somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঢাকাইয়া কুট্টিঃ 'চান্নিপশর রাইতের লৌড়' ও কবি জুয়েল মাজহার

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ বিকাল ৫:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ঢাকার নামকরন নিয়ে দ্বীতিয় কিংবদন্তীঃ
৭৫০ সাল থেকে ১১৬০ সাল পর্যন্ত ‘ঢাবাকা’ নামের ৪১০ বছরের সমৃদ্ধশালী বৌদ্ধ জনপদই আজকের ঢাকা মহানগরী। ১১৬০ থেকে ১২২৯ সাল পর্যন্ত মাত্র ৬৯ বছর ‘ঢাবাকা’ তথা ঢাকা জনপদ ছিল দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটক থেকে আসা হিন্দু সেনবংশ দ্বারা শাসিত। দিল্লির সুলতান ইলতুতমিশের আমলে তাঁর পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপতি মালিক সাইফুদ্দিন আইবেক সেনবংশের এ অঞ্চলের প্রধান সূর্যসেনকে যুদ্ধে পরাজিত করে গোড়াপত্তন করেন মুসলিম শাসনের। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত আনিস আহমেদের ‘ঢাকাইয়া আসলি’ গ্রন্থে এমন তথ্যই পাওয়া যায়। প্রাগুক্ত বইটির সূত্রে আরো জানা যায়, ‘ঢাবাকা’ শব্দটি সেকালের সরকারি ভাষা ফারসিতে উচ্চারিত হতো ‘ঢাওয়াকা’ বলে। একসময় শব্দের উচ্চারণগত বিবর্তনের ফলে এই শব্দটির স্বরবর্ণ ‘ওয়াও’ উহ্য হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে যা উচ্চারিত হয় ‘ঢাকা’ নামে।
মোঘল সম্রাট আকবরের আমলে ঢাকা ছিল বাজু অর্থাৎ থানা মর্যাদার একটি শহর। ১৬০৮ সালে মতান্তরে ১৬১০ সালের জুলাই মাসের কোনো এক সময়ে দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গীরের মনোনীত বাংলার সুবেদার ইসলাম খাঁ চিতশী তাঁর নৌবহর নোঙর করেন ঢাকার বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী সবচেয়ে উঁচু ভূমি চাঁদনীঘাটে। এসময় সুবা বাংলার রাজধানী হিসেবে পত্তন করেন ‘ঢাকা’র। সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ এ অঞ্চলকে ইসলাম খাঁ ‘জাহাঙ্গীরনগর’ নামকরণ করলেও পূর্বকালের ধারাবাহিকতায় এ জনপথের মানুষ ‘ঢাকা’ নামটিকেই ধারণ করেন স্থায়ীভাবে। তৎকালীন ঢাকায় ছিল অগুনিত মানুষের সমাগম। কারণ আঠারো শতকের মধ্যভাগে সুবে বাংলার রাজধানী ঢাকা ছিল বাণিজ্যের এক অন্যতম কেন্দ্র স্থল। সেসময় শস্য হিসেবে চাল ছিল পূর্ববঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ রফতানি পণ্য।
চাল রফতানিকারকদের সকলেই ছিলেন মাড়োয়ারি ও ভারতের মধ্য অঞ্চলের ব্যবসায়ী। তারা পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ধান সংগ্রহ করতেন। সংগ্রহকৃত বিপুল পরিমাণ ধান ঢেঁকিতে ভানার কাজে তারা নিয়োগ করতেন অসংখ্য স্থানীয় শ্রমিকদের। এসব ধান ভানার কাজে শ্রমিক আসতো মূলত ঢাকার আশপাশের অঞ্চল থেকে। দীর্ঘ দিনের এ কাজের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রমিকদের অবস্থান করতে হতো সেখানেই। এদিকে নিজেদের ভাব বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে তারা কথা বলতো ভিন্ন এক ভাষায়। ধান ভানার কাজে নিয়োজিত এই শ্রমিকদের মাড়োয়ারিরা সংক্ষেপে ‘কুট্টি’ নামে ডাকতো।*
