somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পল্লীকবি~ যার সারা দেহে জড়িয়ে ছিল বাঙলার সোঁদা মাটির গন্ধ!

১৬ ই নভেম্বর, ২০২২ রাত ১০:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বিশেষ নিবন্ধঃ পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর লেখা নিয়ে বিবিধ আলোচনা।

গোয়ালন্দ ঘাট থেকে স্টিমারে করে পল্লীকবি যাচ্ছিলেন নারায়ণগঞ্জ- উদ্দেশ্য ঢাকা। শীতের শুরু অথবা শেষ। প্রমত্তা পদ্মা তখন ভীষণ শান্ত! ঘাট পাড়ে তখন ধু ধু বালিয়াড়ি আর সেই বালিতে অস্থায়ীভাবে গজিয়ে ওঠা শনের ঝোপ। সেই বালিয়াড়িতে লাল একটা ডুরে শারি পরে এক কিশোরী আলু থালু বেশে মৃদু মন্দ বাতাসে ঘন চুল ছড়িয়ে নদীর দিকে মুখ করে বহুদুরপানে নির্নিমেষ নয়নে চেয়ে আছে। দরদী কবির মন তাই দেখে ভীষণভাবে কেঁদে উঠে।
উজান গাঙের নাইয়া!
কইবার নি পাররে নদী
গেছে কতদূর?
যে কূল ধইরা চলেরে নদী
সে কূল ভাইঙ্গা যায়,
আবার আলসে ঘুমায়া পড়ে
সেই কূলেরি গায়;
পুতুল খেলার বয়সে একজন কিশোরীর নিজের পরিবার চেনা জানা পরিবেশ আত্মীয় কুটুম আর বন্ধুদের চিরতরে ছেড়ে যাওয়ার সে কি মর্মভেদী কষ্ট আর নাইওরে যাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা- বাপ ভাই আত্মীয়ের জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা যে কি ভয়ানক কষ্টদায়ক সেটা তাঁর গীত আর সুরে কি চমৎকারভাবেই না তুলে ধরেছেন। আমরা শহুরে মানুষেরা এই অনুভূতি ধারণ করতে পারবা না কখনো। এ অনুভূতিকে উপলব্ধি করতে হলে আপনার গা-য়ে বুকে সোঁদা মাটির গন্ধ থাকতে হবে। (*বিশেষ নোট সংযুক্ত করা হয়েছে লিখার শেষে)

চাঁদপুরে বেদে’দের আন্দোলনে জসীম উদ্দীনঃ

১৯৫৩ বা ১৯৫৪ সালের ঘটনা। বেদে সমাজ ‘জাতে ওঠার’ জন্য আন্দোলন শুরু করেছে। জাতে ওঠা বলছি এই কারণে যে, সমাজে তারা অবজ্ঞেয়। মুসলমান হলেও এবং হাজার শিক্ষিত হলেও উচ্চতর মুসলমানদের সঙ্গে বিয়ে সাদী এমনকি সমাজ জামাতের বিভেদের জন্য ওঠা-বসা হয় না। এই বৈষম্য দূর করার জন্য হাজীগঞ্জের আলেম সমাজ এক মহতী সভার আয়োজন করেছেন এবং সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে চাঁদপুরে।’
এ সভার প্রধান অতিথি করা হয় পল্লী-দরদি মানুষ জসীমউদ্দীনকে। চাঁদপুরে তাঁর আগমনের বর্ণনা আবদুস সাত্তার দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন :
“কবিকে রিসিভ করার জন্য স্টীমার ঘাটে অজস্র লোকের সমাগম এবং অধিকাংশই টুপিধারী আলেম সমাজ। বেদে নেতৃবর্গ এবং অন্যান্য সবার হাতে নিশান এবং মুহুর্মুহু ধ্বনি উঠছে : ‘পল্লী কবি জসীমউদ্দীন জিন্দাবাদ’, ‘বেদে সাপুড়ের কবি জিন্দাবাদ’।...স্টিমার থেকে কবিকে নামিয়ে আনা হলো ডাক বাংলোয়।”
O babu, many salams to you
.........................
My home is the Padma river
We cook on one bank,
We eat at another
We have no homes,
The whole world is our home,
All men are our brothers
We look for them
In every door….."
(Jasim Uddin)

ও বাবু সেলাম বারে-বার
আমার নামটি গয়া বাইদ্যা বাবু বাড়ি পদ্মার পাড়
মোরা এক ঘাটেতে রান্ধি বাড়ি আরেক ঘাটে খাই
মোদের ঘরও বাড়ি নাই।।

বেদেদের নিয়ে সভার আয়োজন শহরজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। মাইকে ঘোষণা করা হয় : ‘বেদে সমাজ চিরদিন অবজ্ঞেয়। মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই, এ কথা যদি সত্য হয় তবে বেদে সমাজ সকল মুসলমানের ভাই হতে পারবে না কেন?’ কবির বক্তৃতা শুনে উপস্থিত সবাই মুগ্ধ হয়েছিলেন। সভাশেষে কবি বেদেদের সঙ্গে কোলাকুলি করেন।
____________________________________



বাংলার সেরা দুজন কবি যখন অনুপ্রেরণা;
স্বদেশী আন্দোলন চলছে তখন দেশব্যাপী । সেইসময় একদিন বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে গেলেন এক রকম পালিয়েই । সেখানে তিনি তৎকালীন স্বনামধন্য কবি মোজাম্মেল হক – এর সাথে দেখা করলেন তার কবিতার খাতা নিয়ে। মোজাম্মেল হক তখন বঙ্গীয় মুসলিম পত্রিকার সম্পাদক। তিনি তার কিছু কবিতা তার পত্রিকায় ছাপাতে রাজী হলেন।
এরপর তার পরামর্শে তিনি দেখা করলেন কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে । নজরুল ইসলাম তাকে উৎসাহ দিলেন এবং তাঁর কয়েকটি কবিতা রেখে দিলেন বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপানোর জন্য । জসিম উদদীন উৎসাহ পেয়ে পড়াশুনা শেষ করে কবিতা লিখবেন -এই মনোভাব নিয়ে আবার ফরিদপুরে ফিরে এলেন।
কবিগুরু তাঁর রাখাল ও নকশী কাথার মাঠ কাব্যগ্রন্থ দুটো পড়ে -জসিম উদদীনকে বাংলাদেশের মুসলমান চাষীদের প্রতিনিধিত্বকারী পল্লীকবি হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ একবার বাংলা কবিতার একটা সংকলন প্রকাশ করেন , তাতে পল্লীকবি জসিম উদ্দীনের বালুচর কাব্যের ‘ উড়ানীর চর ’ কবিতাটি স্থান পায়।

