যদি রক্ত ঝরে,তবে সেটা ক্ষত,অন্যথায় প্রতিটি আঘাতই কবিতা। – গুলজার
মহিলারা যা-ই করুক না কেন,সবসময় তাদের কোন না-কোন পুরুষের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। কখনও বাবার কাছে,অন্য সময় স্বামী কিংবা ছেলের কাছে। – গুলজার
আমি সব সময়ই ভাবতাম ভারতীয় চলচ্চিত্রের অত্যান্ত প্রতিভাবান, প্রভাবশালী নামি গীতিকার ও কবি ‘গুলজার’ সম্ভবত মুসলিম সম্প্রদায়ের লোক। বাঙলা সাহিত্যে ‘ইলিশ’নিয়ে গল্প খুঁজছিলাম। অনেক লেখকের ভীড়ে দেখি ‘গুলজার’ নামে একজন লেখকের নাম দেখে অবাক হলাম। ‘গুলজার’ নামে কোন লেখকের নাম শুনিনি কখনো।
গুগলে যতবার সার্চ দেই ঘুরেফিরে ভারতীয় এই গীতিকার ও কবি গুলজারের নাম আসে। অনেক খুঁজে অবশেষে বুঝলাম ইনিই তিনি।
'ইলিশ' গল্পটা ছিল অনুবাদ। উনার জীবনের গল্পে একটু চোখ বুলিয়েই মজে গেলাম;
জন্ম দেশভাগ, অর্থাভাবে গ্যারেজে মেকানিকের চাকুরি। সে আমলের বিখ্যাত সব বাঙ্গালী গুণী, সাহিত্যিক,পরিচালক,সুরকার, গায়ক ও অভিনেতাদের সাথে তার সখ্যতা এবং চলচ্চিত্রে তার উত্থান- সব মিলিয়ে দারুন এক বৈচিত্রময় জীবন তার।
বাঙলা কবিতা ও সাহিত্য বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের দারুন ভক্ত ও অনুরক্ত তিনি। রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু কবিতা আর গান তিনি অনুবাদ করে রি-এরেঞ্জ করে আধুনিক সঙ্গীতের ভুবনে পরিচয় করিয়েছেন। তিনি শুধু কবি,ও গীতিকার নন, একাধারে তিনি গল্পকার উপন্যাসিক ও চিত্রনাট্যকার অঙ্কন শিল্পি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। আসুন অল্প করে তার জীবনের গল্প আর লেখালেখি নিয়ে কিছু কথা শুনি;
শনিবার, ১৮ আগস্ট ১৯৩৪ সাল। তৎকালীন বৃটিশ-ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের ঝিলাম জেলায় (বর্তমান পাকিস্তান) মাখন সিং কালরা এবং সুজান কাউরের ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় এক শিশুপুত্র। 'সাম্পুরান সিং কালরা' নাম পায় বাচ্চাটি। আচমকা তাসের ঘরের মতো তছনছ হয়ে যায় শিশুটির দুনিয়া। অল্প বয়সেই মাতাকে হারান! তারপর হারান দেশমাতাকে। এক ভূখণ্ড দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে নিজেদের আলাদা জাতি, গোত্র আর দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
ভাগ্যান্বেষণে মুম্বাই (তৎকালীন বোম্বে) শহরে পা রাখেন। দু'বেলা দুমুঠো খাবারের আশায় কাজ নেন গাড়ির মেকানিক হিসেবে। কিন্তু কবিতার প্রতি ভালোবাসাও লালন করতে থাকেন সযত্নে গোপনে। আলী আকবর খান আর রবি শংকরের কোনো সঙ্গীতানুষ্ঠান বাদ দিতেন না। দেশভাগ পরবর্তী তীব্র বেকারত্ব এবং ট্রেড ইউনিয়নের আন্দোলন তাকে দারুণভাবে আলোড়িত করে।
পিডব্লিউএ রবিবারের বৈঠকে তাঁর কথোপকথনের সময়ই শৈলেন্দ্র এবং বিমল রায় তাকে ছবিতে যোগ দিতে উত্সাহিত করেছিলেন। গুলজার তার কেরিয়ার শুরু করেছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক বিমল রায় এবং হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের অধীনে। তাঁর রবি পাড় বইতে বিমল রায় ও সৃষ্টির বেদনার বিবরণ রয়েছে। তিনি 'বান্দিনি' (১৯৬৩) চলচ্চিত্রের জন্য সংগীত পরিচালক শচীন দেব বর্মণের সাথে গীতিকার হিসাবে তাঁর কেরিয়ার শুরু করেছিলেন। চলচ্চিত্রগুলিতে তিনি বিমল রায় সহ তিনি যে দলের সাথে কাজ করেছিলেন তাতে সাহিত্যের সাথে যুক্ত একটি পরিবেশ খুঁজে পেয়েছিলেন, যার বেশিরভাগ চলচ্চিত্রই সাহিত্যকর্মের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। শৈলেন্দ্র- লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া "মোরা গোরা আঙ্গ লেলে" গানটি লেখার জন্য গুলজারকে অনুরোধ করেছিলেন।
