"ল্যান্ড অফ টু রিভারস: আ হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল ফ্রম দ্য মহাভারত টু মুজিব" (২০১১) এর লেখক নীতিশ কে. সেনগুপ্ত।
***দুই বছর আগে, ১৯৬৮ সালের ১ ডিসেম্বর, পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের নেতা সিরাজ সিকদার সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতার জন্য তার থিসিস ঘোষণা করেছিলেন। কয়েক মাস পরে, ১৯৬৯ সালের এপ্রিলে, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটিও সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে জাতীয় স্বাধীনতার কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। এবং অবশেষে সাধারণ নির্বাচনের বছরে, তৎকালীন সবচেয়ে প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) ২২শে ফেব্রুয়ারী ১৯৭০ তারিখে ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে এক জনসভা থেকে 'স্বাধীন গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা' প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করে। দলের প্রাক্তন নেতা কাজী জাফর আহমেদ এবং রাশেদ খান মেনন কৃষক, শ্রমিক এবং জনগণের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতার পক্ষে প্রকাশ্যে যুক্তি দেওয়ার সময় জনগণ উল্লাস ও গর্জনে ফেটে পড়ে।
এটা স্পষ্ট ছিল যে তারা মুজিবকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছিল, যিনি তখন পর্যন্ত দুটি স্বাধীন ইউনিটের উপর ভিত্তি করে একক পাকিস্তান বজায় রাখার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিলেন।
***
*বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিয়ে আমি সত্যটা জানতে চাইছি। প্রত্যেকটা ইতিহাস কিছুটা সত্য কিছুটা ধারনার আর বাকিটা মনগড়া। হয় পুরো সত্যটা কেউ জানেনা -না হয় মানুষের স্বভাবজাত চরিত্রের মত, যে যার মতবাদ ও বিশ্বাসকে সত্য বলে চালাতে চাইছে। একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদকে আমি আজ পর্যন্ত নিরপেক্ষ পাইনি। পৃথিবীর সব বৃহৎ ও ক্ষমতাবান প্রতিবেশীই তার পাশের দেশের শত্রু হিসেবে আবির্ভুত হয়। এমন সব প্রতিবেশী দেশই চায় তার পাশের দেশ তদের তাঁবেদারি করুক, সে নিজের স্বার্থে যেমনে চাইবে তেমন চলুক, তার ব্যত্যয় হলে পাশের ক্ষুদ্র দেশটাকে গিলে খাবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আমাদের পাশের সু-বৃহৎ ও শক্তিধর দেশ ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়। ভারত রাষ্ট্র বা তার জনগণের প্রতি আমার কোন ক্ষোভ নেই কিন্তু আমার ক্ষোভ আছে এই রাষ্ট্রকে ভাঙ্গা গড়ার পেছনের কারিগরদের প্রতি কিংবা তাদের রাজনীতিবিদ ও শাসকদের প্রতি। তারা শত বছর ধরে লক্ষ কোটি মানুষের ধর্ম জাতি ভাষা জাতীয়তাবাদ আবেগ থেকে সর্বোপরি জীবন নিয়ে খেলেছে। একজন মাত্র মানুষ তার ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থের জন্য শতকোটি মানুষের জীবন জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলেছে, উচ্ছেদ করেছে তাদের মূল থেকে। অযথাই রাষ্ট্রকে বিভিক্ত করে দুই রাস্ট্রের মধ্যে চির বৈরিতা সৃষ্টি করেছে। এর পরিণতিতে হয় যুদ্ধ। ভয়ঙ্কর সেই যুদ্ধের বলি হয় সাধারণ মানুষ। ফের এই সাধারণ মানুষই একবার ক্ষমতার স্বাদ পেলে হয়ে ওঠে দানব। কেন?