~ পিজি হাসপাতালে পল্লী ও বিদ্রোহী কবি।

রবর্তীকালে তাদের এই সম্পর্কের গভীরতা দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেয়েছিলএবং আমৃত্যু কি চমতকারভাবেই না টিকে ছিল।
কাজী নজরুল ফরিদপুরে আসলে জসীম উদদীনের বাড়িতে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তরুণ কবি জসীম উদদীনকে উৎসাহ দেয়া অব্যাহত রেখেছিলেন।
সারা জীবন সুদীর্ঘ ঘনিষ্ঠতার পরে জীবন সায়াহ্ণে পল্লী কবি আমাদের বিদ্রোহী কবির সাথে পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আর রবি ঠাকুরের পরিবারের সবাই তাকে স্নেহ করত- বিশেষ করে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি সেই সব স্মৃতি নিয়ে লিখেছিলেন' ঠাকুর বাড়ির আঙিনায়; সৃতিকথা!
ঠাকুর- বাড়ির আঙিনায়’ বইটিতে ‘রবীন্দ্র তীর্থে’, ‘অবন ঠাকুরের দরবারে’, ‘নজরুল’ এই তিন শিরোনামে কবি নিজের জীবনকথা শব্দের ফ্রেমে বন্দী করেছেন। এখানে কবির জীবনের ক্ষুদ্র একটি অধ্যায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
‘রবীন্দ্রতীর্থে ‘ শিরোনামে মূলত জসীম উদদীন কবিগুরুর সাথে তাঁর কাটানো কিছু সময়ের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। কবি পড়াশোনার সুবাদে যখন কলকাতায় ছিলেন তখন কিছুদিন ঠাকুর বাড়িতেই অস্থায়ী আবাস গড়েছিলেন। সেখানে তিনি কবিগুরুর সাথে সাক্ষাৎ করেন, নিজের লেখা কবিতার বই কবিকে পড়তে দেন। বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে সাহিত্য, রাজনীতি, গান , হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক প্রভৃতি নানা বিষয়ে আলোচনা করেন।
রবীন্দ্রনাথের দেয়া প্লট অবলম্বনেই তিনি ‘পল্লী বধূ’ নাটকটি লিখেছেন। কবিগুরুর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনে বেড়াতে গিয়ে প্রভাকুমার মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে বেশ কয়েকদিন অবস্থান করেছিলেন। সেখানে হাসু নামের এক ছোট্ট খুকীর সাথে কবির সখ্যতা গড়ে উঠে।
(তাদের নিয়ে আরো অনেক গল্প সেটা অন্যদিন হবে)
_____________________________________
সম্ভবত ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ে;‘রুরাল লাইফ ইন ইংল্যান্ড’ প্রবন্ধ পড়েই তার নাকি সর্বপ্রথম জ্ঞান চক্ষু উন্মুক্ত হোল! ইংল্যান্ডের যেসব কবি বা সাহিত্যিক রুরাল লাইফ বা গ্রাম্য জীবন নিয়ে লিখতেন তারা গ্রামে বসেই গ্রামের প্রকৃতি রস সুধা উপভোগ করেই লিখতেন। তখন তাঁর বদ্ধমূল ধারণা হোল পল্লী জীবন নিয়ে লিখতে হলে পল্লী গাঁয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা যাবে না কোন মতেই;

১৯৭৩ সালে সৈয়দ শামসুল হক- এর কবির সাথে সাক্ষাৎকারে( বিবিসি রেডিও) কবি আবেগঘন কণ্ঠে বলেছিলেন;
‘সেই বাঁশের পাতা কোন সময়ে কেমন করে দোলে, সেই বেতুল ফল কখন পাকে,যখন নতুন গাবের পাতা গজায়- ঝালরের মত সেই পাতার অপূর্ব দৃশ্যে মোহিত হয়ে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থেকেছি।‘
______________________________________
আমার বাবা বলেছিলেন তাঁর এক স্মৃতি কথায়; কবি বহুদিন-বাদে ইংল্যান্ড থেকে স্বদেশে এসেছেন। তাঁর সেই অতি পরিচিত ঘাটে নেমেই তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। গ্রাম-সুদ্ধ মানুষ এসেছে তাকে সাথে কাঁধে তুলে নিয়ে যেতে। কবির কারো দিকেই তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই- তিনি হেটে হেটেই যাচ্ছেন তাঁর বাড়িতে। যাবার পথে ছোট বেলার স্মৃতি বিজড়িত আম জাম জারুল অশ্বত্থ গাছগুলো জাড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছেন।
এই হোল আমাদের পল্লী কবি। এমন করে এই বাংলার মাটি প্রকৃতিকে কেউ ভাল বেসেছে বলে আমার জানা নেই। শুধু তিনিই লিখতে পারেন ‘নিমন্ত্রণে’র মত এমন একটা কবিতা যা পরে আধুনিক শিশু কিশোরেরাও উদ্বুদ্ধ হয় গাঁও গেরামে যাবার জন্য;

তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়া লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;
মায়া মমতার জরাজরি করি
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভায়ের স্নেহের ছায়,
তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।

কিংবা -কবিতা 'আমার বাড়ি'

মার বাড়ি যাইও ভোমর,
বসতে দেব পিঁড়ে,
জলপান যে করতে দেব
শালি ধানের চিঁড়ে।
শালি ধানের চিঁড়ে দেব,
বিন্নি ধানের খই,
বাড়ির গাছের কবরী কলা
গামছা বাঁধা দই।

যে কবি কবিতায় এমন করে ‘আমার বাড়ি’তে ‘নিমন্ত্রণ’ করতে পারেন তিনি তাঁর অতিথিকে এভাবে আপ্যায়নও করবেন নিঃসন্দেহে। কবির গিন্নী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন;
“আমার বিয়ার কথাবার্তা চলতেছে। তারিখ-টারিখও ঠিক হইল। ৩ মাস পরে বিয়া হবে ইউনিভার্সিটির গ্রীষ্মের ছুটিতে। নানা ঠিক করলেন ছেলের বাড়ি দেখতে হয় তিনি ফরিদপুরের অম্বিকাপুরে তার এক ভাইগ্না এবং মিলনদাকে পাঠাইলেন। মিলনদা আমার খালাতো ভাই।
ঐ দুই যুবক সব খোঁজ খবর নিয়া আসলেন। কবি সাহেব তিনদিন তাদের এমন আপ্যায়ন করলেন যে, তারা মহা খুশিতে নারায়ণগঞ্জে ফিরা আসলেন”।
এমন চরম আপ্যায়নের গল্পই নাকি তারা করেছেন বহুদিন। বাড়িঘর দেখে হয়তো তাদের পছন্দ হয়েছিল কিন্তু কবি সেবার আপ্যায়নের জেরে জয়ী হয়েছিলেন নিঃসন্দেহে!

কিন্তু এ বিয়ে হবার কথা ছিল না।
কেননা মাত্র কদিন আগেই বেগম মমতাজের নানা এই বিয়ে ঠিক করেছে শুনে কবির ভাবি শ্বশুর যিনি ততকালীন ফরিদপুর জিলা স্কুলের নামকরা অধ্যাপক ছিলেন তিনি তাঁর শ্বশুর অর্থাৎ মমতাজ বেগমের নানাকে সাত পৃষ্ঠার একখানা চিঠি লিখেছিলেন।

সে চিঠির গল্পটা শুনুন;

