বেদনায় ঝড়া অশ্রুতে উচ্চ ঘনত্ব স্ট্রেস হরমোন থাকে। এর মধ্যে লিউসিন এনকেফালিন নামে হরমোনকে একটি প্রাকৃতিক ব্যথা নাশক হরমোন নামে অভিহিত করা হয়, যা উচ্চ মানসিক চাপের মাত্রা ভারসাম্য রাখতে জৈবিক ভূমিকা পালন করে।
কান্না মানুষের ইমিউন সিস্টেমকে সাহায্য করে। মানুষের মধ্যে চোখের জলের প্রতীকী তাৎপর্য রয়েছে। মানুষ যখন গভীর আবেগে কান্না করে তখন সে কন্ঠনালী দিয়ে ভিন্ন সুরে শব্দ করে ও নাক দিয়ে পানি ঝড়ে!
'টপোগ্রাফি অফ টিয়ার্স' – মাইক্রোস্কোপের নীচে মানব অশ্রু
নিবন্ধকালঃ সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৩
" চোখের জলের হয়না কোন রঙ তবু কত রঙের ছবি আছে আঁকা''
অশ্রুর বৈজ্ঞানিক বর্ণনাঃ
প্রতিটি মানুষ কাঁদে। কিন্তু কান্না করলে কেন আমাদের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়ে সেটা আমরা প্রায়শই ভাবি না। মানব অশ্রু আসলে তিনটি ভিন্ন শ্রেণিতে পড়ে: বেসাল, রিফ্লেক্স এবং সাইকিক (অথবা আবেগজনিত)।
বেসাল অশ্রু হল চোখের প্রাকৃতিক আর্দ্রকরণ, একটি সদায় উপস্থিত তরল যা কর্নিয়া শুকানোর হাত থেকে রক্ষা করে।
রিফ্লেক্স অশ্রু হল সেই অশ্রু যা আপনি তখন ফেলেন যখন আপনার চোখে কোনও বাইরের শক্তি যেমন পেঁয়াজ কাটা, চোখে ময়লা পড়া, বা ঠাণ্ডা বাতাস প্রবাহিত হয়।
সাইকিক অশ্রু হল সেই অশ্রু যা আপনি তখন ফেলেন যখন আপনি শক্তিশালী আবেগের দ্বারা অভিভূত হন, যেমন রাগ, সুখ বা শোক।
মাইক্রোস্কোপের নীচে শুকনো অশ্রু বিশ্লেষণ করলে, একে বড় আকারের ল্যান্ডস্কেপ বা ভূখণ্ডের মত দেখা যায় যা প্রকৃতির ক্ষয়ের মত নিদর্শন প্রদর্শন করে। অশ্রুর গঠনে বিভিন্ন প্রকারের অণু এবং জৈবিক পদার্থ যেমন তেল, এনজাইম, অ্যান্টিবডি, প্রোটিন এবং হরমোনের উপস্থিতি রয়েছে। ফিশার এবং অন্যান্য গবেষকরা বিভিন্ন টিয়ার পরীক্ষা করে এর গঠন এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করেছেন, যা মনোবিজ্ঞান, চিকিৎসা, এবং সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
অশ্রু গঠন এবং তার তাৎপর্য
কান্নার প্রক্রিয়া শুধু একটি শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া নয়, এটি মানবিক অভিজ্ঞতার একটি গভীর ভাষা হিসেবে কাজ করে। মাইক্রোস্কোপি বিশ্লেষণ এই আবেগের সূক্ষ্ম এবং জটিল বৈশিষ্ট্যগুলি প্রকাশ করে, যা আমাদের মনোভাব, সামাজিক সম্পর্ক, এবং আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার দিকে আলোকপাত করে। গবেষণা অনুসারে, মানুষের অশ্রু লিউসিন এনকেফালিনের মতো প্রোটিন-ভিত্তিক হরমোন ধারণ করে, যা দুঃখ এবং চাপের সময় মুক্তি পায়।
গবেষণার উপকরণ এবং কৌশল
অশ্রু বিশ্লেষণের জন্য মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করা হয় যাতে অশ্রুর ক্ষুদ্রতম কাঠামো এবং বিস্তারিত প্রকাশিত হয়। এই ধরনের বিশ্লেষণটির জন্য বিশেষায়িত মাইক্রোস্কোপ, যেমন Zeiss বা Nikon Eclipse Ti2, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাইক্রোস্কোপের সেটিংস যেমন ফোকাস, আলোকসজ্জা, এবং বৈসাদৃশ্য সঠিকভাবে সামঞ্জস্য করা অপরিহার্য, যাতে টিয়ার স্ট্রাকচারের সূক্ষ্মতাগুলি স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়।
অশ্রু এবং মানব অভিজ্ঞতা
অশ্রু মানুষের আবেগ এবং অভিজ্ঞতার এক অমূল্য প্রতিফলন। তা শুধু শারীরবৃত্তীয় এক প্রতিক্রিয়া নয়; এটি সমাজ এবং সংস্কৃতির প্রতীকও। গবেষকরা দেখিয়েছেন যে অশ্রু শুধু একটি শারীরিক তরল নয়, বরং মানবজাতির একটি প্রাথমিক এবং অত্যন্ত শক্তিশালী ভাষা, যা সংকট, আনন্দ, দুঃখ এবং সংবেদনশীল অভিজ্ঞতার সবটুকু ধারণ করে।
