ভোজন রসিক বাঙ্গালীর মুড়ি চিড়া মাখানোয় আর হরেক রকম ভর্তায় পিয়াজ লঙ্কা আর সরিষার তেল অপরিহার্য –আরেকটু স্বাদের জন্য কোনটার সাথে টম্যাটো,সসার কুচি ধনে পাতা আর লেবুর সংমিশ্রন-আর রান্নায় পিয়াজ লঙ্কাতো আছেই সাথে একটু ধনে হলুদ লাল মরিচের গুড়ো আর জিরা কিংবা পাঁচ ফোড়ন না হলে চলে! সেটা হোক কিনা চাইনিজ, থাই,কন্টিনেন্টাল কিংবা মোগলাই সমস্যা নেই নামে খালি ভিন্নতা -স্বাদ বাড়ানোর জন্য এসবের সবগুলো না হলেও কয়েকটা লাগবেই।
ভাগ্যিস চা'য়ে এসবের উৎপাত নেই।ব্রিটিশরা আমাদের চা'য়ের নেশা ধরানোর জন্য কত কর্মই না করেছে! হাটে ঘাটে বাজারে বিনি পয়সায় গেলাস গেলাস চা তো খাইয়েছেই- সাথে কখনো মিলেছে উপঢৌকন।
আমি জানিনা তখন ইউরোপে চা'য়ে দুধ মেশানোর প্রচলন হয়েছে কিনা- তবে আমাদের নেশা ধরাতে দুধের ব্যপক ব্যাবহার শুরু হয়েছিল এখানেই মনে হয়। এরপর শুরু হল চা নিয়ে গবেষনা-কেউ মেশায় হরতকি,দারচিনি,লবঙ্গ কেউ মেশায় আদা লেবুর রস-ধীরে ধীরে চতুর দোকানীরা খদ্দের টানার জন্য কলা পাউরুটিও মেশাতে লাগল। সেই চা খেয় মাঝে মধ্যে ভ্রম হয় চা খা পায়েস খাচ্ছি ভেবে।
খাটি দুধের চা না হলে অনেকের মুখে রুচে না। লাল চা দেখে এখনো অনেকে নাক সিটকান সেটাতে যতই মোক্ষমভাবে পাতি লেবুর আর আদার রস মেশান না কেন!
চায়ের নেশা বাঙ্গালীকে ভালই ধরেছে । চা ছাড়া এখন আর আড্ডা জমে না।
কোন পরিচিতের সাখে রাস্তায় দেখা হলেই আপ্যায়নের শুরুতেই বলেন 'আইস এক কাপ চা খাই বলে!'
কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলেই প্রথমেই আসে চায়ের প্রসঙ্গ! তবে অজ পাড়া গায়ে কেন গেরোস্তের বাড়িতে চা রসিকের চা না খাওয়াই উত্তম। অভিজ্ঞতা তিক্ত হওয়ারই সম্ভবনা বেশী।
চা খেতে গিয়ে জিভ পুড়েনি এমন বাঙ্গালী কম আছে।আমি এক লোককে জানতাম যিনি দুবেলা খেতেন শুধু চা আর একবেলা ভাত রুটি!
জাপানিজরা যে চা খায় তাতে ঠান্ডা গরেমের বালাই নাই-ট্যাল ট্যালে বিস্বাদ ফিকে সবুজ রঙ্গের চা যাকে ওরা বলে ও-চা। সকাল বিকেল সন্ধ্যে নেই পানির বদলে ও-চা খায়।
রুশদের দারুন কারুকাজ মন্ডিত 'চায়নিক' বা সমোভারতো ভুবন বিখ্যাত –সারাদিন ওতে গরমপানি টগবগ করে ফোটে। পাশেই একটা চিনে মাটির পাত্রে ভেজানো থাকে চা পাতা সাথে সুগন্ধি বা গাছ গাছড়ার জঙ্গল। কেউ চা খেতে চাইলেই এক কাপ গরম পানির সাথে মিশিয়ে দেয় সেই ঘন লিকার। চায়ের সাথে অবশ্য একটু আধটু ব্রান্ডি কনিয়াক রসিকরা আর রোগীরা খায়।
ইংরেজ রাজপরিবার বা এলিটরা খায় নাকি হোয়াইট টি বা সাদা চা! সেই চায়ের কি বিশেষ গুন বা স্বাদ তা আমি জানিনা তবে দামটা বড্ড বিস্বাদ জাগায়-পাউন্ড দেড় দু হাজার ডলারের কম-না!(তথ্যে ভুল থাকতে পারে)
সিলেটে চা বাগানে বসে ওদের সেরা সিলেটি চা, দার্জিলিং এ বসে দার্জিলিং টি চায়ের আদি ভুমি নাকি চায়নায় বসে চাইনিজ টি আর দুর দেশ থেকে বহুদামে কিনে আনা বিখ্যাত শ্রীলন্কার চা খেয়ে পার্থক্যটা খুব বেশী উপভোগ করিনি আমি।
