(এবারের ঘটনাটা বেশ মর্মস্পর্শী-যে কারনে অন্য আলোচনা এড়িয়ে গেলাম।) কাহিনীকালঃ ২০০০ সাল
এলিফ্যান্ট রোড থেকে হোটেল সোনারগাঁয়ে যাব । সেখানে ব্যাবসায়িক আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেউ একজন অপেক্ষা করছিল । হাতে সময় খুব কম ছিল। ভীষণ ট্রাফিক! কোন রিক্সা চালকই যেতে রাজি হচ্ছিল না। ১৫/২০ জনকে অনুরোধ করার পর অবশেষে একজন যেতে রাজী হল। ভাড়া কত? জিজ্ঞেস করলে সে বলল,- যা’ইচ্ছে দিয়েন।
আমি উঠে ভালভাবে বসার আগেই সে রিক্সা টান দিল,তড়িৎ হুড আঁকড়ে ধরে কোন রকমে নিজের পতন রোধ করলাম। মেজাজ খিঁচড়ে গেল । মুখে কিছু না বললেও মনে মনে রিক্সা চালককে গালি দিলাম।
জ্যাম ঠেলে সে বিভিন্ন কসরত করে দ্রুত সামনে এগুতে চাইছিল যার ফলশ্রুতিতে সে আরো পিছিয়ে পড়ছিল । একবার রাস্তা একটু ফাকা পেয়ে সে এমন বেপরোয়া ভাবে রিক্সা চালাল যে দু’দুবার অন্য গাড়ির সাথে সংঘর্ষ হতে হতে বেঁচে গেলাম!
আমি তাকে জোরে ধমক দিলাম। বললাম, ধীরে দেখেশুনে চালাতে।
সে আমার কথায় কর্ণপাত করল কিনা জানিনা তবে আরো বেশী বেপরোয়া চালাতে শুরু করল। আমার রাগ সামলানো কঠিন হল মনে মনে ভাবলাম রিক্সা থেকে নেমে তাকে আচ্ছা করে একটা চড় কষাবো।
রিক্সা সোনারগাঁয়ের উল্টো দিকে এসে থামতেই আমি তাড়াহুড়ো করে নেমে তার সামনে গিয়ে আচ্ছা মত বকতে শুরু করলাম-তবে গায়ে হাত তুললাম না।
সে বুঝতে পেরেছিল যে সে অপরাধী ,আমার দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে আমার বকুনি হজম করছিল।
হঠাৎ লক্ষ্য করলাম তার চোখ দিয়ে ফোটা ফোটা জল পড়ছে ।
আমার মন একটু দ্রবীভূত হল আমি বকুনি থামিয়ে ত কে জিজ্ঞেস করলাম ,কত ভাড়া দিব?’
আমার দিকে না তাকিয়েই সে কন্না ভেজা কণ্ঠে বলল,’যা খুশী দ্যান ।’
আমি দশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে ধরে তাকে জিজ্ঞেস করলাম ’কি ব্যাপার কাঁদছ কেন?’
সে এক হাতে চোখ মুছে হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিয়ে আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সরাসরি তাকিয়ে বলল ,’ছার কিছু মনে কইরেন না । মাফ কইরা দিয়েন ।’
কথা বলার সময় তার চোখের পানি বাধ মানছিল না। এই প্রথম আমি তাকে ভাল করে লক্ষ্য করলাম আজো আমার স্মৃতিতে গেঁথে আছে বছর পঁচিশেক বয়সের সেই ছেলেটার কান্না ভেজা অতি সরল মায়াবী মুখখানি।
আমি তার কাঁধে হাত রেখে কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করলাম,’ তোমার কি হয়েছে?’
