সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রাণীদের পুনরুৎপাদন করার জন্য প্রজনন প্রয়োজন। কিন্তু প্রাণীদের একটি ছোট উপসেট সঙ্গম ছাড়াই বংশধর হতে পারে।
পার্থেনোজেনেসিস(যৌন সংসর্গ ব্যতীত সন্তান জন্ম) নামক একটি প্রক্রিয়া মধু মৌমাছি থেকে র্যাটলস্নেক পর্যন্ত প্রাণীদের তথাকথিত ‘ভার্জিন বার্থস’(কুমারী জন্মদান) করতে দেয়।
এই ধরনের ঘটনাগুলি যারা চিড়িয়াখানা বা বা পশু আশ্রমে পশুদের দেখভাল করে তাদের চমকে দিয়েছে। উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছে লিওনি নামে একটি জেব্রা হাঙর, যা অস্ট্রেলিয়ান অ্যাকোয়ারিয়াম রিফ সদর দফতরে অন্যান্য মহিলা হাঙ্গরদের সাথে সাথে রাখা হয়েছিল; উল্লেখ্য সেখানে কোন পুরুষ হাঙ্গর ছিল না। হাঙরটি ২০১৬ সালে সবাইকে হতবাক করে দিয়েছিল- যখন তার তিনটি ডিম থেকে জীবন্ত বাচ্চা হয়।
এর কয়েক বছর আগে, লুইসভিল চিড়িয়াখানায়, থেলমা নামে একটি জালিকা প্যাটার্নের অজগর- যেটি সহবাস তো দুরের কথা তার জীবদ্দশায় কখনও পুরুষ অজগর দেখেনি সে ছয়টি ডিম পাড়ে যেগুলি থেকে সুস্থ তরুণ বাচ্চা বেরিয়েছিল। ২০০৬ সালে, ইংল্যান্ডের চেস্টার
চিড়িয়াখানায়, ফ্লোরা নামে একটি কমোডো ড্রাগন একই রকম একটি কীর্তি সম্পাদন করে চিড়িয়াখানার কর্মচারীদের হতবাক করে দেয়!
থেলমা
পার্থেনোজেনেসিস দুটি গ্রীক আদি শব্দ παρθενική δημιουργία থেকে এসেছে যা আক্ষরিক অর্থে ‘কুমারী সৃষ্টি’!
কিভাবে এটা কাজ করে?
যৌন প্রজননের দুটি উপাদান রয়েছে: ডিম এবং শুক্রাণু। যেগুলো প্রতিটি জীবন্ত জীব তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় জেনেটিক তথ্যের অর্ধেক সরবরাহ করে। কিন্তু পার্থেনোজেনেসিসে, শরীর সাধারণত শুক্রাণু দ্বারা প্রদত্ত জিন প্রতিস্থাপনের একটি অনন্য উপায় খুঁজে পায়।
ডিম্বাশয়গুলি মিয়োসিস নামক একটি জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ডিম উত্পাদন করে, যেখানে কোষগুলি প্রতিলিপি, পুনর্গঠন এবং বিভক্ত হয়। এই ডিমগুলিতে মাতৃ ক্রোমোজোমের অর্ধেক থাকে, প্রতিটি ক্রোমোজোমের একটি কপি। (এগুলিকে হ্যাপ্লয়েড কোষ বলা হয়; দুটি ক্রোমোজোম কপিযুক্ত কোষগুলিকে ডিপ্লয়েড কোষ বলা হয়।)
মিয়োসিসের প্রক্রিয়াটি একটি উপজাত (ছোট কোষ) তৈরি করে: এই ছোট কোষগুলিকে ‘পোলার বডি’ বলা হয়, যা নিষিক্ত ডিম থেকে আলাদা। পার্থেনোজেনেসিসের একটি সংস্করণে, যাকে অটোমিক্সিস(স্বয়ংক্রিয়ভাবে মিশ্রিত) বলা হয়, একটি প্রাণী সন্তান উৎপাদনের জন্য একটি ডিমের সাথে একটি পুরো বিপরীতধর্মী অণুকে সম্পূর্ণরূপে মিলিয়ে ফেলতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি, যা হাঙরের ব্যাপারে ঘটেছে;
'মিয়োসিস'
মায়ের জিনগুলিকে সামান্য এলোমেলো করে এমন সন্তান তৈরি করে যা মায়ের মতো দেখতে কিন্তু সঠিক ক্লোন নয়।