তবে হ্যা বহু বছর আগে বান্দরবানের রিগরিংখ্যানে এক রেস্টুরেন্টের বারান্দায় কুয়াশায় ভেজা শীতের প্রত্যুষে এককাপ চায়ে চুমুক দিতে ই যে অনুভুতি হয়েছিল তার ঠ্যালায় উগড়ে ছিলাম একখান ভেজা ন্যাতানো দু-লাইনের কবিতা;
মেঘের পরে মেঘ জমেছে, পাহাড় জোড়া সারি সারি
কুয়াশায় ভেজা চায়ে চুমুক, জোড় ছুটেছে সপ্ন গাড়ি।
তবুও সব চায়ের স্বাদ ছাপিয়ে কিন্তু আমার ছাত্রজীবনে রাশিয়ার হোস্টেলের সেই চায়ের কথা আজও ভুলতে পারিনা।
রুশরা কি পানি খায়? আমি দেখতাম না তখন। হাড়ি হাড়ি মদ আর বিয়ার গিলছে-খাবারের টেবিলে শুকনো ফল সিদ্ধ করা নির্যাস, বাঙ্কা ভর্তি জুস গ্যালন গ্যালন দুধ আর গেলাস ভর্তি র-টি কিংবা ব্লাক কফি। এইতো দেখতাম পানীয়র মধ্যে। আমরাই খেতাম শুধু সরাসরি ট্যাপের পানি গেলাস গেলাস।
সকালের নাস্তার সাথে আমাদের দেয়া হত প্রমান সাইজের কেটলি ভর্তি চা কিংবা কফি। কফিতে তখনো অভ্যস্ত হইনি। শীতের দেশে শরিরটা গরম রাখতে চা-ই খেতাম। মোটা মোটা সস্তা কাচের গেলাস ভর্তি ধোয়া ওঠা চা প্রথম দিনেই আমি এক চুমুক দিয়ে বমির জন্য দৌড়েছিলাম।
রাশিয়া তাদের অফুরন্ত খনিজ সম্পদ গোলা বারুদ ট্যাঙ্ক কামান এইসব দিয়ে বন্ধু প্রতীম রাস্ট্র ভারত থেকে বিনিময়ে নিত বিলাস সামগ্রী আর চা ( সাথে হয়ত অন্য কিছুও-আমার জানা নেই)।
এমন জঘন্য সেই পেস্ট যা মুখে দিলে দাত যেন আরো বেশী নোংড়া হয়ে যেত আর ওদের সাবান গায়ে মাখলে গায়ে যেন আরো বেশী ছ্যাতা পড়ত।
রুশরা মনে হয় ওই পেস্ট আর সাবানের ভয়ে সারা শীতকাল দাত না মেজে গোসল না করে কাটিয়ে দিত(রুপক! ওদের অমন হলদেটে দাত এই পেস্টের অমুল্য উপহার মনে হয়।)
আর চা পাতার কথা কি বলব? একবার ব্যাবহার করে ফেল দেয়া পাতি দিয়ে মনে হয় তার থেকে অনেক উত্তম পানীয় হত!
যেমন তার সোয়াদ তেমনই বোটকা গন্ধ! সেটা বাদ দিয়ে কফি খেতে গিয়ে একই দশা। অতএব অতিচেনা চা-কেই আলিঙ্গন।ক’দিন বাদেই আমরা রুশদের অনুকরন করলাম। পানি বাদ দিয়ে সারাদিন জুস চা দুধ এসব দিয়ে কাটাই।ওদিকে আমাদের হোস্টেলের ডাক্তার মশাই ছিলেন মনে হয় চা-য়ের ব্রান্ড এ্যাম্বাসেডর।! এমন চা ভক্ত লোক আমি আর এ জীবনে দেখিন। পেট ব্যাথা ডায়রিয়া আমাশয় সর্দি কাশি হাচি মাথা ব্যাথা যা-ই হোক না কেন তিনি পেসক্রাইব করতেন চা শুধু গেলাস ভর্তি গরম চা।
আমার একবার পা মচকে গেলে উনি ঔষুধ পথ্য না দিয়ে নিরাময় পত্রে উনি শুধু বড় বড় হরফে লিখে দিলেন-চায়ে(রুশ ভাষা চায়ে অর্থ চা)।
আমার তখন ধারনা জন্মেছিল রুশ দেশে মেডিকেল স্টুডেন্টদের শুধু চা দিয়েই সব রোগ নিরাময়ের ট্রেনিং দেয়া হয়। শুধু 'চায়' শব্দটা লিখতে পারলেই ডাক্তারি পাশ! কি মজা!
তবুও সেই একখানা মাত্র নিরাময় পত্র নিয়ে আমি আজও হাল তবিয়তে আছি!
(পোস্টে তথ্যগত ভুল থাকলে সাহায্য প্রার্থণীয়।)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ দুপুর ১২:৫৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