“কবি সাহেব যখন বিয়ার প্রস্তাব দিল, তখন প্রথম দিকে আমার নানা-নানী রাজি হয় নাই। ওরা দুই বছর ঘোরাঘুরির পর নানা-নানী নরম হইছে। নানান কারণে তারা রাজি হয় নাই। হয়তো তাদের ধারণা ছিল, বয়সের এতো তফাত্, অ্যাডজাস্ট হইব কি না। এত আদর আহ্লাদ কইরা অচেনা অজানা এক ছেলের সাথে...। তারপর বাবার কাছে নানা চিঠি দিলেন। বাবা তখন ফরিদপুরে জিলা হাই স্কুলের মাস্টার। অনেক ছাত্র তার। শহরে নাম-ধাম আছে। বাবা তো সেই চিঠি পাইয়া সাত পৃষ্ঠা চিঠি দিলেন নানার কাছে।
বাবা লিখছিলেন, আপনি কি পাগল হইয়া গেলেন। এই লোকটা পাগল। চরে চরে ঘুইরা বেড়ায়। গান গাইয়া বেড়ায়। ভাবের গান, আধ্যাত্মিক গান, মুর্শীদি গান। গানের মজলিসে সারারাত কাইন্দা কাইটা মাটিতে গড়াগড়ি খায়। এইরকম ছেলের কাছে বিয়া দিবেন? তার চাইতে আপনি নাতিনরে পদ্মায় ফালাইয়া দেন”।
অত্যান্ত পরিতাপের বিষয় ছিল; চরম ধুমধাম করে হওয়া কবির বিয়েতে মমতাজ বেগমের মা-বাবা উপস্থিত ছিলেন না।
তাঁর বাবা চিঠিতে কবি সন্মন্ধে যা লিখেছিলেন তা একেবারেই নির্জলা সত্য! আমাদের বাঙলায় প্রান প্রকৃতি আর মাটিকে আষ্টে পৃষ্টে ভালবেসে জড়িয়ে রাখার মত মানুষ কবি তিনি একজনই ছিলেন। আমৃত্যু যার গায়ে লেগেছিল মাটির সোঁদা গন্ধ।
কবির ‘নিমন্ত্রণে’ যদি কবির বাড়িতে যান;
পল্লী কবির নিস্তব্ধ গ্রাম, স্রোত হীন কুমার নদ, খোলা বাতাস ও প্রকৃতির দৃশ্য মন কেড়ে নেয়। কুমার নদের পশ্চিমেই কবির বাড়ি। প্রবেশ করতেই পল্লী গ্রামের প্রকৃতি যেন আপনার অনুভূতি স্পর্শ করে স্বাগত জানাবে। চারিদিকের গাছপালা, বাগান, কবির সমাধি ক্ষেত্র, পাখির কিঁচির মিচির শব্দ। কবির বাড়ী-আঙ্গিনায় চারটি দোচালা টিনের ঘর। তাতে লেখা; কোনটি কার ঘর। বারান্দায় ছোট ছোট পাটের ছিকা। ভিতরে নকসা করা মাটির রঙিন কলস রাখা।
ছোট্ট একটা টিনের ঘরেই কবি জসিমউদ্দীনের জন্ম। কবির স্মৃতিঘরে বিভিন্ন মূহুর্তের ছবি তুলে চার দেয়ালে সাজিয়ে রাখা হয়েছে যা ঐ ঘরটিকে আরো সুন্দর করে তুলেছে। কবির ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিস। তার কাঠের আলমারি থেকে শুরু করে আছে একটা সুন্দর পালকিও।
তবে স্মৃতিঘরের দুটি আলমারিতে সাজানো অসংখ্য মাটির পুতুল -প্রিয় কবির প্রিয় পুতুলগুলো যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে সকলকে।
উঠানের পূর্ব দিকে এখনও ঢেকি-ঘরটি’ স্মৃতি স্বরূপ আছে। ঢেকি-ঘরের সামনে কবির লিখা কিছু কথা আপনার মনকে ছুঁয়ে যাবে নিশ্চিত “আমাদের গরীবের সংসার। ঘি-ময়দা-ছানা দিয়ে জৌলুস পিঠা তৈরীর উপকরণ মায়ের ছিলো না। চাউলের গুড়া আর গুড় এই মাত্র মায়ের সম্পদ।‘
ঘরের দেয়ালজুড়েও অনেক স্মৃতি কথা, টুকরো কাহিনী। বিভিন্ন ব্যবহার্য জিনিষগুলো এখনও কবির ইতিহাস। জীবনধারার প্রতিচ্ছবি। আছে তার ব্যবহারের কলম, বিভিন্ন বই খাতা ও অন্যান্য সামাগ্রি। সেখানেও রয়েছে অনেক মাটির ও তুলার পুতুল। ঘরের দেয়ালজুড়ে রয়েছে কবির নিজ জীবনের বিভিন্ন কথা লিখা যা ছবির মতই টানানো। ঘরজুড়ে কবির এতো স্মৃতিচিহ্ন, কবির অস্তিত্ত্বটাকে স্পষ্ট করে তুলেছে। কবির ঘরের সামনেই কবির নিজ হাতে লাগানো সেই গাছগুলো আজও তাঁর বাড়িটিকে সাজিয়ে রেখেছে যা বাড়ির পল্লী প্রকৃতিকে আরো শোভাবর্ধন করেছে।
কবির বাড়িটি দেখলেই ধারনা করা যায়- তাঁর সাথে প্রকৃতির যে কি নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তাঁর হাতে লাগানো সেই গাছগুলিতে ঝুলছে বিভিন্ন মাটির কলসি সে গাছে নাকি একসময় প্রচুর পাখি বাসা করতো, তাই সে সেইসব কলসি বেঁধে রাখতো যাতে পাখির নিশ্চিন্তে তাঁর গাছে থাকতে পারে। কতটা পল্লী প্রকৃতির প্রেমিক ছিলেন পল্লী জসিমউদ্দীন পুরো বাড়িই সেটির প্রতিচ্ছবি।
বেশ কিছুটা পূর্ব দিকে ২০১১ সালে নির্মিত কবির পিতা আনসার উদ্দীনের স্মৃতিঘরট। অন্যসব ঘরের থেকে কিছুটা ভিন্নতায় সাজানো এ ঘরটি। পুরো ঘরজুড়ে পাটের ছিকা যার ভিতরে মাটির কলস দিয়ে সাজানো। কাঠের আলমারি, ব্যবহৃত জিনিস ও বিভিন্ন ছবি রাখা। ঘরে মাঝখানে কাঁচের চারকোনা বাক্সে রাখা সে সময়কার ব্যবহৃত শাড়ি, চাঁদর, টাইপ মেশিন, কলম ইত্যাদি। রয়েছে ব্যবহৃত মাটির পাত্র এবং আরো অনেক কিছু। সেই ঘরে রয়েছে কবির পিতা মাতার ছবিসহ তাঁর পুরো বংশ পরিচয়। এর অনতিদূরেই মাটি থেকে কিছুটা উচু কবি ও তার পরিবারের অনেক সদস্যের কবর।
কবির বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিরামহীন বয়ে চলা কুমার নদের পাড়ে শীতল বাতাসে মন জুড়িয়ে যায়। মনে হয় নদের পরিচ্ছন্ন পানিতে আজো যেন মিশে আছে কবির স্মৃতি। বয়ে চলা কুমার নদ, থেমে না থাকা সময়, এই বিষয়গুলো যেনো মনে করিয়ে দেয় কবি চলে গেছে শিখিয়ে গেছে কিভাবে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হয় বা হবে। (হুবুহু নয়)
_________________________________________