ফটোগ্রাফার ফিশার যেমন অশ্রুর মাইক্রোস্কোপিক বৈশিষ্ট্যগুলো সংগ্রহ করেছেন, তেমনই বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে অশ্রু আমাদের শরীরের ভিতরের গভীর শারীরবৃত্তীয়, মানসিক এবং সামাজিক প্রক্রিয়াগুলির প্রতিফলন হতে পারে। এগুলি শুধু চোখের কোণে এক ফোঁটা জল নয়, বরং প্রত্যেকটি অশ্রু একটি ব্যক্তিগত এবং সামষ্টিক ভাষার গল্প বলে।
২০০৮ সালে, ফটোগ্রাফার রোজ-লিন ফিশার তার জীবনের এক ভীষণ শোককালীন সময় পার করছিলেন। কাছের অনেক প্রিয় মানুষ হারানোর পর, তিনি এক গভীর আবেগের মধ্যে ডুবে যান, আর এর ফলস্বরূপ তিনি প্রায়শই কাঁদতে থাকেন।
তিনি বলেন'এটা ছিল এক ধরনের অনবরত শোক'।কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করত 'কেমন আছো?', আটা কেঁদে ফেলতাম।
তবে এই শোকের মধ্যে, তিনি নিজের জীবন ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রশ্ন করছিলেন, এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু দেখতে চাইছিলেন। এই সময়েই, এক বন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে তার অশ্রুগুলি আরও গভীর অর্থ ধারণ করতে শুরু করে।
'শোকের অনুভূতি ছিল, তবে এক অদ্ভুত কৃতজ্ঞতা অনুভূতি ছিলও। এটি এক ধরনের অদ্ভুত সংযোগ ছিল। 'তখন আমি ভাবতে শুরু করলাম, আমার অশ্রুগুলি কেমন দেখতে, এবং কি আবেগের অশ্রু থেকে কৃতজ্ঞতার অশ্রু আলাদা হয়?'
রোজ-লিন তার এই অনুভূতিগুলির একটি ব্যাখ্যা খুঁজতে শুরু করেন, এবং শৈশবের স্মৃতি ফিরে পান, যখন তারা পুকুরে জল নিয়ে পরীক্ষা করতেন। 'একবার আমি এমন একটি যাদুঘরে গিয়েছিলাম যেখানে দেখানো হচ্ছিল, এক ফোঁটা পুকুরের জল মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে কী দেখা যায়,' তিনি বলেন। 'এটা আমাকে ভাবতে বাধ্য করেছিল, যদি আমি এক ফোঁটা অশ্রু দেখতাম, তাহলে কী দেখতে পেতাম?' রোজ-লিন তখনই সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি এই প্রকল্পটিকে বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষা না করে, বরং কবিতামূলক, সৃজনশীলভাবে অন্বেষণ করবেন। 'বিজ্ঞান মানে প্রমাণ- তিনি বলেন, 'কিন্তু আমি চেয়েছিলাম এই প্রকল্পটি শিল্পের চোখে দেখতে।'
মাইক্রোস্কোপের ব্যবহার তার কাছে নতুন ছিল না। এর আগে তিনি একটি মৃত মৌমাছির ছবি তুলেছিলেন, যা তিনি তার জানালার সিল থেকে পেয়েছিলেন। "আমার এক বন্ধু ল্যাবরেটরিতে কাজ করত," তিনি বলেছিলেন। "আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, যদি আমি কিছু মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে দেখতে পারি, সে বলেছিল কিছু নিয়ে আসতে। তাই আমি মৌমাছিটি নিয়ে গিয়েছিলাম।" প্রথমবার মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে কীটপতঙ্গ দেখা তাকে অস্বস্তিতে ফেলেছিল। "এটা যেন আমি একটি অদ্ভুত মহাকাশযানে বসে ছিলাম, অন্য এক পৃথিবীতে ড্রাইভিং করছিলাম," তিনি বলেন। "আমি জানতাম না আমি কী দেখছি।"
এই অনুসন্ধান তাকে এক নতুন আনন্দের দিকে নিয়ে যায়। খুব শীঘ্রই, তিনি মৌমাছির শরীরের অংশগুলির দিকে মুগ্ধ হতে শুরু করেন এবং ৫০০০x পর্যন্ত ম্যাগনিফিকেশন ব্যবহার করতে থাকেন। মৌমাছির চোখের রূপ, যা হাজার হাজার ষড়ভুজ লেন্স নিয়ে তৈরি, তাকে গভীরভাবে আকর্ষিত করেছিল।
"এটা ছিল এক 'ওয়াও' মুহূর্ত," তিনি বলেন, "এবং আমাকে আরও অনুসন্ধান করতে অনুপ্রাণিত করেছিল।" ১৭ বছর ধরে চলা এই প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত 'Bee' নামে একটি বইয়ে রূপ নেয়, যা ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়।
রোজ-লিন যখন তার অশ্রুগুলিকে মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে প্রথম দেখেন, তিনি অনুভব করেন, -এগুলো যেন আবেগের ভূমির এয়ারিয়াল ভিউ এর মতো দেখতে,"- তিনি বলেন।এটা ছিল অসাধারণ! মৌমাছির ছবিগুলির মতো, যা একটি স্ক্যানিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে তোলা হয়েছিল, রোজ-লিন তার অশ্রুর ছবিগুলি তোলেন একটি অপটিক্যাল মাইক্রোস্কোপ দিয়ে।'আমার চাচা একটি পুরানো জাইস মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করতেন,' তিনি বলেন, 'তিনি মারা যাওয়ার পর পরিবার আমাকে সেটি দেয়। তাই এটি আমার কাছে বিশেষ অর্থ রাখে।'
মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে অশ্রু দেখা রোজ-লিনের কাছে যেন এক নতুন পৃথিবী উদ্ঘাটন করেছিল। অশ্রুগুলির মধ্যে তিনি দেখতে পান বিভিন্ন ধরনের প্যাটার্ন — নদী, দ্বীপ, পথ, ব্লুপ্রিন্ট, শীতল কাচের মতো এবং সূক্ষ্ম কাপড়ের ঠাস বুননের মতো চিত্র। এই বিমূর্ত ছবিগুলি মানুষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন অর্থ গ্রহণ করতে পারে। "কখনও কখনও প্যাটার্নগুলো সত্যিই অবাক করে," তিনি বলেন, "আমি ভালোবাসি যে এসবের মধ্যে তথ্য, সংকেত ও রহস্য থাকতে পারে।"
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে, রোজ-লিনের এই ছবিগুলোর পেছনে রয়েছে পানি, হরমোন, প্রোটিন, খনিজ, অ্যান্টিবডি এবং এনজাইমের মিশ্রণ। বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুযায়ী, আবেগজনিত অশ্রুতে অন্য ধরনের অশ্রুর তুলনায় বেশি প্রোটিন থাকে। এই জ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে, রোজ-লিন তিনটি ধরণের অশ্রুর নমুনা সংগ্রহ করেন: তার নিজের অশ্রু, প্রিয় পোষা প্রাণী হারানোর সময় তার অশ্রু, এবং এমন কিছু বিশেষ অশ্রু যেমন একটি নবজাতক শিশুর কান্নার অশ্রু বা হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলার অশ্রু। রোজ বলেন, "যতটা সম্ভব, আমি প্রতিটি অশ্রু সংরক্ষণ করতাম এবং সেই অশ্রুর সাথে সম্পর্কিত অনুভূতি লিখে রাখতাম,"।
রোজ-লিনের এই প্রকল্পে কোনও বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়নি, কারণ তার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রশ্ন উত্থাপন করা, নিশ্চিত উত্তর দেওয়া নয়। "এটা খুবই লোভনীয় যে আপনি কোনো একটি নির্দিষ্ট বোঝাপড়ার স্তরে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু কখনও কখনও সেটা সম্ভব হয় না," তিনি বলেন। "অশ্রুর কোনো সুপারপাওয়ার নেই, তবে এগুলি কিছু একটা প্রকাশ করে, সীমানা পার করে। এটি চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া ও এর ভিন্ন রকম রহস্য উন্মোচন হওয়াই আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয়।"
রোজ-লিন ফিশারের "টপোগ্রাফি অব টিয়ার্স" প্রকল্পের বইটি ২০১৭ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয়, এবং এটি এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে অশ্রু, আবেগ এবং মানব অভিজ্ঞতার রহস্য উন্মোচন করে।
ফটোগ্রাফার রোজ-লিন ফিশারের 'টপোগ্রাফি অফ টিয়ার্স' প্রকল্প মানুষের অশ্রুর মধ্যে বিদ্যমান গঠন, বৈশিষ্ট্য, এবং এর সাংস্কৃতিক, শারীরবৃত্তীয় তাৎপর্য উন্মোচন করেছে। মাইক্রোস্কোপের নিচে অশ্রুর সূক্ষ্ম গঠনগুলি মানুষের আবেগ, সামাজিক সংযোগ এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য এর ভূমিকার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি দেখিয়ে দেয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:৪৯