ঢাকার নামকরন নিয়ে প্রথম কিংবদন্তি
অনেক ঐতিহাসিকের মতে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকাকে সুবাহ্ বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ, ভারতেরপশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং উড়িষ্যার বেশকিছু অঞ্চল) রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন;তখন সুবাদার ইসলাম খানআনন্দের বহিঃপ্রকাশস্বরূপ শহরে ঢাক বাজানোর নির্দেশ দেন। এই ঢাক বাজানোর কাহিনী লোকমুখে কিংবদন্তির রূপ নেয় এবংতা থেকেই শহরের নাম ‘ঢাকা’হয়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, মুঘল সাম্রাজ্যের বেশ কিছু সময় ঢাকা সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রতিসম্মান জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর নামে পরিচিত ছিলো।তাছাড়া ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্বের চাঁনমাল সরদার ছিলেন ঐতিহ্যবাহী পুরানঢাকার নারিন্দা, ওয়ারি, ধোলাইখাল, গেন্ডারিয়া, সূত্রাপুর, সদরঘাট, সিদ্দিক বাজার সহ আশেপাশের সকল এলাকার সরদারযিনি পুরনো ঢাকার উন্নয়নের লক্ষ্যে তার ও তার সমগ্র পৈতৃক সম্পত্তি ভান্ডার বিলিন করে দেন।
ঢাকাইয়া নাটকগুলি দেশজুড়ে জনপ্রিয়,এমনকি ভারতীয় চলচ্চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায়ওএই উপভাষায় সংলাপ লিখেছেন। ঢাকাইয়া কুট্টি লোককথা সমূহ "কুট্টি কৌতুক" নামে এবং সাধারণত উপভাষার রম্য দিকের জন্য বিখ্যাত।
এটিকে বাংলা উপভাষাগুলির মধ্যে একটি মর্যাদাবান উপভাষা বলে মনে করা হয়। সাধারনত ‘ঢাকাইয়া’ লোকগাঁথায় উল্লেখিত; তারা বহিরাগতদের বা অঢাকাইয়া বাঙ্গালিদের ‘গাঁইয়া’ নামে অভিহিত করে আর কোলকাতানদের ‘ডেমচি’ নামে ডাকে।
সত্যজিৎ রায়ের ‘ছিম্বল’ ও পুরান ঢাকার বক্সার মিয়া:
-----------------------------------------------------------------------------
বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাস দেড়েক পরে সত্যজিৎ রায় ঢাকায় এসেছিলেন। বক্তৃতা দেন ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে। আহামরি নয়,একেবারেই মামুলি।
একটি বাক্যে পুলকিত আমরা; এই আমার পিতৃ-পুরুষের দেশ। কী করে ভুলি বাংলাদেশ,কেউ কি ভোলে?...
প্রতিটি শব্দ কানের ভেতর ঢুকে এখনও সেঁধে আছে। কেন থাকবেনা। ছিলুম মঞ্চের সামনেই। দেখি আপাদমস্তক। পরনে সাদা পাঞ্জাবি, পায়জামা। ভরাটকণ্ঠ। আগে শুনিনি। পাশেই কলতাবাজারের ঢাকাইয়া কুট্টির কথা,
-এই হালারপোর কাছে আমাগো শ্যাখ ছাহাব(শেখ সাহেব।বঙ্গবন্ধু।)লম্বায় খাটো হইব।
মাগার,কলকাত্তার ডায়লগে লেচকার ঝাড়ে। হালায় নাকি বহুত কামিল।
-----------------------------------------------------------------------
সত্যজিৎ রায়ের সাথে নিন্মের সরস আলোচনাটা নির্বাসিত কবি- দাউদ হায়দারের স্মৃতিচারন থেকে নেয়াঃ ( পাঠকদের কাছে অনুরোধ, কুট্টি ভাষা কম জানলেও চলবে- কিন্তু লেখাটা দু’বার কুট্টি ঢঙ্গে জোরে জোরে পড়বেন, তাহলে হয়তো আসল স্বাদ পাবেন।)
কলকাতার ৭ নম্বর যতীন বাগচী রোড। সপরিবারে নিচের তলায় ভাড়াটে সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়। ইউএসআইএস (৭ নম্বর জওহরলাল নেহরু রোড। এখন নাম ও স্থানের বদল।)-এর প্রোগ্রাম ডিরেক্টর।
সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাটে, প্রায়-প্রতিবার বিকেল সন্ধ্যায় জমজমাট আড্ডা। বহু রথী-মহারথীর উপস্থিতি। শিল্পীসাহিত্যিক, গায়ক-গায়িকা, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, রাজনীতিক মায় ভবঘুরেও।
এক আড্ডায় কথা উঠলো সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ ছবি নিয়ে। নানা মুনির হরেক মতামত। অর্থনীতিবিদ-অধ্যাপক সত্যেশ চক্রবর্তী (কবি বিষ্ণু দে’র বড়ো জামাই) খাঁটি ঢাকাইয়া বাঙাল। বললেন, ‘এইটা (অশনি সংকেত) হইলো দুর্ভিক্ষের রোমান্টিক সিম্বলিক ফিলিম।’
- শুনে,আমি সশব্দে হেসে বলি, ‘সিম্বল?’
