আমার প্রিয় বন্ধুরা,আমি নাসরেদ্দিন হোদজা। ‘হোদজা’র অর্থ যে শিক্ষক সেটা আগেই বলেছিলাম। একাডেমিক শিক্ষার জন্য আমার টাইটেল ছিল মৌলভী- তবে ভালবেসে অনেকেই আমাকে মোল্লা বলে ডাকতেন। বিশ্বের বেশিরভাগ মুসলিম দেশে আমাকে শ্রদ্ধাভরে মোল্লা বলেই ডাকে। অনেকে আবার মোল্লা-টাকে ব্যাঙ্গ বা মজার ছলে ব্যাবহার করে। আপনারা যেমন বলেন কাঠ মোল্লা!
আমার জন্ম বা জন্মস্থান নিয়ে ৮ শতকের বেশী সময় নিয়ে টানাটানি হচ্ছে।
ইরানী বা পার্সিয়ানরা দাবী করে আমি তাদের লোক। সেই সুত্রে উজবেক জনগন দাবী করে আমি তাদের- আবার চীনের উইঘুরের বলে হোদজা আসলে তাদেরই। ওদিকে ঐতিহাসিকেরা অনেক তথ্য প্রমান ঘেটে বের করেছে আমার জন্ম তুর্কিতেই। ব্যাপারটা আমার জন্যে বেশ গর্বের! কেননা সবাই আন্তরিকভাবেই আমাকে তাদের লোক ভাবতে ভালবাসে।
আসুন প্রথমে ইরানীদের কাছে শুনি তারা আমাকে কোন যুক্তিতে তাদের নিজের লোক বলে মনে করে;
মোল্লা নাসরেদ্দিন হলেন এক পার্সিয়ান চরিত্র, যিনি হাজারো গল্পে উপস্থিত হন। সবসময় মজাদার, কখনও জ্ঞানী, এমনকি দার্শনিক, কখনও কখনও অন্যের উপর ব্যবহারিক রসিকতার প্ররোচনা এবং প্রায়ই বোকা বা কৌতুককর। মোল্লা নাসেরদ্দিন সম্পর্কিত গল্পগুলি সাধারণত হাস্যকর, তবে সূক্ষ্ম কৌতুকের ক্ষেত্রে সর্বদা একটি শিক্ষামুলক কথা বা পাঠ থাকে। মোল্লা নাসেরুদ্দিন হলেন একটি ব্যঙ্গাত্মক সুফি ব্যক্তিত্ব যিনি প্রায় ১৩ শ শতাব্দীর কাছাকাছি বাস করেছিলেন বলে মনে করা হয়। নাসরদ্দিন ছিলেন এক জ্ঞানী এবং তাঁর মজার গল্পের জন্য স্মরণীয়।
সুফিজম-একটি ইরানী ইসলামী সম্প্রদায়, যা বাহ্যিক ধর্মভিত্তির চেয়েও অভ্যন্তরীণ গুণকে মূল্য দেয়। বোখারার (পার্সিয়া/ইরানের অংশ যা এখন উজবেকিস্তানে রয়েছে) লোকেরা তাকে সেই শহরের আদিবাসী বলে দাবি করেছে।
~কিন্তু তুর্কিরা তাকে তুরস্কের নিজেদের মানুষ বানানোর চেষ্টা করেছে! তুর্কিরা সত্যই নির্লজ্জ। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, তারা দাবি করেছে যে মহান পারস্যের কবি,জালাল আল-দীন রুমী (মোলভী) ছিলেন তুর্ক !!এতে কোনও সন্দেহ নেই যে রুমী পার্সিয়ান। তার সমস্ত রচনা ফার্সিতে রয়েছে,তাঁর সমস্ত পরিবার পার্সিয়ায় বাস করত,তবে তুর্কিরা বলে তার তুর্ক!~
কিছু ইরানিরা মজা করে বলেছেন: "যদি রুমি তুর্ক হত তবে শেক্সপিয়ারও তুর্ক ছিল’। মোল্লা (মোল্লা) নাসেরদ্দিনের বিষয়টাও রুমির মতো। দ্বাদশ থেকে ১৪ শতকের দিকে রুমি,সা’দী,ওবিদ প্রভৃতি মহান পার্সিয়ান কবি ও লেখকদের দুর্দান্ত বিদ্রূপাত্মক রচনাগুলি আমাদের নাসেরদীনের শেকড় বলে ধরতে পারি।
এখন মোল্লা নসরুদ্দীন একটি আন্তর্জাতিক চরিত্র এবং তাঁর গল্পগুলি বহু যুগ এবং বহু সংস্কৃতির। পার্সিয়ান, পার্সিয়ান উপগোষ্ঠী রয়েছে (কুর্দি, এবং পার্সিয়ার সমস্ত পূর্ববর্তী অংশ যেমন আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ইত্যাদি) তুর্কি, আলবেনীয়, আরবি, বসনিয়ান, বুলগেরিয়ান, চাইনিজ, গ্রীক, সার্বিয়ান ইত্যাদি নাসরুদ্দীন গল্পের উত্স।