পার্থেনোজেনেসিসের আরেকটি ফর্মে, এপোমিক্সিস, প্রজনন কোষগুলি মাইটোসিসের মাধ্যমে প্রতিলিপি তৈরি করে, একটি প্রক্রিয়া যেখানে একটি কোষ নিজের সদৃশ দুটি ডিপ্লয়েড কোষ তৈরি করতে করে – যা মূলত এক ধরণের জেনেটিক কপি ও পেস্ট! যেহেতু এই কোষগুলি কখনই মিয়োটিক মিশ্রণের(এক ধরনের কোষ বিভাজন যার ফলে চারটি কন্যা কোষ থাকে যার প্রতিটিতে মূল কোষের ক্রোমোজোমের অর্ধেক সংখ্যা থাকে) প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায় না, এইভাবে উৎপন্ন বংশধরগুলি তাদের পিতামাতার জিনগতভাবে অভিন্ন ক্লোন। পার্থেনোজেনেসিসের এই রূপটি উদ্ভিদে বেশি দেখা যায়।
বেশিরভাগ জীবের জন্য যারা প্রথমে অটোমিক্সিসের মাধ্যমে পুনরুত্পাদন করে, সন্তানরা সাধারণত তাদের মায়ের কাছ থেকে দুটি X ক্রোমোজোম পায়। দুটি X ক্রোমোজোম, প্রাথমিক লিঙ্গ-সংযুক্ত জেনেটিক স্টোর, শুধুমাত্র স্ত্রী সন্তান উৎপাদন করে।
কিন্তু বিরল ক্ষেত্রে, এফিডের মতো প্রাণীরা দ্বিতীয় X ক্রোমোজোমের ছাড়াই, তাদের মায়ের সাথে জিনগতভাবে অভিন্ন যৌন সক্ষম পুরুষ সন্তান তৈরি করতে পারে। এই পুরুষরা সাধারণত সক্ষম হয়- কিন্তু যেহেতু তারা শুধুমাত্র এক্স ক্রোমোজোমযুক্ত শুক্রাণু তৈরি করতে সক্ষম, তাই তাদের সব সন্তানই হবে নারী।
ছোট-বড় প্রাণী
লক্ষ লক্ষ বছর ধরে, প্রাণীরা পার্থেনোজেনেসিসের মাধ্যমে পুনরুত্পাদন করেছে, যা প্রথম কিছু ক্ষুদ্রতম এবং সরল জীবের মধ্যে উপস্থিত হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে মেরুদণ্ডের মতো আরও উন্নত প্রাণীদের জন্য, অযৌনভাবে প্রজনন করার ক্ষমতা প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি প্রজাতির জন্য শেষ অবলম্বন হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল। এর মাধ্যমেই এখন ব্যাখ্যা করতে পারে যে কেন অনেক মরুভূমি এবং বিরান দ্বীপে কিছু প্রজাতির পার্থেনোজেনেসিস সম্ভব হয়েছে।
পার্থেনোজেনেসিস দ্বারা সন্তান জন্ম দেয়া বেশিরভাগ প্রাণী হল ছোট অমেরুদণ্ডী প্রাণী যেমন মৌমাছি, ওয়াপস, পিঁপড়া এবং এফিড যা যৌন এবং অযৌন প্রজননের বিকল্প হতে পারে।
পার্থেনোজেনেসিস ৮০ টিরও বেশি মেরুদণ্ডী প্রজাতির মধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে, যার প্রায় অর্ধেক মাছ বা টিকটিকি। খুব কমই জটিল মেরুদণ্ডী প্রাণী যেমন হাঙ্গর, সাপ এবং বড় টিকটিকি অযৌন প্রজননের উপর নির্ভর করে, যে কারণে লিওনি ও অন্য বড় মেরুদণ্ডী প্রাণী প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞানীদের বিভ্রান্ত করেছিল।
যেহেতু প্রকৃতিতে পার্থেনোজেনেসিস নিয়মিত ঘটে কিন্তু তার ফ্রিকোয়েন্সি ট্র্যাক করা শুধু বেশ কঠিন-ই নয় সেটা প্রায় অসম্ভব। তাই মানুষের পালিত প্রাণীদের মধ্যে অযৌন প্রজননের অনেক’অভিনব নতুনত্ব" পরিলক্ষিত হয়েছে- যা প্রাথমিকভাবে সবাইকে চমকে দিয়েছে।
