শুভ দিন! আমার নাম নাসরেদ্দিন-আপনারা হয়তো আমার নাম শুনে থাকবেন; আপনাদের দেশে এসে আমার নাম হয়েছে নাসিরুদ্দিন হোজ্জা। কি আশ্চর্য এই মুহূর্তে আমি আমার বাপ দাদার দেয়া নামটাই মনে করতে পারছি না!
আমার জন্ম উজবেকের সমরখান্দে। নাহ, আরবের কোন এক বেদুইনের ঘরে ... এটি অনেক আগে ছিল ... আমার জন্ম মিশরের কায়রোতেও হতে পারে। আসলে,আমি মনে করি সেটা ছিল চীনের উইঘুরে। যদিও আমার চাচা দাবি করেছেন যে আসলে আমি জন্মেছিলাম তুরস্কে! কিন্তু আমার জন্ম সনদপত্রটি বলছে; আমি নাকি আজারবাইজানের বাকুতে জন্মেছি।
প্রিয় ব্লগার, নাসরেদ্দিন হোদজাকে নিয়ে এই লেখাটা এক্সপেরিমেন্টাল দীর্ঘ ধারাবাহিক। এই ধারাবাহিকে থাকবে নাসরেদ্দিনকে নিয়ে মিথ, ইতিহাস, রাজনীতি, ধর্মযুদ্ধ, গল্প, কৌতুক সহ আরো নানান বিষয়। করোনাকালীন দীর্ঘ অবসরে আমি প্রায় একুশটা ভাষা থেকে(যার বেশীরভাগ ভাষাই আমার অজানা) গুগল অনুবাদকের সাহায্য ও নিজের কিছু ভাষাজ্ঞান দিয়ে এই সুদীর্ঘ বিশ্লেষণধর্মী লেখাটা লিখতে চেষ্টা করেছি- যা এখনো অসমাপ্ত! আশা করছি আমার ঋদ্ধ লেখক সাহিত্যমনা ব্লগারদের সমালোচনা ও সহযোগীতায় লেখাটা শেষ পর্যন্ত এগিয়ে নিতে পারব। লেখায় ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
---------------------------------------------------
যাইহোক, আমি যে সত্যিকারে জন্মেছি তার প্রমাণ হিসাবে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। আমি আমার বন্ধু টেক্কার সাথে দেখা করতে এসেছি- আমি সেই গল্পটাই আজকে বলতে চাই। আমি যখন যুবক ছিলাম তখন তার সাথে আমার শেষবার দেখা হয়েছিল, তবে সেই সাক্ষাতের গল্পটা আমি আপনাদের আরেকদিন শোনাব- সেটা সম্পূর্ণরূপে অন্য গল্প।সেবার আমি আমার বন্ধু টেক্কার বাড়িতে প্রথমবার পদ্মার ইলিশ খেয়েছিলাম। কি যে স্বাদ সে মাছের এখনো মুখে লেগে আছে। সেই মাছের লোভে সুদূর বংগ দেশে পদ্মার পাড়ে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। ও হ্যাঁ আপনারা হয়তো বহুবার সে গল্প শুনেছেন; নাসিরুদ্দিন হোজ্জা ও ইলিশ মাছ।
আমি তখন রিক্ত নিঃস্ব- এতদূর পথ আসতে গিয়ে বহুবার জিন্দা পীর, কাপালীক সন্ন্যাসী, ঠগ আর লুণ্ঠনকারীর হাতে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছিলাম। একখানা ইলিশ মাছ কিনব সেই পয়সাটুকু আমার কাছে ছিল না। কি করব অবশেষে একটা ইলিশের চারটা টুকরো মাত্র কিনে নিয়ে আমি রাস্তা দিয়ে ফিরছিলাম। কোত্থেকে এক বেঙ্গল ক্রো এসে সেই মাছের থলেটা ছোঁ মেরে আমার হাত থেকে নিয়ে উড়াল দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি পুরা তব্ধা মেরে গিয়েছিলাম। আসার পথে এক বোবা পীর আমাকে কাক পক্ষীর ভাষা শিখিয়েছিলেন। আমি মনের দুঃখে কাককে বললাম, কুৎসিত পক্ষী, তুইতো ইলিশ মাছ রাঁধতে জানিস না – কাঁচা ইলিশ নিয়ে কি করবি!