রুশ ছবি 'হোয়াইট টাইগার' এর শেষাংশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রূপকার হিটলারের একটা সাক্ষাতকার চিত্রায়িত হয়েছে। সেখানে হিটলার চরম কিছু তক্ত অথচ সত্য কথা বলেছেন;
আমি সহজভাবে বলেছিলাম: এই দুটি সমস্যা সমাধান করা যাক, একবার এবং সব সময়ের জন্য তাদের সমাধান করা যাক। আমরা কি সত্যিই নতুন কিছু নিয়ে এসেছি? না! আমরা কেবল সেই প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে এসেছি যার জন্য সমস্ত ইউরোপ স্বচ্ছতা চাইছিল। যতদিন পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরবে, যতদিন ঠান্ডা ও তাপ, ঝড় ও রোদ থাকবে, ততদিন মানব জাতির মধ্যে সংগ্রাম ও সর্বদা যুদ্ধ চলতে থাকবে। পৃথিবীতে মানুষ যদি স্বর্গের সুখে বাস করত তবে তারা ধ্বংস হয়ে যেত। সংগ্রামের কারণেই মানবজাতি হয়ে উঠেছে। যুদ্ধ হল স্বাভাবিক সাধারণ জিনিস যুদ্ধ এটা চিরন্তন এবং সর্বত্র। এর কোন শুরু এবং শেষ নেই। যুদ্ধই জীবন। আদিম মানবের সংগ্রামের শুরুটাই যুদ্ধ দিয়ে।~ এডলফ হিটলার
যুদ্ধবাজ তথাকতিথ ভয়ঙ্কর সেই দানবের এই তিক্ত বচনে বিশ্বাস করতে মন চায়। আসলেই তো যুদ্ধ আমাদের নিয়তি? আমি আপনি চাই বা না চাই যুদ্ধ হবেই। দেশ ভাষা ধর্ম মতবাদ কিংবা সম্পদ অর্থ স্বার্থ অথবা লোভে। মানব জাতি আজকের মানুষ হয়ে উঠেছে যুদ্ধ কিংবা সংগ্রাম করে। তবুও আমরা যুদ্ধহীন একটা পৃথিবী চাই- আর জানতে চাই সত্যটা; সাধারণ মানুষের মধ্যের ঘুমন্ত দানবটাকে জাগিয়ে দেবার জন্য যেই সত্যগুলোকে গোপন করা হয়। আজ আমরা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনের গল্প নিয়ে আমাদের চরম এক শত্রুর মুখে কিছু কিছু তিক্ত বচন শুনব। এই নিবন্ধের কিছুটা সত্য কিছুটা ধারনার আর বাকিটা মনগড়া নিশ্চিত- তবুও এর নির্যাসটুকু নিয়ে আমরা একটা ব্লগীয় বিতর্কের সূচনা করতে পারি;
মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথা;
ভারতীয়রা আগেই সামরিকভাবে পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার সমাধান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। মিসেস ইন্দিরা গান্ধী স্পষ্ট ও সন্দেহাতীত ভাষায় তাঁর উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছিলেন। আগস্ট মাসে জেনারেল মানেকশ অপারেশন অর্ডার জারি করেছিলেন। ট্রুপস তাদের কনসেন্ট্রেশন এলাকায় চলে গিয়েছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনী তার ক্ষুদ্রতর প্রতিবেশীর দুর্বলতা ও অসুবিধার সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য তৈরি ছিল। ভারতীয়দের সুরে তাল মিলিয়ে মুক্তিবাহিনীর নৃত্যের কথা ছিল। কিন্তু ভবিষ্যতের দিকে চিন্তা করে ভারতীয়রা মুক্তিবাহিনীকে নিজেদের চূড়ান্ত শত্রু হিসেবে বিবেচনা করেছিল। তারা পূর্ব পাকিস্তান দখল করার এবং বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পরের পরিস্থিতি অনুমান করতে পেরেছিল। সুসংগঠিত ও সুপ্রশিক্ষিত একটি বাংলাদেশ বাহিনী ভারতীয় দখলের বিরোধিতা করবে। তারা ভারতীয় আধিপত্যকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাবে। সে কারণে পাকিস্তান আর্মিকে দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে দুর্বল ও ক্ষতিগ্রস্ত করার এবং তাদের বিকলাঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এটা ছিল একই ঢিলে দুই পাখিকে মারার ফন্দি- দুই পাখিই ছিল মুসলমান। সমগ্র সীমান্ত জুড়ে এবং দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীকে শর্ট অফেন্সিভ অপারেশনে পাঠানো হয়েছিল। নিম্নবর্ণিত আকারে মুক্তি বাহিনীর আক্রমণ ভারতীয়দের 'কাঙিক্ষত' ফলাফল অর্জন করেছিল;
