(প্রথম যৌবনে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভালবাসা প্রেম নয় উপন্যাস পড়ে এমন দূদান্ত মোহ আর আকর্ষনের শেষ পরিনতিতে নিদারুন বিস্মিত ও বিমর্ষ হয়েছিলাম-ভাবতাম মানুষ কিভাবে পারে তার ভালবাসাকে এমন নির্মমভাবে পদাঘাত করতে! তার কিছু পরে মুজতবা আলীর শবনম যার বাংলা অর্থ শিশির বিন্দুতে এমন সুন্দর একটা প্রেমের ব্যার্থ পরিসমাপ্তিতে ব্যাথিত হয়েছিলাম! প্রথম যৌবনের সেই আবেগী পুরুষের ওই সময়টায় প্রেমের প্রতি ভীষন বিতৃষ্ণা জেগেছিল- নাহ এই জীবনে আর প্রেম নয়।)
আজ অব্দি পৃথিবীতে কত লক্ষ ছত্র কবিতা গান গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ লেখা হয়েছে তার কোন ইয়ত্বা নেই! প্রত্যেক লেখকই তার নিজস্ব স্টাইলে বলতে চেয়েছেন ব্যতিক্রমী প্রেমের উপখ্যান। প্রেমিকেরা করতে চেয়েছে প্রেমকে মহিমান্বিত আর বিরহীরা প্রেমের নগ্ন ব্যাবচ্ছেদ!
কালে ভদ্রে দু-য়েকটা বিরল প্রেম কাহিনীর আর স্থান কাল পাত্রের কথা বাদ দিলে সব প্রেমের গতি প্রকৃতি আর পরিনতি প্রায় একই। প্রত্যেক প্রেমিকের কাছেই তার প্রেমিকা অনন্য দারুন রকমের রোমান্টিক-আর প্রেমটাও আর দশ পাঁচটা এলেবেলে প্রেমকাহিনীর মত নয়-একদম ব্যাতিক্রম!
এক সময় আমিও ছিলাম তাদের দলে। এখন ভাবি কি বোকাটাই ছিলাম না আমি।
তবুও একদম ব্যাতিক্রম না হলেও একটু অন্যরকম দু-য়েকটা প্রেম কাহিনী বলতে ক’দিন ধরে ভীষন মনে চাইছে। প্রত্যেকটা ঘটনাই বাঙ্গালী যুবার সাথে বিদেশীনীর( আবার সেই আমার পুরনো কাসুন্দি; রুশীয়-বেলারুশ, মলদোভিয়ান আর উক্রাইনের ললনা)প্রেম কাহিনী! ঘটনার পাত্র-পাত্রী আজ-অব্দি বহাল তবিয়তে বেঁচে বর্তে আছেন। তাই নাম ধাম সহ আরো কিছু ব্যাপার যার প্রকাশ তাদের বিব্রত করতে পারে কিংবা ব্যাথিত করতে পারে সে জন্য গোপন রাখলাম।
রুশীয় ভালবাসায় প্লেটোনিক লাভের তেমন কোন বালাই নেই(কালে ভদ্রে দু-য়েকটা থাকতে পারে)। প্রেম কথাটা আসলেই শারিরিক বিষয়টা এসে পরে অবধারিত ভাবে!
তার মানে কি ভালবাসাকে ওরা একেবারেই মুল্যায়ন করেনা? অবশ্যই করে। ওরাতো বলেই ‘মোজ্বনা স্পাত(স)ম্নোগম-নু লুবভ মোজ্না তোলকা আদনোম!’এর সহজ বাংলা অর্থ দাড়ায়’বিছানায় যাওয়া যায় অনেকের সাথে কিন্তু ভালবাসা যায় শুধু একজনকেই!' আহ্ কি মহান বাণী!