- এই কথায়, কেউ-কেউ চোখ খাটো করে, রাগমাখা কণ্ঠে জানতে চান, ‘হাসার কী আছে?কারণ কী?’
- বলতেই হয়। বলায় যে কী বিপদ, চারদিন পরে হাড়েমজ্জায় টের পাই। সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় টেলিফোন করে বললেন, ‘কাল বিকেল পাঁচটায় আমার অফিসে আসবি। মানিকদার ওখানে যাবো। মানিকদা তোকে দেখতে চান, তোর সঙ্গে কথা বলতে চান।’ স্থির বিশ্বাস হয়, সত্যজিৎ রায় আগামী ছবির জন্যে নতুন নায়ক খুঁজছেন, চেহারা দেখে, কথাবার্তা শুনে নিশ্চয় নির্বাচন করবেন। অভিনয় না-জানলেও শিখিয়ে দেবেন।
সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় দেখেই বললেন, ‘কী রে, এত মাঞ্জা মেরে এসেছিস কেন? ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়েছিস মনে হচ্ছে। শুরুতেই টাস্কি খেলুম।
ট্যাক্সিতে যেতে-যেতেও সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় খোলাসা করেননি রহস্য। উত্তেজনায় কাঁপছি।
পৌঁছে গেলুম সত্যজিতের ১ নম্বর বিশপ লেফরয়েড-এর বাড়িতে। দরোজা খুললেন সত্যজিৎ রায়। দেখে বুক, হাত-পা কাঁপে (পরে অবশ্য বহুবারই গেছি, নানা অছিলায়। নিজেও ফোন করে ডেকেছেন বিভিন্ন কারণে। থাক সে সব।)চা এলো।
সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন,‘ওর নামই দাউদ হায়দার।ওর কাছেই বিস্তারিত শুনুন।’
সত্যজিতের প্রশ্নঃ‘তুমি নাকি আমাকে নিয়ে কী সব বলেছো সুপ্রিয়’র বাড়িতে? সুপ্রিয় বলেনি,বলেছে তোমার মুখেই শুনতে।’
-আকাশ থেকে পড়ি না, গা গতরও জখম হয় না, প্রায়-আধমরা। মৌন। তা হলে নায়ক-টায়ক নয়, উবে গেলো আশা। স্বপ্ন কুহকিনী।
সত্যজিৎঃ বলছো না কেন?
- না, কিছু বলিনি তো।
সত্যজিতঃ বলোনি? কী সুপ্রিয়...?
সুপ্রিয়ঃ মানিকদাকে নিয়ে ঢাকাইয়া কুট্টির সিম্বলের গল্পটা বল।
- বলা যাবে না।
সত্যজিৎঃ কেন?
- আপনাকে ‘হালা’মানে শালা বলতে হবে।
সত্যজিৎঃ -আমাকে শালা বলবে?
