
সপরিবারে কবি জীবনানন্দ দাস !~ ছবির বায়ে প্রথমে দাড়িয়ে আছেন কবি জীবনানন্দ পত্নী লাবন্য দাস।
অকাল প্রয়াত এই কবি জীবিতকালে তার যোগ্যতা অনুসারে যতটা জনপ্রিয়তা পাবার কথা ছিল কিংবা সফলতা পাবার কথা ছিল তার সিকি পরিমান পাননি বলে আফসোস করা হয়! এমন কি পুরো জীবন তিনি অসুখী ও নিরানন্দ জীবন যাপন করেছেন বলে বিভিন্ন আলোচনায় উঠে আসে। আর এর পেছনে মুলত; তার সহধর্মীনীকে দায়ী করা হয়। এমনকি শতবর্ষের ইতিহাসে একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে ট্রামচাপায় নিহত এই কবির সেই দুর্ঘটনাকে আত্মহত্যা হিসেবে কেউ কেউ ইঙ্গিত করে। আর সেই দায়ভারও লাবন্য দাসকেই নিতে হয়।
এই বিশ্বে লক্ষ কোটি জুটি আছে কিন্তু সফল জুটি কয়খানা? এটা একেবারে খেটে খাওয়া মুজুর থেকে শুরু করে সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে সবখানের কথাই যদি ধরি তবে?
অধুনা বিল গেটস কিংবা কানাডার প্রধানমন্ত্রীর কথাই ধরুন; বিচ্ছেদের ক'মাস আগে আমরা ক'জানাই ভেবেছিলাম, তারা আদপে অসফল একটা জুটি আর কদিন বাদে চিরতরে বিচ্ছেদ হয়ে যাবে?
পৃথিবীর ক'জন বিখ্যাত কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী দার্শনিক তাদের মনের মত জুটি পেয়েছেন? এ বিশ্বে ক'টা পিয়েরে কুরি মাদাম কুরির মত জুটি এসেছে? মনের মত জুটি হয়নি বলে কারো প্রতিভাকে আটকে রাখা গেছে?
আর কবিতা সাহিত্য দিয়ে কে পেট ভরে? সংসারে কত চাওয়া কত পাওয়া- খুট মুট ঝুট ঝামেলা থাকবেই। আমাদের মত মধ্যবিত্তের কার সংসারে মান অভিমান ঝগড়া বিবাদ হয়না? বউ রাগ করে বাপের বাড়ি যায়না?
মাঝে মঝে মনে হয়না; এই সংসারের নিকুচি করি, শালার সব ছেড়ে বিবাগী হয়ে যাই?
অনেকেরই ইচ্ছে করে দেয়ালে মাথা ঠুকি, আড়কাঠে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ি কিংবা বালিশ চাপা দিয়ে ওকে মেরে ফেলি।
~কিন্তু সেই সংসারেই ফের ভালবাসার তুফান বয়। একটুখানি অসুস্থতায় সব কাজ ফেলে ছুটে আসি, সারারাত জেগে বারান্দায় পায়চারি করি। নিজের হাতে তুলে তাকে যত্ন করে খাইয়ে দিই। হাত পুড়িয়ে রাধব তবু তাকে রান্না ঘরে যেতে দিই না।
এভাবে সুখ দুঃখ ঝগড়া বিবাদ মান অভিমান আনন্দ হাসি কান্না বহুবার ছেড়ে যাওয়া ফিরে আসা, বহু চাওয়া পাওয়া না পাওয়া হতাশা দুঃখ বেদনা শেষে একদিন বার্ধক্য আসে...
পৃথিবীর সব রঙ মুছে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন,
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল।
সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী; ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার...
-তখন শুধু ভয় হয়- হারানোর ভয় কিংবা ছেড়ে যাবার ভয়। ভালোবাসা ঠিক তখুনি বাসা বাঁধে। প্রেম তো তাকেই বলে- সেটাই দাম্পত্য প্রেমের সবচেয়ে বড় পাওনা।
এটা খুব কম মানুষে বোঝে- তারা শুধু বাহ্যিক দিকটাই দেখে। কার বউ কতটা সুন্দর- কতটা স্মার্ট। তাদের কেমন প্রেম- কতটা আদুরে, কতটা আহ্লাদ, কি গদ গদ ভাব। স্মার্ট নাকি? দুজনের লেবেলে গেল কি না? এই সব।
এটা হয় কেমনে? দুই সংসারে, দুই পরিবেশের, দুই লিঙ্গের দুজন মানুষ একই রকম কিভাবে হয়?