মুঘল আমলে মূলত কুট্টি সম্প্রদায়, কুট্টি ভাষার উত্পত্তির কাল।(মোগল আমলে ঢাকাবাসীদের মধ্যে যারা মোঘল শাহীর অধীনে চাকরি করতেন অথবা জমিদার কিংবা ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে জড়িত ছিলেন তারা নিজেদের উঁচু স্তরের লোক ভাবতেন।তত্কালে যন্ত্রের কোনো প্রচলন ছিল না। মানুষকে নিজেদের চাহিদা মেটাবার সব রকম উপকরণ হাতেই তৈরী করতে হতো।
এইসব পেশাজীবীদের অনেকেই ধান কুটতো, যব কুটতো, ডাল কুটতো, ডাল কুটতো, সুরকি কুটতো, ইট কুটতো অর্থাত্ যে কোনো ধরনের কুটার কাজ যারা করতেন, তারা চিলেন খুবই দরিদ্র। ...অন্যদিকে তারা কুটার কাজ করতেন বলে শহরের উঁচু স্তরের লোকেরা এইসব কোটার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের ‘কুটিয়াল’ বলতো। সাধারণভাবে এদের কুট্টি বলেই ডাকতেন।)আঠারো শতকের মধ্যভাগ থেকে পূর্ববঙ্গে চাল একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্য ছিল। এবং সুবে বাংলার রাজধানী ঢাকা ব্যবসা-বাণিজ্যের বিরাট কেন্দ্রে পরিণত হয়।
চাল রপ্তানিকারকরা ছিল মাড়োয়ারি ও ভারতের মধ্য অঞ্চলের মানুষ। তারা পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন এলাকা থেকে ধান সংগ্রহ করত। সংগ্রহ করা বিপুল ধান ঢেঁকিতে ভানতে বা কুটতে হতো। এই ধান ভানা বা কোটার কাজে প্রচুর শ্রমিক নিয়োগ করতে হতো। এসব ধান কুটতে ঢাকার আশপাশ এলাকা থেকে শ্রমিক আসত। ধান কোটা বেশ পরিশ্রমলব্ধ কাজ। সুতরাং ধান কোটা শ্রমিকেরা ধান কুটেই ঢাকা ছেড়ে চলে যেত না। তারা আশেপাশেই থাকতে শুরু করল। যেহেতু ঐসব মেহনতি মানুষ কাজ করছে, একসঙ্গে থাকছে, গল্প করছে, সুখ-দুঃখ বিনিময় করছে, তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে একটি ভাষার জন্ম দিল। ধান কুটতে কুটতে তাদের আসল নাম ফেলে দিয়ে মাড়োয়ারিরা সংক্ষেপে ‘কুট্টি’ হিসেবে ডাকতে শুরু করলে, কালের পরিক্রমায় তারা ‘কুট্টি’ হিসেবেই পরিচিতি অর্জন করে। অর্থাত্ ধান কোটার কোটা থেকে ‘কুট্টি’ শব্দ বা সম্প্রদায়ের উত্পত্তি।
কুট্টি’ শব্দটা কানে আসতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে ধবধবে সাদা লুঙ্গি পরিহিত আর মুখভর্তি পান চিবোনো মুখচ্ছবি। কানে বাজে ‘আব্বে হালায়, ছমছ্যা কি।’ ঢাকার আদি অধিবাসী এই কুট্টিদের আসল পরিচয় কী? এরা কি আসলেই ঢাকার আদি অধিবাসী?
পুরনো ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক কুট্টিদের পড়ালেখার প্রতি তেমন খেয়াল দেখা যায় না। বরং এক প্রকার অনীহাই আছে বলা যায়। এই অনীহা জন্মানোর পিছনেও আছে ইতিহাস।
নবাব গনি তাঁর পুত্র নবাব আহসানউল্লাহর কাছে লেখা একটি চিঠিতে কুট্টিদের কথা পাওয়া যায়। সেই চিঠির কথা উল্লেখ করেন ড.মুনতাসীর মামুন তাঁর ‘ঢাকা সমগ্র’ গ্রন্থে। নবাব লিখেন,‘ঢাকার কুট্টিরা প্রজা নয়,কিন্তু তাদের প্রজার মতো ব্যবহার করতে হবে খান্দানের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য। এসব লোক যদি লেখাপড়া শিখে বাস্তব অবস্থা জানতে পারে তাহলে খান্দানের নেতৃত্বের পরিকল্পনা ছাড়তে হবে। তাদের অন্যভাবে টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করা যেতে পারে। কিন্তু স্কুলের ব্যবস্থা যেন না করা হয়।’
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
কলকাতার সল্টলেকে ঐহিক’র নিবিড় সাহিত্য-আড্ডা ও কবি জুয়েল মাজহারের ‘চান্নিপশর রাইতের লৌড় ’
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
ঐহিক’র নিবিড় সাহিত্য আড্ডাঃ

