
রসনা -যত পারো খাও
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবির দেশে কবিতার দেশে ভ্রমণ কাহিনী পড়ে ফ্রান্সের উপকুলে লেবু আর লবণ দিয়ে ঝিনুক আর অতি সুস্বাদু ফোঁয়া খাবার সাধ জেগেছিল।
প্রথমে কিন্তু জ্যান্ত ঝিনুক লেবু লবণ দিয়ে খাওয়াটা অমানবিক মনে হয়েছি তবে তার থেকে অনেক বেশী ঘৃণ্য আর অমানবিক মনে হল ফোঁয়া তৈরির প্রক্রিয়াটা! ফোঁয়াটা মূলত এক ধরনের হাসের লিভারে জমে থাকা চর্বি। সেইসব হাসকে দিনের পর দিন নল দিয়ে জোর করে হাই প্রোটিন ফুড খাওয়ানো হয়। এই অতিরিক্ত খাবারের চাপ সইতে না পেরে অনেক ভাগ্যবান হাস অকালে মরে যায়। ভাগ্যবান কেন বললাম-কারণ বাকি যারা বেচে থাকে তাদের জন্য অপেক্ষা করে ভয়ঙ্কর দুর্ভোগ। লিভারে যাতে অতি দ্রুত চর্বি জমে সেজন্য বিশেষ কায়দায় তৈরি এমন এক ধরনের খাঁচায় রাখা হয় যেখানে তাদের সামান্য নাড়াচাড়ার সুযোগ থাকেনা। অতিরিক্ত খাবার আর চর্বির ভারে তারা বসতে পারেনা ঘুমোতে পারেনা আর এত্তো এত্তো খাবারের বর্জ্য বেরুতে গিয়ে মলদ্বার ছিঁড়ে গিয়ে সারাক্ষণ রক্ত ঝড়ে। অবশেষে মানুষের লালসার আয়োজন পরিপূর্ণ হলে তাদের চরম মুক্তি মেলে –লোভী একজোড়া হাত ওদের বুক চিরে বের করে নেয় চর্বি সর্বস্ব লিভার খানা।
কি ভয়ঙ্কর কি অমানবিক!!
আসলেই কি ব্যাপারটা অমানবিক?
একটা বিরল প্রজাতির বিলুপ্ত প্রায় প্রাণীর গায়ে হাত বুলিয়ে টিভি ক্যামেরার সামনে চেঁচামেচি করে আমরা নিজেদের জাহির করি সৃষ্টির সেরা মহান জীব বলে।ওদিকে মশা মারতে আমাদের কত শত আয়োজন-ছারপোকাকে পিষে মারি তেলাপোকার বংশ নির্বংশ করি আর ইঁদুরের পাছা সেলাই করে দেই যাতে পাল হয়ে বাকি গুলোকে কামড়ে মারি। হত্যা হত্যা হত্যা –মানুষের জন্মই হয় হত্যার জন্য। নিত্য নতুন আয়োজন করে ভিন্ন কারিশমায় হত্যা…
ইলিশের ডিম আমার খুব প্রিয়- বেশ বড় সড় ডিম জোড়া লবণ মাখিয়ে কয়েক ঘণ্টা রেখে অল্প আচে বাদামী করে ভেজে কাগজি লেবুর রস মেখে খেতে কি দারুণ লাগে-আঃ ভাবতে গিয়ে জিবে পানি চলে এল কিংবা বড় কই আর গুলশা ট্যাংরার ডিম।
ওদিকে বেলে মাছের ঝুড়ির সাথে আস্ত আস্ত ডিম বড় উমদা। আর বড় পাঙ্গাশের ডিমের সাথে আধ ভাঙ্গা আলু আর টম্যাটোর ঝোলের ভিতর তেলতেলে পেটি খেতে গিয়ে আরামে চোখ বুজি।
