somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইলিশনামা~ ১

২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১৯৮৫ সালে ডক্টর মোকাম্মেল হোসাইন ‘ ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে যেই রিসার্চ পেপারটা( থিসিস – এম এস এর জন্য) জমা দিয়েছিলেন সেটা এখানে মিলবে;
Spawning times and early life history of Hilsa ilisha in Bangladesh।
বিবিসির সূত্র বলছে;বার্মায় ইলিশ মেলে ১৫-২০ভাগ, ভারতে ৫-১০ ভাগ আর বাংলাদেশে ৬০ ভাগ। বাকি দশভাগ সারা বিশ্বে।
ওদিকে টাইমস অফ ইন্ডিয়া একটা জরিপ করে বলছে; বাংলাদেশে নাকি ৭৫ভাগ ইলিশ পাওয়া যায়, বার্মায় দশ ভাগ ও ভারতে মাত্র ৫ ভাগ।
ইলিশ মাছ বাংলাদেশের পুরো মাছ আহরণের ১২ভাগ পুরন করে আর জিডিপিতে ১ ভাগ অবদান রাখে। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ মানুষ ইলিশ আহরণ এর সাথে জড়িত।

২০০২-৩ সালে হুগলী নদীতে ইলিশ ধরা হয়েছিল-৬২,৬০০ টন। সেখানে বাংলাদেশে ছিল প্রায় দুই লাখ টন। ২০১৭/১৮ তে হুগ্লী নদীতে ইলিশ ধরা পরে ২৭ হাজার ৫৩৯ টন সেখানে বাংলাদেশে ৫১৭০০০ টন। ওপারে কমেছে ৫৬% এপারে বেড়েছে ১৬০%
ওদিকে বার্মার ইরাবতী এর মোহনা ও সুমুদ্র থেকে সেই সময়ে মাছ ধরা পড়ত সারা বিশ্বের ৫ থে ২০ ভাগ – সেটা এখন নেমে এসেছে মাত্র ৮-১০ ভাগে। সারা বিশ্বের নদ নদী মহনা আর সুমুদ্রে বাকি মাত্র ৫ ভাগ ইলিশ ধরা পড়ে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী ইলিশ ধরা পড়ে মেঘনা নদী ও এর অববাহিকায়। ইলিশ ইরাবতী ও হুগলী নদী থেকে তার রুট পাল্টে মেঘনা মুখী হয়েছে।
ফারাক্কা বাধের জন্য হুগলী নদীর মোহনায় দ্রুত পলি জমা, সময় মত ড্রেজিন না হওয়া ও অতিরিক্ত মাছ আহ্রন( মা মাছ ও জাটকা) এর মুল কারন কেননা ইলিশের চলাচলের জন্য নুন্যতম ৩০-৪০ ফুট পানির গভীরতা দরকার। মাত্র কয়েক বছর আগে যেখানে মাত্র ৩০০০ মাছ ধরার বোট ছিল সেখানে এখন এর সংখ্যা প্রায় ৬০০০। কোন কোন জালের বেড় প্রায় ২ কিলোমিটার- মাছ মোহনা দিয়ে নদীতে ধুকবে কিভাবে?
মেঘনার নদীর গড় গভীরতা ৫০-৬০ফিট । জিপিএস সিস্টেমের মত ইলিশের নিজস্ব গাইড সিস্টেম আছে – এর মাধ্যমে সে খুঁজে নেয় নিরাপদ পানি ও নদী।
***
গে ইলিশ গঙ্গা উজিয়ে এলহাবাদে চলে আসত কিন্তু ফারাক্কাবাধ হবার পরে ইলিশের চলাচলের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে সে কারনেও ইলিশ তার গতিপথ পাল্টেছে।
‘আমার মনে (মুজতবা আলী সাহেব) প্রশ্ন জাগল বাদশা সালামৎ কি মাছ খেয়ে শহিদ হলেন?’
আমার এক সিন্ধি দোস্ত আছেন;
তিনি বললেন,’নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে ,পাল্লা মাছ।‘
গঙ্গা উজিয়ে যে আসে বা একদা আসত, সেটা ইলিশ বা হিলসা
নর্মদা উজিয়ে ঐ মাছই যখন আসে তখন ব্রৌচে(Broach)লোকেরা একে বলে মাদার,পার্সিরা বলে বীম্
সিন্ধু উজলেই বলে পাল্লা।
শান ই শাহ বাদশা সালামৎ মুহম্মদ তুঘলক শাহ ইলিশে চড়ে স্বর্গে গেলেন। স্বর্গে যাবেন নাতে কোথায় যাবেন? ইলিশ খেয়ে যে প্রাণ দেয় সে তো শহীদ!
ঞ্চতন্ত্রে তিনি লিখেছেন ’আবার ইলিশ। সুশীল পাঠক আমাকে ক্ষমা করো।ঐ বস্তুটির প্রতি আমার মারাত্মক দুর্বলতা আছে-বেহেশতের বর্ণনাতে ইলিশের উল্লেখ নেই বলে পাঁচ-বখৎ নামাজ পড়ে সেথায় যাবার বাসনা আমার নেই।‘
***
...গুরুর চরণামৃত নিয়ে শুরু করছি;
আমার এলাকার এক নামকরা তাফসিরবিদের ছেলের সাথে বহু আগে এক তর্কে মেতে উঠেছিলাম;
তের কেজি ওজনের ইলিশ!! অসম্ভব হতেই পারেনা-আমি দেখা-শোনাতো দুরের কথা কোন বইতেও পড়ি নাই।
-হ্যাঁ-রে ভাই, আমি নিজের চোখে দেখছি।…হাটখোলায় এক জাইল্যা পাইছিল- পত্রিকাতে আসছিল আপনে দ্যাখেন নাই?
-নারে ভাই বিশ্বাস হয়না।
তার কথায় আমার এক আত্মীয়া সমর্থন করায় আমি মানতে বাধ্য হলাম। মনে মনে ভাবছিলাম-
তের কেজি ওজনের ইলিশ! এ-তো বড় সড় পাঙ্গাশ মাছের সমান!কিভাবে সম্ভব?আমি পদ্মার পাড়ের ছেলে হয়ে বড়জোর আড়াই তিন কেজি ওজনের ইলিশ দেখেছি,ব্যতিক্রম হলে হয়তো পাঁচ ছয় কেজি হতে পারে,তাই বলে তের কেজি!
-জানেন সেইদিন আব্বার এক মুরিদ আসছিল কুয়াকাটা থেইক্যা। একদম তাজা চকচকা আধা-মন ইলিশ আনছিল।একেকটা কমপক্ষে দুই আড়াই কেজি।