রবি ঠাকুরের সবচেয়ে বিখ্যাত বাংলা কবিতা হিন্দিতে অনুবাদ হয়েছে এবং গান হিসাবে এক সাথে রাখা হয়েছে। রবি ঠাকুরের অ্যালবামের সাথে আলাপকালে গুলজার উর্দু এবং হিন্দিতে অনুবাদিত ঠাকুরের সবচেয়ে বিখ্যাত বাংলা কবিতা রয়েছে। গানগুলি ঠাকুরের রোমান্টিক দিক নিয়ে তাঁর সাথে আধুনিক মিউজিকাল গন্ধ দিয়ে তাঁর কবিতাকে সমবেত করার চেষ্টা করেছেন। এমুহুর্তে ভারতীয় চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র আরেক বাঙ্গালী শান্তনু মৈত্রের মিউজিকে এই রচনাগুলি রবীন্দ্র সংগীতকে গিটার,গ্র্যান্ড পিয়ানো,ম্যান্ডোলিন ইত্যাদির মতো আধুনিক বাদ্যযন্ত্র সুরের মুর্ছনায় একটি নতুন যুগের সুচনা করেছে।
সলিল চৌধুরী, শৈলেন্দ্র, সৈয়দ জাফরী এবং বলরাজ সাহানীর মতো স্বনামধন্য মানুষের সান্নিধ্য পেয়ে লেখালেখি শুরু করেন। এরপরের গল্পটা ছিল দিন বদলের। ভারতীয় শিল্প-সাহিত্য এবং চলচ্চিত্র অঙ্গনে পরিচিত, সমাদৃত এবং স্বনামধন্য বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হিসেবে নিজের নাম আজীবনের জন্য স্থায়ী করে নেন। সাম্পুরান সিং কালরা নামক সেই লোককে আমরা না চিনলেও গুলজারকে কমবেশী সকলেই চিনি।
আমি মনে করি,ভারতীয় ছোটগল্প হলো আঁকাবাকা এবং উঁচু-নিচু পাহাড়ী পথে হাঁটার মতো। হাঁটতে হাঁটতে একসময় ঘুরে দাঁড়ালে দেখা যাবে আকাশ। – গুলজার
গুলজারের কবিতা বা লিরিক দুইটার সাথেই আগে থেকেই পরিচিত। তবে এই ভদ্রলোক যে এত ভালো আর দুর্দান্ত সব গল্প লিখেছেন তা সত্যিকার অর্থেই জানা ছিল না। একাধারে কবি, ছোটগল্প লেখক, শিশু সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক, গীতিকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্য রচয়িতা, অঙ্কন শিল্পী এবং অধ্যাপক ছিলেন তিনি। একইসাথে বহু ভাষাবিদ বলে খ্যাতিও আছে তার। বাক্যের বুনন, শব্দচয়ন আর তার সঠিক ব্যবহার; এবং পাঠককে সম্মোহিত করে রাখার অলৌকিক দক্ষতার জন্য অনেকেই তাকে ‘শব্দের মোজার্ট’ বা ‘মাস্টার ওয়ার্ডস্মিথ’ অথবা ‘শব্দ-কারিগর’ খেতাবও দিয়েছেন।
ইংরেজিতে অনূদিত গুলজারের গল্প নিয়ে ‘রাভি পার এন্ড আদার স্টোরিজ’ এবং ‘হাফ এ রুপি স্টোরিজ’ শিরোনামে দুটি গল্প সংকলন আছে। ‘রাভি পার এন্ড আদার স্টোরিজ’ থেকে চারটি গল্প নিয়ে ‘সীমা এন্ড আদার স্টোরিজ’ নামে আরেকটি সংকলনও আছে। ‘টু’ তার একমাত্র উপন্যাস। ইতিমধ্যে যারা সাদাত হোসেন মান্টো পড়েছেন তাদের কাছে গুলজারের গল্পগুলো অত্যন্ত ভালো লাগবে। কেননা, দুইজনের লেখার পটভূমিটা একই। দেশবিভাগ, সীমান্তের গল্প, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে রচিত।
সহজ আর সাবলীলভাবে বলে যাওয়া একটা গল্পই আচমকা একটা বাক্যে এসে এমনভাবে আঘাত করে যে, অন্তরাত্মা অবধি কেঁপে উঠতে পারে!
