
বেশ খানিকটা দুঃখবোধ নিয়ে একটু ব্যতিক্রমী বা ভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করব। ঈশ্বর বা প্রকৃতি পুরুষ ম্যামেলসদের মা হবার ক্ষমতা দেয়নি। কেন শুধু ম্যামেলসদের কথা লিখলাম -তবে অন্য কোন প্রজাতির সে সক্ষমতা আছে?
এ আলোচনায় পরে আসছি, তার আগে একটা বিশেষ একটা তথ্য জানিয়ে রাখি; মা হবার বিশেষ ক্ষমতা দানের পাশাপাশি হোমো-সেপিয়েন্স নারীরা প্রকৃতি থেকে আরেকটি বিশেষ ‘বর’ পেয়েছে। সেই আশীর্বাদ বা বিশেষ বর’টা না পেলে ক’জন নারী নারী হয়ে জন্মানোর ইচ্ছে প্রকাশ করত সেটা নিয়ে বিস্তর তর্ক হতে পারে। তবে কি সেটা?
এই গ্রহের অন্য সব প্রাণী বিশেষ করে যারা সন্তান জন্মদান করে তারা আমৃত্যু বংশ বিস্তার করে যায়। বংশবিস্তারের ক্ষমতা পুরোপুরি রোহিত হবার প্রাক্কালে সে মৃত্যুবরণ করে। মানুষের কাছাকাছি অন্যান্য নারী প্রাইমেটদের আয়ু হয় ৩৫-৪০ বছর বা তার থেকেও কম। সেই হিসেবে হোমো-সেপিয়েন্স নারীদের ৪৫-৫০ এর বেশী বেঁচে থাকার কথা নয়। কিন্তু অলৌকিকভাবে তাদের গড় আয়ু হোমো-সেপিয়েন্স পুরুষদের থেকেও বেশী। এ বিষয়টা জটিল বিবর্তনবাদীদের কপালে ভাঁজ ফেলে। তারা অবশ্য গড়পড়তা কয়েকখানা যুক্তি দাড় করিয়েছেন। যাক সে কথা- ফিরে আসি সেখানেই;
পৃথিবীর সব কঠিন, দুঃসাহসিক, ঝুঁকিপূর্ণ ( যুদ্ধ, দাঙ্গা সহ অন্য কাজ যেখানে জীবন হারানোর শঙ্কা থাকে) ছেলেদের ঠেলে দিয়ে নারীকুল প্রকৃতির দেয়া ওই একখানা উপহারের গল্প করে লক্ষ লক্ষ গল্প উপন্যাস কবিতা আর অঙ্কন শিল্পে ম্যাসাকার করে ফেলেছে। প্রকৃতি নারীদের সুযোগ দিয়েছে পুরুষদের দেয়নি- তো এখানে পুরুষের কি অপরাধ?? তাকে সবসময়ই খোঁচা দিয়ে, ঠোনা দিয়ে মগজ ধোলাই করে কানের কাছে তাদের সেই ভয়ানক কষ্টের কথা বারংবার লক্ষ কোটি বার চেঁচিয়ে বলার মানে কি?
অথচ 'গর্ভধারিণী' কিংবা 'মা' নামে কোন উপন্যাসই নারীরা লেখেনি। পৃথিবীতে মা’ও গর্ভধারিণীকে নিয়ে যত স্মৃতিকথা আবেগ-মথিত গান কবিতা সাহিত্য রচনা হয়েছে তার নিরানব্বুই-ভাগের দাবীদার অধম পুরুষজাতি।
ধর্ম রাজনীতি সমাজনীতি থেকে শুরু করে সবখানেই মায়ের জয়গান। বাবা অন্য পক্ষ শুধু নেপথ্যের সারিন্দা। আমার কাছে ভুরি ভুরি কণ্যা-পাগল বাবার চাক্ষুষ উদাহরণ আছে! কিন্তু সেই মেয়েদের সাহিত্য গল্প শিল্পে বাবারা কোথায়? যদিও ফেসবুক বিস্তারের পরে কিছু মেয়েরা বাবাকে নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে দু-চারটে স্মৃতিকথা লিখছে বটে কিন্তু সেগুলো নোটিশ করার মত নয়। পুত্রের কাছে বাবার পত্র’ নামে একটা বেশ জনপ্রিয় পুস্তক আছে বটে- কিন্তু মেয়েদের কাছে পূজনীয় বাবার বেদীতে কোন অর্ঘ্য নেই!!