মেরুদণ্ডী প্রাণীদের বন্য বা বন্দী অবস্থায়, এই ‘কুমারী জন্ম’ অস্বাভাবিক অবস্থার কারণে সৃষ্ট অতি বিরল ঘটনা।
সরল জীবের বিপরীতে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা এইভাবে প্রজনন করে বলে জানা যায় না- কারণ, স্তন্যপায়ী প্রাণীরা ‘জিনোমিক ইমপ্রিন্টিং’ নামক একটি প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করে। একটি আণবিক স্ট্যাম্পের মতো যা মূলত মানুষের মতো স্তন্যপায়ী প্রাণীদের জন্য মায়ের এবং বাবার জিন চিহ্নিত করে ।এর অর্থ হল অবদানকারী পিতামাতার উপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট জিনগুলি চালু বা বন্ধ হয়। যদি শুধুমাত্র একজন পিতামাতা থাকে, তবে কিছু জিন সম্পুর্নরুপে চালু বা কার্যকর নাও হতে পারে, যা কার্যকরী বংশবিস্তারকে অসম্ভব করে তোলে।
যাইহোক, খরগোশ সহ বেশ কয়েকটি স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে পার্থেনোজেনেসিস করা হয়েছে।
একক বেঁচে থাকার কৌশল
খুব বিরল ক্ষেত্রে, কিছু প্রাণী প্রজাতি একচেটিয়াভাবে পার্থেনোজেনেসিস দ্বারা বংশোবিস্তার করে। এরকম একটি প্রজাতি হল মরুভূমির হুইপটেল টিকটিকি, যার সবকটিই স্ত্রী।
কিছু পোকামাকড়, স্যালামান্ডার এবং ফ্ল্যাটওয়ার্মের শুক্রাণু ডিম্বানুকে ট্রিগার করে এবং ডিমের মধ্যে প্রবেশ করে প্রক্রিয়া শুরু করে, কিন্তু শুক্রাণু পরবর্তীকালে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে শুধুমাত্র মাতৃত্বের ক্রোমোজোমগুলি রেখে যায় । এই ক্ষেত্রে, শুক্রাণু শুধুমাত্র ডিমের বিকাশ ঘটায় - কিন্তু এটি কোন জেনেটিক অবদান রাখে না।
অযৌনভাবে পুনরুৎপাদন করার ক্ষমতা প্রাণীদের সঙ্গীর খোঁজে শক্তির অপচয় না করে তাদের জিনে প্রেরণ করতে দেয় এবং এইভাবে কঠোর পরিবেশে প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোন স্ত্রী কমোডো ড্রাগন একাকী কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে চলে আসে, তবে শুধুমাত্র এটি পার্থেনোজেনেসিসের মাধ্যমে তার সন্তান জন্মদান চালিয়ে যেতে পারে এবং কোন এক সময় সেখানে পুরো ড্রাগনের কলোনি তৈরি করতেপারে।
তবে যেহেতু তারা জিনগতভাবে প্রায় জিনগতভাবে অভিন্ন হবে, তাই মা এবং তাদের কন্যা কমোডো ড্রাগন জেনেটিক্যালি বৈচিত্র্যময় গোষ্ঠীর তুলনায় রোগ এবং পরিবেশগত পরিবর্তনের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হবে।
হুইপটেল টিকটিকি
উদাহরণস্বরূপ, নিউ মেক্সিকোর কিছু অংশে, মহিলা হুইপটেল টিকটিকির কিছু জনসংখ্যার প্রায় অভিন্ন জেনেটিক প্রোফাইল রয়েছে।
# লেখায় ভুলভ্রান্তি থাকলে বিজ্ঞজনেরা পরামর্শ দিবেন নিঃসঙ্কোচে!
সুত্রঃ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০২২ রাত ৯:০৬