-কি কও মিয়া! তোমার বাড়ির পাশে আমি থাকি আর তুমি দুই একখান ইলিশ আমারে পাঠাইলা না। বাজারে যখন এই সাইজ ইলিশ দেখি ৩০০০-৪০০০ টাকায় তখন ভাবি একদিন একখান কিনে সাজগোজ কইরা ছবি-টবি তুইলা খাব!
-হাঃ হাঃ আমি ভাবছিলাম আপনার কথা। কিন্তু আপনে যে ব্যস্ত মানুষ আপনারে পাব কি এই ভাইবা আর দেই নাই।ওই ইলিশ দেইখ্যা আব্বা আমার বউরে কইল,আম্মা কাঁচা-মরিচ পেয়াজ দিয়া ভাল কইরা ঝোল কর।
বউ কইল,আব্বা এত রাইতে ইলিশ মাছ রাধার দরকার নাই-সকালে রাঁধি?
আব্বা শুইনা কইল কি জানেন,-‘মারে,বুড়া হইয়া গেছি-মরণ কখন আসে বলা যায়না-আইজ রাইতে এই ইলিশ না খাইয়া যদি মইরা যাই তাইলে বেহেশতে গিয়াও শান্তি পাবনা।
***
লিশের প্রসঙ্গ আসলেই আমার সৈ.মু. আলীর সেই বিখ্যাত উক্তিটির কথা মনে পড়ে,
সেদিন মুর্শিদাবাদ থেকে আসা আমার এক ভারতীয় বন্ধু বাসায় সর্ষে ইলিশ খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলল,
-তোমরা কি তাজা ইলিশ খাও?
-তাজা ইলিশ বলতে কি জ্যান্ত নড়াচড়া করছে এইরকম ইলিশের কথা বলছ?
সে বেকুবের মত তাকিয়ে বলল, আমি জানি ইলিশ ধরার পরেই মারা যায়। বলতে চাচ্ছিলাম বরফ ছাড়া ইলিশ খেয়েছ নাকি?
-ঢাকায়-তো বরফ ছাড়া ইলিশ পাওয়া যায়না। ইলিশের সিজনে দেশে গেলে খাই।
-তাই নাকি?খেতে কেমন?
-সেইরকম-স্বাদ।তাজা ইলিশ জেলেরা যখন ডালাতে সাজিয়ে রাখে-রূপ দেখে প্রাণ জুড়ায়।চকচকে ইলিশের দেহ জুড়ে যেন রংধনুর সাত রং এর বাহার। বরফ দিলে মাছ সোজা হয়ে যায় কিন্তু তাজা ইলিশ বাঁকা থাকে ঠিক পানসি নৌকার মত।
বন্ধু আমার ইলিশ সন্মন্ধে আমার এই বিশাল গিয়ানি বক্তব্যে টাসকি খাইল!
আর আমি মনে মনে আমি ফিচিক ফিচিক করে হাসলাম।
সে বলল, তাজা ইলিশ খাওয়া যে এত-বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার এই প্রথম জানলাম।
আমি বলি কি;
এইটুকুতেই ও টাসকি খাইছে!
আর সে যদি এই তের কেজি ইলিশের কথা শুনতেন তাহলে নিঃসন্দেহে হার্টফেল করত। বাদশাহ সালামৎ তাও ইলিশ খেয়ে শহিদ হয়েছেন আর সে শুনেই শহিদ হত!
***
গুজরাটে ইলিশ মাছ মোদেন (স্ত্রী) বা পালভা (পুরুষ) নামে পরিচিত।
গুজরাটিয়রা পুরুষ ও মাদি ইলিশের আলাদা নাম দিয়েছে কিন্তু ইলিশের দেশ বাংলাদেশে এটা কেন মিক্সট জেন্ডারে ডাকা হয়?
যদিও ইলিশ লবণাক্ত জলের মাছ বা সামুদ্রিক মাছ,বেশিরভাগ সময় সে সাগরে থাকে কিন্তু বংশবিস্তারের জন্য প্রায় ১২০০ কিমি দূরত্ব অতিক্রম করে ভারতীয় উপমহাদেশে নদীতে পাড়ি জমায়।
ইলিশ প্রধানত বাংলাদেশের পদ্মা (গঙ্গার কিছু অংশ), মেঘনা (ব্রহ্মপুত্রের কিছু অংশ) এবং গোদাবরী(ভারত) নদীতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এর মাঝে পদ্মার ইলিশের স্বাদ সবচেয়ে ভালো বলে ধরা হয়। ভারতের রূপনারায়ণ নদী, গঙ্গা, গোদাবরী নদীর ইলিশ তাদের সুস্বাদু ডিমের জন্য বিখ্যাত।
দক্ষিণ পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশেও এই মাছ পাওয়া যায়। সেখানে মাছটি পাল্লা নামে পরিচিত। এই মাছ খুব অল্প পরিমাণে থাট্টা জেলায় ও পাওয়া যায়। বর্তমানে সিন্ধু নদীর জলস্তর নেমে যাওয়ার কারণে পাল্লা বা ইলিশ আর দেখা যায় না।
***
লিশ একটি চর্বিযুক্ত মাছ আর ইলিশে প্রচুর পরিমাণে প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড (ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড) রয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় পাওয়া গেছে এই অ্যাসিড কোলেস্টোরেল ও ইনসুলিনের মাত্রা কমিয়ে দিতে সাহায্য করে।
***
সুপ্রিয় ব্লগারবৃন্দ; ইলিশ নিয়ে বহুবছর যাবত আমার একটা প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছা ছিল। সুদীর্ঘ সময় ধরে এ বিষয়ে বিভিন্ন সূত্র থেকে অনেক তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছি- যে চেষ্টা এখনো চলমান আছে। আজ থেকে ধারাবাহিক ভাবে লেখাটি শুরু করলাম। আশা করি সুপ্রিয় ব্লগারেরা আমাকে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সর্বোতভাবে সহযোগীতা করবেন। লেখায় যে কোন ধরনের ভুলত্রুটি থাকলে দ্বিধাহীনভাবে সমালোচনা করিবেনো।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৯
২৭টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সৌদি আরব হতে পারতো বাংলাদেশে উৎপাদিত আলু'র বাজার, কেন তা হলো না?

