তিনি পূর্ব বাংলায় জন্মেছিলেন ব্যাস এইটুকুনই জানা যায়। কোথায় জন্মেছিলেন কিংবা তার আদিবাস বাংলাদেশের কোন অঞ্চলে তা ইন্টারনেট ঘেঁটে পেলাম না!! তাঁকে নিয়ে তার নাতির একটা লেখা ;দ্যা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে’- পড়লাম কিন্তু তিনিও শুধু পূর্ব বাংলা বলে চুপ। কেউ কেউ হয়তো জানেন কিন্তু বলতে চাননি- কেন সেটা তো বলতে পারিনা। যিনি প্রায় যৌবনের পুরোটা বাংলাদেশে(পূর্ব বাংলা) কাটিয়েছেন তিনি তার আদিবাস নিয়ে সন্তান আর নাতিদের কাছে গল্প করেননি এটা বিশ্বাস করা শক্ত।
ঋজুতা দে চেন্নাই: একজন ৩৬ বছর বয়সী স্কুলমাস্টার এবং তার শিষ্যরা, ব্রিটিশ রাজের অত্যাচারকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এবং তারা স্বাধীনভাবে বাঁচতে চেয়েছিল এবং সাম্রাজ্যের দাসত্বের জোয়াল ছুঁড়ে ফেলেছিলেন। তারা হয়তো এর চড়া মূল্য দিয়েছে। কিন্তু একটি ব্রিটিশের মুলে চরম এক আঘাত করেছিল। তরুণ বাঙালি পুরুষ ও মহিলাদের একটি ছোট্ট একটা দল নিয়ে চট্টগ্রাম অস্ত্রভাণ্ডার লুণ্ঠন ও দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। আমি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের চট্টগ্রাম শাখার প্রাক্তন সভাপতি 'মাস্টারদা' সূর্য কুমার সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রভাণ্ডারে অভিযান এবং পরবর্তী জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধের কাহিনী উল্লেখ করছি।
*তবে স্বরাজ লাভের পরে পশ্চিম বাংলায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে সর্ব প্রথম যে চলচ্চিত্র হয়েছিল সেটা্ সুর্যসেন ও তার দলের সেই বীরত্বপূর্ন অসীম সাহসিকতার কাহিনী নিয়ে, ' চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন' নামে সেই চলচ্চিত্র মুক্তি পায় ১৯৪৯ সালে।*
আমার দাদা সুরেশ চন্দ্র দে ছিলেন ভারতীয় কংগ্রেস সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম শাখার ৬৫জন সদস্যের একজন।
আমার দাদা একটি স্বাধীন ভারতের ধারণার জন্য তার জীবন উৎসর্গ করতে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এবং তার সহযোদ্ধারা যে মাটিতে রক্তপাত করেছিলেন তা দেশভাগের সময় প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান এবং পরে বাংলাদেশ হিসাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণ করা এবং অনেক বিস্মৃত বীরদের রক্তের বলিদানের উপর প্রতিষ্ঠিত দেশটিকে লালন করা আমাদের সবার উপর বর্তায়।
আমার পিতামহ তার তরুণ জীবনকে একটি স্বাধীন ভারতের আদর্শের জন্য উৎসর্গ করতে বেছে নিয়েছিলেন, কিন্তু জীবনের পরিবর্তন এবং ভাগ্যের অস্থিরতা এমন যে, তিনি এবং তার কমরেডরা যে মাটিতে রক্তপাত করেছিলেন তার পকেটটি দেশভাগের সময় খোদাই করা হয়েছিল, প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান হিসাবে। এবং তারপর বাংলাদেশ হিসাবে।
জাতি গঠনের ছায়া রেখা হয়তো আমার দাদা-দাদীকে তাদের মাতৃভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে, কিন্তু এটা আমাদের সকলের উপর বর্তায় যে আমাদের ত্যাগীদের স্মরণ করা এবং আমাদের স্বাধীন দেশের ফল ও স্বপ্নকে লালন করা যা অনেক বিস্মৃত বীরদের রক্তে ভেজা আত্মত্যাগের উপর প্রতিষ্ঠিত।
