মুজতবা আলী সাহেবের ‘রসগোল্লা’ গল্প পড়ে রসগোল্লার রস আস্বাদন করেননি এমন বাঙ্গালী সাহিত্যপ্রেমী খুঁজে পাওয়া দুস্কর!
কোত্থেকে যেন জেনেছিলাম রসগোল্লার উদ্ভাবক কলকাতার এক ময়রা আর সেটা উদ্ভাবিত হয়েছিল এই বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মাত্র। একটু অবাক হয়েছিলাম কিন্তু খুব একটা গাঁ করিনি তখন।
সেদিন বেশ মনযোগের সহিত অতি নিবিষ্ঠ ধ্যানে সাঁইজির অতি বিখ্যাত ‘কানার হাটবাজার’ গীতটা শুনছিলাম। বড় মনে ধরেছে সে গীত।তবে গানের এক লাইনে ‘বোবায় খায় রসগোল্লা’ শুনে একটু চমকে উঠলাম –তার মানে রসগোল্লার খবর তিনিও তাহলে জানতেন!!
এমন কি হতে পারে কুষ্টিয়ার আখড়া থেকে তিনি সুদুর কলকাতা অব্দি যেতেন শুধু রসগোল্লার রস আস্বাদন করতে!!
কিন্তু তাজ্জব কি বাত; তিনিতো ইন্তেকাল ফরমাইয়াছেন উনিশ শতকের শেষভাগে( ১৮৯০)। তাহলে রসগোল্লা চাখলেন কিভাবে???
অবশেষে এই ‘মদনা কানার’ গুগলের দ্বারস্থ ছাড়া উপায় কি?
বাঙালির পাতে ‘রসগোল্লা’ পরিবেশন করেছেন নবীনচন্দ্র দাস ১৮৬০ সালে।
যতদূর জানা যায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রথম রসগোল্লা প্রস্তুত করা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার ফুলিয়ার হারাধন ময়রা আদি রসগোল্লার সৃষ্টিকর্তা। কলকাতার নবীনচন্দ্র দাস আধুনিক স্পঞ্জ রসোগোল্লার আবিষ্কর্তা ছিলেন এবং তিনি ইতিহাসে পাতায় আবিষ্কর্তা হিসেবে রসগোল্লার কলম্বাস হিসেবে অভিসিক্ত হয়েছেন। ১৪ শতকের শেষভাগে ১৫ শতকের ভক্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভীষণা ভক্তি বৃদ্ধি লাভের সময় মিষ্টিটির প্রাচীনতা নদিয়াতে ফিরে আসে। এর পর এই রসগোল্লা জনপ্রিয় হয়ে,পাশের রাজ্যগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। তবে বিশেষ করে কলকাতায় এটি উল্লেখযোগ্যভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। রসগোল্লা নদীয়া থেকে কলকাতা ও ওড়িশায় ছড়িয়ে পড়ে।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে রসগোল্লার আদি উৎপত্তিস্থল বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল অঞ্চলে। বিশেষ করে,পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ায় পর্তুগীজদের সময় সেখানকার ময়রাগণ ছানা,চিনি, দুধ ও সুজি দিয়ে গোলাকার একধরনের মিষ্টান্ন তৈরি করেন যা ক্ষীরমোহন বা রসগোল্লা নামে পরিচিত। পরবর্তীতে বরিশাল এলাকার হিন্দু ময়রাগণের বংশধর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতা কিংবা ওড়িশায় বিস্তার লাভ করে।
হয়ে গেল, জনাব হারাধন আর নবীনচন্দ্র কট খেয়ে গেলেন -আমাদের সাঁইজি সম্ভবত সেই বরিশালের রসগোল্লার স্বাদ আস্বাদন করেছেন!
অবশ্য কলকাতা থেকে জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় ও এনে খাওয়াতে পারেন।
আমার বাবার মত মিষ্টি পাগল লোক এ জীবনে আমি কম দেখেছি। আমার দাদার কন্ট্রোলের কাপড়ের দোকান ছিল গোপালগঞ্জ শহরে। আমার বাবা তার বড় সন্তান।
দুর্গাপুর থেকে গোপালগঞ্জের দুরত্বের বিচারে খুব বেশী না হলেও সেই আমলে সেটুকু পথ পাড়ি দেয়া সময়ের ব্যাপার ছিল। বর্ষার একমাত্র বাহন নৌকা আর গ্রীষ্মে কিছু পথ হেটে কিছুপথ গরুর গাড়িতে খানিকটা নৌকায় যেতে হোত।
দাদা মাসে দু’এবার বাড়িতে আসতেন – বাবার তার দোকানে বসা শুরু করেন বার কি তের বছর বয়স থেকে। তাকে দু-তিনদিনের জন্য দোকানে রেখেই আসতেন তিনি।