ভাবে মনে হয় মায়েরা শুধু ‘পুরুষ বাচ্চা’দের জন্ম দেয়!! বেশ বেশ।
এবার প্রথম থেকে শুরু করি; কেন আমি ম্যামলস বা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের কথা বললাম?
ভেবে দেখুন কেউ দুখানা মাত্র পা নিয়ে দাবড়ে বেড়াচ্ছে সারা বিশ্ব কারো ফের শ’খানেক পা লাগে চলাফেরা করতে। এক জোড়া চোখেই যেখানে মহাবিশ্বের শুরুর রশ্মি দেখতে চাইছি আমরা সেখানে কেউ কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে হাজার খানেক চক্ষু নিয়ে। কেউ নিজেকে শক্ত খোলসে পুরেছে কেউবা পশমের কোট পরে আছে আবার কেউ একেবারে ন্যাংটো। প্রাণ ও প্রাণী সন্ম্নধে বিজ্ঞানীরা যত জানছে তত বেশী অবাক হচ্ছে; তেমন একটা অবাক করা তথ্য পুরুষ হয়ে গর্ভে সন্তান ধারন- তাও একটা দুটো নয় এক দেড় হাজারের উপরে বাচ্চা কাচ্চা একবারে জন্মদান। আসুন পরিচিত হই সেই প্রকৃতির ভীষণ ব্যতিক্রমী উপহার পাওয়া সেই পুরুষ মায়ের সাথে।
গ্রহ জুড়ে বিস্তৃত সমস্ত বৃহৎ প্রাণী রাজ্যের মধ্যে সমুদ্রের ঘোড়া (পাইপফিশ ও সমুদ্র ড্রাগন) একমাত্র প্রজাতি যার পুরুষ সদস্যরা বাচ্চাদের জন্ম দেয়। দীর্ঘ এক প্রেমের "নৃত্য" নাটক (!) করার পরে, মহিলারা তাদের ডিমগুলি পুরুষের বাচ্চা-দানীতে জমা করে, যেখানে সেই থলেতেই পুরুষেরা তাদের নিষিক্ত করে।

গর্ভাবস্থায়, পুরুষ ডিমকে পুষ্টি, হরমোন এবং বিকাশের জন্য একটি সামগ্রিক নিরাপদ পরিবেশ প্রদান করে। এই সময়কাল ৯-৪৫ দিনের মধ্যে যে কোনও জায়গায় স্থায়ী হতে পারে। ভ্রূণ বড় হওয়ার সাথে সাথে পুরুষের পেট বেঢপ ফুলে যায়, ঠিক যেমন একটি মানব গর্ভ। যখন সে জন্ম দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়, তখন পেট উন্মোচন ও সংকোচন করে শিশু সামুদ্রিক ঘোড়াগুলিকে বের করে দেয়।
কিছু নবজাতক প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষুদ্রাকৃতির সংস্করণের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, কিছু তখনও তাদের ডিমের ঝিল্লির অংশ দ্বারা কুঁচকানো এবং ঢেকে থাকে মানে আধা ফুটন্ত অবস্থায় বের হয়। একটি পুরুষ এবং মহিলা সামুদ্রিক ঘোড়া জোড়ার বেশ কয়েক’শ থেকে হাজারের উপরে সন্তান থাকতে পারে। এটা অজানা কেন সামুদ্রিক ঘোড়া প্রজননের ক্ষেত্রে এই লিঙ্গ পরিবর্তন করে, তবে একটি ধারণা হল যে, মা ঘোড়া মাছ দ্রুত দ্বিতীয় ব্যাচ ডিম ধারণ করার জন্য বাবা ঘোড়া মাছের ঘাড়ে গুরুভার চাপিয়ে দেয় কেননা প্রাপ্ত বয়স পর্যন্ত ১ ভাগেরও কম ঘোড়া মাছ টিকে থাকতে পারে। যুক্তিখন্ডনঃ সামুদ্রিক কচ্ছপের মত আরো অনেক প্রাণীই আছে যাদের এক ভাগেরও কম পরিণত বয়স পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে- প্রকৃতি কিন্তু তাদের সে সুযোগ দেয় নি।

