Голодомо́р- হলোদোমোর
The Classes and the races too weak to master the new condition of life must give way.
They must perish in the revolutionary holocaust. -Karl Marx April 16 1858
আমি তখন আট বছরের কিশোরী। মায়ের অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার বাবা চাকুরী থেকে অবসরের পরে তার গ্রামে ফিরে এলেন-সেখানে ছোট্ট একটা স্কুলে মাস্টারি করার পাশাপাশি কৃষিকাজ করে বাকি জীবনটা কাটাবেন বলে।
গত কয়েকদিন তিনি বেশ বিরক্ত ও রাগান্বিত ছিলেন! মাঝে মধ্যেও উচ্চস্বরে মাকে বলছিলেন তার ক্ষোভের কথা। মায়ের কাছে পরে জেনেছি; তার ক্ষোভ ছিল বলশেভিক পার্টির(অল ইউনিয়ন কম্যুনিস্ট পার্টি) রাষ্ট্রীয়-করনের বিরুদ্ধে- তিনি কোন মতেই মেনে নিতে পারছেন না জনগণের কাছ থেকে সব জমি কেড়ে সরকার তার কুক্ষিগত (কোল্কজ) করবে। সরকার শ্রমিকের, এ সরকার খেটে খাওয়া মজুরের। তারা কেন শ্রমিক আর মজুরের শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নিবে?
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
~আমি প্রতিদিন রাতের খাবারের পর বাবার কাছে শুয়ে রূপকথার গল্প শুনতাম। সেদিন রাতেও আমি বাবাকে বললাম,- বাবা আমাকে গল্প শোনাও। অবশ্য সে রাতেও বাবার থমথমে চেহারা দেখে আমি বুঝলাম তিনি বেশ রেগে আছেন- তাকে কেমন বিক্ষিপ্ত বিধ্বস্ত মনে হচ্ছিল। আমি তার কাছে গিয়ে একটু ভয়ে ভয়ে গল্প শোনানোর জন্য আবদার করলাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে একটু খানি হেসে আমাকে কোলে তুলে রূপকথার গল্প শোনাতে শুরু করলেন। আচমকা ভারি কিছু দিয়ে দরজায় করাঘাতের শব্দে আমরা চমকে উঠলাম।
বাবা দরজা খুলতেই; কয়েকজন ‘অগপু(পরবর্তীতে কেজিবি)’র সদস্য হুড়মুড় করা আমাদের ঘরে ঢুকে পড়ল। তারা কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমাদের পুরো বাড়ি তল্লাশি শুরু করল। তল্লাশি শেষে কিছু না পেয়ে আমার বাবাকে বলল, তাদের সাথে থানায় যেতে হবে- সামান্য কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। আমার বাবা ভারী পোশাকটা গায়ে জড়াতে জড়াতে আমাকে কাছে ডেকে গভীর একটা চুমু খেয়ে বললেন; দিয়ানা সোনা, আমি বাকি গল্পটা এসে বলব- তুমি কিন্তু ঘুমিয়ে পড় না।
আমি আজও বাবার সেই বাকি গল্পটা শোনার অপেক্ষায় আছি...