~ মমতাজ বেগমের সাথে কবি।

মুল নিবন্ধে যাবার আগে আমি তাঁর বিয়ের গল্পটা করার লোভ সামলাতে পারছি না ( যাদের জানা আছে তারা এই অংশটুকু এড়িয়ে যান);
আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। দেখতেও বেশ ভালো ছিলাম। সবাই আদর করত। সোনা ভাই সোনা মা (নানী) একটু চোখের আড়াল হইলেই অস্থির হইয়া পড়ত। আমার নানীর বাবা হাজী ইব্রাহীম নারায়ণগঞ্জের প্রথম হাজী। শফিউল্লাহ সাহেবের সাথে আমার খালার আত্মীয়তা ছিল। উনি তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইকোনমিক্সের লেকচারার। তার সঙ্গে কবি সাহেব আসলেন আমাদের বাড়িতে। জসীম উদ্দীন সেই সময় ঢাকা ইউনিভার্সিটির বাংলার লেকচারার। শফিউল্লাহ সাহেব একদিন আমার নানা ভাইকে বললেন, আপনার বাড়িতে আগামীকাল একজন গুণী মানুষ আনব। যদি অনুমতি দেন। সোনা ভাই বললেন, লোকটি কে? উনি বললেন, ভদ্রলোক একজন কবি। সোনা ভাই খুব খুশি হইছিলেন। তিনি তো নিজেও কবিতার প্রতি দুর্বল ছিলেন। ফার্সি ও বাংলায় খুব সুন্দর আবৃত্তি করতে পারতেন আমার নানা। গুণী মানুষ পাইলে আপ্যায়ন করতেন নিজে। তিনি অনুমতি দিলেন। পরের দিন কবি সাহেব আসলেন পাইকপাড়ায় আমার নানার বাড়িতে। সোনা ভাই কবির জন্য সম্মানজনক মেহমানদারীর ব্যবস্থা করলেন।
ঐদিন কবি জসীম উদ্দীনকে ঝাপসা দেখছি। আমার ঘরের সামনে দিয়া তো সোনাভাইয়ের ঘরে যাইতে হয়। আমি ঘরের ভিতর থেইকা জানালা দিয়া দেখলাম—শফিউল্লাহ আর কবি সাহেব ছিলেন লম্বা। এক ঝলক দেখলাম একজন নতুন লম্বা মেহমান আমার ঘরের সামনে দিয়া হাইটা গেলেন।
পনের ষোলদিন পরে শফিউল্লাহ সাহেবকে নিয়ে কবি আবার আসছিল। আমাকে জানানো হয়নি।প্রাইভেট পড়া শেষে আমি খাতা টাতা গুছাই এদিক ওদিক তাকাই, এমন সময় দেখি এক ভদ্রলোক ওই ঘরের সামনে দিয়া আমার দিকে চাইতে চাইতে বারান্দা পার হইল। আমিও চাইয়া রইলাম। দেখলাম ভদ্রলোক গলায় চাদর প্যাঁচানো, মানে সাহেবি পোশাক না। ধুতি পরা পাঞ্জাবি পরা সাদা চাদর গলায়। চশমা ছিল না। জসীম উদ্দীন তখন মাঝে মধ্যে ধুতি পরতেন।
আমি কি যেন একটা খাতা নাড়াচাড়া করতেছিলাম। হঠাত্ দেখি সেই ভদ্রলোক টপ কইরা আমার পড়ার টেবিলের সামনে যে চেয়ারে আমার মাস্টার মশাই বসেন সামনাসামনি, সেই চেয়ারটায় একাই বইসা পড়লেন। আমি একটু অবাকই হইয়া পড়লাম। হঠাত্ কোন জানান না দিয়া আমার ঘরের ভিতরে অচেনা মানুষ! আত্মীয়-স্বজন না। আশ্চর্য ব্যাপার। আমার একটা খাতা টান দিয়া নিয়া বলল, খুকী তুমি এই খাতাটা আমাকে দিবা, আমি তোমাকে একটা কবিতা লেইখা দেই? আমি মাথা ঝুলাইলাম। কিছুক্ষণ বেশ কাটাকুটি কইরা এক পৃষ্ঠায় কবিতা আর এক পৃষ্ঠায় গান লিখলেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন খুকী তুমি কবিতা ভালোবাস? আমি একটু ঠাট্টাচ্ছলে বললাম, না। কথাটা বলার পর আমি একটু হাইসা দিছি। তারপর আর কোন কথা হয় নাই। তখন তো আমি জানি যে কবি জসীম উদ্দীনের কবিতা আমাদের সিলেবাসে আছে। রাখাল ছেলেটা। আমার খাতায় লেখা কবিতাটা ছিল—
আমারে করিও ক্ষমা-সুন্দরী অনুপমা
তোমার শান্ত নিভৃত আলয়ে-হয়তো তোমার খেলার বাসরে
অপরাধ রবে জমা-আমারে করিও ক্ষমা।

নারায়ণগঞ্জের মর্গান স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ি। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, খুকী তুমি কি গান গাইতে পার? আমি বললাম, না। আসলে গান জানতাম।
ভদ্রলোক তো আমারে দেখার পর নানা দিক থেইকা আমার নানা ভাইরে হাত করার জন্য লাইগা গেল। অনেককে দিয়া সুপারিশ করতে লাগল। ওই যে আমারে দেখল, আমার রূপ তার মনে ধইরা নিল, কবি তো!
কবি সাহেব আরেকদিন যখন আসলো, আমাকে গান গাওয়ার জন্য পনের বিশ মিনিটের মত অনুরোধ। আমি আর হারমোনিয়ামে হাত দেই না। আমার নানী ধমক দিল খুব জোরে। নামকরা লোকের সাথে বেয়াদবি করতেছ। গান শিখছ তো মানুষরে শুনানোর জন্যই। শুনাও। তারপর আমি তখন গাইছিলাম নিশীথে যাইও ফুলবনে...।
এটা জসীম উদ্দীনের লেখা গান। কিন্তু আমি তখন জানতাম না।
কবি হিসেবে তাকে তো জানতামই। তখন মনে হয় নাই একটা কালো লম্বা মানুষ, আবার কবি, তার সাথে আমার বিয়া হইতে যাইতেছে। আমার মা অবশ্য বিয়া দিতে চায় নাই। কালো, এ জন্য আমার কোন অসুবিধা ছিল না। তারে দেইখা আমারও পছন্দ হইছিল। বয়সটাও আমার কাছে কোন বাধা মনে হয় নাই। সবচেয়ে পছন্দ হইছিল কি—তিনি হাইসা যখন কথা বলছিলেন একদিন দেখলাম সোনার দুইটা দাঁত চকচক কইরা উঠল। তাঁর সোনার বান্ধানো দাঁত ছিল দুইটা সামনের দিকে। সোনার দাঁত দেখার জন্য তার দিকে বারে বারে চাইছি। সোনার দাঁত পরে ছিল না। প্লাস্টিকের দাঁত লাগাইছিল।
এর আগে পরে অনেক ঘটনা। দীর্ঘ দুই বছর অনেক চেষতা তদ্বিরের পরে কবির বিয়ে হোল মমতাজ বেগমের সাথে;
বিয়ার জিনিসপত্র কেনাকাটা শুরু হইল। কলকাতা গেল বিয়ার মার্কেটিং করতে। সাথে মিলনদাও গেছিল। তাকে নেয়া হইছিল আধুনিক জিনিসপত্র চিনবার জন্য, কারণ নানাভাই আগের দিনের মানুষ। তারা বহু জিনিসপত্র আনলো—খুব সুন্দর বেনারসী, আকাশী নীল রঙের। আমি মনে মনে ভাবলাম আমারে লাল শাড়ি দিল না কেন। সে সময় শাড়িটার দাম ছিল একশ’ সত্তর টাকা। আর বরের জন্য কলকাতা থেইকা খুব দামি সেলোয়ারের কাপড়, তারপর শেরওয়ানী, টুপি ও পাগড়ি এবং কাপড় আনছিল। কাপড় নিয়া অম্বিকাপুর পাঠানো হইছিল। সেগুলি নারায়ণগঞ্জের ভালো টেইলারিং থেইকা বানানো হইল। কবি সাহেব তখন গ্রীষ্মের ছুটিতে অম্বিকাপুরে।
ঘটনাটা ১৯৩৯ সালের। গায়ে হলুদ যখন হইছিল, তখন আমি ঘরের জানালা দিয়া উঁকি মাইরা দেখলাম অনেক জিনিসপত্র, ডালা-ডুলা আর সাত-আটটা ঘোড়ার গাড়ি বাড়ির সামনে। প্রত্যেকটা ঘোড়া নানা রঙের ফুল দিয়া সাজানো হইছে। ঐভাবে গায়ে হলুদের জিনিস দিয়া সারা শহর ঘুইরা আইছে সবাই। খুব ফুর্তি হইছিল। গায়ে হলুদেই লোক হইছিল এক হাজারের মতো। আমার মা-বাবা’র বিয়াতে মত ছিল না। তারা ক্ষুব্ধ। তাই বিয়ার কোন অনুষ্ঠানে তারা আসেন নাই।
হলুদের মালপত্র নিয়া আমাদের ঘাটে যাওয়া হয়, যেখানে ফরিদপুরের স্টিমার আসে। ওই ঘাটে কবিকে সমস্ত কাপড়-চোপড় পরাইয়া আনা হইল নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায়। বরযাত্রী পঁচিশ ত্রিশজন, এর বেশি হবে না। সাথে ছিল তার বড় ভাই, বোনের জামাই, চাচাতো ভাইরাও ছিল। বিয়াতে গেইট ধরা হইছিল। শালীদের সঙ্গে এক ঘণ্টা যুদ্ধ। খালাতো বোনদের সাথে কথা কাটাকাটি হইল। এক টাকাও দেয় নাই। আমার বোনরা বলছিল, যাইতে দিব না। কবি বলছিল, ঠিক আছে দাঁড়াইয়া থাক। তারপর সময় নষ্ট হইতেছে দেইখা আমার নানা সবাইকে গেইট ছাইড়া দিতে বললেন। বিয়ার তারিখটা ছিল, আমার ইংরেজি মনে নাই, বাংলা মনে আছে— ১০ই আষাঢ়, ১৯৩৯ সাল। মনে হয় পঁচিশ তারিখ ছিল। তখন কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ শুরু হইয়া গেছে।

