স্থান; আমার সেই বিক্রমপুরী ‘সবদার’ ডাক্তার বন্ধু রিন্টুর দোকান। রিন্টু দীর্ঘ সময় ধরে চুলে কলপ নেয়। এবার তার টাকের দুপাশের দীর্ঘ শুভ্র এলোমেলো কেশগুচ্ছ দেখে বেশ অবাক হলাম! কি রিন্টু মিয়া, কাহিনী কি?
চিরকুমার রিন্টুর বিশাল পরিবারের সকল দেখভাল করে ওর বিধবা বড় বোন। সে মাঝে ভীষন অসুস্থ থাকায় পুরো পরিবারের হাল-বৈঠা সব ভেঙ্গে গেছে! সে গত দুইমাস ধরে নিজের সুরত আয়নায় দেখার ফুসরত পায়নি। তার চেয়ারের এক হাতল ভাঙ্গা লম্বা ডান্ডির উপরে অলসভাবে হাতটা রেখে, চোখে এক ডান্ডি খুলে পড়া চশমাটা কায়দা করে ঝুলিয়ে হাতে সেই বিখ্যাত কেচিখানা দিয়ে কিছু একটা কাটতে কাটতে নিজের ‘দুখ ভরা কাহানি’ বলছিল।
এর মধ্যে ‘নিশিথ’ এসে উপস্থিত! ও এমনিতে পেটে ব্যোম মারলেও কথা বলে না কিন্তু একবার শুরু করলে লাইন বেলাইনে বকবক করতেই থাকে।
-কিরে নিশিথ কবে আসলি?
-নিশিথ ভীষন বিরক্তি নিয়ে বলল ‘এইতো আজকে’ (অষ্টমীর সন্ধ্যেয়)
-ক্যান ছুটি পাইস নাই?
-নারে ভাই আমাগের কি আর ওইরকম সুখের কপাল আছে।
-বোনাস দিছে তো- নাকি?
ও ক্ষেপে গিয়ে গালি দিয়ে বলল, ‘কিসের বালের বোনাস! ছুটিই দেয় না।‘
শফি মিটিমিটি হেসে বলল, ‘তা বৌদিরে নিয়ে মায়ের দর্শন করছিস তো?’
নিশিথ চুপ। ভীষন রাগ!
আমি বললাম, যে কয়টা মণ্ডপে ঘুরলাম- দেখি শুধু ভিডিপি আনসার আর পুলিশ। তোরা দেখি 'মায়েরে' একলা ফেলায় রাইখ্যা সবাই ভাগছিস। তোগেরে ভিতরে ঢুকতে দেয় তো নাকি?
নিশিথ এবার ভীষন রেগে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘মায়ের কপাল খামচাই। ওরা পাহাড়া দেয় ক্যা? আমরা পাহাড়া দিতে কইছি নাকি?’ কথাটা বলেই সে ‘যাইগা’ বলে উঠে গেল….
এর মধ্যে ‘কমল সাহা’ দোকানে ঢুকল ঔষধ নিতে – সে আমার বড় ভাই এর বন্ধু, তাই দাদা কেমন আছেন? বলে চুপসে গেলাম। ওদিকে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল এক লীগের মাঝারি দরের নেতা। এরা সবখানেই সুযোগ বুঝে ‘খোচাচ্ছে’
-'কি হে কমল দা, কোন ঢোল-ডুগীর আওয়াজ তো শুনিনা –সরকার সব বন্ধ কইর্যা দিল নাকি?’ বলেই তিনি একটা ফিচেল হাসি দিলেন।
কমল সাহা হাসতে হাসতেই বলল, ‘দাদা কি কানে কম শুনেন নাকি? ঢোল ডুগী কি সবসময় বাজাই আমরা- লগ্ন তিথি অর্চনার ব্যাপার আছে। সময় হইলে ঠিকই বাজবে।
লীগ নেতা বেশ হতাশ ও মনঃক্ষুন্ন হয়ে উল্টোপথে হাটা দিলেন।
***
রাত তখন দশটার ঘর পেরিয়েছে। আমাদের গল্প-গুজব চলছে। এর মধ্যে মটর সাইকেলে এক সাব- ইন্সপেক্টর রিন্টুর দোকানের সামনে ব্রেক কষে ওর 'কুশল' জিজ্ঞেস করল।
রিন্টু, এইতো ভাল- আপনি ভাল আছেন বলে, জিজ্ঞেস করল, যাচ্ছেন কোথায়?