‘গল্পটা করতে করতে দিয়ানার নীলাভ চোখের কোন গড়িয়ে শ্বেতশুভ্র কুঞ্চিত গণ্ড বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ল।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
দিয়ানার( ছদ্ম নাম) সাথে যখন গল্প করছিলাম-তখন তার বয়স ৯৬! সুদীর্ঘ ৮৮ বছর পরেও এখন তার বাবাকে খুঁজে ফিরে। ১৯৮০ সালে চাকুরী থেকে অবসরের পরে সে তার আরেক বান্ধবী, যে সেই ভয়ঙ্কর বিভীষিকাময় হলোদোমোরে তার পরিবারের বাকি চার সদস্যকেই হারিয়ে অনাথাশ্রমে বড় হয়েছে- তারা দু’জনে মিলে নিজেদের জীবনের তোয়াক্কা না করে তখনও জীবিত সেইসব মানুষগুলো যারা ‘হলোদোমোরে’র ভয়ঙ্কর থাবার সাক্ষী ছিলেন তাদের স্মৃতিকথা লিপিবদ্ধ করেছেন। আমাদের লক্ষ্য ছিল সারা বিশ্বকে জানানো সেই বিংশ শতাব্দীতে সভ্য সমাজে ঘটে যাওয়া সেই ভয়াবহতম গল্পগুলো যা পৃথিবীর মানুষ কখনো শোনেনি।
সব মিলিয়ে তিনশ পঞ্চাশ জন মানুষের স্মৃতিচারণ আমরা নথিভুক্ত করেছিলাম। প্রথমে কেউ বলতে চায়নি- তারা আমাদের আগে তারা সন্তান বা নাতিদের কাছেও সেই গল্পগুলো কখনো বলেনি। তারা স্মৃতিপট থেকে একেবারে মুছে ফেলতে চাইত ১৯৩৩ সালের সেই দিনগুলোর কথা! তারা যে বেঁচে আছে এইতো ঢের!
~আমরা ভীষণ ক্ষুধার্ত ছিলাম – পুরো শহর জুড়ে কারো বাড়িতেই হয়তো সামান্য শস্যদানা নেই যা দিয়ে অন্তত একবেলা গ্রাসাচ্ছাদন হবে।আমরা সব ক্ষুধার্ত শিশুরা দলবেঁধে সময়মতো স্কুলে যেতাম- আর কিছু নয়, একে অপরের দিকে চেয়ে থাকার জন্য, সময় কাটানোর জন্য, হয়তো ঈশ্বরের অসীম কৃপায় কিছু একটা মিলবে এই দুরাশায়!
কিন্তু ঈশ্বর আমাদের কৃপা দেখায়নি। কখনো কখনো মানুষ ঈশ্বরের থেকেও শক্তিশালী হয়ে যায় সেটা আমরা সচক্ষেই দেখেছি। আমরা যাবার পথে মাথা নিচু করে অতি ধীরে প্রতিটা পদক্ষেপ গুনে গুনে যেতাম।
ক্লাসে যেন কবরের নিস্তব্ধতা! সবাই আমরা ফ্যাঁকাসে দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতাম প্লাস্টার ওঠা দেয়াল বা ব্লাকবোর্ডের দিকে। কথা বলার সব শক্তি আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম। টেবিলে যে একটু আঁকিবুঁকি কাটব সেটুকু শক্তিও আমাদের ছিলনা।
আমাদের ক্লাস শিক্ষক তার চেয়ারটিতে এসে অসীমের পানে প্রাণহীন ঘোলা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতেন মূর্তির মত বসে। মাঝে মধ্যে মনে হোত- তিনি হয়তো আর বেঁচে নেই। কোন একদিন ক্লাসে কেউ অনুপস্থিত থাকলে অবশ্য -আমাদের মধ্যে চাঞ্চল্যতা বিরাজ করত। আমরা তখন তার ভীষণ অমঙ্গল চিন্তায় ফিসফাঁস করতাম।
ক্লাসের সবচেয়ে দুরন্ত ও সুদর্শন সাশা যেদিন আসল না আমরা সবাই ভীষণ অবাক হলাম। ক্লাসের মাঝপথেই আমরা কয়েকজন অভুক্ত ক্লান্ত দেহে-ই বেড়িয়ে পড়লাম সাশার খোঁজে। ওর বাড়ির কাছাকাছি যেতেই কেউ একজন পথ আটকাল- সে জানালো যে, সাশার বাবা-মার মাথা খারাপ হয়ে গেছে! গতরাত্রে তারা নাকি সাশাকে হত্যা করে তার মাংস রেঁধে খেয়েছে। বাকি মাংস নাকি ফ্রিজে রেখে হাড়গোড় ওই পুকুরে ফেলে দিয়েছে।
তোমরা নিশ্চয়ই মানুষের মাংস মানুষের খাবার গল্প শুনেছ? কতগুলো শুনেছ? অনেক অনেক শুনেছ- নিশ্চয়ই নয়?