হতে পারে লটারির মতন। লাখে কিংবা কোটিতে একজন।
***
জীবনানন্দ দাস মারা যাবার পরে লাবন্য দাস যখন 'মানুষ জীবনানন্দ' লিখলেন তখন এটা নিয়ে বেশ উপহাস হয়েছিল। অনেকেই বলেছিল ন্যাকা কান্না। বইটি পড়ে আমার তেমন মনে হয়নি। বরাবরের মত অযথাই বাঙ্গালী যা করে থাকে, কারো ব্যার্থতার জন্য আর কাউকে না পেলে ঘরের বউকে দায়ী করে। এখানেও তেমনটাই ঘটেছে। (ব্লগারদের ভাল লাগলে দ্বিতীয় পর্বে যাবার ইচ্ছে রইল)
মানুষ জীবনানন্দ থেকে নেয়াঃ (একেবারে শেষ থেকে শুরু করছি)
অল্প কথায় অনেক গল্প
আমার বিয়ের দশ বারোদিন পরে ঢাকায় আমার জেঠামশাই-এর কাছে যাওয়া ঠিক হল। আমি মনের আনন্দে বাক্স গুছোতে বসলাম। অল্প ক’দিনের জন্য যাচ্ছি বলে শাশুড়ী একটা ছোট বাক্সে সামান্য কিছু জামা কাপড় নিতে বললেন। কিন্তু নেবার সময় আমি কোনটাই বাদ দিতে পারছিলাম না। অথচ বাক্সেও আঁটে না। দুবার, তিনবার চেষ্টা করার পরেও যখন কিছুতেই পারা গেল না, তখন রাগ করে বাক্সটাকে উল্টে ফেলে দিয়ে উঠে গেলাম।
কবি কাছে বসে সবই দেখছিলেন। আস্তে আস্তে আমার কাছে গিয়ে বসলেন, ‘তুমি তো গোড়াতেই একটা ভুল করে বসে আছ। অল্পদিন থাকলে ঐ ছোট বাক্সে কুলিয়ে যেত। তুমি না হয় বেশীদিনই থাকলে৷ থাকার ইচ্ছেটা তো তোমার। সেটা অন্যের কথায় কি করে হবে?’ তখন আমার মুখে হাসি ফুটল। আমি বড় একটা বাক্স নিয়ে কাপড় গুছোতে বসলাম।
কিন্তু কোথায় গেল সে সব দিন? পর্দার বুকে ছায়াছবির মতই একের পর এক মিলিয়ে গেল। যা কিছু দেবার ভগবান আমাকে তো দরাজ হাতেই দিয়েছিলেন। কিন্তু সব হারিয়ে আজ আমি রিক্ত, শূন্য হয়েই বসে আছি।
সাদাসিধে শান্ত অথচ ভীষন জেদি
লোকে জানে, কবি ছিলেন শান্ত, নিরীহ প্রকৃতির। অর্থাৎ এক কথায় যাকে বলে ভালোমানুষ। তাঁকে চালানো খুবই সোজা। কিন্তু ছাইচাপা আগুনের মত সেই নিরীহ ভাবের নীচেই চাপা থাকত তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তবে অকারণ চিৎকারে সে ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করাটা তিনি কোনদিনই পছন্দ করতেন না। শান্তভাবে, অল্প কথার ভিতরেই ছিল তাঁর অভিব্যক্তি। তাঁর এ পরিচয় আমি বহুবার বহুভাবে পেয়েছি।
তিনি মিলের মোটা ধুতি ছাড়া পরতেন না, এবং একটু উঁচু করেই পরতেন। আমি একদিন একখানা ভাল ধুতি কিনে কবিকে বললাম,— ‘কী যে তুমি মোটা মোটা ধুতি হাঁটুর উপরে পরে রাস্তা দিয়ে হাঁট। লোকে হাসে না?’ কথাটা বলেই ধুতিখানা তাঁর দিকে এগিয়ে দিতে যাচ্ছিলাম।
তিনি তখন কি একটা লেখার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ধুতিখানা ধরেও দেখলেন না। তাঁর মুখে সামান্য একটু বিরক্তির ভাবও প্রকাশ পেল না। শুধু লেখাটা থামিয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, ‘দেখ, তুমি যে ভাবে খুশি সাজ-পোশাক কর, তোমার সে ইচ্ছেয় আমি কোনদিনই বাধা দেব না। কিন্তু আমাকে এ বিষয়ে তোমার ইচ্ছামত চালাতে বৃথা চেষ্টা কোরো না!’
