বাঙ্গালীমাত্রই কবিতা বুঝুক না বুঝুক, পড়ুক না পড়ুক, কবিতা তার মজ্জাগত। জীবনে অন্তত একখানা কবিতা (হোক সেটা খাদ্য কিংবা অখাদ্য) লিখেনি-এমন বাঙালী পাওয়া দুষ্কর!
*আমিও লিখাছিলুম প্রথম যৌবনে, কি করব বল; প্রায় মধ্যরাতে গঞ্জিকা সেবন করে লাজুক রক্তিম নয়নে উর্ধ্বাকাশে চেয়েছিলুম- একাদশীর চাঁদ আকাশে। আচম্বিতে সে আমার নাকের ডগায় নেমে এসে কাতর নেত্রে বলল, চল তোমাতে আমাতে মিলে একখানা ভাবের কবিতা লিখি। লিখে ফেললুম অত্যুত্তম একখানা ভাবের কবিতা- নেশার রেশ কেটে গেল, কবিতাটাও ভুলে গেলুম! না হলে লক্ষ কোটি কবিতার ভীড়ে আরেকখানা মূষিকের হস্তি প্রসব হত!*
শেষে কিংবা অবশেষে পঞ্চাশের কবিতা
নামখানা পঞ্চাশের কবিতা কেন হল? আমিতো কবিতাকে ছেড়েছি কিন্তু কবিতার ভুত আমাকে ছাড়েনি। সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে সে আমাকে দাবড়ে বেড়িয়েছে। অবশেষে পাকড়াও করে বলল, জীবনে টসটসে কিংবা রগরগে প্রেম বিচ্ছেদের কবিতা একখানা তো লিখতে পারলিনা ব্যাটা-এইবার অন্তত একটা আধবুড়ো বয়সের পানসে কবিতা লিখে ফেল।
-আমিতো কবিতার ক’ বুঝিনা। আমার চারপাশে যে সকল ঝানু ঝানু কবি আছেন তারা দেখলে বেজায় গোস্যা করবেন। কবিতা লিখতে হলে কত্তোকিচ্ছু জানতে হয়।
-কেমনে কেমনে?
-এই যে অন্ত্যমিল, মিশ্র কলাবৃত্ত বা অক্ষরবৃত্ত ছন্দে,স্বরবৃত্ত ছন্দে বা মাত্রাবৃত্ত ছন্দে এরপরে আছে পর্ব, অতিপর্ব ও উপপর্ব: সনেট( তিনটি চতুঙ্ক পদে-নাকি অষ্টক ও ষষ্টক পদে রচিত হবে? ফের সনেট শূধু ১৪ খানা অক্ষর বা মাত্রায় হয়না ১৮ খানাতেও রচনা করা যায়। এটা কোন অক্ষর।/মাত্রায় হবে? এর জন্মদাতা কবি দান্তে, পেত্রার্ক নাকি শেক্সপিয়েরের ঢঙ্গে হবে?) অথবা এটা আখ্যানকাব্য, গীতিকাব্য কিংবা গাঁথা কাব্য হবে? ফের সেটা কি নৈর্বক্তিক নাকি বর্ণনাত্মক রীতিতে…
-আরে রোখ রোখ ও সব হল ‘আর্য কবিদের ঠাট-বাট আর বুজরকি’।
-আরে নাহ্- কবিতা আসে ভাবে। ভাবে কি আর বুজরকি হয়?
-এখন তুই ওসব বুঝবিনে। কষ্ট করে দু’চারখান কবিতা প্রসব কর-পরে দেখবি ‘চ্যাল-ব্যাল’ করে লাইন ধরে বেরুচ্ছে আর বেরুচ্ছে।রাত-বিরেতে কিংবা সকাল দুপুরে দেখবি তরতাজা একেবারে খাসা আর অতি উত্তম কাব্য তোর মগজে এসে খোঁচাখুঁচি করছে- সেটাকে না বের করে আর উপায় থাকবে না।
-মাফ করে দে না ভাই। ব্লগের বাঙ্গলা ভাষায় বিদগ্ধ সব জাত কবিদের চক্ষুশুল হতে চাইনে! আমার কোবতে পড়লে জটিল কুটিল ভাইয়েরা তো হেসে গড়া গড়ি খাবে। দেখেছিস ‘কবি হইতে কি লাগে’ এই নিয়েই এরা দু’খানা অতিউত্তম কাব্য রচনা করে ফেলেছে!!!
ওদিকে গাজী সাহেব বলবেন। আমি জানতাম এ গদ্যে সুবিধা করতে না পেরে শেষমেষ কোবতেই লিখবে।
এর থেকে প্রথমে একখানা অনুবাদের কবিতা শোনাই; সারিন্দা যেমন গাইতে গাইতে গায়েন হয়- তেমনি অনুবাদে হাত পাকিয়ে কোন একদিন আমিও একদিন আমিও জাত কবি হয়ে উঠতে পারি।
******বার্ধক্য******
কবি: জুলি হেবার্ট, © 2012
একদিন জেগে উঠে,
তুমি ভয়ানক এক ব্যথা অনুভব করবে।
যখন তুমি বুঝবে, জন্মদিনের কেকটি তোমার
বয়সের মোমবাতির জন্য পর্যাপ্ত নয়
নিশ্চিত এটি একটি অমোঘ ও অনিবার্য বিষয়,
যে আমরা সবাই একদিন বুড়ো হয়ে যাব।
আমরা একে যেভাবে দেখব
সেই দৃষ্টিভঙ্গীই বলে দেবে সামনের দিনগুলো কীভাবে যাবে।
তুমি কি ভাবছ তেমন কিছু,
এই মুহূর্ত থেকে জীবন আরো সুন্দর হবে?