বিয়ের উপঢৌকন;
বিয়ার আসরে নামকরা অনেক লোক আসছিল। আমার স্পষ্ট সবার নাম মনে নাই। অনেক চিঠিপত্র আসছিল কলকাতা থেইকা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজ হাতে শুভেচ্ছা জানাইয়া চিঠি দিছিল। আর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, খুব বড় শিল্পী, তিনি খুব সুন্দর একটা চিঠি এবং তার হাতে আঁকা একটা ছবি পাঠাইছিলেন দুইজনের নামে। ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেন শুভেচ্ছা জানাইছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিটায় ছিল সুন্দর গোলাপী রঙের দুইটা কবুতর একটা ডালে বসা। ছবিটা এখনও আমার কাছে আছে। দীনেশচন্দ্র সেন লিখছিলেন, তিন পৃষ্ঠার এক চিঠি। চিঠিটা এখনও পড়ি। জীবনের যে এত ধাপ তার প্রত্যেকটির বিবরণসহ উপদেশ দিয়ে চিঠিটা লেখা। কে যেন ডাকযোগে কলকাতা থেইকা লাল টকটকা একটা মটকা শাড়ি পাঠাইছিল।

ফরিদপুরের বিখ্যাত গায়েন এরোন ফকির- যার কথা ভুলে গেছে সবাই;
বিয়ার সময় তিন দিন আলোকসজ্জা করা হইছিল এবং ব্যান্ড পার্টি বাদ্যযন্ত্র বাজাইছে। বাসর ঘর কাঠ গোলাপ, রজনীগন্ধা এবং চামেলী ফুল দিয়া অপরূপ কইরা সাজানো হইছিল। এরোন ফকিরের গল্পটা বলা হইল না। ফরিদপুরের সেই আমলের বিখ্যাত গায়েন এরোন ফকির কবি সাহেবের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি আসছিলেন বিয়াতে। আমি তো ঘোমটা দিয়া বইসা আছি। অনেকেই ঘোমটা উঠাইয়া নতুন বউয়ের মুখ দেইখা যায়। তখন হঠাত্ সামনে তাকাইয়া দেখি দাড়িঅলা এক বয়স্ক লোক। অদ্ভুত পোশাক, সবার চাইতে আলাদা। আমার মুখের দিকে তাকাইয়া আছেন। আমি দেখলাম স্ফটিকের মালা গলায় বাউল গোছের লোক, ফকিরী পোশাক। আমাকে দোয়া-টোয়া করল। এরোন ফকিরের বাড়ি চর ভদ্রাসনে।

বিয়ের আসরে মুখরা কবি ও বর বিদায়;
বিয়ার আসরে খুব হাসাহাসি ধাক্কাধাক্কি চলছিল। আমার খালাতো ও চাচাতো বোনরা কবি সাহেবকে জব্দ করতে চাইলে তিনি সমানে ওদের সাথে তর্ক করতে লাগল। নতুন জামাইয়ের মতো চুপ থাকে নাই। ওরা তো কবির কাছে হার মাইনা গেল। অনেক রাইত পর্যন্ত বিয়ার অনুষ্ঠান চলল। প্রায় ভোর রাতের দিকে সব অনুষ্ঠান শেষে আমাদেরকে বাসর ঘরে আনা হয়। আমি খুব ক্লান্ত হইয়া পড়লে আমার নানী পাঙ্খা দিয়া বাতাস করতেছিল। তখন কবি সাহেব বললেন, সোনামা, আপনি চইলা যান। আমি ঘুমাবো। আমি তো ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ছি। সোনামা চইলা গেলে কবি সাহেব বলেন, আসো আমরা একটু নামাজ পড়ি। আমি মনে মনে বলি ঘুমের মধ্যে কিসের নামাজ-টামাজ। আমি কথা কমু কি, উনি লজ্জা ভাইঙ্গা নিজেই কথা কইতে থাকলেন। তারপর গণকের মতো আমার হাতটা দেখল। তারপর আমি তো ঘুমাইয়া গেছি।
পরের দিন স্টিমারে নারায়ণগঞ্জ ঘাট থেইকা চাঁদপুর হইয়া গোয়ালন্দ ঘাটে পৌঁছাই। তখন দুপুর। সেখান থেইকা ট্রেনে অম্বিকাপুর রেল স্টেশন। স্টেশন থেইকা ঘোড়ার গাড়িতে কবি সাহেবের বাড়িতে আসি।
______________________________________

জসীম উদদীনের অধিকাংশ রচনায় চোখ রেখে বলতে পারি- এক বিস্ময়কর মানবপ্রেমী; বিশেষ করে দরিদ্র কৃষক, দিনমজুর, রাখালের প্রতি তার অসম্ভব মমতা লক্ষ্য করার মতো। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তথা বাংলার হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজের মানুষের যাপিত জীবন অসামান্য দরদে উপস্থাপন করেছেন। সমাজ বাস্তবতায় মানুষের জাগতিক দুঃখের রূপায়ণ করেছেন। সবসময় সহানুভূতিশীল ছিলেন নিপীড়িত ও অবহেলিত মানুষের প্রতি। সেই তুলনায় বিরলপ্রজ মানুষদের একজন সেই সঙ্গে বাংলার মা মাটির সন্তান জসীম উদদীন।
জসীম উদদীন বহুমুখী আধুনিক ব্যক্তিত্ব। তিনি একাধারে কবি, কাব্যোপন্যাসিক, ঔপন্যাসিক, গীতিকার, ভ্রমণকাহিনীকার, নাট্যকার, স্মৃতিকথক, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক ইত্যাদি বহুবিধ পরিচয়ে পরিচিত।

আজও রোগে তার পথ্য জোটেনি, ওষুধ হয়নি আনা,
ঝড়ে কাঁপে যেন নীড়ের পাখিটি, জড়ায়ে মায়ের ডানা।
ঘরের চালেতে হুতুম ডাকিছে, অকল্যাণ এ সুর,
মরণের দূত এল বুঝি হায়। হাঁকে মায়, দূর-দূর। (পল্লী জননী)


এটি কি আমাদের চিরায়িত বাংলার দৃশ্য নয়? জীবন সংসারের শাশ্বতরূপ তো এমনি হয়। এক কথায় জসীম উদদীন হতে চেয়েছেন গ্রামীণ মানুষের অলিখিত জীবনের রূপকার। বরাবরই সফল- কী গদ্যে, কী পদ্যে। কারণ, সেসময়ে রবীন্দ্র বলয় থেকে বের হওয়া দুরহ ছিলো! সেই সঙ্গে ক্যালকুলেটিভ বুদ্ধদেব বসু যখন ইউরোপীয় সাহিত্য অনুবাদ শুরু করেন। পরিকল্পনাহীন কাজী নজরুল ইসলাম অনুবাদ করেন ওমর খৈয়াম, কাব্যে আমপারা।
রবীন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দ, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মহাশ্বেতা অনেকেই লিখেছেন, কিন্তু জসীম উদদীন যে বাংলাকে লিখেছেন তার স্বাদ ছিলো বিরল আত্মজা বৃক্ষের মতো। বাংলার মা-মাটির সন্তান জসীম উদদীন। লোক ঐতিহ্যের রূপায়নে কবি মানসের পরিপুষ্টি হয়েছে। তৃতীয়মাত্রায় অনুসন্ধান করলে হলফ করে বলা যায়- কবি জসীম উদদীন গোটা বিশ্বসাহিত্যের এক অমূল্য রত্ন। সময়ের প্রয়োজনে চির-আধুনিক কবি জসীম উদদীন কিংবা বাঙালি জীবনের রূপকার জসীম উদদীনকে নিয়ে আলোচনা প্রাসঙ্গিক।