ছেলে মিষ্টি পছন্দ করে জেনে তিনি বাবা দোকানে পৌছানো মাত্র কেজি খানেক জিলাপি নিয়ে আসতেন। তিনি খেতেন দু-একটা মাত্র বাকিটা বাবার পেটে চালান হোত। গাঁয়ে আসার সময়ে দু’তিনদিনের খাবার খরচ বাবদ দু’চার আনা দিয়ে আসতেন।
দাদা বের হতেই বাবা চলে যেতেন ময়রার দোকানে। পুরো পয়সাগুলো তার হাতে দিয়ে বলতেন, বাপজান না আসা পর্যন্ত আমি শূধু মিষ্টি খাব।
আশ্চর্যজনক ভাবে দাদার অনুপস্থিতির কয়েকদিন ভাত না খেয়ে তিনি শুধু মিষ্টি খেয়ে কাটিয়ে দিতেন।
আমার বাবার যখন ১৫ কি ষোল বছর বয়স তখন আমার দাদা বেরিবেরি রোগে মারা যান।
দাদাজানের রেখে যাওয়া কিছু জমিজমা আর শহরের দোকানখানায় নজর পড়েছিলতার ঘনিষ্ট আত্মীয়দের। পরিবারের বড় ছেলে সে, নাবালক অবস্থায় বাবা মারা যাওয়ায় প্রথমে জোড়াজুড়ি তারপরে গ্রামসুদ্ধ লোক মিলে জড়িয়ে পড়ল ‘কাজিয়া’য়( গোপালগঞ্জে বেশ প্রসিদ্ধ ‘ কাইজ্যা’ নামে- ঢাল বর্শা নিয়ে হুলস্থুল মারামারি! এ বিষয় নিয়ে গল্প করার ইচ্ছে রইল অন্য সময়ে)। শেষমেশ আমার বাপের জান নিয়ে টানাটানি! কপর্দক শুন্য অবস্থায় তিনি রাতের আধারে পালিয়ে এসেছিলেন রেলওয়েতে চাকুরিরত বড় বোনের স্বামীর এখানে গোয়ালন্দ ঘাটে।
এমনিতেই অর্থাভাব তারুপরে কিনে খাওয়া মিষ্টিতে তার মন ভরছিল না। শয়নে স্বপনে তিনি দেখতেন। রসে ভেজা গরম গরম, আমিত্তি,রসগোল্লা,চমচম,কালোজাম, রাজভোগ, কমলাভোগ, লবংগ, ছানার জিলাপি ছানার সন্দেশ সহ কতকিছু তিনি বানাচ্ছেন আর ইচ্ছেমত খাচ্ছেন!
সবে বছর পাঁচেক হোল দেশভাগ হয়েছে।বাঙ্গালীর ভাষা আন্দোলন তুঙ্গে তখন! গোয়ালন্দের তখনও রমরমা অবস্থা! ভারত ভাগ হয়ে গেলেও গোয়ালন্দী জাহাজে এপার ওপারের রথী মহা রথীরা তখন চক্কর কাটছেন আর আর জাহাজের ব্রিটিশ বাবুর্চির হাতে বিখ্যাত গোয়ালন্দী চিকেন কারির স্বাদ নিচ্ছেন।
ট্রেনের জন্য ঘাটে এসে দীর্ঘ সময় বসে থাকা বেশ কষ্টকর তাদের জন্য। ঘাটের দোকান পাট তো বটেই স্টেশন পর্যন্ত অস্থায়ী- পদ্মার ভাঙ্গনের তোড়ে বছরে দু’চার দশবার ঘাট আর স্টেশোনের স্থান পালটায়। তারা যুত হয়ে বসবেন কোথায়?
তখন তার বয়স বিশ কি একুশ- সেখানকার হেড অব পার্সেল ক্লার্কের বড় ছেলের সাথে শলা করে তাদের অর্থায়নে ঘাটের পাড়ে একখানা মিষ্টির দোকান তুললেন।
এমনিই গল্পবাজ তারপরে অন্যদের তুলনায় মোটামুটি পরিপাটি দোকান আর অভিজ্ঞ হিন্দু ময়রার হাতে তৈরি অতি স্বুসাদু রসগোল্লা আর খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের মুচমুচে পরোটার লোভে ভিড় বাড়তেই লাগল দিন দিন।
আর নিজের দোকানের মিষ্টি খেয়ে খেয়ে তিনি দশাসই বপুধারি হয়ে পড়লেন অচিরেই।
ব্যাবসা জমতে সময় লাগল না, একজন ভয়ানক মিষ্টি পাগল মানুষের উদ্ভাবিত নিত্য নতুন ধরনের মিষ্টির সুনাম এলাকার গন্ডি ছাড়িয়ে পৌছে গেল দূর –দুরান্তে!
শুনেছি তার দোকানের রসগোল্লা নাকি টিনে করে সুদুর করাচী অবধি পৌছে যেত।
কে জানে সুদুর ভেনিস বন্দরে টিনভর্তি সেই ‘রসগোল্লা’ ঝান্ডু দা এখান থেকেই নিয়েছিলেন কি না !
“কর্তা বললেন,‘টিন খুলেছ তো বেশ করেছ,না হলে খাওয়া যেত কী করে?’আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,‘এখানে দাড়িয়ে আছেন কী করতে? আরও রসগোল্লা নিয়ে আসুন।’ আমরা সুড়সুড় করে বেরিয়ে যাবার সময় শুনতে পেলুম। বড়কর্তা চুঙ্গিওলাকে বলছেন, ‘তুমিও তো একটা আস্ত গাড়ল। টিন খুললে আর এই সরেস মাল চেখে দেখলে না?’
আমি গাইলুম,
রসের গোলক,এত রস কেন তুমি ধরেছিলে হায়।
ইতালির দেশ ধর্ম ভুলিয়া লুটাইল তব পায়। - গুরু নমস্য মুজতবা আলী
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০২১ দুপুর ১:০৩