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ১৭ ই জানুয়ারি, ২০২৫ রাত ১২:৪০

..
...
.......খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশে চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরের ১ম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) আলু রপ্তানিতে ধ্বস নেমেছে। তাই, আলু রপ্তানির নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। অন্যদিকে, ইন্টারনেট ঘেটে দেখা যায়, ২০১১... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তর মানে মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে আমাদের জীবনের ল্যান্ডমার্ক, ৩৬ জুলাই আমাদের চেতনা....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১৭ ই জানুয়ারি, ২০২৫ ভোর ৬:৪২




এই ছবিটার গুরুত্ব অপরিসীম।
কেন জানেন, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের খোলনলচে বদলের ব্লু প্রিন্ট রচনার দায় তাদের কাধে। এই ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি আর স্বাধীনতাকামীদের এক করে ফেলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারত-আফগানিস্তান কূটনীতি, ক্রিকেট ও বৈশ্বিক বাস্তবতা প্রসঙ্গে!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৭ ই জানুয়ারি, ২০২৫ দুপুর ১২:৪০


কথায় আছে শত্রুর শত্রুকে বানাতে হয় বন্ধু- এই প্রবাদ ভারত ও আফগানিস্তানের সমসাময়িক কূটনীতিক তৎপরতার প্রেক্ষিতে সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য। পাকিস্তান ও আফগানিস্তান... ...বাকিটুকু পড়ুন

জুলাই মাসে কোন আন্দোলন বা বিপ্লব হয়নি, ইহা ছিলো আমেরিকান এম্বেসীর আরেকটি ক্যু

লিখেছেন জেনারেশন৭১, ১৭ ই জানুয়ারি, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:০৫



১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট'এর পর আমেরিকান এম্বসী আরেকটি বড় ক্যু করেছিলো এরশাদকে ক্ষমতা দখলে সাহায্য করে; এরপর আরেকটি বড় ক্যু করে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটায়েছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধানসিঁড়িটির তীরে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৭ ই জানুয়ারি, ২০২৫ রাত ৮:৫৫



ধানসিঁড়িটির তীরে স্বপরিবারে ঘুরতে গেলাম। শালিক সাহেব পিছনে এসেই বসলেন। মেয়ে ছবি তুলতে গেলেই উড়ে গেলেন। বকের ঝাঁক কয়েকবার মাথার উপর দিয়ে টহল দিলেন। ছাগল ছানা খেলছিল বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×