কাকটা এমন একটা বিটকেলে হাসি দিল; সে বলে হোজ্জা- এটা-তো পদ্মার ইলিশ কাঁচাও খেতে বেশ মজা।
আমার চাচা বলেছিলেন তুর্কিতে নাকি আমি মক্তবের শিক্ষক ছিলাম তাই সবাই আমাকে শ্রদ্ধাভরে ‘হোদজা’ বলে ডাকত। সেই হোদজা এখানে এসে হয়ে গেছে হোজ্জা। এ পদবীর মানে আমি জানিনা। এই দেশে এসে বাপ ঠাকুর্দার নাম পদবী সব হারাইলাম- তারপরে এদেশে পশু পাখি কীট পতঙ্গ সবাই ইলিশ ভক্ত। আমার মত কপর্দকশূন্য এক মানুষের ইলিশ খাওয়ার কোন উপায় নাই। তাই মনের দুঃখে ফিরে গেলাম আফগানস্থান।
আমি এখন একটা বিশাল এক জঙ্গলের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। এই জঙ্গলটা পার হলেই টেক্কার নিজের গ্রাম,বেশ কয়েকদিন আগে আমাদের মাঝে শুধু একটা বিশাল ঊষর মরুভূমি আর এই জঙ্গলটা ছিল।
মরুভূমি ভ্রমণটা বেশ সহজ ছিল। বারো দিন একটানা জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের ভেতর দিয়ে হেটে এসেছি ... সেটা কোন ব্যাপার নয়- সেখানে ঘাম নেই।
ঠিক আছে,তবে গল্পে ফিরতে আমি জঙ্গলে এসেছি। আপনি যদি কখনও সুন্দরবন দেখে থাকেন তবে আপনি জানেন যে এটি বড় এবং অন্ধকার এবং গাঢ় সবুজ। গাছগুলি লম্বা,ঝোপঝাড়গুলি ঘন এবং প্রচুর ছোট্ট ছোট্ট প্রাণী রয়েছে ।
আমি আমার পথচলা শুরু করলাম; পথটি বেশ সরু ছিল,এবং উভয় পাশের জঙ্গলও খুব ঘন এবং কণ্টকাকীর্ণ ছিল এবং পথটির উপরে এমনভাবে সব বিছিয়ে ছিল যে পুরো রাস্তাটাই বন্ধ হয়ে গেছে! যা আমাকে কিছুটা উদ্বিগ্ন করেছিল।
তবে আমি আমার বন্ধু টেক্কাকে ভালোবাসি, তাই আমি নিজেকে বলেছিলাম, নাসরেদ্দিন, আপনি একজন বোকা প্রাণী। টেক্কাকে দেখার জন্য আপনাকে অবশ্যই এই জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আপনি আপনার বিষয়ে মনোযোগ দিন কেবল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার কথা ভাবুন!" যাওয়া না যাওয়া নিয়ে আমি নিজের সাথে নিজে তর্ক করার চেষ্টা করেছিলাম, তবে এতে কোনও লাভ হয়নি। আমাকে যেতেই হবে।
তাই আমি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম, এবং আমার চোখ অন্ধকারে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় পথটা আর এতটা খারাপ মনে হচ্ছিল না। আমি যখন মনের সুখে হাঁটছিলাম তখন পিছনে একটি আওয়াজ শুনতে পেলাম: "হাহহহ ... হাহহহ ... হালুম"। আমি আমার কাঁধের ওপর দিয়ে মাথাটা ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকালাম, এবং অবাক হয়ে দেখলাম, একটি বাঘ ও জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আমার পিছু পিছু হাঁটছিল!
