড়ে এসে ঝাপিয়ে পড়ত আনিসের গায়ে। তারপর বহুক্ষন ধরে চলত হুটোপুটি ভালবাসা আর আদর!
রাশিয়ার সেই অস্থির সময়টাতে-জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার খোজে মানুষ যখন দিশেহারা তখন এই বোকাসোকা জো কিন্তু দারুন বিশ্বস্ততায় সহচর বন্ধু কিংবা বডিগার্ডের দায়িত্ব নিয়ে সামলেছে তার মনিব কিংবা পালক পিতাকে।সে সর্বক্ষন চোখে চোখে রেখেছে তাকে।একটু সন্দেহ হলেই সে ঝাপিয়ে পড়েছে শত্রুভাবাপন্ন যে কারো উপরে।
ডাকাবুকো তরতাজা যুবক জো’র একটা বান্ধবী জোটেনি তখনো।নিজের রিপুকে দমন করতে না পেরে মাঝে মধ্যে অবশ্য সে জাত পাত ভুলে কোন টেরিয়র কিংবা বুলডগ মাদি কুকুরের উপর ঝাপিয়ে পড়তে দ্বীধা করতনা।তাকে সামলাতে তখন আনিসের ভীষন বেগ পেতে হত।জীবনে দু চারটা চড় থাপ্পর খেয়েছে সে অবশ্য এই চরিত্রহীনতার দোষে।
সবকিছু ঠিকঠাক সত্বেও আচমকা জো’র শরির ভেঙ্গে যেতে শুরু করল। সে সারাক্ষনই বিষন্ন থাকে। খাবারে একদম রুচি নেই। বাইরে ঘুরতেও চায়না বিশেষ।আনিস পড়ল মহা বিপদে। উপায়ন্তর না দেখে অবশেষে ডাক্তারের সরনাপন্ন হল সে।
সব দেখে শুনে ডাক্তার বলল,ভরা যৌবনে যৌনাকাঙ্খা মেটাতে না পেরে জো’র এই দশা। হয় তাকে একটা বান্ধবী জুটিয়ে দিতে হবে নয়তো। হস্ত দ্বারা মৈথুন করে স্খলন করতে হবে।
ওখানকার নিয়ম স্বজাতি কোন মাদী কুকুরের মনিব ইচ্ছাকৃত ভাবে এগিয়ে না এলে পুরুষ কুকুর সহবাস বিহিন জীবন কাটাতে বাধ্য হত।কুকুরের দেহ মিলনের জন্য তাদের দুপক্ষের মালিকেরই সম্মতির প্রয়োজন ছিল।এজন্য কেউ কেউ পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দিতে বাধ্য হত।
বহু চেস্টা তদ্বির করে একটা স্বজাতি বান্ধবী জোগার করতে না পেরে অবশেষে বাধ্য হয়ে আনিস শেষোক্ত কঠিন কার্যটিই সম্পাদন করল। সেটা একটা দেখার মত দৃশ্য ছিল বটে। দু হাতে গ্লভস পড়ে বাথটাবে জো কে নিয়ে সে কি যুদ্ধটাই না করেছিল বেচারা!সপ্তায় দুচারবার হস্তমৈথুনের সুবাদে জো ঠিক আগের মতই তরতাজা হসি খুশি হয়ে উঠল।সেই সাথে বেড়ে চলল তার পাগলামী আর বোকামীটাও।
আনিসের প্রিয় সেই প্রিয় সহচর বন্ধু কিংবা সন্তানটি বেচে ছিল দীর্ঘ ষোল বছর।দুটো দিন তাকে চোখের আড়াল করেও আনিস কখনো শান্তিতে ঘুমোতে পারেনি।দুজনেই দুজনার ছিল হরিহর আত্মা। আনিসের বউ সন্তান সবাই তাকে নিজের আপন আত্মীয়টির মত ভাল বাসত।শেষ বয়সে তার যখন গায়ের লোম খসে পড়তে শুরু করল তখনো কারো ভাল বাসা কমেনি এক রত্তি।
শেষ কটা দিন ওর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে অবশেষে সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলার। আনিস সামনে থেকে তার সন্তানের হত্যাদৃশ্য দেখতে চায়নি।
সে জোর অগোচরে পালিয়ে এসেছিল বাংলাদেশে। সেই কটা দিন সারাক্ষনই অজানা আশঙকায় তার বুক কাপত মনে হত এই বুঝি পাবে জোর মৃত্য খবর। জোর মৃত্যুর আগের পুরো সময়টা দেখেছি ভয়ানক বিষন্ন তাকে। অবশেষে একদিন সেই চরম খবরটি এল – জো মরে গেছে কিংবা তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। আনিস কখনোই স্বীকার করতে চায়নি বা চায়না সেই চরম সত্যটা। তার কাছে জো অমর। জোর স্মৃতি সারা জীবন সবার অলক্ষ্যে জুড়ে থাকবে তার হৃদয় জুড়ে।আর ক্ষত হয়ে রক্ত ঝড়াবে তার মৃত্যুটা।
('জো' মারা গিয়েছিল ২০০৮ সালের ১০ই মার্চ। আনিস এখন সপরিবারে থাকে 'জো'র পূর্বপূরুষের ভুমি জার্মানীতে।)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০০৯ দুপুর ১২:৪৯
১৩টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মায়ের শূন্যতা

লিখেছেন শাওন আহমাদ, ১৪ ই জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৪:৩৯



যেদিন ভোরবেলা আব্বা মারা গেলেন, মা আমাদের চার ভাইকে মুরগির ছানার মতো বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। তার কান্নায় কেবল অসহায়ত্ব নয়, মিশে ছিল এক বুক গভীর শূন্যতা। বারবার বলছিলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের নিরাপত্তার আয়োজন কতটুকু?

লিখেছেন খাঁজা বাবা, ১৪ ই জুলাই, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:১৭



ভারত পাকিস্তান ও ইরান ইজরাইল সংঘাত যুদ্ধক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার সামনে নিয়ে এসেছে। প্রথাগত সমরাস্ত্র আজ নতুন প্রযুক্তির কাছে খেলনায় পরিনত হয়েছে। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান ও ঐতিহাসিক ভাবে প্রাপ্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।।এক রাতেই বদলে গেল হাসিনার ইতিহাসের গতি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই জুলাই, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০১



সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত সংবাদ সম্মেলন নিয়ে সারাদিন ধরে অপেক্ষায় ছিল গোটা দেশ। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজের আশা ছিল, আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে হয়তো কোনো ইতিবাচক বার্তা আসবে। কিন্তু রাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবার তোরা মানুষ হ

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৪ ই জুলাই, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৬


আবু সাইদের আত্মত্যাগ কি শুধু বৈষম্যহীন এক সমাজের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, নাকি তা এখন নতুন করে বৈষম্য সৃষ্টির এক ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে? জুলাই অভ্যুত্থানের সেই রক্তক্ষয়ী দিনগুলোর এক বছর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপির মুখে কেন জামাতবিরোধি শ্লোগান?

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১৪ ই জুলাই, ২০২৫ রাত ৯:১১







নয়া পল্টন থেকে শাহবাগ অভিমুখে ছাত্রদল আজকে জামাত শিবির বিরোধী শ্লোগান দিতে দিতে মিছিল করছে!! কিন্তু যেই দলের নেতাকর্মীরা এই স্লোগান দিচ্ছে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×