(ঐহিক পশ্চিমবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ একটি সাহিত্য পত্রিকা। ১৯৯০ সালে যাত্রা শুরু করা এ পত্রিকাটি ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করে।
বাংলাদেশের সাহিত্যকে পশ্চিমবঙ্গে আরও বেশি প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে ২০১৫ সাল থেকে কেবলমাত্র বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের‘ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা’ দেওয়া হয়ে থাকে। যেসব গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কোনো পুরস্কার পাননি তাদেরই এ সম্মাননার জন্য নির্বাচিত করে ঐহিক সম্পাদক পর্ষদ। এর আগে কবি মাসুদুজ্জামান,ফরিদ কবির, কাজল শাহনেওয়াজ প্রমুখ এ সম্মাননা পান।)
ঐহিকে’র একটা সাহিত্য আড্ডায় এসেছিলেন গৌতম বসু, একরাম আলী, সৈয়দ কাওসার জামাল, সমরজিৎ সিংহ, সুব্রত সরকার, রাহুল পুরকায়স্থ, রানা রায় চৌধুরী, কালীকৃষ্ণ গুহ, বহতা অংশুমালী, শতাব্দী দাস, অনিন্দ্য বর্মণ, ফরিদ ছিফাতুল্লাহ, কবি জুয়েল মাজহার, কবি মেঘ অদিতি, কথা সাজিত্যিক তমাল রায়।
অনাড়ম্বর নিমগ্ন এই পাঠ অনুষ্ঠানটি শুরু হয় কবি গৌতম বসুর কবিতা পাঠ দিয়ে। একে একে অগ্রজ ও অনুজদের কবিতা ও গল্প পাঠে সন্ধ্যে কখন রাতের দিকে গড়িয়ে গেছে, উপস্থিত সাহিত্যিকদের তা খেয়ালই হয়নি।
জুয়েল মাজহারের কবিতা পাঠ ছিল রীতিমত আকর্ষণীয়। ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষায় লিখিত 'চান্নিপশর রাইতের লৌড়' কবিতাটি পাঠ শেষে উপস্থিত সকলেই পাঠোল্লাসে বিস্মিত হন। প্রতিটি কবিতা পাঠই সোশাল মিডিয়ায় লাইভ দেখানো হচ্ছিলো এবং অত্যাশ্চর্যের বিষয়,দর্শকরা সরাসরি প্রিয় কবি ও গল্পকারদের কাছে তাদের প্রিয় কবিতা ও গল্পপাঠের অনুরোধ জানাচ্ছিলেন সোশাল মিডিয়াতেই।
তিরিশে পা দেওয়া ঐহিক ইতিমধ্যেই দু বাংলাতে সাহিত্য সংস্কৃতি সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে এক উল্লেখযোগ্য নাম। সারা বছর ধরেই দুই বাংলা জুড়ে এমন ছোট বড় বিবিধ অনুষ্ঠান বই ও পত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে তারা উদযাপন করবে তাদের ত্রিশতম বছর পূর্তি। একটি লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে যা এক মাইলস্টোন।
রাত ন'টায় এই নিবিড় পাঠ অনুষ্ঠানটির অন্তিম অধ্যায়ে অনেকেরই চোখে জল। ষাটের উল্লেখযোগ্য কবি কালীকৃষ্ণ গুহ তখন বটবৃক্ষের ন্যায় স্নেহের আলিঙ্গনে বুকে টেনেছেন জুয়েল মাজহারকে। অনুজ রাহুল পুরকায়স্থ অসুবিধে বোধ করায় জল এগিয়ে দিচ্ছেন অগ্রজ কবি,গৌতম বসু তার চিকিৎসকের সাথে নির্ধারিত এপয়েন্টমেন্ট বাতিল করে রয়ে গেলেন শেষ অবধি। ১৫০ ট্রেন ক্যানসেলড,রাণা রায়চৌধুরী ফিরবেন শ্রীরামপুর,তবু ফেরার তাড়া নেই।
যে কোনো সাহিত্য অনুষ্ঠানেই অগ্রজ কবিরা তার নিজ কবিতা পাঠ শেষে বিদায় নেন, অন্যের কবিতা না শুনেই! এই সাহিত্য সন্ধ্যা বিরল ব্যতিক্রম সে দিক থেকেও। শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত কেউ উঠে যাননি। এমন কি সভা শেষের পরও রয়ে গেলেন অনেকেই। আসলে প্রাণের সাথে প্রাণের মিলনের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলেই যেন এক পরিবার। মানুষী হৃদয়ে কোনো কাঁটাতারই চিরস্থায়ী নয়। সাহিত্য তা আরও একবার প্রমাণ করে দিলো।