-বলতেই হবে। উপায় নেই। জানেন,বাপ ছেলেকে হালা বলে,ছেলে বাপকে হালা। ঘরোয়া তথা আত্মিক সম্বোধন। হালা কলোকুয়াল। আরবি ভাষায়,- হালা সুন্দরী ও সুখী। ঢাকাইয়া কুট্টিদের নিত্যবেলার মুখের বুলি হালা,ছোট-বড় বয়স মানেনা। এবং এই নিয়ে কেউ ঘিলু খামচায় না।
-জানি, কুট্টিরা কথায় কথায় ‘হালা’ বলে।
আমি,- যদি অনুমতি দেন,ঘটনা বলতে পারি?
-তারমানে, তুমি আমাকে হালা বলবেই?
সুপ্রিয় বন্দোপাধ্যায় বলল,
-একটু কম বলিস। আচ্ছা বল।... যেন সত্যজিতের হয়ে তিনিই অনুমতি দেন। সত্যজিতের মুখ ভয়ঙ্কর গম্ভীর। পরিবেশ থমথমে। লজ্জা ও ভয়ে শরীরে কাঁপুনি আমার। কয়েক সেকেন্ড কেটে যায়।
সত্যজিৎ রায় বললেনঃ -শুরু করো।
পুরান ঢাকার বকশিবাজারের বক্সার মিয়ার বহুত ঝনঝনানি(টাকাকড়ি)। খরচের অলিগলি-মাঠ-ময়দান নাইক্যা। বক্সার মিয়ার খায়েস জাগছে টকি খ্যালাইবো (সিনেমা বানাবে)। বনছলের(আর ডি বনসল) ল্যাহান নাম ফাটাইবো দুনিয়ায়। এই হাউস লইয়া, রিসকায় চইড়্যা,গায়ে লাল পাঞ্জাবি,গলায় ফুল তোলা রুমাল,পরনে সফেদ লুঙ্গি, ডাইন পায়ের উরপে(উপরে)বামটা তুইল্যা ঢাকার ফিলোম স্টুডিওয়(এফডিসি)গ্যাছে। গ্যাটম্যানরে হুকুম ঝাড়ে,
-এইহালায়,তোগো মহল্লায় ক্যাঠায়-ক্যাঠায়(ডিরেক্টর)টকিস খ্যালায়? ডাইক্যা লইয়া আয়। জলদি যা,
-এই ল দুই পাত্তি (দশটাকা,দশটাকা)।
বক্সার মিয়ার নাম হুইন্যা দুই খ্যালোয়ার(ডিরেক্টর) হাইজাম্প দিয়া আইয়া ছালাম ঠোকে।
বক্সারমিয়াঃ-তুমরা হালায় টকি খ্যালাও?
দুই পরিচালক (বুকখোলা। দু'জনের বুকেই সোনার চেন।)
-দেইখখ্যা ও কি মালুম হয়না?
বক্সারমিয়াঃ এক্ষণে হইছে। ওই হালারা,কলিকাত্তার বনছল পোরডিউছার হালার নাম হুনছ? ওই বনছল মিয়া আর ছোত্যযিত হালার টকি খ্যালায় ( সিনেমা বানায়)। দুই হালায় তামাম দুনিয়ায় চক্কর মারে। বনছল পোরডিউছার হইয়া বহুত নাম ফাটাইছে। ছোত্যযিত মিয়া ছিম্বলের টকি মারে ( সিম্বোলিক ফিল্ম করে)। তুমরা হালারা,ছোত্যযিত হালার ল্যাহান টকি খ্যালাইবার পারবা?
দুই পরিচালক কয়ঃ পারুমনা মানে,আমাগো হালায় পোলাপান পাইছেন? ডবল ছিম্বল খ্যালামু। ছোত্যযিতের উস্তাদ হইয়া যামু। আফনিও (আপনিও)হালায় বনছল হইবেন।
বক্সারমিইয়াঃ-টকির দুই সটের(সিনেমার দুই শটের)কাহানি লাগাও?