~দিনগুলো কেটে যেত কোনমতে আমাদের রাতগুলো ছিল আরো ভয়ঙ্কর ! এ কান ও কান করে সারা গ্রামে ভেসে বেড়াচ্ছিল ভয়ঙ্কর সব গল্প; কোন কোন গ্রাম থেকে তাদের পাশেরই বা দুরের গ্রামে গভীর রাতে অতর্কিতে অস্ত্রহাতে কিছু মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। তারা কোন সম্পদ লুণ্ঠন করতে আসত না –প্রথমে ঘর , ভাড়ার, ছাদ , মেঝে কিংবা উঠোন খুঁড়ে( সেটা ঠিক খোঁড়া নয়- এক ধরনের লম্বা সূচালো লোহার দণ্ড দিয়ে মাটিতে গেঁথে দেখত) কিছু না পেলে তারা হাতের সামনে যাকে পেত তাকেই হত্যা কর। সে পুরুষ কিংবা নারী, কিশোর অথবা শিশু। অবশেষে আগে থেকেই অনাহারে থাকা অর্ধ মৃত আর হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হওয়া মৃত মানুষগুলোকে খাবারের জন্য নিয়ে যেত। আমাদের গ্রামেও যেকোনো সময়ে এমন আক্রমণ হতে পারে ভেবে অজানা-অদৃশ্য সেই শত্রুকে ঠেকাতে আমাদের শহরের পুরুষ আর নারীরা সারারাত অস্ত্র হাতে বসে থাকত।
অবস্থা আরও যখন ভয়াবহ হোল- অনেকেই তাদের নিকটজনের মাংস খেতে শুরু;
হলোদোমোরের সময় ব্যাপক নরমাংসের প্রমাণ নথিভুক্ত করা হয়েছিল:
বেঁচে থাকা ছিল নৈতিকতার পাশাপাশি শারীরিক সংগ্রাম। একজন মহিলা ডাক্তার ১৯৩৩ সালের জুন মাসে একটি বন্ধুকে লিখেছিলেন যে তিনি এখনও নরখাদক হননি, কিন্তু "আমার চিঠি আপনার কাছে পৌঁছানোর সময় আমি নিশ্চিত হব না যে আমি নিশ্চিত নই।" ভালো মানুষ আগে মারা যায়। যারা চুরি বা পতিতাবৃত্তি করতে অস্বীকার করেছিল তারা মারা গেছে। যারা অন্যদের খাবার দিয়েছে তারা মারা গেছে। যারা লাশ খেতে অস্বীকার করেছিল তারা মারা গেছে। যারা তাদের সহকর্মীকে হত্যা করতে অস্বীকার করেছিল তারা মারা গেছে। পিতা -মাতা যারা নরমাংস খাদককে প্রতিরোধ করেছিল তাদের সন্তানরা মারা যাওয়ার আগেই মারা গিয়েছিল।
তারাই আগেভাগে মরে গিয়ে বেঁচেছিল। কত মা-বাবা যে তার মৃত সন্তানের কিংবা মৃতপ্রায় শিশু সন্তানকে হত্যা করে মাংস খেয়েছে তার ইয়ত্তা নেই!!
সোভিয়েত শাসক পোস্টার ছাপিয়ে ঘোষণা করে: "আপনার নিজের সন্তানদের খাওয়া একটি বর্বর কাজ।
কত মা তার মৃতপ্রায় সন্তানকে বাঁচাতে গিয়ে আত্মহত্যা করার আগে বলে গিয়েছে—বাছারে তুই আমার শরীরটা টুকরো টুকরো করা খাস।‘
হলোদোমোর চলাকালীন ২৫০০এরও বেশি লোককে নরমাংসের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। হিউম্যান ফ্লেশে’র কয়েক হাজার ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছিল!