আহা কতই না মানবতার দোহাই দিচ্ছি আমি নিজের অজান্তে। শালা নিজের পাছায় নিজের লাথি মারতে ইচ্ছে করে। একবার কি ভাবি আমার নিজের রসনা বিলাসের জন্য কত লক্ষ মৎস্য ভক্ষণ করলাম- দুয়েকটা মাছের ডিম দাঁতের ফাঁকে জড়িয়ে থাকলে সেটা আবার টুথপিক দিয়ে ঠেলে ভিতরে চালান করে দেই।
ছোট বেলায় আমার দাদা বাড়ি সংলগ্ন খাল কুয়ো নামে শুকিয়ে যাওয়া এক বিলে মাছ মেরেছিলাম। হাত খানেক পানি হবে আর বিঘৎ খানেক পাঁক এর মধ্যে পাড়[আর সব ছেলে বুড়োরা হাড়ি পাতিল বালতি নিয়ে নেমে পড়েছে মাছ ধরতে।মাছ মারা খুব সহজ-কাদার ভিতর হাত ডোবালেই হাতের ফাকে খলবল করে পুঁটি খয়রা টাকি শোল আর কৈ-সাথে দু চারখান পটকা আর চ্যাঙ। সে কি মজা! এত সহজে মাছ ধরা যায় তা আমার ধারনার মধ্যে ছিলনা। ঘণ্টা খানেক এলোপাথাড়ি কাদায় জলে ডুবো-ডুবি করে হাতের বালতি প্রায় ভরে ফেললাম।
তখনকার দিনে মাছ প্রিজার্ভেশনের কোন ব্যবস্থাই ছিলনা। শুধু কই শোল আর শিঙ মাছ কোলা ভর্তি পানিতে চুবিয়ে কিছুদিন রাখা যেত- আর বিক্রির-তো প্রশ্নই আসেনা-এ তল্লাটে সবার বাড়িতেই মাছের প্রাচুর্য-ওদিকে ইজ্জত বলেতো একটা কথা আছে! মাছ মানুষ বেচে নাকি?
এত মাছ কে খাবে? সেটা নিয়ে ভাবার সময় নেই- সবাই হত্যা উৎসবে মেতেছে। যত পার হত্যা কর- পরে খাও ছড়াও ফেল কিংবা শুটকি বানাও সমস্যা নেই।
একটা নদীর উৎপত্তি স্থল থেকে শুরু করে সঙ্গম স্থল পর্যন্ত মানুষের মৎস্য নিধনের নিমিত্তে কত শত আয়োজন। বেড়ি জাল টানা জাল খ্যাপ জাল সহ শত কিসিমের জাল দিয়ে তাদের গতি রুদ্ধ করে শান্তি নেই- এর পরে আছে ফাঁদ পেতে ধরা বাধ দিয়ে ধরা। তাতেও যদি ধরা না পরে- মানুষের হাতে আছে অন্য অস্ত্র-পলো দিয়ে চালন দিয়ে নিদেন পক্ষে গামছা দিয়ে মার। ওদিকে ট্যাটা বল্লম কোচ বড়শি-তো আছেই। মোদ্দা কথা মৎস্যকুলকে সমূলে বিনাশ কর। হাত গলে একখানা কাচকি মাছ বেরিয়ে গেলে আফসোসে মরে যাই। সব কিছু শেষ করে শুরু করি মায়া কান্না! নদী বাচাও মাছ বাচাও আন্দোলন। ওদিকে নব্য প্রজন্মের বুড়োদের ভ্যাজর ভ্যাজরে কান ঝালাপালা হয়। আড়াই কেজির ইলিশ ষাট কেজির পাঙ্গাশ আর কেজি ওজনের কৈ মাছ কত উপাদেয় রান্না করে ক্যামনে হাড় মাংস চিবিয়ে খেয়েছে তার গল্প।
আফসোস করে মরে তারা –নদীর মাছ কই গেল- নদীর মাছের স্বাদ কি আর চাষের মাছে মেলে!