নাকি দুঃস্বপ্নের ঘোরে আছো
যে শীঘ্রই তুমি মারা যাবে।
জন্মদিন এলেই যদি
প্রতিবার তুমি ভয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হও
তবে তুমি বসে থাক চুপচাপ
আর দেখ, জীবনটা কিভাবে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যায়
বার্ধক্য নিয়ে ভাবতে হবে,
তার চেয়ে বেশি ভাবো; পেয়েছ যা কিছু ভাল
বার্ধক্য তার সাথে বিজ্ঞতা নিয়ে আসে,
এটাওতো অনেক বড় পাওয়া
বার্ধক্য মানে তুমি এখনো বেঁচে আছ,
আর জন্মদিন মানে আরও একটা
শুভ জন্মদিনের অপেক্ষা…
যেহেতু এই জীবনে এখনও অনেক কিছু জানার বাকি আছে।
Old Age নামে চমৎকার একটা কবিতার অতি আনাড়ি হাতের নিন্মমানের অনুবাদ। কবি/অকবি ব্লগারগন নিজগুনে ক্ষমা করবেন।
***
আসুন এবার ‘কবি হইতে কি লাগে’? তা নয় বরং শুনি, কবিতা কি? সেই নিয়ে একটু কাষ্ঠ কঠিন কেতাবি কথা-বার্তা শুনি;
উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ কবিতাকে "শক্তিশালী অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত উপচে পড়া" হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এমিলি ডিকিনসন বলেছিলেন, "যদি আমি একটি বই পড়ি এবং এটি আমার শরীরকে এত ঠান্ডা করে দেয় যে কোন আগুন আমাকে কখনও গরম করতে পারে না, আমি জানি এটিই কবিতা।" ডিলান থমাস কবিতাকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন: "কবিতা হল যা আমাকে হাসায় বা কাঁদায় বা হাই তোলায়।
সব তো বুঝলাম তবে কবিতার কেতাবি সহজ সংজ্ঞা কি?
কবিতা / (ˈpəʊɪm) / বিশেষ্য। শ্লোকের একটি রচনা, সাধারণত ঘনীভূত এবং উচ্চতর ভাষা দ্বারা চিহ্নিত করা হয় যেখানে শব্দগুলি তাদের শব্দ এবং ইঙ্গিতমূলক শক্তির পাশাপাশি তাদের অনুভূতির জন্য এবং মিটার, ছড়া এবং অনুপ্রেরণার মতো কৌশলগুলি ব্যবহার করে বেছে নেওয়া হয়।
কবিতা সাধারণত শৈল্পিক উপায়ে বিশেষ কিছু প্রকাশ করার জন্য সংরক্ষিত । তুলনা, ছন্দ এবং ছন্দ একটি ভিন্ন শব্দ এবং অনুভূতিতে অবদান রেখে কবিতার ভাষা আরও অভিব্যক্তিপূর্ণ বা সজ্জিত হতে থাকে। ধারণাগুলি এমন লাইনগুলিতে থাকে যা বাক্য হতে পারে বা নাও হতে পারে। লাইনগুলো স্তবকে সাজানো হয়েছে।
শেষমেষ কবিতা হল এমন একটা ব্যাপার যা কবি না হলে আপনি বুঝবেন না। বাদ দেন- তাঁর থেকে আসেন আমার ‘পঞ্চাশের কবিতা’খানি শুনে ফেলেন;
***
যুবক জানেনা ; পাশাপাশি থেকে আবেগ মরে যায়-
একদিন চাওয়া পাওয়া গুলোই মুখ্য হয়
পৃথিবীর মহৎ সব প্রেমের পরিণতি তো এমন-ই!
কত ক্ষুদ্র ও দীর্ঘ এ জীবন
উচ্ছলতা আবেগ আর ভালবাসা-ভাললাগায় কাঁপে প্রথম যৌবন
তারপর ফুরায় সে উদ্দীপনা-শুরু হয় দীর্ঘ ক্লান্ত অবসাদ
সবকিছু ছেড়ে শুধু বেঁচে থাকার বাসনা
ভালবাসা রূপ নেয় অবলম্বনের।
ভেবেছিলাম; একটাইতো জীবন
তার অংগুলি ধরে ঠোটে ঠোট রেখে কেটে যাবে টুপ করে।
কত সহজ সরল অংকের সমাধান...!
ভেবেছিলাম আমার প্রেম হবে অন্যরকম
হায় কেন ভাবিনি, এ জীবনে ক্লান্তি আসে
জড়া আসে, আর আসে প্রকৃতির নোংড়া সব ইচ্ছেগুলো
সংসার বয়স বুদ্ধির পরিপক্কতা(!)
সেই প্রেমকে একদিন গলা টিপে মেরে ফেলে।।
***
সুত্রঃ
কবিতার ছন্দ, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৭
বাংলাপিডিয়া
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০২৩ রাত ৮:৪৮