যদিও বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই প্রেমে পড়ার প্রথম রাতেই সেটা গড়াগড়ি খায় বিছানায় চরম উন্মাদনায়। কিন্তু প্রেম শুরুর প্রথম পর্বে ওদের ভালবাসার মাখামাখি দেখে হিংসে হয়!মনে হয় এমন করে ভালবাসতে পারেনা আর কোন জাতি। আমার এই একটু অন্যরকম প্রেম এর লেখায় তাই শরির ছোয়াছুয়ির ব্যাপারটা বাদ দিতে পারিনি। সেজন্যই লেখার কিছু অংশ প্রাপ্ত বয়স্কদের মনোরঞ্জন করলেও অপ্রাপত বয়স্ক আর রুচিশীল পাঠকরা একটু আহত হতে পারেন- সেজন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি শুরুতেই। (অনেক বড় গল্প কিংবা কাহিনী পুরোটা লিখতে বছর খানেক লেগে যেতে পারে! ব্লগারদের ভাল লাগলে গল্প হবে তিনখানা-না হলে একটাতেই খতম! )
. আলকাশ
[আলকাশের সঠিক বাংলা অভিধানিক অর্থ আমার জানা নেই। মদে যার প্রচন্ড আসক্তি-মদ ছাড়া যে একটা মূহুর্তের কথা ভাবতে পারেনা তাদেরকে রুশীয়রা তাচ্ছিল্য করে ‘আলকাশ’বলে ডাকে। ইংরেজীতে যাকে বলে ‘এ্যালকোহলিক’(কিন্তু আলকাশ শব্দের অর্থ ঠিক এ্যালকোহলিক নয়, এটা কিছুটা বিদ্রপাত্মক, কিছুটা শ্লেষাত্মক-আবার কিছুটা মজা করার জন্যও বন্ধু বলে বন্ধুকে কিংবা প্রেমিক প্রেমিকাকে) এর অর্থ আমরা ধরে নিই মদ-আসক্ত। যাকে নিয়ে আমার এই লেখা তাকে আমি ঘনিষ্ঠ ভাবেই চিনি। প্রায় এক যুগেরও বেশী সময় তার সাথে কোন যোগাযোগ নেই। আমার সেই বন্ধু নিজে থেকেই হারিয়ে গেছে-হয়তো চিরতরে…। এই লেখাটা তাকে উৎসর্গ করছিনা –করছি ভাগ্য বিড়ম্বিতা সেই বিদেশীনিকে;যাকে সে ভালবেসেছিল।]
বহু বছর বাদে মস্কো গিয়েছি। আমার দেখা চেনা সেই পুরোনো মস্কোর সাথে এই মস্কোকে যেন কিছুতেই মেলাতে পারছিনা। এত অল্প ক’ বছরে এমনি ভোজবাজির মত কোন শহরের আমুল পরিবর্তন হতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে আমরই বিশ্বাস হতনা। পরিবর্তন শুধু শহরটার নয় আমার পুরোনো বন্ধুদের অর্থনৈতিক আর মানসিক পরিবর্তনও চোখে পড়ার মত। বেকার ছেলেগুলো এই সামান্য কয়েক বছরে কোটিপতি বনে গেছে! কি অবিশ্বাস্য পরিবর্তন! আমার প্রানের দোস্ত যে কিছুদিন আগেও কোন পথে ইতাল- জার্মানী যাওয়া যায় সেই ধান্দায় ব্যাস্ত ছিল সে এখন বড়সড় কেউকেটা ব্যাবসায়ী। বাঙ্গালী কমিউনিটি যাকে এক নামে চেনে!
ওর অফিসে বসে আছি বেশ কিছুক্ষন। কাজের ফাকে ফাকে আড্ডা চলছে। হঠাৎ কার সাথে যেন রাগী স্বরে কথা বলে রিসিভারটা আমার দিকে এগিয়ে দিল-‘ধর -কথা বল!’
আমি প্রশ্ন করলাম-কে?
সে কপাল কুচকে বিরক্ত হয়ে বলল- ধরে দ্যাখ কে!
-হ্যালো!
ওপাশ দেখে একটুক্ষন চুপ, তারপর নিরুত্তাপ কন্ঠে বেশ হালকা স্বরে কেউ বলল-কে মিশু ভাই নাকি?
আরে! আমি উত্তেজনায় লাফ দিয়ে উঠলাম-মইন ভাই? কেমন আছেন রে ভাই? আপনাকেইতো খুজছি!
ওপাশ থেকে মইন তেমনি আবেগহীন কন্ঠে বলল- এইতো আছি! মস্কো এসেছেন কবে?
-এইতো গতমাসে। আপনার কথা বলেন? কত লোককে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার খবর কেউ বলতে পারেনা! এখন কোথায় আছেন আপনি?
-এইতো আপাতত লুবভ এ আছি।
-কি করছেন ওখানে? লারিসা কই?
আবার একটুক্ষন চুপ- এইতো ব্যাবসা বানিজ্য করছি। আপনি কিছু জানেননা? লারিসার সাথে আমার সেপারেশন হয়ে গেছে!
-তার মানে! ভীষন বিস্মিত তখন আমি। কবে কিভাবে? আর আপনার ছেলে?