কবির কথাঃ
প্রথম যখন ফোনোগ্রাম আসল এদেশে শুধু নাকি হাসির রেকর্ড বিক্রি হোত হাজার হাজার। মেশিন হাসে- কি আজব কারবার!! এটা শোনার জন্যই মানুষ পাগল হয়ে যেত। ফোনোগ্রামে ঘন্টার পর ঘন্টা শুধু হাসির শব্দ শুনত।
তারপরে আসলো গান; গানের কথা আর সুর ছিল অতি মামুলী- যেমন; 'ও যাদুমনি খাও তুমি -মাথার মুড়ো খানি'।
হিন্দী সিনেমায় ব্যবহৃত কবির গান।
বন্ধু রঙ্গীলা রঙ্গীলা রঙ্গীলা রে-১৯৫০ সালে শচীন দেব বর্মন।১৯৫৫ বিমল রায় পরিচালিত দেবদাস সিনেমায়- শিল্পীঃ গীতা দত্ত ও মান্ন দে। হিন্দী গীতিকারঃ সাহির লুবিজানোহী।
দীলিপ কুমার বৈজন্তী মালা ও সুচিত্রা সেনের অভিনীত।
নিশিথে যাইও ফুলও বনে- (শেখ ভানু মুল গীতিকার)
প্রথম হিন্দীতে গানঃ শচীনদেব বর্মন। ~ধীরে সে যানা বাগিয়ান মে। ভারতবর্ষে তুমুল জনপ্রিয় হয়।
১৯৭৩ সালে ছুপা রুস্তম- কিশোর কুমার ( গীতিকার-মিরাজ) –ধীরে সে জানা খাটিয়ানমে ও খাটমাল। ( এইটা মুলত প্যরোডী গান * খাটমাল শব্দের অর্থ ছারপোকা। এ গানও তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল)
__________________________________

~ কবর কবিতার শেষ অংশের উপর আলোকপাত করে শিল্পী যোগেশ্চন্দ্রের আঁকা ছবি।

কবর কবিতাঃ
নজরুলের 'বিদ্রোহী', সুকান্তের 'ছাড়পত্র, জীবনানন্দের 'বনলতা সেন' আর সুনীলের 'কেউ কথা রাখেনি'র থেকেও সম্ভবত বাংলা ভাষার সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা ‘কবর’
আজও এ কবিতা শুনলে আবেগ ধরে রাখা কষ্ট হয়ে পড়ে। চোখের কোল আপনিতেই ভিজে আসে। বিশ্ব সাহিত্যে এতটা আবেগপূর্ণ কবিতা নিঃসন্ধহে বিরল!
গ্রামীণ এক চিরায়ত বৃদ্ধের কষ্টের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এই কবিতায়। বাংলা সাহিত্যে যেসব মর্মস্পর্শী কবিতা আছে, তার মধ্যে কবর একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। পল্লী কবি জসীমউদ্দিনের লেখা এই কবিতাটি শুধু প্রিয়জনদের জন্য শোক নিয়েই নয়, বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের একটি সুন্দর চিত্র অথচ নির্মম বটে।
১৯৩০-রে দশকে যখন ইউরোপীয় আধুনিক কাব্যের আদলে বাংলা কাব্যে আধুনিক কবিতার সূত্রপাত হয় একই সময়ে জসীম উদদীন রচনা করেছিলেন ‘কবর’।
কবর- কবিতার এই আবৃতিটা হয়তো সেরা নয় বা সেরার ধারে কাছে নয়। কবিতার সুর ওয়াজের ঢঙ্গে, ভুল ভাল শব্দ চয়ন, আঞ্চলিকতার দোষে দুষ্ট হলেও পরিপুর্ণ আবেগ ঢেলে ব্যতিক্রমী এক আবৃত্তি করেছেন ‘নুর মোহাম্মদ বর্ধমানী’ নামে ভারতের এক মৌলভী।
চাইলে এখানে ক্লিক করে শুনতে পারেন;
(47) কবিতা,এইখানে তোর দাদীর কবর।Noor mohammad bordhomani,India//নূর মোহাম্মদ বর্ধমানী ভারত - YouTube
কলেজে পড়াকালীন ‘কবর’ কবিতা রচনা করে তিনি বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। জসীম উদ্‌দীন যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখনই কবর কবিতাটি প্রবেশিকা বাংলা সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়। এমন ঘটনা বিরল।
১৪ মার্চ ১৯৭৬ সালে ঢাকায় কবি মৃত্যুবরণ করেন। তার শেষ ইচ্ছা অনুসারে তাকে ফরিদপুর জেলার আম্বিকাপুর গ্রামে তার সেই দাদীর কবরের পাশে দাফন করা হয়।
___________________________________
সীম উদদীন বহুমুখী আধুনিক ব্যক্তিত্ব। তিনি একাধারে কবি, কাব্যোপন্যাসিক, ঔপন্যাসিক, গীতিকার, ভ্রমণকাহিনীকার, নাট্যকার, স্মৃতিকথক, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক ইত্যাদি বহুবিধ পরিচয়ে পরিচিত।” ‘তুজম্বর আলী’ ছদ্মনামে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতিকে কেন্দ্র করে কবিতা রচনা করেন তিনি, যা ‘ভয়াবহ সেই দিনগুলোতে’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়।
পাক-রুশ মৈত্রী সমিতির সহ সভাপতি ড. গস্কোওস্কির আমন্ত্রণে জসীম উদদীন সোভিয়েত রাশিয়া যান। কবির নিজের ভাষায়, ‘সারাজীবন আমার দেশের জনগণকে লইয়া সাহিত্য করিয়াছি। তাহাদের সুখ, দুঃখ, স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, লইয়া কবিতা উপন্যাস লিখিয়াছি। আমার খুব বড় স্বপ্ন ছিল একবার সোভিয়েত দেশে যাইব। সে দেশের রাষ্ট্র কিভাবে তার জনগণকে সব চাইতে বড় আসন দিয়াছে ও কূপমণ্ডুকতা হইতে মুক্ত করিয়া উপরে তুলিয়া ধরিয়াছে’। লেনিন, সোভিয়েত দেশ ও সমাজতন্ত্রের প্রতি কবির গভীর শ্রদ্ধা ছিলো। সোভিয়েতের সেই ব্যবস্থা দেখে কবি বলেছেন, ‘ইস্ আমার বাংলাদেশে যদি এমন ব্যবস্থা থাকতো সকলে সোভিয়েত দেশের মতো সুখে থাকতো’।
_____________________________________
আল মাহমুদের একটি বক্তব্য: “আমাদের কাছে অবাক লাগলেও এবং তাঁকে যেখানে-সেখানে ‘পল্লীকবি’ বলে গাল পাড়লেও নাগরিক নৈঃসঙ্গ সহ্য করার মতো খাঁটি ‘আরবান’ মানসিকতা তার মধ্যে ছিলো বলেই পরবর্তী ত্রিশ, চল্লিশ এবং পঞ্চাশ দশকের ‘আরবান কবিকুলের’ যূথবদ্ধ গ্রাম্য অবজ্ঞাকে তিনি পাত্তা দেননি।”
কবি নির্মলেন্দু গুণ জসীম উদদীনের জন্মশত বার্ষিকীর স্মারকে দুটি স্মৃতি উল্লেখ করেছিলেন একটিতে তিনি পদ্মার এক বৃদ্ধ মাঝিকে স্মরণ করেছেন। সেই মাঝি বলেছিল; রবীন্দ্রনাথ নজরুলের পরে জসীম উদ্দীনই শেষ কবি। অন্যটিতে তিনি তার স্বর্গীয় পিতার স্মরণ করেছেন এই বলে যে, “পদ্মানদীর সেই মাঝির মত তিনিও মনে করতেন বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ নজরুল জসীমউদ্দীন ছাড়া আর কেউ কবি নন।
_____________________________________