প্রথম পরিচালকঃ বিহান বেলায় সুরয ওঠে আর ডোবে,প্রেমিক-প্রেমিকা রমনা পার্কে। লা জবাব। ঝিরিঝিরি হাওয়া। প্রেমিকার ছিনার উড়ূনি খইস্যা ( বুকের ওড়না খুলে) ঘাসে লুটায়। লভর (প্রেমিক)খাবি খায়। এইটা হইলো নয়া ছিম্বল (সিম্বলিক শট)
বক্সারমিয়াঃ ওই হালা,আমারে ছাগলনাইয়ার পাগলা পাইছো? সুরয ডোবে আর ওঠে? বিহানবেলায় উড়ূনি পিন্দায়ে জগিং মারে ( সকালে ওড়না পড়ে জগিং করে?)? ছিম্বলের মাজেজা হিগাইয়া আমারে টিচিং দিবা? টাল্টিবাল্টি ঝাইড়ো না।
দ্বিতীয় পরিচালকঃ
-রাইতের আসমানে এক ফালি চান (চাঁদ)। ফাগুন মাস। জোছনা টাঙ্কি মারে নদীর ঢেউয়ে। ম্যাঘ আইয়া ফুচকি মারে। লভর-লাভার কচি ধুতরা ফুল মুখে হান্দায়,না চিবাইয়া কিসিং করে। মহব্বতের এই ছিম্বল- ছোত্যযিত দেখাইতে পারবো?
বক্সারমিয়া কয়ঃ এই হালার হালা,আমারে কাছিমপুরের কাওঠা (কাছিম)পাইছো? আসমানে এক চিলতে চান(চাঁদ),তুমার মরা বাপ হালায়- গোর ত্যান বাই পোস্টে জোছনাম্যাঘ পাঠাইছে?
বক্সার মিয়াঃ
-লভর কি বিষ ধুতরা খায়? দিমুনে চটকানি। আচ্ছা টকির প্লটে কি ছিম্বল অইব কই; ছাহারা ডেরজারট। চোত মাসের দুপ্পুরবেলা। মধ্যিখানে পার্ক। টবের গাছগাছালি কালার দিয়া সাজাইবা- সব কালারের ফুল সদরঘাটে পাইবা। কাগজের গাছ ও- কাগজের বহুত কালারের ফুলও পাওন যায়। ছব হাচা মনে হইবো।
পার্কের এক ফার্লং তফাতে সইরছা খ্যাত,পটলের খ্যাত। মনে লয় তো একখান কদম গাছও লাগাইও। কদমফুলও। চোত মাসের ছাহারায় লভর-লুভর সানবাথ করবো। কসটিউম বেশি ছোট কইরো না। সেন্সর আটকাইবো। পাবলিকে পেঁদাইবো।
যহন ডেরেস চেরেন্জ করত্যাছে,হঠ্ঠাস ওল্ড লভর হাজির। শুরু হইলো ওল্ড আর নব্যর (নতুন লাভারের) ফাইট। ওল্ড- ভিলেন। নব্য- হিরো। ঢিসুমঢুসুম চলত্যাছে,চলত্যাছে। নব্যর বলো (ঘুষি) ছুটত্যাছে ওল্ডের ডাইন চোক্ষে। কাট!
অহন কও,কী ছিম্বল অইব?
দুই পরিচালক চুল ঝাঁকিয়ে,মাথা খামচিয়ে নানা ‘ছিম্বল’ বললে।
বক্সারমিয়াঃ
-ধুর হালারা,তুমরা হালা ছোত্যযিত হইবার পারবা না,আমিও হালায় বনছল। ওই যে বলো ছুটত্যাছে, কাট কইরা দেখাইবা সইরছা খ্যাত,ওল্ড সইরছা ফুল দ্যাখত্যাছে চোক্ষে।
দোসরা ছিম্বল; আরব দরিয়ার বিচে লভর-লুভর হাঁটত্যাছে। কোলাজ (ক্লোজ)মোসনে দেখাইবা। খবরদার,হাত ধরাধরি না। পাবলিকে পিটাইয়া তক্তা বানাইবো। আবার ওল্ডের লগে দেখা। ফাইট। চলত্যাছে,চলত্যাছে। নব্যর বলো ক্যারেন্টের ল্যাহান ছুটত্যাছে। কাট।
কও কী ছিম্বল?