মনোজ বাজপেয়ী, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী আর রাজকুমার রাও এর মত দক্ষ ও জনপ্রিয় অভিনেতাদের কাষ্টিং করে ২০১২ সালে বলিউডে মুক্তি পায় ফিল্ম' চিটাগাং'
অস্ত্রাগারের চত্বরে ভারতীয় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করার সময় অন্যদের মধ্যে দুটি বলিউড সিনেমা বিপ্লবীদের উত্সাহকে ধরার চেষ্টা করেছে। কিন্তু স্পন্দন ত্বরান্বিত হয় যখন সুরেশ দে-এর বড় ছেলে শেখর দে বর্ণনা করেন, ‘আমার বাবা জালালাবাদ পাহাড়ে একটি অসম বন্দুক যুদ্ধে তার প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়েছিলেন। সেই যুদ্ধে তিনি আহত হয়ে অন্য কমরেডদের সহায়তায় পালিয়ে বেঁচেছিলেন। এরপর তিনি আত্মগোপন করেছিলেন ও বছরের পর বছর ধরে কর্তৃপক্ষকে ফাঁকি দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ধরা পরেন। ভয়াবহ নির্যাতনের পর কারাবরণ করেছিলেন। কারাগার থেকে বের হয়ে তিনি নতুন আলোকবর্তিকা অনুসন্ধানের জন্য বের হয়েছিলেন। একটি নতুন শহরে একটি নতুন সূচনা, এবং অবশেষে, ছোট্ট 'নাগপুর মালভূমি'র একটি শিল্প শহরে ভিত্তি স্থাপন করা বিভিন্ন বীরত্বের গল্পের টুকরো যা আমরা, তার বংশধর হিসাবে, সর্বদা গর্বিত থাকব’।
মাস্টারদা সূর্যসেন এবং প্রীতিলতাসহ তার শিষ্যরা, আয়ারল্যান্ডে ১৯১৬ সালের ইস্টার বিদ্রোহের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, ব্রিটিশ রাজের অত্যাচারকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। সূর্য সেন একটি ভিন্ন পরিণতির মুখোমুখি হন: সেনকে ব্রিটিশদের কাছে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল ১৯৩৪ সালে তার বন্ধু তারকেশ্বর দস্তিদারের সাথে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং উভয় ব্যক্তিকে তাদের মৃত্যুদণ্ডের আগে নির্মম নির্যাতন করা হয়েছিল বলে জানা গেছে।
‘ভাতে মাছে বাঙ্গালী, এদের দ্বারা ব্যবসা হয় না’--বাঙালির নামে এমন অভিযোগ কান পাতলেই শোনা যায়। কিন্তু এহেন অভিযোগ যে কতটা ভিত্তিহীন তা ইতিহাসের পাতায় চোখ বোলালেই বোঝা যায়। এই বাংলার ছেলে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় স্বদেশীয়কতার আদর্শে গড়ে তুলেছিল “বেঙ্গল কেমিক্যালস”, আর বাঙালি বিপ্লবী সুরেশ চন্দ্র দে গড়ে তুলছিলেন জুতা কোম্পানি ‘শ্রীলেদার্স’
সালটা ১৯৩০,১৮ই এপ্রিল,ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে একদল ছেলে মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে হামলা চালালো চট্টগ্রামের ব্রিটিশদের অস্ত্রাগারে। চলল অস্ত্র লুট, আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল অস্ত্রাগারে, উপড়ে ফেলা হলো রেললাইন। সেই ৬৫জনের তরুণ-যুবকদের দল অস্ত্র হাতে চলল শহরের দিকে, তাদের লক্ষ্য শহরের ব্রিটিশ বাহিনী। শহরে পৌঁছানোর আগেই রাত্রি শেষ হয়ে আসছে দেখে বিপ্লবীরা আশ্রয় নিল স্থানীয় জালালাবাদ পাহাড়ে। হঠাৎ-ই ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী ঘিরে ফেলল জালালাবাদ পাহাড়কে। উপায় না দেখে, বিপ্লবী লোকনাথ বলের নির্দেশে বিপ্লবীরা গুলি চালাতে শুরু করলো পুলিশের ওপর, শুরু হয়ে গেল খণ্ডযুদ্ধ। ওই ৬৫ জন যুবকের দলে একজন ছিলেন বিপ্লবী সুরেশ চন্দ্র দে। যুদ্ধ-চলাকালীন গুলির আঘাতে আহত হয়ে পাহাড় থেকে নীচে পড়ে যান সুরেশ দে। তাঁর সহ বিপ্লবী শান্তি নাগ তাঁকে কাঁধে নিয়ে পালিয়ে আসেন।