সেদিন ঐহিকের সেই সাহিত্য আড্ডায় জুয়েল মাজহার পাঠ করেছিলেন তার ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষায় রচিত অনন্য সাধারন কবিতা-‘চান্নিপশর রাইতের লৌড়’
শুধু আমাদের ধারনা নয়- এপার বাংলা-অপার বাংলা সবারই ধারনা 'কুট্টি' ভাষায় সর্বকালের সেরা কবিতাখানি লিখেছেন, কবি জুয়েল মাজহার। এখানে তার কবিতাটা নিয়ে একটু আলোচনা না করলে 'কুট্টি’দের নিয়ে আলোচনা অপূর্ণ রয়ে যাবে।

উল্লেখ্য কবিতাটি আমি নিজে চেষ্টা করেছি চলতি বা কথ্য ভাষায় রুপান্তর করতে। কিন্তু খুব একটা সুবিধের হয়নি সেটা নিশ্চিত! কোন ভুল-ভ্রান্তি নজরে এলে ব্লগারদের কেউ ঠিক ঠাক করে দিলে কৃতজ্ঞ থাকব।
আমার মত যারা কুট্টি ভাষা কম বোঝেন বা যারা একেবারেই বোঝেননা তারা সহজেই মুল কবিতার রস আস্বাদন করতে চাইলে স্কিপ করে কবিতার চলতি ভাষায় রূপান্তরটা আগে দেখে নিতে পারেন।
ঢাকাইয়া ভাষা ভাল জানা না থাকলে চেষ্টা করুন কুট্টি স্টাইলে দুই তিনবার শব্দ করে পড়তে-(খানিকটা অশ্লীল ভাষায় দুষ্ট!)
‘হালা-মজা না পাইলে পয়ছা ফিরত!’
________________________________________
চান্নিপশর রাইতের লৌড়
________________________________________
চান্নিপশর রাইত,লিলুয়া বাতাস। সুমসাম
আন্ধাগলির চাইর পাশ আচানক ফক্‌ফকা শাদা।
চাক্কা নাই-রিকশা-একরাতে হইছে মাতেলা;
যেমুন জোয়ান লৌড়ের টাট্টু!
রিকশার গতরে মর্দামি খালি ফাল্ পাড়ে ।

দুই চউখে সুরমা দিয়া
বুড়া চৌকিদার কালা মিয়া
পাহারা শিকায় তুইলা
নবাবের হুমুন্দির লাহান
চৌকিতে পুটকি উঁচায়া ঘুম যায়।

গল্লির ঘাউড়া কুত্তা, হে-ও ভি ঘুমায়;
এই মওকা লা-জওয়াব!

গ্যারেজের খিড়কি দিয়া,
সরু হয়া, সরু হয়া-হয়া
চিকনে সে আইছে পলায়া।

বাবরিচুল, আ-বিয়াইত্তা, চানখাঁরপুলের কেরামত;
হালায় এক আজিব মিস্তিরি!
মহল্লার হগলে ওরে ‘আটিরিস্ট সা’ব কয়া ডাকে।
রিকশার পাছায় একদিন খুবসুরত ছবি একখান
বড় মহব্বতে আঁইকা দিছে—খানদানি হাতে!

আসলে হালায় এক আউলাচান্দি
ইস্কুরুপ ঢিলা। মাগার খাসদিল্।
ওর ওই ফাগলাগা দিলে
নানান রঙের তেলেস্মাতি ;
মখলুকাতের বেবাক সুন্দর পিনিস
জিন্দেগিভর ওর দিলের জমিনে আঁকা।

কেরামত বহুত যতনে আঁকে আজগুবি ছবি বেশুমার;
সেই ছবির জমিন জুইড়া গাছপালা-নাও-নদী
পশুপঙ্খী-লায়লা-মজনু-শিরি-ফরহাদ
ভাল্লুক-উল্লুক সব, বান্দর-উন্দর হনুমান
ডানাঅলা বোর্‌রাক, পঙ্খীরাজ ঘোড়া, জিনপরি
ছিনেমার নায়িকা মৌছুমী আর পপি-ছাবনুর
ফুল পাতা আসমানের চান ও সিতারা।