তিনি নসরুদ্দিন, নাসরুদ্দিন,নাসিরুদ্দিন, নাসের, বা নাসের আল দিন, নাসের আল দায়ু, নস্রুদ্দিন এরকম ভিন্ন ভিন্ন নামে লোকে চেনে তাকে। আবার পদবিগুলোও বেশ পার্থক্য নজরে পরে- যদিও এর বেশীরভাগ বিভিন্ন ভাষার সম্মানসূচক পদবীঃ জোহা, হোজাস, জিহা, জুহা, খোদজা,হোদজা, হোজ্জা, মোল্লা,অপেন্দি,আফান্দি(একখানে ঋষি ও উল্লেখ আছে) ইত্যাদি নামে পরিচিত।
--------------------------------------------
পার্সিয়ানদের কথায় যুক্তি কম আবেগ আর ঝাঁঝ বেশী। যেহেতু ওরা আমার জন্ম বোখারায় হয়েছিল বলে মনে করে সেহেতু বোখারা এখন উজবেস্থানের অন্তর্গত হওয়ায় উজবেকদের দাবিটা ন্যায্য।
আমার দেহগত মৃত্যুর বহু বছর বাদে ভারতবর্ষের সু বিখ্যাত সুফি কবি মির্জা আব্দুল্লাহ বেগ খানের জন্ম হয়েছিল। যাকে তোমরা ‘মির্জা গালিব’ নামে জান। তিনি আমাকে নিয়ে আলোচিত একটা উপাখ্যানের মুল তত্ত্ব অবলম্বন করে তার বিখ্যাত একটা শায়েরি করেছিলেন;
“গালিব(ঘালিব) শরাব পিনে দে মাসজিদ মে বৈঠ কার
ইয়া- ওহ জাগা বাতা জাহা খুদা নেহী হ্যায়”
-------------------------------------------------------
এবার আমার সেই মুল গল্পে আসি;
আমি বহু বছর পরে আবার আমার বন্ধু টেক্কার গ্রামে ভ্রমণ করেছি।টেক্কার বাড়িতে আসতে গিয়ে কি হ্যাপাটাই না পোহাতে হয়েছে সেটা গত পর্বেই বলেছি। এবার টেক্কার এখানে এসে আমি আশ্চর্য হয়ে গেছি দেখে যে, আমার সেই অতি চঞ্চল যাযাবর টাইপ বন্ধুটা খুব ধার্মিক হয়ে উঠেছে। বেশ জাঁকজমক করেই সে ধর্ম পালন করছে-কখনও কখনও কিছুটা আড়ম্বরপূর্ণ, কিন্তু তবুও আমি আমার বন্ধুকে আগের মতই ভালবাসি।
আমাকে দেখেই সে দারুন উৎফুল্ল হয়ে হোই হুল্লোড় করে কাছে টেনে নিল। এমনভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখল যে, ভেবেছিলাম বাহু থেকে আর মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
"নাসরুদ্দিন,আমার প্রিয় বন্ধু- আপনি চোখের আলো," টেক্কা বললেন,আপনি এখান থেকে আর কোথাও যাবেন না-আমরা দুই বন্ধু আমৃত্যু একসাথেই থাকব।"
আমি তাকে নিরাশ করিনি। পরে কি হবে দেখা যেবে, সে সময়ের জন্য আমি তার সদয় আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলাম।
রাতে দারুন এক ভোজ হোল। ভোজ শেষে দু বন্ধু গল্প করতে করতে রাত গভীর হয়ে গেল! পথে বাঘের সাথে দৌড় ঝাঁপ করে আমি বেশ ক্লান্ত ছিলাম!
তিনি আমাকে আমার শোবার ঘর,যার পূর্ব দিকে একটি জানালা লাগোয়া বিছানা দেখিয়ে বেশ গর্ব ও ভক্তির সাথে বললেন; "আমি আপনার ঘুমানোর ব্যবস্থা এমনভাবে করেছি যাতে আপনার মাথাটা মক্কার দিকে থাকে"। "আপনাকে অবশ্যই সর্বদা আল্লাহর ঘর মক্কার দিকে মাথা রেখে ঘুমাতে হবে। রাসূলের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে-তার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।"
বন্ধু টেক্কার বাসায় আমার প্রথম রাত,ভীষণ ক্লান্তির কারনে আমি বিছানায় গিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছি। দারুন একটা ঘুম হোল। পরদিন সকালে যখন টেক্কা আমাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুলল,তখন তিনি খুব উত্তেজিত ছিলেন।
"নাসরুদ্দিন,আমি চরম হতাশ!" আমি নিজের মনে বললাম,"আমি প্রায়শই নিজেকে হতাশ করি,টেক্কা,আজকের সমস্যাটি কি বলে মনে হচ্ছে?"