প্রায় এক বছর আত্মগোপন করে থাকার পর পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন সুরেশ দে। চলতে থাকলো তার ওপর অকথ্য অত্যাচার। এত আঘাত স্বত্বেও সতীর্থদের সম্পর্কে তাঁর মুখ থেকে একটা কথাও বার করতে পারেনি ব্রিটিশ পুলিশ। বাধ্য হয়ে তাঁকে নিঃশর্ত মুক্তি ও বিদেশে গিয়ে ওকালতি পড়বার প্রস্তাব দেওয়া হয়, কিন্তু তিনি তাও প্রত্যাখ্যান করেন। পরে, গৃহবন্দী হয়ে থাকার শর্তে তাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। এমনকি কিরণময়ী দেবীর সঙ্গে বিবাহ হবার সময় ব্রিটিশ প্রহরীর পাহারায় তা সম্পন্ন হয়।
স্বাধীনতা ও দেশভাগের সময় তিনি চলে আসেন এপার বাংলায়। বসতি গড়েন জামশেদপুরে। নিজের দমে কিছু করার লক্ষ্যে, ব্যবসা শুরু করতে চাইলেন। তিনি বুঝতে পারলেন সাধারণ ভারতবাসীর পক্ষে জুতো পরা কোন বিলাসিতার চেয়ে কম কিছু ছিল না, জুতো ছিল বড়লোকদের প্রসাধন সামগ্রী। সুরেশ দে ঠিক করলেন তিনি প্রত্যেকের সামর্থ্যের মধ্যে জুতো তৈরি করবেন।
আত্মদর্শন করার সময়, তিনি পাদুকার ধারণার উপর আঘাত করেছিলেন। তিনি লক্ষ্য করছিলেন যে কীভাবে বেশিরভাগ ভারতীয় খালি পায়ে হাঁটেন। জুতা বা স্যান্ডেল ইউরোপীয় এবং শুধু স্থানীয় ধনী ব্যক্তিদের পরিধানের জন্য এমনটা বোঝানো হয়েছিল এবং এটি জনসাধারণের জন্য বিলাসিতা হিসাবে বিবেচিত হত। তাদের জুতা কেনার কোনও উপায় ছিল না। বেশিরভাগই অসম নুড়িযুক্ত পৃষ্ঠ, ময়লা এবং নোংরা-ভরা রাস্তা এবং গলিপথে চরম আবহাওয়ায় হেঁটে এবং পায়ের অস্বাস্থ্যকর অবস্থা থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন রোগে ভুগছিল।
আর এই পরিকল্পনা থেকেই ১৯৫২ সালে জামশেদপুরে শুরু হল শ্রীলেদার্সের পথচলা। প্রথমে ছিল একটি জুতোর দোকান। তবে স্বল্প দামে চামড়ার জুতো জনপ্রিয় হতে বেশি সময় লাগেনি। ধীরে ধীরে ব্যবসাও বাড়তে থাকে। একটি দোকান থেকে ভারতের নানা প্রান্তে তৈরি হল আউটলেট। তবে এসবই মূলত সুরেশ দে-র ছেলেদের হাত ধরে।
১৯৯০ সালের ২১ মে প্রয়াত হলেন সুরেশ দে। তারপর ব্যবসার দায়িত্ব নিলেন তিন ছেলে শেখর, সত্যব্রত এবং আশিস। ভারতের বাইরে জার্মানি, গ্রিস এবং কুয়েতেও ব্যবসা শুরু করেছে শ্রীলেদার্স। শুধু ভারতবর্ষেই কোম্পানির শোরুম আছে অন্তত ৩০টি। সব মিলিয়ে বছরে টার্নওভার প্রায় ১০০ কোটির উপরে।
কোম্পানির ট্যাগলাইনে বলা হয়েছে ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস, রাইট প্রাইস’। তবে সেই বিশ্বমানের নিচেই লুকিয়ে আছে খাঁটি স্বদেশি উদ্যোগের ইতিহাস। স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক রক্তও মিশে আছে তাতে। আর আছে অসংখ্য মানুষের আবেগ আর নস্টালজিয়া।
বানিজ্যিকভাবে শ্রীলেদার্সকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে গেলেও, এমন একটা ঐতিহ্যের জন্ম সব কোম্পানি দিতে পারবে না।
লেখাসুত্রঃ
দি এভিনিউ মেইল
গেট বেঙ্গল
দ্যা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
বং পাইওনিয়ার
ঐক্য বাংলা
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২২ সকাল ৯:২২