* ব্লগের কি হাল!! গত ১২ ঘন্টায় কোন পোস্ট হয়নি!!! এই পোস্টের পরে দেখি কে কে পোস্ট দেবার অপেক্ষায় ছিল...(ব্লগে প্রথমদিকে প্রচুর প্রবাস জীবনের রম্যগল্প লিখেছি। রম্য আমার প্রিয় বিষয়। এখন অনেক কাঠখোট্টা হয়ে গেছি! গতকালের একটু অবসরে পুরনো লেখা খুঁজে দেখি দু'য়েকটা এখনো পোস্ট করা হয়নি। সালঃ ২০০০, স্থানঃ দুবাই।)
***জুলাই মাস। বাইরে প্রচণ্ড গরম। ট্যাপের পানিও যেন টগবগ করে ফুটছে। গায়ে লাগলে ফোস্কা পড়ে যায়। বাইরে বেরুতে ভয় করে। কাজকর্মও বিশেষ নেই, সারাদিন এসি রুমে শুয়ে বসে গল্পের বই পড়ি না হয় মোবাইলে দু'য়েকজন পরিচিতের সাথে বকবক করে সময় কাটাই। যে ভদ্রলোকের বাসায় আমি সাব-লেট হিসেবে উঠেছি। তিনি আমাকে একরকম পাহারায় রেখে দেশে গেছেন বেড়াতে। কবে আসবেন নিশ্চিত নই! আশে পাশে কথা বলার মত আর কোন বঙ্গ সন্তান নেই । এভাবে একা একা সময় কাটানো কঠিন।
সমগ্র আরব আমিরাতেই আমার ঘনিষ্ঠ অনেক আত্মীয় স্বজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তবে সমস্যা হল তারা সবাই কোন না কোন কাজে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকে।
যারা দিনে ব্যস্ত থাকে তাদের সাথে দেখা করলে রাতে ছাড়া সম্ভব না।আর যারা রাতে কাজ করে তাদের সারাদিন কাটে ঘুমিয়ে।তাছাড়া দুরুত্ব একটা বড় ব্যাপার।
আমার এক দুলাভাই মোটামুটি উচ্চ পদে কর্মরত একজন সরকারী চাকুরে।ভদ্রলোক দারুণ আন্তরিকতাপূর্ণ।তার বড় মেয়ে তার সাথেই থাকে সে সেখানে তখন স্টাডি করছে। আমার সেই ভাগ্নির সাথে ছোটবেলা থেকেই সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুর মত। আর সবচেয়ে আনন্দদায়ক ব্যাপার ছিল আমার বাসা থেকে তাদের ফ্লাটের দুরুত্ব বড়জোর কিলোমিটার খানেক। দুটোর দিকে ক্লাস সেরে বাসায় ফিরে
প্রায়শই আমাকে ফোন করে পীড়াপীড়ি করত দুপুরে তার ওখানে খাওয়ার জন্য।
আমিও তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেই ঘিলু-পাসিনা করা রোদে কয়লার ইঞ্জিনের মত ধুকতে ধুকতে তাদের ফ্লাটে হানা দিতাম।
এত কষ্ট করে সেখানে যাওয়ার আরও দুটো উদ্দেশ্য ছিল। আমি যে ফ্লাটে থাকি সেখানে পানি ঠাণ্ডা করার কোন ব্যবস্থা নেই ,আর প্রথমেই বলেছি মিউনিসিপালটির সাপ্লাইয়ের পানি মধ্যরাতেও এতই গরম থাকে যে তা দিয়ে চা বানানো সম্ভব। অগত্যা গোসল করার জন্য হিজরত করতে হত।
আর দ্বিতীয়টা খুব সাধারণ; সময় কাটানো। তার সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খেলো গল্প করে, টিভি দেখে, ইমেইল করে, ইন্টারনেটে চ্যাট করে সময় ভালই কাটত। অবশ্য ইমেইল রিসিভ ও পাঠানো আমার কাজের একটা অংশ ছিল।
ওহ্ এখানে আমার সেই ভাগ্নির চেহারা স্বাস্থ্যের একটু বর্ণনা না দিলেই নয়।
উচ্চতা গড় পড়তা বাঙ্গালী মেয়েদের মতই তবে সূক্ষ্ম ভাবে লক্ষ্য করলে কমই মনে হবে। গায়ের রঙটা শ্যামলার কাছাকাছি। সু-স্বাস্থ্যের অধিকারিণী! সাস্থ্যটা একটু বেশইি সু কেননা তার ঘনিষ্ঠ জনেরা তার এই দ্রুত বর্ধিষ্ণু গড়ন নিয়ে কটূক্তি করতে ছাড়ে না। তারও এনিয়ে আফসোসের অন্ত নেই। রোজার দিনে সেহেরী আর ইফতারি না করেও কোন লাভ হয়নি। আর আমার সাথে দেখা হলেই তার সেই দুঃখের সলতেটা আরেকটু উস্কে দেই ।একগাল হেসে বলি ,’বাহ্ তোমার সাস্থ্যটা দেখি মাশাল্লাহ আগের একটু ভাল হয়েছে’।
প্রতি উত্তরে তার চেহারা খয়েরী রঙ্গ ধারণ করে। আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে আরও বেশী করে ডায়েট করে।
একদিন সন্ধ্যেয় বসে নিরস টিভি অনুষ্ঠান দেখছি। হঠাৎ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল ,’চলেন মামা বাইরে থেকে ঘুরে আসি’।
’যাঃ এই গরমে মাথা খারাপ!’সে যতটা উচ্ছলতা নিয়ে আমাকে বেরাতে যাবার অফার করেছিল আমি ঠিক ততটাই অনুজ্জ্বল ভঙ্গিতে সেটা প্রত্যাখ্যান করলাম।
সে দমে না গিয়ে বলল,’ অসুবিধে কি ট্যাক্সিতে যাব তো। আর আপনাকে দেখিয়ে আনব দুবাইয়ের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী বৃহত্তম সুপার মার্কেট।’
আমি মুখ বাঁকালাম। ফুঃ যে দেশের গোড়াপত্তনের ইতিহাস *৩০ বছরের বেশী নয় তার আবার তার আবার ঐতিহ্য।’(তখনকার হিসেবে)
কিন্তু তার জেদের কাছে আমি হার মানলাম। হা বলতেই সে পোশাক পাল্টাতে ছুটল। মিনিট বিশেক পরে আমার সামনে এসে স্মার্টলি ভঙ্গীতে বলল,ওঠেন, আমি রেডি।’
আমি বসা অবস্থায় তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ’কি ব্যাপার তোমাকে এত লম্বা লাগছে কেন?’
সে মুখভঙ্গিতে বোঝাল এটা একটা রহস্য যা ভেদ করার দায়িত্ব আমার।কি ভেবে পরক্ষণেই তার স্যান্ডেল দেখিয়ে বলল,’স্যান্ডেলটা সুন্দর না মামা।’
হুম! এতক্ষণে বুঝলাম তার লম্বা হওয়ার রহস্য। ইঞ্চি চারেক উঁচু হাল ফ্যাশনের 'হোভার-ক্রাফট' টাইপের স্যান্ডেলের কারিশমায় এটা সম্ভব হয়েছে। তাকে খুশী করার জন্য উঠে দাড়াতে দাড়াতে বললাম ’হ্যাঁ খুব সুন্দর!’
সে দ্বিগুণ উৎসাহে বলল,’জানেন দুবাইতে না দারুণ দারুণ স্যান্ডেল পাওয়া যায় আর দামও খুব কম।’
’তাই ?’
’৪০/৫০ দিরহামে আপনি সবচেয়ে ভালো জোড়া কিনতে পারবেন। যাবার সময় মামীর(তখন কি এখনো হয়নি) জন্য কয়েক জোড়া নিয়ে যাইয়েন।’
’ঠিক আছে।কিন্তু শেষমেশ সেই জুতার ঘা ফের আমার উপর বর্ষিত না হয়!’
Al Guira Centre Dubai
আসলেই বিশাল মার্কেট। চার পাঁচতলা গাড়ি পার্কিং লটেই কয়েক হাজার গাড়ি পার্কের সুব্যবস্থা। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য যে তখন মার্কেটটার পুরাতন আদল ভেঙ্গে নতুন করে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে। তবে কয়েকটা ফ্লোরের একাংশ ক্রেতাদের জন্য উন্মুক্ত আছে। ভিতরে ঢুকে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে চেয়ে দেখছি কাঠ ও পাথরের অপূর্ব কারুকাজ। দুপাশের সপ গুলোর থেকে এটাই আমাকে বেশী আকর্ষণ করল সেই সঙ্গে আফসোস হল অর্থের বিশাল অপচয় দেখে।
ভাগ্নি আমার পাশে পাশেই হাঁটছিল। হঠাৎ আমার পাশেই 'ধপাস' করে ভারি কিছু একটা পতনের শব্দ! সচকিত হয়ে দেখি, সে মেঝেতে কার্পেটের উপুড় হয়ে পড়ে আছে!
সম্ভবত কার্পেটের কোথাও জোড়া খুলে গিয়েছিল সেখানটায় স্যান্ডেল আটকেই এই বিপত্তি! আর তার অনতিদূরেই এক আরবীয় দম্পতি বেবি স্ট্রলারে তাদের বাচ্চাকে নিয়ে জড়োসড় হয়ে ভীত চোখে দাড়িয়ে আছে। তাকে কোন ক্রমে টেনে তুলতেই তারা আমাদেরকে লক্ষ্য করে উচ্চস্বরে গালিগালাজ(সম্ভবত) শুরু করল। ভাষা না বুঝলেও বুঝতে বাকী রইল না ভাগ্নি আমার অল্পের জন্য তাদের বাচ্চার গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েনি। আশেপাশে লোক জমে গেছে। কোন রকমে কয়েক ভাষায় মাপ চেয়ে তাদের বিদেয় করলাম।
আর ওদিকে লজ্জা অপমান ও ব্যথায় সে নির্বাক বিবর্ণ হয়ে গেছে। চোখের কোনে টলমল করছে পানি।
এর থেকে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল তার স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেছে। সেদিকে দুদণ্ড অসহায়ের মত তাকিয়ে থেকে এবার সে বুঝি সত্যিই কেঁদে ফেলল। আমিও তাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। সব কিছু ভুলে তার এখন বড় চিন্তা খালি পায়ে ছেঁড়া স্যান্ডেল হাতে করে কিভাবে এতগুলো লোকের সামনে হাটব। কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল ’মামা আপনি একটা ব্যবস্থা করেন।’
আমি কি করব? নতুন স্যান্ডেল কিনব? এত টাকা সঙ্গে আনিনি যে! বড়লোকের মার্কেট!! এ মার্কেটে দু-আড়াই'শো দিরহামের কমে স্যান্ডেল/জুতা কেনা সম্ভব নয়।
***
ও হ্যাঁ পাওয়া গেছে!
খুশীতে আমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আবছা মনে পড়ল এর আগের রো-তেই একটা জুতা স্যান্ডেল সারাইয়ের দোকান দেখেছি। তড়িৎ সেখানে গিয়ে স্যান্ডেলটা তাদের দেখালাম। দোকান মালিক স্যান্ডেলটা হাতে নিয়ে গম্ভীর মুখে বলল,'সারতে ৫০দিরহাম লাগবে।
মুলোমুলির অবকাশ নেই। স্যান্ডেলের প্রকৃত মূল্য থেকে সারাইয়ের দাম বেশী দিতে রাজী হওয়ার পরে জানলাম,- দিতে দিন তিনেক দেরী হবে। ভাগ্নিকে সেটা বলতেই সে হতাশ হয়ে সেখানেই বসে পড়ে আরকি!
আমিও কিঞ্চিৎ হতাশ। কি করা যায় ভাবছি? হঠাৎ .. হ্যাঁ পেয়েছি!
পাশের গ্রোসারী সপে ঢুকে সবচেয়ে দামী ও শক্তিশালী বড় এক টিউব পাওয়ার গ্লু (চামড়ায় লাগানোর উপযোগী)কিনলাম।
তাকে সহ মার্কেটের নির্জন এক কোনে গিয়ে সেই গ্লু দিয়ে অনেক চেষ্টায় ছেড়া স্যান্ডেল জোড়া দিলাম।
পায়ে দিয়েই সে খুশীতে চকমকিয়ে উঠল। পঞ্চমুখে শুরু করল আমার প্রশংসা সেই সঙ্গে অসংখ্য ধন্যবাদ দিতেও কার্পণ্য করল না। নিজের উপস্থিত বুদ্ধিতে আমি নিজেও তখন আপ্লুত। বাড়ি ফেরা ক্যানসেল করে আবার মার্কেট দেখায় মনোনিবেশ করলাম।
দোতলায় অনেক্ষণ ঘোরাঘুরি তিন তলা ড্রপ দিয়ে আসলাম চার তলায়।চারতলার প্রবেশ মুখেই চলন্ত সিড়ি থেকে একটু তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে আবার~ ধপাস!! ইয়া আল্লাহ সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
স্যান্ডেল নয় এবার হয়তো তাকেই কাঁধে করে নিয়ে যেতে হবে ।