"আহ," আমি নিজেকে বলেছিলাম,এই পরিস্থিতিতে আমি যা করতে পারি তা সবচেয়ে ভাল। তারপরে আমার একটা চিন্তা ছিল,যাহোক আমার ভেতরে একজন মোল্লা মৌলভী বা আধ্যাত্মিক কেউ একজন বাস করে সে আমাকে প্ররোচিত করল" আপনার সু-স্বাস্থ্যের কথা ভেবে আপনি চাইলে এই মুহূর্তে খানিকটা জগিং করে ঘাম ঝড়িয়ে নিতে পারেন।
ঠিক আছে এই মুহূর্তে" আমি রাজি হয়েছি, এবং সাথে সাথে শুরু করেছিলাম। আমি ধীরে ধীরে জগিং করতে করতে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, আমার মনে হচ্ছিল আমার সুস্বাস্থ্যের জন্য এটা খুব ভাল একটা ব্যাপার ছিল।
ফের আমি আমার পিছনে একটি শব্দ শুনলাম: "হাহাহাহ ... হাহহহ ... আ হালুম"। আমি আমার কাঁধের ওপর দিয়ে পেছন ফিরে তাকালাম, এবং - আপনি কী জানেন! - বাঘও জগিং করছিল। যদিও আমার কাছে এটা বেশী বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল তবুও মেনে নিলাম। আমার কেন যেন মনে হোল পুষ্টির থেকে সেই বাঘটা অতিমাত্রায় স্বাস্থ্য সচেতন হিল।
ব্যায়ামের উপকারী প্রভাবের কারণে, আমার মস্তিষ্ক আরও দক্ষতার সাথে কাজ করছিল। "আপনি যদি জগিং করতে পারেন তবে অবশ্যই আপনি দৌড়াতে পারবেন," আমি নিজেকে বলেছিলাম। "কেন আমি বিশ্ব রেকর্ডের জন্য চেষ্টা করব না?"
ভাবতে ভাবতেই আমি তৎক্ষণাৎ শুরু করেছিলাম স্থল গতির জন্য নতুন বিশ্ব রেকর্ড স্থাপন করতে পারি কিনা তা দেখতে। আমি সেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এমনভাবে দৌড়ুচ্ছিলাম যেন পথটি একটি হাইওয়ে।
আমি নিশ্চিত যে একটি বিশ্ব রেকর্ড আমার দখলে ছিল,কেবল যদি স্টপ ওয়াচ হাতে বিচারক থাকতেন। দৌড়াতে দৌড়াতেই আমি আমার পিছনে একটি পরিচিত শব্দ শুনতে পেলাম, যা সম্ভবত "হাহহহহহহহহহহ" এর মতো উচ্চারণের মতো -ব্যাখ্যা করা দুরূহ! আমার ধারনা বাঘটাও আমার সাথে বিশ্বরেকর্ড করার জন্য মরিয়া !
দুই অ্যাথলেট জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বাতাসের মতো ছুটে চলেছেন! রোমাঞ্চকর ছিল! এটা ছিল উত্তেজনাপূর্ণ! ভয়াবহ! আচমকা দেখলাম সামনে কোনও জঙ্গল নেই!
আসলে সামনে কোনও পথই ছিল না, কেবল নীল আকাশ ও একটি শিলাখন্ড, আর আমি, নাসরেদ্দিন, পড়ে যাচ্ছিলাম। আমি বলেছিলাম, "আউউফ !!" পতন ঠেকাতে গিতে পাহাড়ের খাড়ায় কোনমতে একটা লতা গুল্ম কিংবা একটা ঝোপ আকড়ে ধরলাম।
(আপনি কি কখনও খেয়াল করেছেন, প্রতিবার আমি যখন একটি পাহাড়ের উপর থেকে নীচে পড়ে যাই তখন সেখানে আমাকে বাঁচানোর জন্য ঝোঁপঝাড় বা কিছু একটা থাকে।)
তাই আমি এই ঝোঁপটি ধরলাম এবং প্রিয় জীবনটা বাঁচানোর জন্যই ঝুলে রইলাম। আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে এটিকে আঁকড়ে ছিলাম, যার প্রয়োজন আমার ছিল, কারণ উপর থেকে বাঘ আমার দিকে তাকিয়েছিল আর বলেছিল ‘’ হাঃ হাঃ হালুম হালুম " ~তুমি কি আর কোন কথা জানো না?"
আমি জিজ্ঞেস করলাম তাকে( স্পষ্টতই তা নয়) বাঘ বার বার একই কথা বলছি। আমি এমন ভয়ঙ্কর অবস্থা থেকে উদ্ধারের মরিয়া হয়ে চারপাশে তাকাচ্ছিলাম।, কিন্তু কোন উপায় পেলাম না। উপরন্তু আমি লক্ষ্য করলাম ঝোপের শিকড়গুলি একের পর এক খুলে আসতে শুরু করেছে।
"নসরুদ্দীন," আমি নিজেকে বলেছিলাম, আমি যখন সমস্যায় পড়ি তখন দুই লাইনের একটা গান গাই, যা আজকাল প্রায়শই বেশি বেশি মনে হয়, "ওহে নাসরেদ্দিন, / তুমি একদিন কাউকে ভাল বেসেছিলে।‘’কি একটি দুর্দান্ত ছোট্ট রোমান্টিক গান,খুব সান্ত্বনার। গানটি অবশ্যই সেই মুহূর্তে আমাকে সহায়তা করেছিল।
গান গাইতে গাইতেই আমি আমার পিছনে এবং নীচে একটি শব্দ শুনতে পেলাম যা অদ্ভুতভাবে পরিচিত লাগছিল: "হাহাহাহ ..হালুম’!!