ক. বিরাট সংখ্যক মুক্তিবাহিনী নিহত হয়েছিল। কারণ তাদেরকে খুবই সামান্য গোলাবারুদের সমর্থন দেয়া হয়েছিল।
খ. পাকিস্তান আর্মিকে আরো বাইরের দিকে টেনে নেয়া হয় এবং বিরামহীনভাবে পাল্টা-আক্রমণ চালাতে গিয়ে তারা ক্লান্তও হয়ে পড়ে। ভারতীয় আর্মি যখন আক্রমণ চালায়, ততদিনে বিশ্রামের অভাবে পাকিস্তান আর্মি পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল।
গ. ভারতীয় আর্মির কোনো ব্যয় ছাড়া পাকিস্তানের অভ্যন্তরে চূড়ান্ত আক্রমণ চালানোর আগেই ভারতীয়রা অপারেশনের ঘাঁটি পেয়ে গিয়েছিল। এই ঘাঁটিগুলো তারা মুক্তি বাহিনীকে অনুপ্রবেশ করানোর মাধ্যমে পেয়েছিল
ভারতবর্ষ বিভক্তির আগে ও পরের কথাঃ
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছিল তার সঙ্গে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন-এই চারটি দেশ জড়িত ছিল, কেউ ঘনিষ্ঠভাবে এবং অন্যরা পরোক্ষভাবে। প্রথমোক্ত দেশ দুটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল, পাকিস্তানের বন্ধু হিসেবে পরিচিত বাকি দুটি দেশ আমাদের শীর্ষ নেতৃত্বের অপটু পরিচালনার কারণে নিরপেক্ষ অবস্থা নিয়েছিল।
ভারতীয় নেতৃত্ব অত্যন্ত অনীহার সঙ্গে পাকিস্তানের সৃষ্টিতে সম্মত হয়েছিলেন এই আশায় যে, নতুন দেশটি ছয় মাসের বেশি টিকে থাকতে পারবে না। তারা এর ভাঙনকে ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন। রাজনৈতিকভাবে তারা মাউন্টব্যাটেনকে দিয়ে যতটা সম্ভব পাকিস্তানকে ছেঁটে ছোট করেছিলেন। অর্থনৈতিক দিক থেকে পঞ্চাশ কোটি রুপীর হিস্যা তারা যতদিন সম্ভব আটকে রেখেছিলেন যাতে দেশটির অর্থনৈতিক পতন ঘটে। মিলিটারি ফ্রন্টে তাঁরা সেই সব লোকজনকে ভারত, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় যতদিন সম্ভব আটকে রেখেছেন, যাদের দিয়ে পাকিস্তান আর্মি গঠিত হওয়ার কথা ছিল। পরে তাদের মুক্তি দেয়া হলেও খণ্ডিতভাবে বা ভাগে ভাগে ছাড়া হয়েছিল। শরণার্থীদের এক বিরাট বোঝা চাপানো হয়েছিল পাকিস্তানের ওপর। অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটানোর উদ্দেশ্যে দেশত্যাগী হিন্দুরা তাদের সঙ্গে সকল অর্থ নিয়ে গেছে। পাকিস্তানের টিকে যাওয়াটা এর সৃষ্টির মতোই ছিল এক অলৌকিক ঘটনা।
পাকিস্তানের প্রতি ভারতীয় মানসিকতা সম্পর্কে একটি যথার্থ বর্ণনা দিয়েছেন পাশ্চাত্যে একজন ঐতিহাসিক-কিভাবে ভারতীয়রা পাকিস্তানের সমাপ্তি ঘটাতে চেয়েছিল। "ইন্ডিয়া পাকিস্তান অ্যান্ড বিগ পাওয়ার' গ্রন্থে বিষয়টির ওপর লিখতে গিয়ে উইলিয়াম জে বার্নড ভারতীয় নেতৃবৃন্দের চিন্তাধারা বিশ্লেষণ করেছেন এভাবে: "ভারতীয় নেতারা নিশ্চিত ছিলেন যে পাকিস্তান একটি জাতি হিসেবে টিকে থাকতে পারবে না। দেশের দুই প্রদেশের মধ্যে দূরত্ব, ভাষা ও সংস্কৃতির পার্থক্য, শিক্ষিত প্রতিভাবানদের স্বল্পতা এবং প্রাকৃতিক সম্পদে দেশটির ভবিষ্যতের ব্যাপারে আস্থার প্রেরণা যোগায় নি। উপরন্তু ভারতীয় নেতারা বিশ্বাস করতেন যে, এটা টিকে থাকে পারবে না, কারণ এর টিকে থাকা উচিত নয়।” বার্নডস-এর ভাষায় নেহরু পাকিস্তানে 'একটি অসম্ভব মোল্লাতান্ত্রিক ধারণাভিত্তিক এক মধ্যযুগীয় রাষ্ট্র' হিসেবে বর্ণনা করে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেনঃ "পাকিস্তানের সঙ্গে যতটা ঘনিষ্ঠভাবে সম্ভব সহযোগিতা রাখা অত্যন্ত স্বাভাবিক হলে এবং একদিন অঙ্গীভূতকরণ ঘটবে। এটা চার, পাঁচ কিংবা দশ বছরে ঘটবে কিনা আমি জানিনা।” নেহরুর উপরোক্ত বক্তব্য উদ্ধৃত করতে গিয়ে বার্নডস প্রশ্ন করছেন, "ভারত অফিসিয়ালরা কিভাবে দু'দেশের পুনর্মিলনের ছবি এঁকেছিলেন কিনা সেকথা পরিষ্কার নয়।"
আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়কে কেবল নয়, নিজের দেশের জনগণকেও নেহরু প্রতারিত করার চেষ্টা করেছিলেন। 'পাকিস্তানের সঙ্গে যতটা ঘনিষ্ঠভাবে সম্ভব সহযোগিতা রাখা' নেহরুর কর্মসূচী ছিল না, বরং পাকিস্তানকে মাথা নত করতে বাধ্য করা এবং সমগ্র পৃথিবী থেকে যত বেশি সম্ভব শক্তি সংগ্রহ করে সেই শক্তি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করাই ছিল নেহরুর পরিকল্পনা। পাকিস্তানে বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের কর্মসূচীর সূচনা হয়েছিল দেশ দুটি সৃষ্টি হওয়ার অব্যবহিত পরেই এ ১৯৪৭ সালেই।
ভারতীয়রা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও মিলিটারি কৌশলের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছিল এবং সে কারণে তারা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের দিকে তাদের কৌশলের দিক পরিবর্তন করেছিল। এই উদ্দেশ্যে যে অঞ্চলটিকে বেছে নেয়া হয়, তা ছিল পূর্ব পাকিস্তান।
এ ব্যাপারে তারা সেখানে বসবাসরত হিন্দুদের সহযোগিতা নিয়েছিল, বিশেষ করে শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসহ নির্দিষ্ট কতগুলো ক্ষেত্রে নিজেদের অশুভ প্রভাব বিস্তার করার মতো অবস্থানে ঘটনাক্রমে এই হিন্দুরা ছিল। তাদের মাধ্যমে ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানীদের মনকে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিষিয়ে তুলতে শুরু করেছিল। এটাই ছিল সেই এলাকা যেখানে ভারতীয়রা সাফল্য অর্জন করতে পেরেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের বিশেষ কতিপয় নেতা এ ধরনের প্রচারণা গ্রহণে উন্মুখ হয়ে উঠেছিলেন এই আশায় যে, এটা ক্ষমতা অর্জনে তাঁদের সাহায্য করবে। এর ফলাফল ছিল আন্দোলনের জন্ম, ভাষা দাঙ্গা, পশ্চিম পাকিস্তানীদের হত্যাকাণ্ড এবং শেষ পর্যন্ত বল প্রয়োগের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান দখল করার ষড়যন্ত্রকে এগিয়ে নেয়া। পাকিস্তানের শাসকরা কোনোদিনই পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারেন নি, তারা বরং ক্ষমতায় পূর্ব পাকিস্তানীদের ন্যায়সঙ্গত হিস্যাকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে আগুনে আরো ইন্ধন যুগিয়েছেন।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় ভারতীয়রা কোনভাবেই পূর্ব পাকিস্তানকে আক্রমণ চালানোর মতো অবস্থায় ছিল না। তারপরও আমাদের কিছু কিছু নেতা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার জন্য চীনকে কৃতিত্ব দিয়েছিলেন। এই বিষয়টিকে পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করে ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানীদের বুঝিয়েছিল যে, পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের থাকাটা অর্থহীন।
১৯৭০-এর নির্বাচনের পর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়, যার পরিণতি ছিল মিলিটারি আ্যকশন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দেন এবং কোলকাতা চলে যান। ভারতীয়রা তাদেরকে সকল সুযোগ-সুবিধার যোগান দেয়। তারা হিন্দুদেরকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসতে এবং সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যেতে বলে, যেখানে আগে থেকেই তাদের স্বাগত জানানোর এবং থাকার আয়োজন করা হয়েছিল। এর পরপর অনতিবিলম্বে অন্তত তিন ডজন প্রশিক্ষণ শিবিরে বিপুল সংখ্যায় মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়, যার দায়িত্বে ছিলেন নিয়মিত আর্মির একজন মেজর জেনারেল। এমন কি নিয়মিত আর্মি অফিসারদের ট্রেনিং স্কুলগুলোকেও পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহী অফিসারদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল।