সামুদ্রিক ঘোড়া, পাইপ-ফিশ ও সি-ড্রাগনের সব পুরুষই গর্ভধারণ করে এবং সন্তান জন্ম দেয়। সামুদ্রিক ঘোড়ার গর্ভধারিণী পিতারা তাদের বিকাশমান ভ্রূণগুলিকে তাদের লেজের উপর অবস্থিত পেটের কাছের একটি থলিতে সঞ্চয় করে।এই থলেটা শুধু ডিমে তা দেবার জন্য নয়- মহিলা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মত এই থলিটিও জরায়ুর সমতুল্য। এটিতে একটি প্ল্যাসেন্টা রয়েছে, যা সমুদ্রের ঘোড়া শিশুর বৃদ্ধি এবং বিকাশে সাহায্য করে। সামুদ্রিক ঘোড়ার বাবারা গর্ভাবস্থায় তাদের বাচ্চাদের পুষ্টি এবং অক্সিজেন সরবরাহ করে, স্তন্যপায়ী প্রাণীদের গর্ভাবস্থার মতো একই জেনেটিক নির্দেশাবলী ব্যবহার করে।
আরো অদ্ভুত ব্যাপার কি জানেন; Syngnathidae পরিবারের মাছগুলি(পাইপফিশ এবং সিড্রাগন) লম্বা, টিউব-সদৃশ স্নাউট এবং হাড়ের প্লেট অংশে আবৃত শক্ত খোলস দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। এরা অন্যান্য মাছের থেকে ভিন্ন, এদের পেটে কোন পাখনা থাকে না – এরা ঘুরে বেড়ানোর জন্য শুধু তাদের পিঠের পাখনার উপর নির্ভর করে সেজন্য এদের চলার গতি বেশ ধীর। শুধু তাই নয় এরা নির্দিষ্ট কোন দিকে চলতে পারে না অনেক সময় সামনে পেছনে এগোতে গিয়ে নিজের অক্ষের উপরেই ঘুর পাক খায়। সার্ভাইভাল অফ দ্যা ফিটেস্ট- এর এই গ্রহে অতীব নাজুক এই প্রাণীটি লড়াই করে এখনো বেশ ভালভাবেই পৃথিবীতে টিকে আছে।
এইতো সেদিন মাত্র বুলেট ট্রেনের টানেলে ঢোকার সময়ে বোম ফাটানোর মত যে বুম শব্দ হয় সেটা থেকে উদ্ধার পেতে জাপানের বিজ্ঞানীরা মাছরাঙ্গা পাখির শরণাপন্ন হয়েছে- তার ঠোঁট আর মাথার আকৃতি দিয়ে বুলেট ট্রেনের গতির শব্দের ৪০ ভাগ কমিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছে।
সেই দিন বেশী দূরে নাই সামুদ্রিক ঘোড়া মাছকে ফলো করে হোমো-সেপিয়েন্স পুরুষজাতি হয়তো একসময় গর্ভধারণ করে গর্ভধারিণী বাবা হয়ে যাবে। অতএব এককভাবে জন্মের অধিকার নিয়ে নারীদের আনন্দিত হবার তেমন কিছু নেই। দোয়া করেন যেন এইদিন আপনাদের দেখে যেতে না হয়।
জয়তু ঘোড়া মাছ- তুমি পুরুষদের ইজ্জত বাঁচাইছ।
লেখা সুত্রঃ
Seahorse fathers give birth in a unique way, new research shows (theconversation.com)
See a Male Seahorse Give Birth - Scientific American
3 Types of Male Animals That Give Birth (With Pictures) - Wildlife Informer
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ বিকাল ৪:৫৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