এক রঙের সঙ্গে অন্য রঙ মেশালে দুটি রঙই তাদের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে এবং তারা বদলে যায়৷ অথচ পাথর স্বকীয়তা হারায় না এবং বদলায়ও না। – গুলজার
রাভি নদী পেরিয়ে গল্পটি মূলত দেশভাগের সময় উদ্বাস্তু এক শিখ পরিবারের গল্প। এই গল্পটা আমার অনেকটা চেনা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটা গল্প এই গল্পটার সাথে অনেকটাই মিলে যায়। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের কোন সিনেমাতে দেখানো হয়েছে সম্ভবত। পাক সেনাদের ভয়ে মা বাচ্চার মুখ চেপে রাখে; যাতে বাচ্চা চেঁচিয়ে কেঁদে না উঠে। কিন্তু পাক সেনারা চলে গেলে দেখা যায় বাচ্চাটা মরে গেছে। এই গল্পটা অনেকটাই তেমন তবে অনন্য গুলজারের শব্দচয়ন আর বলার ঢং-এ।
ধোঁয়া গল্পটি ধর্মীয় নিয়মকানুনের ব্যবধান আর হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সংঘর্ষ নিয়ে লেখা। মুসলমান হোক আর হিন্দু,নিজেদের গোঁড়ামির জন্য দাঙ্গা তাদের কাছে নিতান্ত তুচ্ছ এক বিষয়। এলাকার প্রভাবশালী চৌধুরী মারা গেছেন। চৌধুরীর উইল মতে দাফনের বদলে পোড়ানোর সকল ব্যবস্থা করছেন চৌধুরানী। কিন্তু বাদ সাধে মহল্লার মুসলিমমনা লোকজন। এই অপমান যেন তাদের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আর তাই তো,মৃতকে দাফন করার জন্যে জীবিতকে পুড়িয়ে মারে।
ইলিশ গল্পটি আদতে প্রেম আর ভালোবাসার গল্প মনে হলেও এটি সমাজের বাস্তব চিত্রের এক দারুণ প্রতীকী গল্প। বিভূতি আর কাঞ্চন বিবাহিত দম্পতি। প্রেমের কুলে ভাসছে দুজন। কাঞ্চনের গর্ভবতী হবার দিন এলো বলে। বছরের তিনটে মাস যখন ইলিশের পেটে ডিম থাকে তখনকারই এক সময়ে বিভূতি একজোড়া গর্ভবতী ইলিশ নিয়ে আসে। যে ইলিশের মুখটি হা করা থাকে সামান্য, যেন কিছু বলতে চায়।
আমরা সবাই কমরির মতো। কমরির অর্থ হলো মুরগি। এই শহর শস্য দানা ছিটায়। আমরা মুরগির মতো টুক-টুক শব্দ করে সেগুলো কুড়িয়ে খাই। সেই খাবার খেয়ে যখন মোটা তাজা এবং নাদুসনুদুস হবো, তখন ওরা আমাদের কতল করবে। কারা? অনুভূতিহীন মহারাজারা। – গুলজার
গুলজারের গল্প প্রতীকী। সাধারণ একটা গল্পের ছলে খুব ভারিক্কি চালের বড়সড় কোন প্রতীকী ঘটনার পরিস্ফুটনই মূলত তার গল্পের মূল লক্ষ্য। মানব মনের অন্ধকার দিক, সামাজিক অবক্ষয়ের রূপ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহতা, সমাজে নারীর অবস্থানসহ সামাজিক ইস্যুগুলোকে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন নিজের লেখায়। শব্দচয়নের ক্ষেত্রে বেশ পারঙ্গম এই লিরিক জাদুকর। আর তাই জন্যই তাকে ‘মাস্টার ওফ ওয়ার্ডস্মীথ’ বা ‘শব্দের মোৎজার্ট’ ডাকা হয় তাকে। তবে হ্যাঁ পুরো গল্পটা একদমই সাধারণ মনে হলেও শেষের বা তার আগের একটা বাক্য যে আপনাকে ধাক্কা দেবে তা নিশ্চিত থাকুন।