প্রথম পরিচালকঃ
- ঢেউয়ে-ঢেউয়ে গর্জন। ঢেউ আর নট নড়নচড়ন।
দ্বিতীয় পরিচালকঃ
-নীল নদে আমেরিকা আর রাশিয়ার নাবিক হুইস্কি-ভদকা খাইত্যাছে। গল্গাসে-গল্গাসে ঠক্কর দিয়া ‘তুম হামারা কমরেড বইল্যা ডিসকো নাচত্যাছে’!
বক্সারমিয়াঃ
-তুমরা হালারা ঝিঁঝির পোলা। গুন্জরণ করো। নব্যর বলো ওল্ডের খোমার (মুখের)দিকে যাইত্যাছে, কাট কইরা দ্যাখাইবা,ওল্ড পটল তুলত্যাছে। কও,ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন ...
সত্যজিৎ রায় গলা-চড়িয়ে হেসেই বিষম খান। কয়েক সেকেন্ড ঘরময় আর কোনও শব্দ নেই। সত্যজিৎ স্থিতু হন।
সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়: পটল তুলল, মানে?
সত্যজিৎ রায় বললেনঃ ওল্ড প্রেমিক মারা গেছে। আচ্ছা, গল্পটি ঢাকাইয়া কুট্টির না তোমার?
-না আমার না, এটা চাঁদভাই মানে অভিনেতা গোলাম মুস্তফা ভায়ের গল্প।
কবি দাউদ হায়দার (জন্মই যার আজন্ম পাপ…) বাংলাদেশের প্রথম নির্বাসিত লেখক
'আমিও ভাবি তাই, ভাবি নতুন মডেলের চাকায় পিষ্ট হবো
আমার জন্যই তোমাদের এত দুঃখ
আহা দুঃখ
দুঃখরে!
আমিই পাপী, বুঝি তাই এ জন্মই আমার আজন্ম পাপ'।
কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়- অবশ্যই আপত্তিকর এমন কিছু কথা আছে যা চরমভাবে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত হানে! তিনি একসাথে তিন তিনটে ধর্ম অনুসারীদের ক্ষেপিয়ে তুলেছিলেন (কিন্তু মাত্র বাইশ বছের একজন সদ্য যুবক কি-ই বা বুঝত তখন?)।
যদিও পরে ক্ষমা চেয়েছিলেন-‘কোন ধর্মকে বা ধর্মবোধকে আঘাত করার অভিপ্রায় আমার ছিলনা।আমি নিজেও মুসলমান। আল্লাহ, রাসুল(দঃ) ও কোরানে আমি বিশ্বাস করি।অন্য ধর্মমতকে আমি শ্রদ্ধা করি।আমার কবিতার জন্য আমি শুধু লজ্জিত ও বিব্রত নই পীড়িত ও অপরাধ বোধ করিতেছি।ভবিষ্যতে আমি ওই কবিতাটি কোন বইতে অন্তর্ভুক্ত করিব না কিংবা কাহাকেও প্রকাশ করার অনুমতি দিব না’।
সেই সময়ে ক্ষমা করে দিলে কি হত জানিনা- তবে পরবর্তীতে তিনি তার কথা রাখেননি, হয়তো ক্ষমা পাননি বলে।
তবে আমার ব্যক্তিগতভাবে তার কবিতা’কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ বেশ কিছু বক্তব্যের ব্যাপারে চরম আপত্তি থাকলেও-সেইকবিতার কয়েকটা লাইন বেশ ভাল লাগে।
'আদমের সন্তান আমি; আমার পাশে আমি?