এটাকে একটি প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। ভারত উল্টো এই বলে শোরগোল তুলেছিল যে, শরণার্থীদের বোঝা তার অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করছে এবং দর কষাকষির পর্যায়ে সে তার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিলিয়ন ডলারের সাহায্য পেয়ে গেছে। ভারতীয় সরকার ভারতের অভ্যন্তরে এবং বিশ্বব্যাপী পাকিস্তানকে নিন্দিত করার উদ্দেশ্যে নৃশংসতার মনগড়া কাহিনী প্রচার করতে থাকে এবং পাকিস্তানকে একটি দুষ্কৃতকারী ও অসভ্য, বরং বর্বর একটি জাতি হিসেবে চিত্রিত করে। তথ্য মাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকায় ইহুদীরা সর্বাত্মকভাবে ভারতকে প্রচারণায় সহযোগিতা করেছিল।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যাপারে সক্রিয় সোভিয়েত সমর্থন জয় করার পর ভারতের গৃহীত অবস্থানের ন্যায্যতা সম্পর্কে অন্য জাতিদেরকে বোঝানোর উদ্দেশ্যে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বিশ্ব সফরে বেরিয়েছিলেন। তিনি এত বেশি ধূর্ত ও প্রতারণাপূর্ণ ছিলেন যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে তিনি যখন তার শাক্তিপূর্ণ পরিকল্পনার ব্যাপারে আশ্বস্ত করছিলেন, তাঁর সেনাবাহিনী তখন এমন এক প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের চারদিকে সমাবেশ ঘটিয়েছিল, যে প্রতিবেশীটি দুর্ভাগ্যক্রমে তখন অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত এবং ইতিহাসের ঐ বিশেষ সময়টিতে যে দুর্বল ছিল।
মিস্টার সুব্রামনিয়মের নেতৃত্বে ভারতীয় কৌশলবিদরা অম্লানবদনে ভারত সরকারকে 'শতাব্দীর সুযোগটিকে কাজে লাগানো'র উপদেশ দিয়েছিলেন। অবশ্য কিছু সংখ্যক ব্যক্তি উপ- জাতীয়তাবাদকে সমর্থনের বিপদ সম্পর্কেও সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কারণ সে ক্ষেত্রে ভারতের জাতিগুলোও স্বাধীন মর্যাদার দাবি উপস্থাপন করবে এবং যার ফলে ভেতর থেকে অন্তত এক ডজন রাষ্ট্রের সৃষ্টি ঘটবে। কিন্তু মিসেস গান্ধী ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে জয় লাভ করতে চেয়েছিলেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে একটি সহজ বিজয় অর্জন করা তার দরকার ছিল, যা তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন এবং যার প্রলোভন কোনো রাজনীতিবিদের পক্ষেই হাতছাড়া করা সম্ভব নয়।
ভারতীয়দের বিশ্বশক্তিতে পরিণত হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। হিন্দুকুশ থেকে ইন্দোনেশিয়ার বালি পর্যন্ত ভূমি নিয়ন্ত্রণ করার এবং আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলসহ সমগ্র ভারত মহাসাগরের ওপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য তাদের স্বপ্ন রয়েছে। তারা নিজেদেরকে বৃটিশ সম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করে এবং মনে করে যে, সমরকন্দ ও বুখারার প্রাক্তন এশিয়াটিক রাজ্যসহ মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে ইরান-ইরাকের ওপর প্রভাব খাটানোর অধিকার তাদের রয়েছে তারা মনে করত যে, পূর্ব দিকে প্রভাব বিস্তারের পথে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিমে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তান