পুলিশ কর্মকর্তার চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি। ‘এই আর কই যাব- সন্ধ্যায় বেরোইছি। ভোর সাড়ে চারটা পর্যন্ত মণ্ডপে মণ্ডপে ডিউটি। এইভাবে শরির টেকে কন?’
***
নবমীতে হিন্দু সহপাঠী বন্ধু অনেকের সাথে দেখা হল। সন্ধ্যে রাতেই মণ্ডপগুলো চুপচাপ প্রায় মনুষ্যবিহীন। একটু অবাক হলাম; ৫০০ মিটারের মধ্যে চারখানা পুজা মণ্ডপ। সবগুলোই প্রায় জনশুন্য।
দেখা হল গোবিন্দ আর সুশীলের সাথে। গোবিন্দ বড় সরকারী কর্মকর্তা- একসময় সাংবাদিকতার সাথেও জড়িত ছিল, হিন্দুদের মধ্যে বেশ প্রভাবশালী। আর সুশীল স্থাণীয় এক হাইস্কুলের হেডমাস্টার। ওরাদু’জনে আমাদের জোর করে ধরে নিয়ে গেল বিধানদার মিষ্টির দোকানে। গোবিন্দ যার যা খুশী যত খুশী খাবে বলে এহলান করল। কামরুলের উচ্চ সুগার, সে কোন মতেই মিষ্টি খাবে না। আমার মিষ্টি মোটামুটি অপছন্দ। তবুও জোরাজুরিতে একটুখানি ছানার জিলাপি আর এক চামচ রাজভোগ খেলাম। বসে বসে সুশীলের সাথে গল্প করছিলাম নিমাই ঘোষের লবঙ্গ লতিকা মিস্টির। আহা কি স্বাদ ছিল! আমার ধারনা বাংলাদেশ থেকেই এই মিষ্টির আসল রূপ হারিয়ে গেছে।
*চিনির সিরা বা রসে জাফরান দেয়া থাকত। লবঙ্গ লতিকার রঙ হত জাফরানী- ভিতরে থাকত খাটি দুধের খিস্সা। ভিতরে খিস্সার পুর দিয়ে পরোটার মত চার ভাজ করে মুখটা সেঁটে দিত আস্ত একটা লবঙ্গ দিয়ে। খাটি ঘিয়ে ভেঁজে যখন চিনির সিরায় চুবিয়ে সেই মিষ্টি ছাকনির উপর রাখত; চারিদিকে ঘ্রানে মৌ মৌ করত। আহা সে কি স্বাদ! কুরমুড়ে সেই লবঙ্গ লতিকায় কামড় দিলে মুখ ভরে যেত রসে!*
নিমাই ঘোষ গত হয়েছেন বহু আগে- তার সাথে চলে গেছে সেই বিখ্যাত, লবঙ্গ লতিকা, গজা আর বুঁদিয়া। তার সন্তানেরা কিছুদিন ব্যাবসা করে জুত করতে না পেরে চম্পট দিয়েছে। মিষ্টির এই দোকানে বিধানদার ছবিটা ঝুলছে। আমি কখনো মিষ্টি খেলে টাকা রাখতে চাইতেন না- খুব আদর করতেন।
***
মণ্ডপের এই হাল কেন জানতে চাইলে গোবন্দ জানাল, পুজাতো শেষরে ভাই।
-মানে?
গোবিন্দ হেসে বলল, এবার নবমী আর দশমীর তিথি একই দিনে পড়ছে। ঠাকুর ডোবানোর দিন ছিল আজকে। সব পুজা অর্চনা শেষ হয়ে গেছে। এমনি এমনিতেই আমরা একদিন পিছিয়ে ডোবাচ্ছি – কালকের জন্য ‘সধবা’ নারীদের সিঁদুর খেলাটা রেখে দেয়া হয়েছে।
আমি গোবিন্দকে বললাম, এই একদিন ইচ্ছাকৃতভাবে ছুটি বাড়ানোর জন্য প্রতিমাকে ফেলে রাখা হয়েছে- কেউ এই নিয়ে একটা কথাও বলল না, আশ্চর্য! তুই না বললে তো জানতাম-ই না! একদিন ছুটির পাশাপাশি এই যে সারা দেশের মানুষকে টেনশনে রেখে অর্ধ লক্ষাধিক মণ্ডপের নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য কোটি কোটি টাকা নষ্ট হল এর দায়ভার নিবে কে? তোরা তো পুরা সরকাররে বোকাচোদা বানায় দিলি রে!!
গোবিন্দ হেসে বলল, কি করবি দোস্ত, এইভাবেই চলতেছে দেশ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৪২