সোজন বাদিয়ার ঘাট
ইতল বেতল ফুলের বনে ফুল ঝুরঝুর করে রে ভাই ফুল ঝুরঝুর করে, দেখে এলাম কালো মেয়ে গদাই নমুর ঘরে।
স্থানঃ ফরিদপুরের আরিফ বাজারের দক্ষিন পাশে কুমার নদীর একটা ঘাট।
‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যেপন্যাসটি জসীম উদদীনের বহুলপঠিত বই। ১৯৩৩ সালে কবির মাত্র তিরিশ বয়সে লেখা এই বইটি বাংলা কাব্যেপন্যাসের জগতে বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। সর্বাধিক বিদেশি ভাষায় অনূদিত এই গ্রন্থটি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ”তোমার ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ অতীব প্রশংসার যোগ্য। এই বই যে বাংলার পাঠক সমাজে আদৃত হবে, সে বিষয়ে আমার লেশমাত্র সন্দেহ নেই। “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্যেপন্যাসের প্লট নির্মিত হয়েছে মুসলমান চাষীর ছেলে সোজন আর হিন্দু নমুর মেয়ে দুলীর অপূর্ব প্রেমের কাহিনীকে ঘিরে;তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সামন্ত যুগের জমিদারি প্রথার নিষ্ঠুরতার আলেখ্য।
শিমুলতলীর গ্রাম। হিন্দু-মুসলমানের মিলেমিশে বসবাস।
গ্রামের হিন্দু বালিকা দুলীর সাথে মুসলমানের ছেলে সোজনের আবল্য বন্ধুত্ব। বন্ধু থেকে আস্তে আস্তে প্রেমে পরিণত হয়। হঠাৎ গ্রামে মহরমের উৎসবকে কেন্দ্র করে জ্বলে ওঠে হিন্দু মুসলমান সংঘাত। সংখ্যালঘু হবার কারণে প্রাণ নাশের ভয়ে গ্রাম ছাড়ে মুসলমানেরা। ধীরে ধীরে শিমুলতলী মুসলিম শূন্য হয়। এদিকে নিজেদের আক্রমণাত্মক মনোভাবের কারণে অনুতপ্ত হয় হিন্দুরা।
কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মুসলমানেরা গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে বহুদূর। চলে গেছে দুলীর সোজনও। যার বিরহে দুলীর সব কিছু শূন্য হযে যায়। সোজনকে ছাড়া দুলী অম্পূর্ণ। দুলীর বাবা অন্য ছেলের সাথে দুলীর বিয়ে ঠিক করে। দুলীর বিয়ের দিন হঠাৎ করেই সোজনের সাথে দেখা হয়্। সোজন জানে দুলিকে নিয়ে ঘর বাঁধার বহু বিপদ। মনের সকল দ্বিধা হার মানে দুলীর ভালোবাসার কাছে, দুলীর কাকুতি মিনতির কাছে হার মানে। দুলী বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে সোজনের সাথে ঘর বাঁধে গড়াই নদীর তীরে। সেখানে গিয়ে ভালোবাসার ঘর বাঁধে একটু সুখের আশায়। কিছুদিন সুখের সংসারও করে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয না।
দুলীর পরিবার অপহরণের মামলা করে সোজনের নামে। মামলার রায়ে সোজনের সাত বছরের জেল হয়। দুলীকে এনে দ্বিতীয় বিয়ে দেয় ধনাঢ্য কালাচাঁদের সাথে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সোজন যাযাবরের মত দুলীর খোঁজে বেদের নৌকায় দেশে দেশে ঘুরে। কাকতালীয় ভাবে আবারও সোজন দুলীকে খুঁজে পায়। দুলী তার সাথে রূঢ় আচরণ করে। কারণ দুলী তখন স্বামী (কালাচাঁদ)সোহাগী।
ফলে সে জ্বালা মিটাতে বিষের বড়ি খেয়ে গভীর রাতে নদীর ঘাটে বাঁশীর সুর তোলে। দুলী বাঁশীর সুর শুনে পাগল হযে ছুটে আসে। একদিকে স্বামী কালাচাঁদের বিশ্বাসের মূল্য, অন্যদিকে সোজনের ভালোবাসার টান। দুই মূল্যবোধের টানাপোড়নে পড়ে যায় অভাগি। আর এই টানাপোড়নের শেষটা হয় বড্ড করুণ, বড্ড মর্মান্তিক। তাদের মিলন হয় মৃত্যুর পরপারে। বিষপান করে গড়াই নদীর ঘাটে মৃত্যু হয়েছিল দুলী-সোজনের। পরবর্তীকালে তার নাম অনুসারে সে ঘাটের নাম হয় গেল সোজন বেদের ঘাট। ঘাটটি প্রেমের তীর্থ হিসেবে পরিচিত। আমাদের লৌকিকজীবনের এক সুনিপুণ আলেখ্য নির্মিত হয়েছে “সোজন বাদিয়ার ঘাট” এ।
এখানে তিনি সুনিপুণ ভাবে কথার মালায় এঁকেছেন ;ছেলে ভুলানো ছড়া, গাজির গান, মুর্শিদি গান, জারিনাচের গান, বশীকরণের মন্ত্র, বসন্তরোগের মন্ত্র, কবিগানের ধূয়া, বিচ্ছেদের গান, বাউল গান, হা-ডু-ডু খেলার ছড়া ইত্যাদি।
এরপর এ কাব্যেপন্যাসে ব্যবহৃত হয়েছে লোককথা, রূপকথা, লোকসংস্কার, তন্ত্রমন্ত্র, প্রবাদ, লোকশিল্পকলা, লোকখাদ্য ইত্যাদি।
পরিশেষে বলা যায়, জসীম উদদীন গ্রামীণ জীবনের লোককাহিনী ও গাঁথা অবলম্বন করে “সোজন বাদিয়ার ঘাট” নামের যে কাব্যেপন্যাস লিখেছেন তা অনন্য। গ্রামবাংলার সাদামাটা জীবনের মাধুর্যকে দেশীয়(লোকসংস্কৃতি) সংস্কৃতি প্রয়োগ করে তা কাব্যমহিমায় ভাস্বর করে তুলেছেন; যা দেশি ও বিদেশি পাঠকদের মনে আজো বিস্ময় জাগায়। (হুবহু নয়)
১৯৬৯ সালে ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ ইউনেস্কোর অনুবাদ প্রকল্পে দ্বিতীয় গ্রন্থ হিসেবে অনূদিত হয় যার নামকরণ হয় জিপ্সি ওয়ার্ফ।
এই বইয়ের ভূমিকায় কবি লিখেছিলেন- “আমাদের ফরিদপুর অঞ্চলে বহু চাষী মুসলমান ও নমঃশূদ্রের বাস। তাহাদের মাঝে সামান্য ঘটনা লইয়া প্রায়ই বিবাদের সূত্রপাত হয়।
মুল বিষয়ঃ মহাজন ও জমিদারের মধ্যে কোন জাতিভেদ নাই। শোষণকারীরা সকলেই এক জগতের। ইহাদের প্ররোচনায় হতভাগ্য নমঃশূদ্র ও মুসলমানদের যে অবস্থা হয় তাহা চক্ষে দেখিলে অশ্রু সংবরণ করা যায় না।