মাছ নেই তো কি হয়েছে আকাশেতে পাখি আছে বনে আছে পশু-ওদিকে গর্তে আছে সাপ ব্যাঙ সজারু আর আল্লার দুনিয়ায় পোকা মাকড়ের তো অভাব নেই।
খাও- যা আছে যত আছে খাও। তেলাপোকা কিংবা কুমির নয় পৃথিবীর একমাত্র সর্বভুক মনুষ্য জাতির অখাদ্য কিছুই নেই।
আমার মত নাক কুচকে থাকা ভদ্রনোকেরও থাইল্যান্ডে গিয়ে পোকা ফ্রাই দেখে জিভে জল এসেছিল।
মানুষ কি না খায়? তাজা অক্টোপাস সস দিয়ে মাখিয়ে কুকুরের বমি বানরের মগজ অজগরের মাথা থেকে শুরু করে গুবরে পোকা পর্যন্ত।কাগজ কাঠ লোহা গু ও কেউ কেউ খায়।
আমাদের জিভের মাথায় সারাক্ষণ লালসার রস চট চট করে-আজ প্রকৃতি তার সমগ্র প্রাণীকুল নিয়ে চিন্তিত কেমন করে এই শত শত কোটি ভয়ঙ্কর সর্বভুকদের হাত থেকে তাদের বাঁচাবে?

যখন ফিনল্যান্ডের সমুদ্র উপকুলে সদ্য যুবকদের পৌরুষ প্রদর্শনের নমুনা স্বরূপ হাজার হাজার ডলফিন হত্যার সচিত্র প্রতিবেদন দেখে আঁতকে উঠি – ভাবি মানুষ কেন এত নির্মম পাষণ্ড হয়?
কিন্তু এর পাশাপাশি আমাদের এই মৎস্য নিধন আর কোরবানির গরু ছাগল হত্যা যজ্ঞ মোটেই নির্মম মনে হয়না।
একজন কাপালিক সন্ন্যাসী কোন কালী মন্দিরে খড়ি কাঠে দশখানা পাঠা এক এক কোপে বলি দিলে তাকে বাহবা দেই- উৎসবের আমেজে খুশীতে লাফিয়ে উঠি!আ-হাহা কচি পাঠার মাংসে ভোজ হবে ভেবে।
কিন্তু যদি শুনি তেমনি করে একখানা মাত্র নর বলি হয়েছে- তখন ভয়ে আঁতকে উঠে ভাবি শালা কি পাষণ্ড!তবুও এই মানুষ ই মানুষের মাংস খায়।কখনো দায় ঠেকে কখনো সখ করে।
আমার বাবা গল্প করে পাখি শিকারের। কবে ক'খানা বক ঘুঘু হরিয়াল বুনোহাঁস মেরেছে তার গল্প।
একবার একজোড়া হাড়গিলার খোজ পেয়ে বন্দুক নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন। সারাদিন দৌড়ে দাবড়ে একখানা কোনমতে মারলেন। কিন্তু তার অজান্তে নিহত সঙ্গীকে অনুসরণ করল জোড় অন্য পাখিটা।
আমাদের বাড়ির ধারের বেশ বড় একটা গাছের মগডালে বসে সারারাত ডুকরে ডুকরে কাঁদল সেই পাখিটা। সকাল হতেই আমার বাবা খুব সহজে সেটাকে সাবাড় করলেন। তার ভাষায় পাখিটার এমন কষ্ট তার সহ্য হচ্ছিল-না। তাই ওকেও চিরতরে সেই কষ্ট থেকে মুক্ত দিলেন।
আহারে একটা পাখির দুঃখে আমাদের মন ক্যামনে করে কাঁদে! কত্তো মহান আমরা -কি দারুণ মানবিক উদাহরণ…
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৩৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




