আমাদের ছোটবেলায় কৈশরকাল আর যৌবনের প্রারম্ভিক সময়কালের প্রায় পুরোটাই গেছে মুরুব্বীদের চাপের উপরে।
বাঙ্গালীর আদি চরিত্র সবলের- দুর্বলের উপরে, ক্ষমতাবান অক্ষমের উপরে, অর্থবান দরিদ্রদের উপরে যেমন চাপিয়ে দেয় ঠিক তেমনি মুরব্বীরাও ছোটদের উপর এমন চাপিয়ে দিত। এতে কোন অপরাধ গ্লানিবোধ মায়া মমতা স্পর্শ করত না তাদের। ছোটরা মানেই 'কাম কাজের পোলা-মাইয়া'; এইটা নিয়ে আস, ওইটা নিয়ে আস, এইখানে যা ওইখানে যাও- সামনে পাইলেই দৌড়ের উপরে রাখা। বড়দের কথা একটু দাঁড়িয়ে শুনতে গেলেই; এই পিচ্চি পোলাপাইন বড়দের মধ্যে কি কিংবা বড়দের কথা শুনছ কেন? ভাগো এখান থেকে।
আর যদি বড়দের কথার মাঝে নিজের একটু স্বাধীন মতামত পেশ করত তবেতো কথাই নে; কথা যত যৌক্তিক হোক না কেন। বড়দের বচন ছিল, বাচ্চা পুলাপান এত কথা বলতে হবে কেন? দেখছ না মুরুব্বীরা কথা বলছে? তোমার কাছে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেছে?
কেউ আবার এক কাঠি সরেস হয়ে বলত, আইজকালকার পুলাপান বেশী পাকনা হয়ে গেছে।
ঘরের মধ্যে আমাদের ছিল পরিপূর্ণ পরাধীনতা। এমন কি বাইরেও সালাম, আদব লেহাজ, পোষাক, চলন বলন, বন্ধু আড্ডা এই নিয়ে বড়দের কটুক্তি ওয়াজ নসিহত ছিলই।
বাইরে একটু নিভৃতে সমবয়সী বন্ধুদের আড্ডাতেই ছিল একটু প্রশান্তি। সেখানে মন খুলে কথা বলা যায়, ইচ্ছে মত খিস্তি খেউড় করা যায়, রাজ্যের যত দুরন্তপনায় সেখানে কোন বাঁধা নিষেধ ছিল না। তাই সারাক্ষন পরে থাকত মন সেখানে।
আমাদের গ্রাম মফস্বলের মানুষেরা এখন আধুনিক বিশ্বের সাথে সংযুক্ত হয়েছে- আগে যেটাকে ট্যবু হিসেবে ভাবা হত এখন সেটা নিতান্তই এলেবেলে হয়ে গেছে। আমরা দেশ বিদেশ ঘুরে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছি - সারা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় পেয়ে গেছি। দেশে কিংবা বাইরে মনন মানসিকতায় অনেক বেশী আধুনিক ও উন্নত চিন্তা চেতনার অধিকারি হয়েছি সত্য কিন্তু জেনিটিক্যালি আমাদের সেই আদিম চরিত্র থেক এখনো বের হতে পারিনি।
ছোটদেরকে আমরা এখনো ছোটই ভাবি।এখনো ভাবি ওরা সবকিছু করবে ঠিক আছে কিন্তু আমাদের (মুরুব্বীদের) গাইডে। মুরুব্বীরা যে বিষয়ে পড়তে বলবে সে বিষয়ে পড়বে, যে ভাবে এইম ইন লাইফ ঠিক করতে বলবে সেভাবে ভবিষ্যতকে সাজাবে। মুরুব্বী যদি চায় সে ডাক্তার হবে তবে সে ডাক্তারী পড়বে- ইঞ্জিনিয়ার চাইলে ইঞ্জিনিয়ারিং। বিয়েটাও করতে হবে তাদের মতে, জাত পাত পরিবার ছাড়া সুরৎ, শিক্ষা অর্থ দেখা শেষে দেশের বাড়ি ভাষা আচার ব্যাবহার সব দেখে সিদ্ধান্ত নিবে তারাই। এমনকি ভাই-বোন কয়টা, তারা কি ছোট না বড় এই নিয়েও ক্যাচালের অবকাশ থাকে। সবকিছু শেষে শুধু বিয়ের খাবারে মাংশ শক্ত হল কেন এই নিয়ে মুরুব্বীরাই বিয়ে ভেঙ্গে দিল। বর কনে কিছু বলতে গেলেই- ধমক দিয়ে চুপ- তোমরা কি বোঝ চুপ কর।
আমাদের ব্লগে এমন কিছু মুক্তিযোদ্ধা এখনো সক্রিয় যারা নিতান্ত কিশোর বয়সে অস্ত্র ধরেছিলেন। যারা মুরুব্বীদের না জানিয়ে গোপনে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলেন। যুদ্ধ বিজয়ের পরে যারা নতুন বাংলাদেশ গড়ার সপ্ন দেখেছিলেন- কিন্তু তখুনি গর্ত থেকে বেরিয়ে আসলেন সব মুরুব্বীরা। একদল মুরুব্বী দেশ পরিচালনার পুরো ভার তাদের হাতে নিয়ে নিলেন আরেক দল হলেন বিশ্লেষক, বিশেষজ্ঞ আর মন্ত্রনা দাতা।
সবার এককথা পুলাপান কি বোঝে ওদের রক্ত গরম ছিল যুদ্ধ-টুদ্ধ করছে, এখন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাক। পড়াশুনা করুক খেলাধুলা করুক, দেশটা মুরুব্বীরা সামলাক- ওরা এই গুরুদায়িত্ব নিতে পারবে না।