উপন্যাস ~বোবা কাহিনী

বোবা কাহিনীকে বলা হয় একমাত্র উপন্যাস। কিন্তু এটা সঠিক নয়; তাঁর এক খানা উপন্যাস আছে যার নাম ‘বউ টুবানীর ফুল’। কবির মৃত্যুর ১৪ বছর পরে তাঁর পুত্র খুরশীদ আনোয়ার জসীম উদ্দীন পান্ডুলিপিটা খুঁজে পান।
বোবা কাহিণীঃ বাংলাদেশের ফরিদপুর অঞ্চলের একটি বিশেষ এলাকার জীবনচিত্র এ উপন্যাসের উপজীব্য। এ উপন্যাসের নায়ক আজাহের এক ছিন্নমূল কৃষকসন্তান। বাল্যকাল থেকেইে লাঞ্ছনা আর বঞ্চনা তার নিত্যসঙ্গী । তবুও সে স্বপ্ন দেখে সুখী জীবনের । তাই স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধ করে করে যায় বেশি ফসল ফলিয়ে সুখের নাগাল পেতে। বিভিন্ন প্রতিকূলতায় তার স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব হয়না। নিজের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে গিয়ে সে স্বপ্ন দেখে তার পুত্র বছিরকে উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষায় মানুষ করার। নানা বিপত্তি সত্ত্বেও অনেক ত্যাগ ও স্বশ্রেণীর সাহায্য ও সহায়তায় তার স্বপ্নপূরণের পথ খুলে যায়। বছিরের স্বপ্ন তার নিজের পরিবারের এবং নিরক্ষর গ্রামের মানুষের দুর্গতি-মুক্তির। দরিদ্র গ্রাম্যচাষী আজাহের ও তার পুত্র বছির, এই দুই প্রজন্মের জীবন সংগ্রামের সফলতা ও বিফলতার কাহিনী নিয়ে এই উপন্যাস।
________________________________________



নকশী কাঁথার মাঠ
ডঃ দিনেশ চন্দ্র সেনের কথায় ময়মনসিংহের লোকজ সঙ্গীত সংগ্রহের উদ্দেশয়ে গিয়ে গফরগাঁও এর সাহিত্যপ্রেমী মৌলভী শেখ আব্দুল জব্বারের বাড়িতে ওঠেন।
গফরগাঁওয়ে কাইয়ুম মার্কেটে আড্ডা দিতেন কবি জসীম উদ্দীন। সেখানেই রূপা’র সাথে প্রথম পরিচয়। রূপার জীবন কাহিনী থেকেই কবি সৃষ্টি করেন কালজয়ী এক অমর সাহিত্য ‘ নকশী কাথার মাঠ’। যা বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাতেও সমান ভাবে সমাদৃত হয়েছে। সে সময় রূপাকে মানুষ রূপা গুণ্ডা হিসেবে জানত। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ইউপি সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।
আর সাজু নামে যে নারী চরিত্র বাস্তবে তাঁর নাম ছিল ললিতা। ২০০৭ সালে ললিতা মারা যায় আর ২০০৮ এ নকশী কাঁথার মাঠের সেই কালো মানিক রূপা মারা যায়।
বিবিসি'তে সৈয়দ শামসুল হককে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন;
নকশী কাঁথা আবহমান গ্রামবাংলার অপূর্ব কারুকার্যময় এক শিল্প! যদিও সেখানে শিল্প থেকে বেশী ছিল আবেগ ও ভালবাসা। গ্রাম বাংলার নারীরা তাদের সেই সূচীকর্মে যে ফুল পাখি লতা পাতার চিত্র ফুটিয়ে তুলত সেখানে জড়িয়ে থাকত তাদের ভালবাসা, আশা নিরাশা আবেগ, আনন্দ দৈনন্দিন দুঃখ হতাশা আরও বহু শত অব্যক্ত অনুভূতি। একেকটা নকশী কাঁথা যেন একেকটা জীবনের আলেখ্য কোন মা সারাজীবন তাঁর চোখের জম মমতা ভালবাসা দিয়ে একটা কাঁথার অর্ধেক নকশী করে মেয়ের কাছে দিয়ে যেত। সেই মেয়েও সারাজীবন ধরে বাকি অংশটুকুতে তাঁর জীবন আলেখ্য লিখে মেয়ের বিয়েতে উপহার দিত। তিন পুরুষের বংশপরম্পরার গল্প শুনি আমরা- কিন্তু তিন নারীর বংশপরম্পরার গল্প উপাখ্যান আলেখ্য আমরা শুনি না কখনো। একসময় এই বাংলার নিভৃত-কোনে সবার অলক্ষ্যে রচিত হয় এই তিন নারীর বংশপরম্পরার গল্প! ( হুবুহু নয়)
(অনুবাদ: রনেদীদউ মিসজ। জসীম উদ্‌দীনের “নকশী কাঁথার মাঠ” কাব্যটি “দি ফিল্ড অব এমব্রয়ডার্ড কুইল্ট” এবং বাঙালীর হাসির গল্প গ্রন্থটি ‘ফোক টেল্স অব ইষ্ট পাকিস্তান’ নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে।)
তার ‘নকসী কাঁথার মাঠ’ ১৯৪০ সালের মধ্যে একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্ববিখ্যাত হয়।
‘বহুদিন পরে গাঁয়ের লোকেরা গভীর রাতের কালে,
শুনিল কে যেন বাজাইছে বাঁশি বেদনার তালে তালে।
প্রভাতে সকলে আসিয়া দেখিল সেই কবরের গায়
রোগ পান্ডুর একটি বিদেশী মরিয়া রয়েছে হায়।
সারা গায়ে তার জরায়ে রয়েছে সেই নক্সী কাঁথা,
আজও গাঁর লোকে বাঁশী বাজাইয়া গায় এ করুণ গাথা।’
_______________________________________

কবি গিন্নীর শেষ কথাঃ
আমি নিজেও এখন জীবন সায়াহ্নে। জীবিত কালেই আমার প্রথম সন্তান হাসু ( বেগম মওদুদ) মৃত্যুবরণ করছে। আমার নাতি আসিফের অকাল মৃত্যু, সবই আমাকে দেখতে হইছে। অনেক স্মৃতি আছে লিখতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু শরীর বাধা হইয়া দাঁড়ায়। দেশের মানুষ কবিকে এত ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন দেইখা আমার মনটা ভইরা যায়। তখন আমার মনে হয়, উনি মরেন নাই। আমার কবি এখনও জীবিত আছেন।
_______________________সমাপ্ত____________________

[sbনোটঃ গোয়ালন্দ ঘাটের ওই কাহিনীটা একজনের মুখ থেকে শোনা। সত্য-মিথ্যা যাচাই করার উপায় নেই। অন্য একজন আমাকে বলেছিলেন; এটা উনি নন ছিলেন শচীন বাবুর গিন্নী মীরা দেব বর্মণ। যিনি এ দৃশ্য দেখে লিখেছিলেন বিখ্যাত এক গানের লিরিক্স'
কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া
আমার ভাইধন রে কইয়ো
নাইওর নিতো বইলা
তোরা কে যাস কে যাস।

______________________________________

সুত্র ও সহযোগীতায়ঃ
নাসির আলী মামুন সম্পাদিত ‘শতবর্ষে জসীম উদ্দীন’ (প্রকাশক ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদ) গ্রন্থ থেকে পুনর্মুদ্রিত।
অক্ষর ব্লগ-লাবিব আহসান
উইকি
বাংলা পিডিয়া
মুক্ত কলাম
ইমরোজ মাহফুজ- দি ডেইলি স্টার
দৈনিক আজাদী
সুত্রঃ পল্লী কবি জসীম উদ্দীন - World Travel Bangladesh (worldtravelbd.com)
চাঁদপুরে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জসীমউদ্দীনঃ চাঁদপুরে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জসীমউদ্দীন (shampratikdeshkal.com)
'ঠাকুর বাড়ির আঙিনায়'- একজন কবির জীবনের গল্প - Mohioshi
জসীম উদ্দীন অর্গানাইজেশন
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০২২ রাত ১০:৫৭
১৭টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×