ওরা সব বোবার লাহান
চায়া চায়া দেইখা যায় দুনিয়া ও
আসমানের আন্ধাউন্ধা তামাম খেইল।

মনে অয় রাইতের লিলুয়া বাতাস তারে—রিকশারে—
উড়ায়া নিবার চায় দূরে

হীরা-পান্না সোনা-দানা, মায়, জহরতের পিদিম
জ্বলে তার দিল-পিঞ্জিরায়। আর ওই
তারার জেওরে ভরা আসমানের নীল সিংহাসনে
বেহুদা বইসা এক আকেলা সুলতান
খালি খালি ভাব লয়, গাইল পাড়ে
দুনিয়ারে দিমাগ দেখায়।

আউলা কেরামতের লাহান ওই হালারও ভি
ছিলা চান্দির তলে দুই একখান
ইস্কুরুপ ঢিলা—মনে অয়;

চান্নি-পশর রাইতে লাখে লাখে গুলবদন পরি
রিকশার গতরে খালি খুশবো ছিটায় আর
চউখ মাইরা ডাকে ইশারায়

রাইত এক সমুন্দর। আলিশান ঢেউ তার দিলের কপাট
চাবি ছাড়া খুইলা দিয়া যায়। দেখায় তেলেসমাতি।
গতরের পানসি তার সেই ঢেউয়ে খালি লৌড়্ পাড়ে ;
লৌড় পাড়ে না উইড়া চলে ?

ঠাহর মিলে না ওর মালেটাল - বেচইন দিলে।
আর্মানিটোলার রাস্তা, ডাইলপট্টি, ডুরি-আঙুল লেন
নবাবপুর, সুরিটোলার গতরে জোনাক জ্বলে—আর—
দিলখোশ চান্দের পিদিম ভি লড়েচড়ে

মোরজ্বালা! এইটা খোয়াব না খোয়াবের
মাঞ্জামারা আজগুবি ঘুড্ডি একখান
—জানে কোন্‌ হউরের পুতে?

চিপা গল্লির ভিতর থিক্যা, ইবলিসের চেলা যেমুন,
দল বাইন্ধা আৎকা-আচানক ঘাউড়া কুত্তাভি আহে।
খামাখা চিক্কুর পাড়ে,পিছে পিছে খালি লৌড়্ পাড়ে।

মান্দির পোলারা এলা লৌড় পাড়ে ক্যালা?
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
চাঁদনী পশর রাতের দৌড়

চাঁদনি পশর রাত লিলুয়া বাতাস। সুনসান
অন্ধ-গলির চারপাশ আঁচমকা ফকফকা সাদা
চাকাছাড়া- রিকশা –একরাতে একা হয়েছে মাতালঃ
ঠিক যেন জোয়ান দৌড়ের ঘোড়া
রিকশার শরির মর্দানীর জোশে লাফাচ্ছে

দুই-চোখে সুরমা দিয়ে
বুড়ো চৌকিদার কালা মিয়া
পাহারা শিকে তুলে
নবাবের সুমুন্দির মতন
চৌকিতে নিতম্ব উঁচিয়ে ঘুমায়।

গলির ঘাউড়া কুত্তা,সে ও ঘুমায়

এই সুযোগের জবাব নেই
গ্যারেজের জানালা দিয়ে
সরু হয়ে,সরু হয়ে-হয়ে
গোপনে সে পালিয়ে এসেছে

বাবরিচুলের,অবিবাহিত,চানখাঁরপুলের কেরামত;
শালা আজব এক মিস্ত্রি
মহল্লার সবাই ওকে ‘আর্টিস্টসাহেব’ বলে ডাকে
রিকশার পিছনে একদিন খুব সুন্দর ছবি একখানা
বেশ মহব্বতে এঁকে দিয়েছে- খানদানি হাতে

আসলে শালা একজন আধ পাগলা(পাগলমাথা)
স্ক্রু ঢিলা। কিন্তু সাদা মনের
ওর ওই পাগল হৃদয়ে
নানা রঙের খেলা(তেলেসমাতি);
সৃষ্টির সব সুন্দর জিনিস
সারাজীবন ওর হৃদয়ের জমিনে আঁকা