গত ৫৩ বছর দেশটা এই মুরুব্বীদের দ্বারা পরিচালিত হল। সেইসব কিশোর সদ্য যুবক একদিন মুরুব্বী হল-তারাও আগেকার মুরুব্বীদের একই চরিত্রের উত্তরাধিকার হল।
নতুন বাংলাদেশে নতুন একদল উদ্যোম টগবগে রক্তের কিশোর তরুন ফের জেগে উঠল। নাহ্ এইভাবে আর দেশ চলে না। তথাকতিথ ফার্মের মুরগীরাও ফার্মের আয়েসী ঘর থেকে বেরিয়ে আসল। 'বুক পেতেছি গুলি কর' স্লোগান দিয়ে অত্যাধুনিক রাইফেলের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তাদের তেজ ক্ষোভ দ্রোহের আগুনে পড়ে ছাড়খার হয়ে গেল একঝাক মুরুব্বীদের সাজানো বেহেশ্তি বাগান।
আমাদের এই নীতিহীন বিবেক বর্জিত সীমাহীন দুর্নীতি গুম হত্যা অত্যাচার লুন্ঠন বাক স্বাধীনতা হরন ভয়ঙ্কর এই স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে আপামোর জনতা। আমি অঁজ পাড়া গায়ের নিরক্ষর কৃষক থেকে শুরু করে টপ কর্পোরেট বস, এমনকি সেনাবাহিনীর বহু অফিসারের সাথে কথা বলে এর বিরুদ্ধে তাদের চাপা ক্ষোভ দেখেছি। অন্যদল বাদ দিলাম শত শত আওয়ামী কর্মীরা বেজায় নাখোশ ছিল- তাদের অন্তরে দহন হচ্ছিল হচ্ছিল রক্তক্ষরণ।
আজ যখন দেশকে নতুন এক সুর্যোদয়ের সপ্ন দেখাচ্ছে তখনই ফের সেই মুরুব্বীরা জেগে উঠলেন, তাদেরকে হেয় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে তাদের বুদ্ধির অপরিপক্কতা,অযোগ্যতা সহ নানা উপহাসে এত বেশী নসিহত দিচ্ছেন যে তারা কোনদিন কিশোর যুবক ছিলেনই না। তারা মায়ের গর্ভ থেকে বের হয়েছেন পরিপক্ক বেরেন ( মগজ) আর পক্ক বা বিরল কেশে- হাতে তখন ধরা ছিল সব ডিগ্রী আর অভিজ্ঞতার কাগজপত্র।
হেলাল হাফিজের "এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।" এই একটা লাইন আগুনের মত ছড়িয়ে গিয়েছিল বাঙ্গালী তরুনের রক্তে। কৌশরের শেষ বেলা আর যৌবন হল ভাঙ্গা গড়ার বয়স , দুরন্তপনা করার বয়স, প্রেমে পড়ার বয়স, যুদ্ধ করার বয়স।
একটা ছেলে বিয়ের আগেই সত্যিকারে পুরুষ থাকে তেমনি একটা মেয়েও। বিয়ের পরে সন্তান হয় পরিবার হয় দায়িত্ব বাড়ে আর মানুষ ধীরে ধীরে স্বার্থপর হয়।
নেতিয়ে পড়া যৌবনে শুধু মাথায় বুদ্ধিটাই (মুখ্য ক্ষেত্রে কূটবুদ্ধি) গিজগিজ করে বাকি সব কিছুতে আগে নিজে বাঁচি নীতিতে সবাই অটল থাকে। এরপরে চলে নসিহত আর কিচ্ছু হবে না, কিচ্ছু হবে না রব।
আমাদের এক জীবনে তো দেখলাম, আসলে আমরা কতটুকু কি 'ছিঁড়তে' পারি। এবার ওরা না হয় ভুল করুক- বারবার ভুল করুক, ভুল করে শিখুক। এ দেশটা ভবিষ্যত প্রজন্মের। ওরা ওদের মত দেশটাকে গড়া-পেটা করে নিক।
এর থেকে আসুন আমরা মুরুব্বীরা প্রজন্মের পর প্রজন্মের এই 'চাপিয়ে' দেয়ার রীতি আর 'পুলাপাইন কি বোঝে' এই মতবাদটা পাল্টে ফেলি।
মনে রাখবেন;
মিছিলের সব হাত/কণ্ঠ/পা এক নয়।
সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিরাগী থাকে,
কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার।
কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার ...
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।
****
* সুপ্রিয় ব্লগার, বিশেষ একটা সমস্যার কারণে ইদানিং নিয়মিত ব্লগে আসতে পারছিনা, কারো লেখায় সেভাবে মন্তব্য করতে পারছি না বলে আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। আমার এই লেখার মন্তব্যের উত্তর দিতেও হয়তোবা কিছুসময় দেরি হতে পারে সে কারণে ভাববেন না যে আমি মন্তব্যের উত্তর দেয়ার ব্যাপারে উদাসীন কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করছি। ধন্যবাদ
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩৮