
আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া তার চতুর্দশ-বর্ষীয় কন্যাকে নিয়ে সদ্য পরলোকগত এক লোকের বাড়ির স্বজনদের সান্ত্বনা দিয়ে ব্যাটারিচালিত রিক্সা-যোগে বাড়ি ফিরছিলেন। গোয়ালন্দে পদ্মা বহু আগে তার ভয়ঙ্কর রূপ জৌলুস হারিয়ে কোনমতে শীর্ণ খাল হয়ে এখন টিকে আছে। সেই খালের উপর দিয়ে কিছুদূর রাস্তা আর খণ্ড খণ্ড ব্রিজ।ব্রিজে উঠতে বেশ খানিকটা ঢাল বেয়ে উঠতে হয়। ব্যাটারিচালিত রিক্সার অনেক সময় শক্তিতে কুলোয় না সেই ঢাল বেয়ে উপরে ওঠার। রিক্সা চালক নীচে নেমে টেনে অতি শ্লথ গতিতে ঢাল বেয়ে উঠছিল।
সেই মূহুর্তে উল্টো দিক দিয়ে আসছিল এক ঘোড়ার গাড়ি- কিভাবে যেন লাগাম ছিঁড়ে ঘোড়া গাড়ি ফেলে তীব্র বেগে দিল ছুট!
ঘোড়াটা রিক্সার পাশ দিয়ে ছুটে যাবার সময়ে কোন প্ররোচনা ছাড়াই পেছনের জোড়া পা দিয়ে আচমকা দিল কষে এক লাথি। রিক্সা দুই যাত্রী সহ ছিটকে পড়ল পাশের খাদে। রিক্সার ব্যাটারিগুলো খাদের চারপাশে ভারি পাথর-খন্ডের মত ছড়িয়ে পড়ল। প্রায় বিশ ফুট খাড়া গভীর খাদ –রিক্সার নীচে আমার সেই আত্মীয়া। অতীব ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক ছিলনা। কিশোরী মেয়েটা চরম ভাগ্যগুণে কোন বড় ধরনের আঘাত পায়নি। সমস্যা হোল মাঝ বয়সী আত্মীয়াকে নিয়ে- তার হাঁটু ভেঙ্গে গেছে। খবর পেয়ে কয়েক মুহূর্তেই কয়েক’শ আত্মীয় পরিজন ও স্থানীয়রা ছুটে এসেছে। মুল সমস্যা হোল তাকে সেই খাদ থেকে তুলে আনা- প্রায় জনা বিশেক লোক অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাকে সেখান থেকে কেমনে তুলে আনল সেটা দু’চার কথায় লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।
*****
এম্বুলেন্সে রোগীকে ফরিদপুরের নামকরা এক প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে এমারজেন্সীতে ঢোকানো হোল। অর্থপেডিকের বড় ডাক্তার এসেই হুলস্থূল শুরু করে দিলেন। পারলে এখনি তিনি রোগীকে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকান-টাইটানিয়াম স্ক্রু পাত হেন-তেন লাগাতে হবে বলে এমন সব ভয়ঙ্কর কথা বলতে শুরু করলেন যা শুনে রোগীর আত্মীয়দের বেহুশ দশা!
ডাক্তারদের ভয়াবহ লোভ,দৌরাত্ব্য, রোগীর আবেগকে পুঁজি করে অর্থ আয়, হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে ভুল চিকিৎসায় জেরবার সারা দেশের মানুষ এখন কোন ডাকাতের কথাতেই পরিপূর্ণ আস্থা রাখতে পারে না- কিংবা বিশ্বাস করে না। মানুষ তার সাধ্যমত বিভিন্ন রেফারেন্স থেকে তথ্য সংগ্রহ করে একের পর এক হাসপাতালে দৌড়ায় একটু ভাল চিকিৎসার আশায়। অনেকের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপরেই কোন আস্থা নেই তারা ছুটে যায় পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে শুরু করে সিঙ্গাপুর থাইল্যান্ড কিংবা ইউকে আমেরিকায়!