তিনি রাগলেনও না, বকাবকিও করলেন না। কিন্তু আমার মনে হল কে যেন আমার শরীরের সমস্ত শক্তি টেনে নিয়েছে। আমি কোনও মতে নিজেকে টানতে টানতে সেখান থেকে সরে এলাম।
যতদিন তিনি পৃথিবীতে ছিলেন, আমার মুখ থেকে এ রকম কথা আর কোনদিনই বের হয়নি। যেদিন তিনি চিরদিনের মতই যাত্রা করলেন, সেই ধুতিখানাই পরিয়ে দিলাম। সেখানা বছরের পর বছর আমার বাক্সেই রাখা ছিল।
গুপ্তদাসের 'গুপ্ত' গোপনেই রাখলেন সারাজীবন
আমরা কতখানেই কতবার না শুনেছি কবি ‘দাস’ বা নিন্মবর্ণের হিন্দু ছিলেন বলে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করত। তিনি রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের সর্বকালের সেরা কবি হবার পরেও তাকে সেভাবে মুল্যায়ন করা হয়নি বা তার কবিত্ব প্রতিভাকে পাদ প্রদীপের আলোয় আসতে দেয়া হয়নি মুলত নিন্মবর্ণের হিন্দু হবার জন্য। আসলে কি তাই;
তিনি ‘দাসগুপ্ত’ না লিখে শুধু ‘দাশ’ লেখাতে তফসিলী সম্প্রদায়ের বহু ছাত্র এসে তাঁকে বলত, ‘স্যার, আমাদের সমাজে আপনার মত
এইরকম একজন প্রতিভাশালী লেখক ও সহৃদয় অধ্যাপক পেয়ে আমাদের সম্প্রদায়ের প্রতিটি নরনারী ধন্য হয়ে গিয়েছে।’
কবি কোনও উত্তর না দিয়ে মৃদু মৃদু হাসতেন। আমি রাগ করলে বলতেন, ‘দেখ, আমাকে সমগোত্রীয় ভেবে কেউ যদি ভুল করেও মনে আনন্দ পায়, তবে সে ভুল ভাঙ্গবার দরকার কি? কারো জন্যে কিছুই তো করতে পারি না। তারা নিজে থেকে যদি একটু আনন্দ পায় তো পাক না।’
তৎকালীন ছাত্রসমাজে কবির জনপ্রিয়তা
১৯৪৬ সনের শেষদিকে তিনি স্বরাজ পত্রিকায় ছিলেন। সেই সময়কার একটি ঘটনা বলছি।
একদিন দুপুরের দিকে তিনি ক্রীক রো দিয়ে ফিরছেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন রাস্তার লোকেরা দৌড়ে যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে, এবং প্রতিটি বাড়ির জানালা দরজা দুমদাম শব্দে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তিনি সামনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন-একটা মিলিটারী ট্রাক ছুটে আসছে। ট্রাকটা এসে তাঁর সামনেই থেমে পড়ল । একজন অফিসার নীচে নেমে বন্দুকের নলটা কবির বুকের সামনে ধরেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আর য়্যু এ হিন্দু?’
কবি উত্তর দিলেন, ‘ইয়েস।’
অফিসারটি বন্দুক ধরে থাকা অবস্থাতেই বললেন, ‘আই থিংক য়্যু আর দ্য রিংলীডার অফ দিস এরিয়া। যাস্ট গেট অন্।’
কবি চিরদিনই ধীর স্থির প্রকৃতির সুতরাং তিনি আর একটি কথাও না বলে ট্রাকে উঠে দেখলেন তাঁর মত আরও কয়েকজন হিন্দু ভদ্রলোককে আগেই ধরে আনা হয়েছে। তাঁরাও চুপচাপ বসে আছেন। কবিকে উঠিয়ে নিয়ে ট্রাকটি বহু জায়গা ঘুরে একটি থানায় এসে থামল। সেখানে পৌছে একখানি বেঞ্চে সকলকে বসিয়ে রাখা হল।
‘কতক্ষণ এখানে বসে থাকতে হবে’ একজন ভদ্রলোক একথা জিজ্ঞাসা করাতে কয়েকজন কনস্টেবল অভদ্র ভাষায় উত্তর দিল, ‘যতক্ষণ ও-সি না আসেন, চুপ করে বসে থাক।’
সন্ধ্যের দিকে হঠাৎ সমস্ত পুলিস শশব্যস্তে উঠে দাঁড়াল এবং অন্যান্য সকলকেও উঠে দাঁড়াতে বাধ্য করল। কবি তাকিয়ে দেখলেন একটি অল্পবয়সী মুসলমান ছেলে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে। ছেলেটি যতই সামনের দিকে এগোচ্ছে ততই ঘন ঘন অবাক হয়ে কবির দিকে তাকাচ্ছে। যখন প্রায় কাছে এসে পড়েছে, তখন এক ছুটে এসে কবির
পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, ‘এ কী! স্যার আপনি এখানে এ অবস্থায় কেন?’
কবি একটু চুপ করে থেকে উত্তর দিলেন, ‘আমি তো তোমাকে ঠিক চিনতে পারছি না।’ তখন ছেলেটি দারুণ অভিমানভরে বলল, ‘আমি আপনার বি এম (বরিশাল) কলেজের ছাত্র, আর আপনি আমাকে চিনতেই পারলেন না?’
কবি তখন অপ্রস্তুত হয়ে সস্নেহে তার গায়ে হাত রেখে বললেন, ‘সত্যি আমার পক্ষে তো এটা অন্যায়ই । তা, তুমি এখন কি করছ?’
‘আমি এখানকার ও-সি।’ কবি অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতেই সে লজ্জিত মুখে আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যার, আপনি এখানে কেন, সে কথার উত্তর তো আমি পেলাম না।’
কবি তখন অফিসার এবং কনস্টেবলদের সব কথাই বললেন। সমস্ত শুনে ছেলেটি তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যে যেমন অবস্থায় আছ, বসে থাক। আমি এসে তোমাদের ব্যবস্থা করছি।’ তারপর কবির দিকে ফিরে বলল, ‘আসুন স্যার আমার সঙ্গে।’ এই কথা বলেই সযত্নে এবং সম্ভ্রমের সঙ্গে হাত ধরে তাঁকে নিয়ে চলল। নানা রাস্তা ঘুরে অবশেষে নিরাপদ স্থানে এসে তাঁকে ট্রামে তুলে দিয়ে আবার ভক্তিভরে প্রণাম করে বলল, ‘স্যার, আপনার অসম্মান করে ওরা যে আজ কতবড় অপরাধ করেছে সেটা বুঝবার মত শক্তি হয়তো ওদের কোনদিনই হবে না। কিন্তু আমি আজ ওদের সকলের হয়ে বারবার আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। সব দোষ ত্রুটি আমার জন্যই হয়েছে ধরে নিয়েই আপনি আমাকে ক্ষমা করতে চেষ্টা করবেন।
যদি তার আবার কোনও বিপদ ঘটে সেজন্য কবি তাকে ট্রামের সামনে আসতে বারবার বারণ করেছিলেন। কিন্তু সে হাসিমুখে উত্তর দিয়েছিল, ‘আপনার আশীর্বাদে কোন বিপদই আমার ধারে কাছে আসতে পারবে না। কিন্তু আজ যদি আপনি ঠিকভাবে বাড়ি পৌঁছতে না পারেন তাহলে নিজেকে আমি কোনদিনই ক্ষমা করতে পারব না।’
রাত্রে কবি যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল তাঁর মনটা যেন সেই ছেলেটির কাছেই চলে গিয়েছে। ছাত্রের এই মহানুভবতার কথা কবি কোনদিনই ভোলেননি, ভুলতে পারেননি। সে রাতে তিনি নীরবে যে তার সুখ, শান্তি এবং দীর্ঘজীবন কামনা করে বারবার তাকে আশীর্বাদ জানাচ্ছিলেন, সেটা শুধু বুঝেছিলাম আমি।
তাঁর এক লাইন কবিতা পাবার আশায় আমাদের ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতে প্রতিদিন দলে দলে ছাত্রছাত্রীকে আসতে দেখেছি। সকলে কিন্তু হাসিমুখেই ফিরে যেত । কিছু বললেই উত্তর দিতেন, ‘এরাই তো আমাদের ভবিষ্যতের আশা ভরসা। এদের ভিতর দিয়েই তো আমি বেঁচে থাকব। এদের কি ফেরাতে পারি?’
এই আন্তরিকতা এবং স্নেহের বিনিময়ে ছাত্র এবং ছাত্রসম অন্যান্য কিশোর এবং যুবকদের অন্তরতম প্রদেশে তাঁর আসন দৃঢ়ভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
একবার কোনও এক জায়গায় কবির স্বরচিত কবিতা আবৃত্তির কথা ছিল। তাঁর সেদিন শরীরটা খুবই খারাপ ছিল। তিনি সজনীবাবুকে (সজনীকান্ত দাস) অনুরোধ জানালেন যে তাঁকে যেন আবৃত্তির কাজটা প্রথম দিকেই সেরে নিতে দেওয়া হয়। সজনীবাবু চটে গিয়ে বললেন, ‘আপনি তো বেশ লোক মশাই। আপনাকে প্রথমদিকে আবৃত্তি করতে দিয়ে শেষে আমি চেয়ার বেঞ্চ নিয়ে বসে থাকি।’ শেষে হাসতে হাসতে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না জীবনানন্দ বাবু, আমি জানি যে আপনার কবিতা শোনার পরে ছাত্রদলকে কিছুতেই আর আটকে রাখা যাবে না। সুতরাং আপনাকে আজ একটু কষ্ট করতেই হবে।’

শেষ সময়ে ভালবাসাঃ
'যেই ঘুম ভাঙে নাকো কোনোদিন ঘুমাতে ঘুমাতে
সবচেয়ে সুখ আর সবচেয়ে শান্তি আছে তাতে!
আমরা সে সব জানি; - তবুও দুচোখ মেলে জেগে
আমরা চলিতে আছি আমাদের আকাঙ্খার পিছে...'
আহত অবস্থায় শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে শয্যা নেবার পরে দেখেছি তাঁর সেবা করবার জন্য তরুণ বয়সী ছেলেদের সে কি আগ্রহ। তাদের মধ্যে কয়েকজন আবার হোস্টেলেও থাকতেন। কিন্তু সেখানকার নিয়মকানুন, উপরওয়ালাদের রক্তচক্ষু, পাঁচিলের উচ্চতা-কোন কিছুই তাদের আটকাতে পারেনি। তারা ঠিক সময়েই ছুটতে ছুটতে কবির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
আজ তাঁর আত্মা যেখানেই থাকুন না কেন, এই সব ছেলেদের আশীর্বাদ তিনি করছেন বৈকি, নিশ্চয়ই করছেন।
তাঁর সঙ্গে পরিচিত হয়ে এবং তাঁর সান্নিধ্যে এসে সকলে কতটা আনন্দ পেতেন তাঁর প্রমাণও যথেষ্ট পেয়েছি। তাঁর সেবারতা সিস্টার শান্তিদেবীর কথা আমার আজও মনে আছে- এবং চিরদিনই থাকবে। জীবিকার্জনের জন্য টাকা তাঁকে নিতে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তাঁর সেবার মধ্যে যে দরদ, যে আন্তরিকতা আমি দেখেছি, তা শুধু টাকার বিনিময়ে কোনদিনই পাওয়া যায় না। কত সময় তিনি আমাকে বলেছেন, ‘বউদি, এই রকম দাদার সেবা করার সৌভাগ্য যে আমার কখনও হবে, সে কথা আমি কোনদিন কল্পনাও করতে পারিনি।’ কবির মরদেহ শ্মশানে নিয়ে যাবার পরে শান্তিদেবীও চোখের জল ফেলতে ফেলতে সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন। অন্তরের অনেকখানি টান থাকলে তবেই এ কাজ সম্ভবপর হয়।
কবির বাল্য ও কৈশোরের স্মৃতিঘেরা বরিশাল। সেখানে দেখেছেন তিনি হিন্দু-মুসলমানের অপূর্ব ভ্রাতৃরূপ। দুঃখে, বিপদে, একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছে-স্নেহ, ভালবাসায় হয়ে উঠেছে অতি আপনজন। এমনিই ছিলো তাদের একাত্মবোধ।
কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পূর্ব মুহূর্তে একই মায়ের কোলে ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি, তাদের সে রক্তের হোলিখেলা, বেদনায় মূক করে তুলেছিল কবি-চিত্তকে, বিকল করেছিল তাঁর প্রাণ। অন্তরের সে ব্যথা, সে বেদনাকে মুখে প্রকাশ করার ভাষা তিনি খুঁজে পাননি। তাই লেখনীর বাহুডোরে বেঁধে রেখে গেলেন ভাবীকালের সন্তানদের পথ দেখাবার জন্যে—
(কবির এই কবিতায় শুধু সেদিনের হিন্দু মুসলিমের লড়াইয়ের গল্প নয় সেটা আজকের পৃথিবীর ধর্মের নামে লড়াই, জাতি, বর্ণের ছদ্মাবরনে একই ভিন্ন রূপে ভিন্ন পরিবেশে লড়াই- যেখানে মুষ্টিমেয় মানুষের ক্ষমতার দ্বন্দে শুধু অসহায় উপেক্ষিত মানুষের আত্মসমর্পন। যেখানে আমরা শুধু সংখ্যা গুনি আর ওই ধর্ম বর্ণ আর জাতির নামে এক এক পক্ষ নেই কোনরূপ বন্ধন ছাড়াই)
“প্রকৃতির পাহাড়ে পাথরে সমুচ্ছল
ঝর্ণার জল দেখে তারপর হৃদয়ে তাকিয়ে
দেখেছি প্রথম জল নিহত প্রাণীর রক্তে লাল
হ’য়ে আছে ব’লে বাঘ হরিণের পিছু আজো ধায়;
মানুষ মেরেছি আমি— তার রক্তে আমার শরীর
ভ’রে গেছে; পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার
ভাই আমি; আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু
হৃদয়ে কঠিন হ’য়ে বধ ক’রে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর
কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজপ্রতিম বিমূঢ়কে
বধ ক’রে ঘুমাতেছি— তাহার অপরিসর বুকের ভিতরে
মুখ রেখে মনে হয় জীবনের স্নেহশীল ব্রতী
সকলকে আলো দেবে মনে ক’রে অগ্রসর হ’য়ে
তবুও কোথাও কোনো আলো নেই ব’লে ঘুমাতেছে।
ঘুমাতেছে।
যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হ’য়ে
ব’লে যাবে কাছে এসে, ‘ইয়াসিন আমি,
হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ—
আর তুমি?’ আমার বুকের ’পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে
চোখ তুলে সুধাবে সে— রক্তনদী উদ্বেলিত হ’য়ে
বলে যাবে, ‘গগন, বিপিন, শশী, পাথুরেঘাটার;
মানিকতলার, শ্যামবাজারের, গ্যালিফ স্ট্রিটের, এন্টালীর—’
কোথাকার কেবা জানে; জীবনের ইতর শ্রেণীর
মানুষ তো এরা সব; ছেঁড়া জুতো পায়ে
বাজারের পোকাকাটা জিনিসের কেনাকাটা করে;
সৃষ্টির অপরিক্লান্ত চারণার বেগে
এইসব প্রাণকণা জেগেছিলো— বিকেলের সূর্যের রশ্মিতে
সহসা সুন্দর ব’লে মনে হয়েছিলো কোনো উজ্জ্বল চোখের
মনীষী লোকের কাছে এইসব অনুর মতন
উদ্ভাসিত পৃথিবীর উপেক্ষিত জীবনগুলোকে।
****
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৩:১৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