একটা লাশ নিয়ে ‘গোরে’ ফেলে মাটিচাপা দিতে পারলে দু’খানা পাউরুটি মিলবে! কিছু লোক সারাদিন মহল্লা গলি আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে লাশ নিয়ে গিয়ে গর্তে ফেলে মাটিচাপা দিত। কখনো দুটো কখনো দশটা কখনো পঞ্চাশ জনকে এক গর্তে মাটিচাপা দেয়া হোত।
আরো বেশী রুটির লোভে শুধু মৃত নয় অর্ধমৃত মনুষদেরকেও তারা ধরে নিয়ে যেতে শুরু করল।
সে ব্যক্তি বা নারী শরীরের সমস্ত শক্তি দিতে প্রতিরোধের চেষ্টা করত- চীৎকার করত’- আমিতো মরি নাই- আমাকে কেন নিয়ে যাচ্ছ? আমি বাঁচতে চাই-ঈশ্বরের দোহাই লাগে আমাকে বাঁচতে দাও।‘ লাশ সংগ্রহকারীরা হেসে হেসে হেসে বলত, তোমার মরার দেরি নেই গোরস্থানে নিতে নিতে মরে যাবে।
~তোমরা হয়তো বিশ্বাস করবে না; ২০ কিংবা পঞ্চাশ জনকে মাটিচাপা দেয়া সেই কবরখানা আমি পরেরদিনও ভীষণভাবে নড়তে দেখেছি। মাটিতে কান পেতে আমি ভয়াবহ চাপা আর্ত চীৎকার শুনেছি...।
কত লক্ষ মৃত-অর্ধমৃত মানুষকে মাটি চাপা দেয়া হয়েছিল তার হিসাব কেউ কোনদিন জানবে না। ধারনা করা হয় ৫০ লক্ষ থেকে এক কোটি বিশ লক্ষ।
---------------------------------------------------------
ইংরেজি উচ্চারণটা ‘হলোদোমোর’ হলে উক্রাইন ভাষায় উচ্চারণ হবে ‘হলোদোমোর’ আর রাশান ‘গলোদোমোর’ গলোদ বা হলোদ অর্থ ক্ষুধা আর মোর অর্থ-মৃত্যু। 'মোর' শব্দটার অর্থ স্বাভাবিক মৃত্যু নয়-অস্বাভাবিক মৃত্যু বা হত্যা 'to kill by starvation'
রুশ ভাষায়‘মোর’ শব্দের অর্থ অভিশপ্ত মহামারী হিসেবেও ব্যাবহার হয় ( এর আরেক অর্থ সমুদ্র)। প্লেগ রোগে মৃত্যুতে এই শব্দটা বেশী ব্যবহৃত হয়েছে।
গলোদোমোর যা সন্ত্রাস-দুর্ভিক্ষ-বা যাকে মস্কো-ভিত্তিক সোভিয়েত নেতারা একে ‘মহা দুর্ভিক্ষ’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
হলোদোমোর-শব্দটি ইচ্ছাকৃত বা মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ যা বাইরের সাহায্য প্রত্যাখ্যান,গৃহ অভ্যন্তর ও বাজার থেকে সংরক্ষিত সমস্ত খাদ্যদ্রব্য তুলে নেয়া বা বাজেয়াপ্ত করা এবং জনগণকে খাদ্যের সন্ধানে অন্যত্র যাবার চেষ্টায় বাঁধা দেয়া হয়।
সবে ২০০৬ সালে মানবসৃষ্ট সেই ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বারা ‘গণহত্যার’ স্বীকৃতি পায়!
তিন পর্বের(সম্ভবত) প্রথম পর্ব সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০২১ সকাল ৮:০৮