কি ভয়াবহ নৈরাজ্য অরাজকতা ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেটের পাল্লায় পড়ে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার কি চরমতম অবনতি হয়েছে তা বাইরে থেকে অনুধাবন করা সম্ভব নয়।
যাহোক আমাদের দেশের প্রতিটা মানুষ পরামর্শ দিতে কার্পণ্য করেনা- প্রত্যেকেই নিজের চিকিৎসা-তো বটেই আত্মীয় পরিজন দূর সম্পর্কের কেউ থেকে শুরু করে নেহায়েত অপরিচিত-জনের চিকিৎসা ও পরামর্শ দিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসে। চারিদিকে খবর রটে গেল; একেকজনের একেক পরামর্শ। হাসপাতালে দর্শনার্থী যে-ই আসছে সে-ই লম্বা সেশন নিয়ে বিভিন্ন রেফারেন্স দিয়ে সেরা চিকিৎসকের সন্ধান দিতে ব্যস্ত। আর মোবাইলে-ম্যাসেজে নতুন নতুন লিস্টি তো আছেই।
*****
শেষমেশ বহু আলোচনা সমালোচনা করে সিদ্ধান্ত হোল বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান বর্তমান সময়ের অন্যতম নামীদামী অর্থপেডিক ও শল্যবিদের পরামর্শ নেয়া হবে।
প্রথমদিন এপয়েনমেন্ট বাতিল হয়ে গেল ব্যস্ততার কারনে উনার অনুপস্থিতির জন্য। তক্ষুনি পরের দিনের সিরিয়াল দেয়া হোল – নম্বরঃ২৪!
ডাক্তার চেম্বারে বসেন বিকেল পাঁচটায়। সে হিসেবে সাতটা সাড়ে সাতটার দিক গেলে হবে ভেবে সবাই হাসপাতাল অভিমুখে রওনা হোল। রোগীর কন্ডিশন বিবেচনায় তাকে অযথা না এনে তার সব রিপোর্টগুলো নিতে তার পতি-দেব তার ব্যাবসা-বানিজ্য ফেলে রেখে ফরিদপুর থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে দেড় ঘণ্টায় ঢাকার প্রবেশদ্বারে এসে তিনঘণ্টার জ্যাম ঠেলে ধানমণ্ডি ল্যাব এইডে যখন পৌছুলো ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা। তাড়াহুড়ো করে উপরে গিয়ে দেখে সিরিয়াল সবে তিন। ডাক্তার সাহেব নাকি দু'ঘন্টা লেট করে এসেছেন।সিরিয়াল তখন পঞ্চাশের ঘর অতিক্রম করেছে- আরো রোগী আসছে সরাসরি সিরিয়াল দিতে। ডাক্তারের চেম্বারের সামনে ভিড়ভাট্টা হট্টগোল ঠিক ও এম সি’র ট্রাকের পেছনের ভিড়ের মত। একেকজনের একেক আবদার, উৎকোচ দেবার চেষ্টা, বিভিন্ন প্রশাসনের রেফারেন্স আর অনুনয় বিনয় শুধু একটু আগে ডাক্তারের দর্শন পাবার জন্য। গেটের দুপাশে দুজন বেশ বড় ডেস্ক নিয়ে কয়েকখানা কম্পিউটার আর ল্যাপটপে, রোগীর সিরিয়াল, অপারেশনের ডেট, ওষুধ পথ্যের খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দিতে ব্যস্ত! একজনের পঞ্চাশবারের অনুরোধে একবার সাড়া দিচ্ছে তারা। দুজন ব্যস্ত রোগীকে ভিতরে নেয়া আর বের করায়। ভিতরে আর কয়জন সহকারী আছে তা বাইরে থেকে ঠাহর করা যায় না। প্রাইমারি ভিজিট ১৫০০। খানিক বাদে বাদেই স্ট্রেচারে বা হুইল চেয়ারে রোগী তাদের সিরিয়াল ছাড়াই ভেতরে ঢোকানো নিয়ে হুড়োহুড়ি।
কাহিনী কি? জানা গেল খানিক বাদে। উনাদের বিভিন্ন ইনজেকশন পুশ করা হবে; করবেন ডাক্তার সাহেব নিজের হাতে।
৫০০ টাকা মূল্যের একটা ইনজেকশন পুশ করতে ভিজিট নেন ৩৫০০। আর দু’হাজার টাকার-টা ৮০০০!!!( কনফার্ম নয়; শোনা কথা।)
কি ভয়ঙ্কর অবস্থা!!!