সে নিজেকে আর সামলাতে পারল না দু’হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে উঠল।
***
মিনিট খানেক পরে একটু ধাতস্থ হয়ে বলতে শুরু করল যার সারমর্ম হচ্ছে;
গতকাল রাতে তার মা রান্না করছিল । রোদ বৃষ্টিতে যাতে তার কষ্ট না হয় সেজন্য সে রান্নার জায়গাটায় দুটো পাতলা টিন দিয়ে একটা চালার মত করে দিয়েছিল । কিন্তু গতরাতে হঠাৎ একটা দমকা বাতাসে সেই চালার আলগা বাধন ছিঁড়ে যায় টিনের ধারালো অংশে তার মা আঘাতপ্রাপ্ত হন । তখন সে বাইরে ছিল বাড়িতে গিয়ে শোনে তার মা অসুস্থ ,বস্তিবাসীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। সে প্রথমে উপলব্ধি করতে পারেনি আঘাতটা কতটুকু গুরুতর কিন্তু হাসপাতালে গিয়ে শোনে উনার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। এখনও ডাক্তাররা তার জ্ঞান ফেরাতে পারেনি । তার সেই শোক বিহ্বল অবস্থায় ডাক্তার তাকে একটা প্রেসক্রিপশন হাতে ধরিয়ে দিয়ে ’ একটা ইনজেকশন নিয়ে আসতে বলেছে। এই ইনজেকশনটা না হলে নাকি তাকে বাঁচানো নাও যেতে পারে ।
ডিসপেনসারিতে গিয়ে জেনেছে ওটার মূল্য হাজারের বেশী ।
সেই থেকে সে সারা রাত উদ্ভ্রান্তের মত দৌড়িয়েছে। বস্তিবাসীদের কাছ থেকে সর্বসাকুল্যে সাত'শ টাকার মত জোগাড় করেছে।
ভোর না হতেই রিক্সা নিয়ে বের হয়েছে । সকাল থেকে এপর্যন্ত সে সত্তুর টাকার মত রোজগার করেছে । ডাক্তার বলেছে দুপুরের আগেই যে করে হোক ঔষধ যোগাড় করতে হবে ।আরো ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে সে আড়াইশো টাকা কিভাবে জোগাড় করবে সেই চিন্তায় তার মাথা খারাপের উপক্রম। সেজন্যই সে যত দ্রুত চেষ্টা করছে রিক্সা চালিয়ে বাকী টাকা রোজগারের । কিন্তু সে জানে এত অল্প সময়ে রিক্সা চালিয়ে এতগুলো টাকা কামাই করা অসম্ভব । প্রতিমুহূর্তে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা তার মূমুর্ষ মায়ের চেহারা চোখে ভাসছে যতবারই তার মায়ের চেহারা মনে পড়ছে ততবারই চোখ জলে ভিজে উঠছে । মনের মাঝে দুঃশ্চিন্তা উকি দিচ্ছে হয়তোবা তার মা এতক্ষণ মরেই গেছে ।কথাগুলো বলতে গিয়ে তার কণ্ঠ বারবার বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসছিল ।
আমি নিজের মানিব্যাগ হাতরে যে কটা টাকা পেলাম তার হাতে গুজে দিয়ে বললাম ,
’সময় নষ্ট করার দরকার নেই। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে যাও । আমার কাছে এর থেকে বেশী নেই ,তবে এখানে যা আছে সেটা দিয়ে তোমার মায়ের ঔষধ কেনার টাকা হয়ে যাবে ।’
তার মুখের ভাষা হারিয়ে গেল । সে কিছুটা হতবাকের দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল।
আমি তাকে চোখের ভাষায় সান্ত্বনা ও অভয় দিতে চাইলাম । মনে মনে বললাম’ মাকে যে ছেলে এত ভাল বাসে মা তাকে এভাবে ফেলে কখনও যেতে পারেনা।’জানিনা আমার সেই অন্তরের উপলব্ধি সত্যি হয়েছিল কিনা?
আমি যখন চলে আসছি তক্ষুনি হঠাৎ সে যেন সম্বিৎ ফিরে পেল। আমার হাতটা খপ্ করে ধরে বলল,’ভাই আপনার নামটা কি?’
তার এহেন ব্যাবহারে আমি প্রথমে চমকে উঠেছিলাম,পরক্ষণেই মুচকি হেসে বললাম,
’নাম দিয়ে কি হবে? তোমার মা সুস্থ হলে আমার জন্য দোয়া করতে বোল।’
তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি চলে এসেছিলাম।
বাকী সারাটা দিন কেন যেন দারুণ এক আনন্দের অনুভূতি আমার সারা দেহ মনে ছড়িয়ে ছিল।
***
আমি বাস্তবিকভাবে এমন মহানুভব মানুষ নই। গতরাতে আড্ডা দিতে যাবার সময়ে সপ্ন সুপার সপের ঠিক দরজার সামনে তিনজন মহিলা পথ আটকালো;
লম্বা একহারা গড়নের একজনের বোরখার সাথে হিজাব দিয়ে মুখ ঢাকা, আরেকজন তরুনী বোরকা পড়া কিন্তু মুখ খোলা, বেশ উজ্জল গায়ের রঙ, হাতে ধরা একটা চার পাঁচ বছরের ফুটফুটে ছেলে। আরেকজন অলবয়সী তরুণী বাসন্তি রঙের সালোয়ার কামিজ পড়া।
হিজাব পড়া মহিলাটা শুদ্ধ ভাষায় তীক্ষ্ণ কন্ঠে আকুতি করে বলল, স্যার একটু শুনেন, একটু শুনেন... আমি তাঁকে পাত্তা না দিয়ে পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে যাচ্ছি দেখে সে প্রায় কেঁদে ফেলল, একটু শুনেন, একটু শুনেন-ই না। তবুও আমি শুনিনি।
ওরা ভাবে; এ শহর আর শহরের মানুষগুলো বড় নিষ্ঠুর। কারো দুঃখ কষ্ট কাউকে স্পর্শ করে না!- আসলেই কি তা?