কেরামত খুব যত্ন করে আঁকে অগুনিত আজগুবি ছবি
সেই ছবির জমিন জুড়ে গাছপালা-নৌকা-নদী
পশুপাখি-লায়লা-মজনু-শিরি-ফরহাদ
ভাল্লুক-উল্লুক্সব, বান্দর-টান্দর হনুমান
ডানাওয়ালা বোরাক,পঙ্খীরাজ (উড়ন্ত)ঘোড়া,জ্বীন-পরি
সিনেমার নায়িকা মৌসুমীআর পপি-শাবনুর
ফুল পাতা আকাশের চাঁদ-তারা।

ওরা সব বোবার মতন
চেয়ে চেয়ে দেখে যায় দুনিয়া ও
আকাশের উল্টা-পাল্টা সব খেলা।

মনে হয় রাতের লিলুয়া বাতাস-তারে- রিকশারে-
উড়িয়ে নিতে চায় দূরে

হীরা-পান্না সোনা-দানা, এমনকি,রত্নখচিত চেরাগ(পিদিম-বাতি)
জ্বলে তার হৃদয়ের কুঠুরিতে। আর ওই
তারার গহনায় খচিত আকাশের নীল সিংহাসনে
অযথা বসে একজন মাত্র সুলতান
শুধু শুধু ভাব নেয়,গালাগালি করে
দুনিয়াকে দেমাগ দেখায়।

আউলা কেরামতের মত ওই শালার ও
টাক মাথার নীচে দুই-একখান
স্ক্রু ঢিলা –মনে হয়

চাঁদ পরি এই পূর্ণিমার রাতে লাখ লাখ সুন্দ্রী(গুলবদন)
রিকশার গায়ে খালি খুশবু ছিটায় আর
চোখ মেরে ডাকে ইশারায়

রাত যেন সুমুদ্র। রাজকীয় ঢেউ তার হৃদয়ের দরজা
চাবি ছাড়াই খুলে দিয়ে যায়। দেখায়
শরিরের নাও(নৌকা) তার সেই ঢেউয়ে শুধূ দৌড়ায়
দৌড়ায় না উড়ে যায়

ওর মাতাল- অশান্ত হৃদয় কিছুই বুঝতে পারে না
আর্মানিটোলার রাস্তা, ডাইলপট্টি, ডুরি-আঙুল লেন
নবাবপুর, সুরিটোলার গায়ে জোনাকি জ্বলে—আর-
মহা আনন্দিত চাঁদের আলোও নড়েচড়ে

কি যন্ত্রনা! এইটা সপ্ন না সপ্নের
মাঞ্জামারা আজব ঘুড়ি একটা-
জানে কার শালা(শ্বশুরের ছেলে)?

চিপা গলির ভিতর থেকে, শয়তানের সঙ্গীরা যেমন
দল বেঁধে হঠাত আচমকা ঘাউড়া কুত্তারা আসে
এমনিতেই চিৎকার করে, পিছনে পিছনে শুধূ দৌড়ায়

মাঙ্গির পোলারা এত দৌড়ায় কেন?

জুয়েল মাজহার
জন্ম ১৯৬২ সালে; নেত্রকোণা। মার্কসবাদী। কোনো অলৌকিকে বা পরলোকে বিশ্বাস নেই। ঘৃণা করেন পৃথিবীকে খণ্ড-ক্ষুদ্র করে রাখা সীমান্ত নামের অমানবিক ‘খাটালের বেড়া’। লেখেন মূলত কবিতা, বিচিত্র বিষয়ে প্রচুর অনুবাদও করেন।

বর্তমান পেশা সাংবাদিকতা। কৈশোরে বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা। দীর্ঘ ভবঘুরে জীবন।পেটের দায়ে নানা কাজ। যৌবনের একটা বড় অংশ কেটেছে পাহাড়ে। সেভাবে বাড়ি ফেরা হয় নি আর।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
-৪ পর্বের দ্বীতিয় পর্ব শেষ। লেখাটা কোন ধারাবাহিক সিরিজ নয়। আগের পর্ব না পড়লেও চলবে, তবে আগের পর্ব পড়তে ইচ্ছে হলে টোকা দিন (সত্যজিৎ রায়ের 'ছিম্বল' ও কবি দাউদ হায়দার) Click This Link

(সুত্রঃ নিউজ টুয়েন্টিফোর, ওয়ার্ড প্রেস,ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষার অভিধান;মোশাররফ হোসেন ভূঞা, নাজির হোসেনের‘কিংবদন্তির ঢাকা’ দৈনিক ইত্তেফাক, ইসলাম টাইমস ও সৈয়দ মুজতবা আলী’ভবঘুরে ও অন্যান্য’)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ বিকাল ৫:৩৭
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×