"আপনি মক্কার দিকে পা দিয়ে শুয়ে ছিলেন ! এটি অত্যন্ত অসম্মানজনক!"
"আমার ক্ষমা চাইছি, টেক্কা। এটা অনিচ্ছাকৃত ছিল - ঘুমের ঘোরে কখন আমার পা ওদিকে ঘুরে গেছে আমি টেরই পাইনি।"
টেক্কা অবশেষে শান্ত হোল। কিন্তু জোর দিয়ে বলেছিল যে, পরের রাতে আমার আরো সাবধানে ঘুমানো উচিত। আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম।
পরের রাতে- প্রথম রাতের সাদৃশ্য। আমি বেশ ভাল ঘুমিয়েছিলাম, তবে ঘুমের ঘোরে আমার পা মাদুরের শেষে আমার বালিশে এবং আমার মাথাটি মেঝেতে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য খুঁজে পেয়েছিল।“
আমি আমার দুর্দশা বুঝতে পারার সাথে সাথে টেক্কা দরজায় দাঁড়িয়ে চিন্তায় পড়ে গেল।
"এটি কখনই করবেন না, নাসরুদ্দিন। আপনি একজন ভাল নাগরিক এবং একজন ভাল মুসলমান। আপনাকে অবশ্যই মক্কা থেকে বিপরীত দিকে আপনার পা এবং আপনার মাথা মক্কার দিকে ইঙ্গিত করে নবীকে শ্রদ্ধা ও আল্লাহর প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করে ঘুমাতে হবে।"
"আমার বন্ধু,এ ধরনের জিদ করার কারণ কী?" আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম.
"আপনি অবশ্যই আপনার পা ঈশ্বরের দিকে ফেরাবেন না !" তিনি ফের বললেন,অবশ্যই নিজের মাথা ঈশ্বরের দিকে এবং পা তাঁর কাছ থেকে দূরে রাখতে হবে" "
দিনের বেলায় আমি ব্যাপারটা একরকম ভুলেই গেলাম। আমরা সারাটা দিন একসাথে কাটালাম এবং সেই রাতে টেক্কা বেশ জোরের সাথে খানিকটা হুমকির সুরে বলল"নাসরুদ্দিন,-আপনি যদি কাবার দিকে মাথা রেখে ঘুমাতে না পারেন, তবে আমাকে ভীষণ দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে আমি আপনাকে আমার বাড়িতে রাখতে পারব না। একজন পুরানো বন্ধুকে একথাটা বলতে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে,তবে আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি প্রদর্শনের জন্য এছাড়া উপায় কি বলুন?"
তৃতীয় রাত অনেকটা আগের দু-রাতের মতোই ছিল। তবে এরাতে আমি উল্টো দিকে উপুর হয়ে শুয়েছিলাম। পরদিন ভোরে ফের আমাকে এ অবস্থায় দেখে আমার প্রিয় বন্ধু টেক্কা কষ্ট ও রাগে-ক্ষোভে কাঁপছিল!
"আপনি কিছু বলার আগে আমার কথার উত্তর দিন টেক্কা," আমি উঠে বসলাম।
"আল্লাহ কি সব কিছুর উপর এমনকি মানুষের ভাগ্যকেও নির্ণয় করেন?"
"আপনি জানেন তিনি কি করেন," টেক্কা আশ্চর্য হয়ে বললেন।
"আল্লাহ কি তাঁর সৃষ্টির প্রতিটি অংশে আছেন?"
"অবশ্যই তিনি আছেন!"
আমি আকাশে উড়তে থাকা এক ঝাঁক পাখির দিকে জানালার দিয়ে ইশারা করলাম।
"সে কি বাতাসে পাখির সাথে আছেন" ?
"হ্যাঁ-টেক্কা বলল। "কেন আপনি এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছেন?"
-দয়া করে পুরানো বন্ধুর কিছু প্রশ্নের ধৈর্যের সাথে উত্তর দিন;
"আল্লাহ কি সর্বত্র, এমনকি মরুভূমি এবং পর্বতমালা, সাগরে, আকাশে সবখানে আছেন?"
অবশ্যই "আল্লাহই স্রষ্টা। আল্লাহ তার সব সৃষ্টিতে রয়েছেন এবং তিনিই সৃষ্টির মালিক।" ভীষণ উত্তেজিত টেক্কা।
"তাই,টেক্কা, বন্ধু আমার" আমি তার সামনে আমার পা জোড়া মেলে ধরে জিজ্ঞেস করলাম,
- ‘আপনি বলুন, কোথায় ঈশ্বর নেই – আমি সেখানে আমার পা-জোড়া রাখব?!"
( মোল্লা নাসরেদ্দিনকে নিয়ে এই গল্পটা পার্সিয়ান ভাষা থেকে অনুবাদকৃত। অনেকটা এমনই একটা গল্প শিখ ধর্মের শ্রদ্ধেয় গুরু নানক'কে নিয়ে আছে।)
আগের পর্বের জন্যঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২১ সকাল ৯:৪৫