আমি আমার জন্ম জানি না। কীভাবে জন্ম?আতুরের ঘরে কথিত
জননী ছাড়া আরে কে ছিল? আমায় বলে নি কেউ।
আমার মা শিখালো এই তোর পিতা, আমি তোর মাতা।
আমি তাই শিখেছি। যদি বলতো, মা তোর দাসী, পিতা তোর দাস;
আমি তাই মেনে নিতুম। কিংবা অন্য কিছু বললেও অস্বীকারের
উপায় ছিল না।
আমি আজ মধ্য যৌবনে পিতা মাতার ফারাক বুঝেছি। বুঝেছি সবই মিথ্যা
বুঝেছি কেউ কারও নয়; কেউ নয় বলেই তো বলি
একদিন সবকিছুই যাবে চলে (চলে যাবে)'
দাউদ হায়দার একজন বাংলাদেশী বাঙালী কবি, লেখক ও সাংবাদিক, যিনি ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে দেশ থেকে নির্বাসনের পর বর্তমানে জার্মানীতে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। তিনি বর্তমানে একজন ব্রডকাস্টিং সাংবাদিক।তিনি একজন আধুনিক কবি যিনি সত্তর দশকের কবি হিসাবে চিহ্নিত। তার একটি বিখ্যাত কাব্যের নাম "জন্মই আমার আজন্ম পাপ"।
কর্মজীবন
সত্তর দশকের শুরুর দিকে দাউদ হায়দার দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৩ সালে লন্ডন সোসাইটি ফর পোয়েট্রি দাউদ হায়দারের কোন এক কবিতাকে “দ্যা বেস্ট পোয়েম অব এশিয়া” সম্মানে ভুষিত করেছিল। সংবাদের সাহিত্যপাতায় 'কালো সূর্যের কালো জ্যোৎসায় কালো বন্যায়' নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। ধারণা করা হয়ে থাকে, তিনি ঐ কবিতাতে হযরত মোহাম্মদ, যিশুখ্রীষ্ট এবং গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কিত অবমাননাকর উক্তি ছিল যা সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছিল। তার সংস্ অব ডেস্পায়ার বইতে এই কবিতাটি সঙ্কলিত আছে বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশে মৌলবাদী গোষ্ঠী এর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রতিবাদ শুরু করে। ঢাকার এক কলেজ-শিক্ষক ঢাকার একটি আদালতে এই ঘটনায় দাউদ হায়দারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন।
দেশত্যাগ
তৎকালীন বঙ্গবন্ধুরসরকার তখন চায়নি আন্তর্জাতিকভাবে মুসলিম সরকারদের সাহায্য হারাতে। ১৯৭৩ সালে কবিকে নিরাপত্তামূলক কাস্টডিতে নেয়া হয়। ১৯৭৪ এর ২০ মে সন্ধ্যায় তাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় সুকৌশলে ২১শে মে সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটা রেগুলার ফ্লাইটে করে তাকে কলকাতায় পাঠানো হয়। ওই ফ্লাইটে তিনি ছাড়া আর কোনো যাত্রী ছিল না।
তার কাছে সে সময় ছিল মাত্র ৬০ পয়সা এবং কাঁধে ঝোলানো একটা ছোট ব্যাগ (ব্যাগে ছিল কবিতার বই, দু'জোড়া শার্ট, প্যান্ট, স্লিপার আর টুথব্রাশ)।
কবির ভাষায়,-আমার কোন উপায় ছিল না। মৌলবাদীরা আমাকে মেরেই ফেলত। সরকারও হয়ত আমার মৃত্যু কামনা করছিল।
কলকাতা জীবন
কলকাতা ছিল তার কাছে একদম অচেনা বিদেশে যেখানে কাউকেই চিনতেন না। তিনি দমদম এয়ারপোর্টে নেমে প্রথমে কাঁদছিলেন। কলকাতায় তিনি সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষ এর কাছে প্রথম আশ্রয় পান। তিনি সেখানে একমাসের মতো ছিলেন। তিনি সেখানে লেখালেখি শুরু করেন। কলকাতার কঠিন বাস্তবতার মাঝে তিনি দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় লেখা শুরু করেন। তার জীবনে প্রেমও আসে সেখানে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই তরুণী, তাকে প্রেম নিবেদন করে। তারপরও তিনি বুঝতে পারেন যে তিনি একা কলকাতা শহরের মতোই। তিনি সেখানে একজন আগন্তুক মাত্র।