"অপেক্ষা করুন!" আমি নিজেকে বলেছিলাম, "আমি ভেবেছিলাম এই শব্দটি উপরে থাকা বাঘের কথার প্রতিশব্দ!" আমি নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে খারাপের পরে সবসময় ভালই আসে। কেন এমন আপনার কি মনে হয়?
তবে ভালটি খুব বেশি ভাল ছিল না এবং বেশ ভাল বিষয় যে এখান থেকে পড়ে গেলে আমার বিশেষ কোনও ক্ষতি হবে না। খারাপ ব্যাপারটা ছিল ঠিক আমার পায়ের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য বাঘটি,সে আমার দিয়ে জুল জুল করে তাকিয়ে আছে!
আমি সেখানে ঝোপগুলো কোনমতে আঁকড়ে ধরে উপর ঝুলন্ত অবস্থায় ছিলাম যার শিকড়গুলি উপড়ে যাচ্ছিল, আমার উপরে বাঘ এবং আমার নীচে একটি বাঘ ছিল। আমি আমার সেই ছোট্ট বিস্ময়কর গানের জন্য এটাকে ফের একটি ভাল মুহূর্ত বলে মনে করেছি, তাই আমি আবারও গাইলাম, ""ওহে নাসরেদ্দিন, / তুমি একদিন কাউকে ভাল বেসেছিলে। এটা 'এ' মেজর-টিউনে ছিল'।" এর প্রভাব ছিল - আমার মাথা পরিষ্কার ছিল এবং আমি আমার অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মরিয়া হয়ে ছিলাম।
আমি দু'পাশে তাকালাম, এবং ডানপাশে কিছু সবুজ ঝোপঝাঁড়ের ফাঁকে একটি লাল রঙের স্ট্রবেরি নজরে এল। এটি একটি বন্য স্ট্রবেরি ছিল!
আমার দর্শন সর্বদা আমি যেখানেই যেই অবস্থায় থাকি না কেন নিজেকে পুরোপুরি উপভোগ করা। তাই আমি আমার পায়ের আঙ্গুলগুলির সাথে পাহাড়ের খাড়িটা বেশ ভালভাবে আঁকড়ে ধরলাম, যা যথেষ্ট বিবেচ্য এবং আমি এক হাতে ঝোঁপটি ধরেছিলাম এবং একটু কসরত করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে গেলাম। পুরো ব্যাপারটাতে খানিকটা,ঝুঁকি ছিল কিন্তু সেই স্ট্রবেরিটা অবশেষে আমার হাতের মুঠোয় এলো।
আমি ওটা খেয়েছিলাম? ওহ, হ্যাঁ, আমার প্রিয় বন্ধুরা,সেই মুহূর্তে আমি ঝোপ আকরে একটা পাহাড়ের ঢালে কোনরকম পতন ঠেকাচ্ছিলাম- সে ঝোপগুলোর শেকড় আলগা হয়ে যাচ্ছিল। আমার উপরে একটি বাঘ এবং নীচে একটি বাঘ আছে, এবং আমি তখন একটি বন্য স্ট্রবেরি খুঁজে পেয়েছিলাম এবং এটি খেয়েছিলাম এবং বিশ্বাস করুন সেটা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে সুস্বাদু ও মধুরতম স্ট্রবেরি!
* *
কোথায় যাচ্ছেন অপেক্ষা করুন ... শেষমেশ বাঘ আর আমার কি হবে? সেই গল্পটা কি বলব? ঠিক আছে,সংক্ষেপে বলিঃ তারা বেশ সজ্জন ও ভদ্র সভ্য বাঘ ছিল~ তারা আমাকে খুব বেশী কাছ থেকে দেখে আমাকে খাবার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২১ সকাল ৯:২১