-মিশুভাই আমি এখন রাখি পরে কথা বলব।এই নাম্বারে ফোন করলেতো আপনাকে পাওয়া যাবে?
-হ্যা ফোন করলেই আমাকে ডেকে দিবে। আপনি কিন্তু পরে অবশ্যই ফোন করবেন। অনেক কথা আছে।
-ঠিকাছে। বলতেই ওপাশ থেকে লাইন কেটে গেল।
ফোন রেখে আমি আমার বন্ধুর দিকে তাকালাম।সে তখনো রেগে আছে। ফোনে আমার উচ্ছাস তার হয়তো পছন্দ হয়নি!
-মইন কি তোর কাছে মাঝে মধ্যেই ফোন করে?
-হ্যা করে। শালা একেকবার একেক জায়গা থেকে ফোন করে।ফোন করেই কান্নাকাটি শুরু করে-ওর অবস্থা খারাপ খাওয়ার পয়সা নাই। কিছু টাকা ধার দ্যান-এই সব।
আমি উত্তরোত্তর বিস্মিত হচ্ছি! জামান এইসব কি বলছে? মইনের অবস্থা এত খারাপ!
- তুই টাকা পয়সা দিছিস কিছু?
- প্রথম প্রথম দিতাম। এখন আর দেইনা। শালার ভাওড়া-পয়সা পাইলেই মদ খেয়ে উড়িয়ে দেয়!
- তার মানে তুই ওর খবর জানতি। আমাকে এদ্দিন লুকিয়েছিস কেন?
- হ্যা জানতাম, ফালতু যোগাযোগের দরকার আছে? প্রথম দিন গল্প করবে –পরদিনই টাকা চাইবে। তুই টাকা দিবি কোত্থেকে?
- তাই বলে! তুইতো জানিস ওর সাথে আমার কি সম্পর্ক?
- হ্যা জানতাম। মিশু বাদ দে। ও এখন পুরা বাতিল। ও শালা পুরা আলকাশ হয়ে গেছে। এই মইন আর সেই মইন নাই। আমি আগে সহানুভুতি দেখিয়ে মাঝে মধ্যে টাকা পয়সা দিতাম।পরে যখন বুঝলাম-ইমোশনাল ব্লাক মেইল করছে -তার পর থেকেই পয়সা কড়ি দেয়া বন্ধ করেদিলাম।
- লারিসার সাথে যে ছাড়া ছাড়ি হয়ে গেছে তুই জানতি?
- হ্যা জানতাম। দোষ সব ওই শালা আলকাশের । মদ খাবে না সংসার চালাবে! পারলে ছেলের দুধ বেচেও মদ খায়!
- কি বলিস এই অবস্থা! ছেলেটা কি লারিসার কাছেই আছে?
- হ্যা।
দিন তিনেক বাদেই ফের মইনের ফোন পেলাম।এবার একটু উৎফুল্ল উচ্ছাসিত! অনেক্ষন কথা হল। কথায় যেন সেই পুরোনো দিনের আমেজ।
-মিশু ভাই একটা কথা বলি কিছু মনে কইরেন না?
-বলেন কোন সমস্যা নাই।
-আপনার হাতে কি টাকা পয়সা আছে কিছু? আমি বেশ সমস্যায় আছি।
- কত টাকা?
- এই শ’পাচেক ডলার। থাকলে দেন- সপ্তাহ খানেক পরেই ফিরিয়ে দেব।
- নারে ভাই এত টাকাতো আমার কাছে নাই। দেখি ব্যাবস্থা করতে পারি কি না।
- একটু দেখেননা। আপনার বন্ধুদের কাছে বলে। খুব উপকার হয়।
-দেখি চেস্টা করে। কি সমস্যা বলা যায়না?
- না এখন না পরে বলব। প্লিজ একটু দেখেন না।
ফোন রেখে আমি জামানের কাছে গেলাম টাকা ধার চাইতে। জামান অনেক গাইগুই করেছিল। কিন্তু আমি ছিলাম নাছোড় বান্দা। মইন, যদি আমার টাকা নিয়ে মদ খায় তাও ভাল। তবুও ভাবব-তার ঋন একটু খানিক হলেও শোধ করতে পেরেছি।আমার চরম দুঃসময়ে দেবদুতের মত আবির্ভাব হওয়া এইসব বন্ধুদের সামান্যতম উপকার করতে পারিনি কখনো। সুযোগ এসেছে কিছুটা হলেও শোধরাবার...
...প্রথম পর্ব শেষ
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০২১ রাত ৮:৫২