১৬ আগস্ট ২০০৯ সালের সমকালে লেখা তার কলামে (বঙ্গবন্ধু ও অন্নদাশঙ্কর) দেখা যায় ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে 'আন্তর্জাতিক তুলনামূলক সাহিত্যের' ছাত্র ছিলেন। কলকাতায় তিনি সমাদৃত হন। অন্নদাশঙ্কর রায় তাকে নিজ বাড়ীতে আশ্রয় দেন। নির্বাসিত অবস্থায় ১৯৭৯ সালে তিনি ভারতেবাংলাদেশ দূতাবাসে নবায়ণের জন্য পাসপোর্ট জমা দিলে তা বাজেয়াপ্ত করা হয়। দাউদ হায়দারকে ভারত থেকেও নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৮৫ সালে পেন আমেরিকান সেন্টারের ২০০০ লেখকের পক্ষ থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটা চিঠি লেখা হয় যাতে দাউদ হায়দারকে ভারতের নাগরিকত্ব দেয়ার অনুরোধ করা হয়।
(ভারতে গিয়েও রক্ষা পাননি কবি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর জিয়াউর রহমান এর নির্দেশে তাঁর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়। হাইকমিশনার তাঁর বাসায় গিয়ে, বাসা মানে দাউদ হায়দার ভারতে যাঁর আশ্রয়ে থাকতেন সেই বাড়ীতে গিয়ে পাসপোর্ট নিয়ে আসে। ভারত সরকার তাঁকে ভারত ত্যাগের ফাইনাল নোটিশ দেয়- “… য়্যু হ্যাভ নো কেইস ফর গ্রান্ট অব লংটার্ম ষ্টে ফ্যাসিলিটিজ ইন ইন্ডিয়া এন্ড য়্যু আর দেয়ারফর রিকোয়েষ্টেড টু লীভ ইন্ডিয়া ইম্মিডিয়েটলি উইদাউট ফেইল।”
এর পর নোবেল লরিয়েট জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস ভারত সফরে এসে পুরো ঘটনা শুনলেন। কথা দিয়ে গেলেন তাঁকে “তোমার জন্য কিছু একটা করবো। তিনি জার্মান সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত কবিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা করেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এলে তিনি আটক পাসপোর্ট ফেরত চেয়ে আবেদন করেন। তার পাসপোর্ট ফেরতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এরশাদ সরকারও। এরশাদের আমলে ঘোষণা করা হোল, “এই লোক বাংলাদেশের জন্য সন্দেহজনক”- এই মর্মে পৃথিবীর যেসব দেশে বাংলাদেশ দূতাবাস আছে, সেই সব দেশে নোটিশ পাঠানো হল। নোটিশে বলা হল- “এই ব্যক্তিকে সরকারের পূর্বানুমতি ব্যতিরেকে কোনো পাসপোর্ট প্রদান করা যাইবে না। তাহার নাম সন্দেহজনক ব্যক্তিদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করিতে হইবে।’)
জার্মানীতে
জার্মানীর নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক গুন্টারগ্রাসের সহযোগিতায় ২২ শে জুলাই ১৯৮৭ সালে তিনি জার্মানীর বার্লিন শহরে যান এবং তারপর থেকে সেখানেই আছেন। উল্লেখ্য তিনি বার্লিন যাত্রায় পাসপোর্টের পরিবর্তে জাতিসংঘের বিশেষ ট্র্যাভেল পাস ব্যবহার করেছেন। দাউদ হায়দার পরে এই জাতিসংঘের ট্র্যাভেল পাস ব্যবহার করে বহু দেশ ঘুরেছেন। ১৯৮৯ সালে তিনি জার্মানীতে সাংবাদিক হিসেবে চাকুরী শুরু করেন।
তিনি প্রায় ৩০টির মতো বই লিখেছেন জার্মান, হিন্দি, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জাপানি ও স্প্যানিশ ভাষায়। -সমাপ্ত
সুত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন,ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষার অভিধান;মোশাররফ হোসেন ভূঞা,নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তির ঢাকা’, দৈনিক ইত্তেফাক। ইসলাম টাইমস। ছবিঃ নেট
ঢাকাইয়া কুট্টি নিয়ে ৪ পর্বের আলোচনার -এক পর্ব সমাপ্ত।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:১৩