ডাক্তারের চেম্বারে যখন ঢুকলাম তখন ঘড়িতে রাত সাড়ে দশটা! ভাগ্যিস সিরিয়ালের কয়েকজন রোগী আসেনি বা দেরি হবে দেখে চলে গেছে না হলে রাত বারটার আগে সম্ভব ছিল না নিশ্চিত। ওদিকে কিছু লোক চেঁচামেচি করছে; তাদের রোগীকে দুই ঘণ্টা আগে ওটিতে ঢোকানো হয়েছে অথচ ডাক্তার এখনো চেম্বারে বসে ক্যামনে কি??
*****
ডাক্তারের বিশাল চেম্বার! দামী দামী সোফা ও চেয়ার পাতা আছে। ডাক্তার সাহেব বেশ খানিকটা দুরুত্বে খুব শক্ত পোক্ত কাঁচ ঘেরা আলাদা কক্ষে বসে আছেন। তার কাছাকাছি গিয়ে কথা বলা যাবেনা – দূরে চেয়ারে বয়ে ভাল করে মাস্ক বেঁধে পরামর্শ নিতে হবে। আমার আগের রোগী মাস্ক ভাল করে পরেনি বলে উনি বকাবকি করছিলেন। অথচ উনার চেম্বারে তার নিজের তো বটেই কোন সহযোগীই মাস্ক পরেননি।
ডাক্তারের বয়স পঞ্চাশ পেরোয়নি সম্ভবত! এই বয়সে উনি এত নামীদামী একটা মেডিকেল কলেজের বিভাগীয় প্রধান হয়ে ফের অবসরে গেলেন কিভাবে এটা ভেবে আমি ঘেমে গেলাম।
ডাক্তারের বিশাল টেবিলের ঘিরে শতাধিক অটো সিল। রোগী বা তার আত্মীয়ের সাথে কথা বলতে বলতে একেকটা করে সিল ব্যবস্থাপত্রে চেপে ধরছেন! এই ব্যাপারে তিনি এক্সট্রা অর্ডিনারি ট্যালেন্টেড। এতগুলো সিল থেকে অতি দ্রুত হস্তে সঠিক সিল নির্বাচন করা তেমন তালেবর ব্যক্তি ছাড়া অসম্ভব!
আমার রোগীর কাগজ পত্র দেখে চমৎকার একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন; অপারেশন ছাড়া গত্যন্তর নেই।
কবে কিভাবে ক্যমনে কি করতে হবে কি জানতে চাইলে তিনি বললেন;এখানে সব নির্দেশনা দেয়া আছে বাইরে আমার সহকারীর সাথে কথা বলেন, সে সব বলে দিবে। মাত্র তিন মিনিটের সেশন।
বাইরে ভিড় ঠেলে সহকারীর কাছে ফাইল দিয়ে অপারেশনের কথা বলতেই তার ব্যাবহার আমূল পাল্টে গেল। নিজের পাশে যত্ন করে বসিয়ে বাকি সবাইকে ইগ্নোর করে সবকিছু ঝটপট বুঝিয়ে দিলেন। সাঁঝের বেলা থেকে চরম বিরক্তি নিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা আমরা তার ব্যবহারে চরম পুলকিত ও বিগলিত হয়ে প্রায় মধ্য রাতে চনমনে মন নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ালাম!
তবে ফেরার পথে একজন নামী ডাক্তারের একদিনের আয়ের হিসেব মেলাতে গিয়ে ফের ঘেমে নেয়ে ফের ক্লান্ত বিধ্বস্ত ও বিমর্ষ হয়ে পড়লাম। আমার মেয়ে এইটুকুন বয়েসে নিজের এইম ইন লাইফ ঠিক করে ফেলেছে; সে অঙ্কের শিক্ষক হতে চায়।
ধ্যাত্তেরি! আমাদের অভিভাবকেরাই অনেক বেশী দূরদর্শী ছিলেন- তারা নিজেরাই ঠিক করতেন সন্তানের 'ভবিষ্যত লক্ষ্য'। তারা তাদের সন্তানকে ইঞ্জিনিয়ার ব্যারিস্টার আর ডাক্তার করতে চাইতেন।
আমরা হয়তো ভুল পথে হাঁটছি- আমাদের সন্তানদের ‘এইম ইন লাইফ’ আমাদেরই ঠিক করতে হবে এবং সেটা হবে একমাত্র ডাক্তার হওয়া।
~ ভুল বললাম?
*** ছবিটা প্রায় মধ্যরাতের- ফেরার পথে তোলা।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জানুয়ারি, ২০২৩ দুপুর ১:০২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