গুলজারের গল্পগুলো ভেতর থেকে নাড়া দেয়, নতুন করে ভাবতে শেখায়। তবে অনেকের কাছে ভালো নাও লাগতে পারে। পছন্দ আর রুচিতে ভিন্নতা থাকাটাই স্বাভাবিক। শেষ করছি গুলজারের একটা কবিতা দিয়ে –
সারাদিন আমি কাটিয়েছি
বন্ধুহীন, একাকী এবং দুঃখ নিয়ে,
নিজের কাছেই ছিলাম আমি অচেনা।
সৈকতে ডুবে গেলে দিন
আমি বিরান সড়ক পথে
ফিরে আসি হেঁটে
নিঃসঙ্গ নিবাসে।
যেই মুহূর্তে
দরোজার পাল্লা খুলি,
তখন আমার টেবিলের উপর বই
মৃদু শব্দে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে শুধায়:
‘বন্ধু, কোথায় ছিলে তুমি
এই দীর্ঘ সময়?
গীতিকার হিসাবে গুলজারের সংগীত পরিচালক রাহুল দেব বর্মণের সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল। গুলজার আনন্দ (১৯৭১) এবং মেরে আপনে (১৯৭১) সলিল চৌধুরীর সাথে কাজ করেছিলেন।
এ. আর রহমান দিল সে .. ১৯৯৮, স্লামডগ মিলিয়নেয়ার (২০০৮) গুলজার আমির খুস্রোর "আই সারবতে আশিকী" থেকে মণি রত্নমের ২০০৭ সালের হিন্দি ছবি ‘গুরু’ রচনার জন্য অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন, যার নাম ছিল এ আর রহমান। আরেকটি রত্নম-রহমান হিট করেছিলেন, দিল সে থেকে "ছাইয়া ছাইয়া"। এ গান গুলজার লিখেছিলেন,কবি বুলিহ শাহের সুর সহ, সুফি লোকগান "থাইয়া থাইয়া" অবলম্বনে। ড্যানি বোলের হলিউড ছবি স্লামডগ মিলিয়নেয়ারের জন্য রহমান এবং গুলজার ৮১ তম একাডেমি পুরষ্কারে "জয় হো" এর জন্য সেরা অরিজিনাল গানের জন্য একাডেমী পুরষ্কার পেয়েছিলেন।)
এই শহরে অনুভূতিহীন মহারাজারা দুই ধরনের। প্রথমত- পল্টি মানুষ। তারা কথার ফুলঝুড়ি ছড়ায়। বক্তৃতা দেয়। মালপানি ঢালে। ভোট নেয়। দ্বিতীয়ত- অস্ত্র-ছোরাবাজ। টাকাকড়ি নেয়। জীবন নেয় না। কিন্তু সময় জীবন নেয়,টাকা দেয়। উভয় দলই গুণ্ডা। শুধু পার্থক্য হলো তাদের ধরনধারণে। – গুলজার
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
জনাব ওয়াজেদুর রহমান ওয়াজেদ (যার লেখা না পড়লে আমি ‘গুলজার’ এর সাহিত্য সন্মন্ধে কিছুই জানতাম না) ও উইকি
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০২১ দুপুর ১২:৫৮