তাদের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। তারা হয়তো দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠতম শক্তি হিসেবে বিবেচিত ও গৃহীত হতে চায় এবং চায় যে, এই অঞ্চলের সকল দেশ তাদের আধিপত্যের অধীনে আসুক। তারা চারটি দুর্বল ও ক্ষুদ্র মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকে স্বাগত জানাবে। এ রকম ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের সংখ্যা যত বেশি হবে, তত দুর্বল হবে মুসলমানদের প্রভাব ও শক্তি। এ সব কিছুর পেছনে যে বিবেচনাটি সর্বোচ্চ হিসেবে ছিল এবং রয়েছেও, তা হল পাকিস্তানকে দুর্বল করে ফেলা, একে ছোট ছোট টুকরো করা।
এর সূচনা হয়েছিল কাশ্মীরকে দখল করার মধ্য দিয়ে এবং দ্বিতীয় পর্যায়টি চূড়ান্ত করা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে, বল প্রয়োগ করে পূর্ব পাকিস্তানকে তার পশ্চিমের অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে। প্রকাশ্য দিবালোকে প্রকাশ্যে ডাকাতির মতো এই কাজ করার পাশাপাশি ভারতীয় লেখক ও বিশ্লেষকরা অচিরেই একে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, "এটা ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা, ২৫ বছর আগে অর্জিত স্বাধীনতাকে আরো এক ধাপ সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া।" বাংলাদেশের সৃষ্টিতে নিজেদের ভূমিকা স্বীকার করতে গিয়ে ভারতীয়রা তাদের লজ্জার মুখোশকে গোপন করেন নি, বরং জোর দিয়ে বলেছেন, "এ ভাবে যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে ভারত অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় নিজেকে অনেক বেশি নিরাপদ করেছে।" সময় সম্ভবত একে ভিন্ন চেহারা দেবে।
পাকিস্তানকে তারাই 'পঙ্গু' হিসেবে বিবেচনা করত, যারা একে একটি অসম্ভবে পরিণত করার জন্য কঠোর সংগ্রাম করেছে, বিশেষ করে হিন্দু ও ইংরেজরা ছিল এ ব্যাপারে বেশি সক্রিয় উপমহাদেশকে ভারত ও পাকিস্তানে বিভাগকালে পাকিস্তানকে অরক্ষিত বা আক্রমন করার উদ্দেশ্যে সকল প্রচেষ্টাই চালানো হয়েছিল। এর অরক্ষণীয়তা ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে যে অঞ্চলিক ঘটনা- যে যুগটি সংকীর্ণ ভৌগোলিক ধারণার ভেতরে নতুন নতুন জাতি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় প্রত্যক্ষ করছিল। পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের ভিত্তিতে জাতীয়তার মতবাদের ওপর এবং তার ফলে একটি নতুন বিস্ময়কর বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। এ কারণেই কোনো শক্তিই এমন একটি দেশের জন্মকে উপেক্ষা করতে পারেনি। যে দেশটি পৃথিবীর বুকে একটি প্রজাতি হিসেবে মানুষের অগ্রগতির ক্ষেত্রে নিজের অবদানের ব্যাপারে পেছনের দিকে তাকানোর মতো যোগ্যতা রাখতো। স্পষ্টত এ জন্যই ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট সংখ্যা লন্ডনের 'দ্য টাইম' তার সম্পাদকীয়তে পাকিস্তানের জন্মের প্রশংসা করেছিল। পত্রিকাটি লেখে, “সৃষ্টিকালে পাকিস্তান মুসলিম বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তুর্কী সাম্রাজ্যের পতনের পর মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এই মুসলিম বিশ্বে এমন কোনো দেশ অন্তর্ভুক্ত হয়নি, যার সংখ্যা, প্রাকৃতিক সম্পদ ও ইতিহাসের অবস্থান তাকে অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠতা দেবে। সেই শূন্যতা এবার পূর্ণ হল। আজ থেকে করাচী মুসলিম ঐক্যের নতুন কেন্দ্রের অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং মুসলিম ধ্যান-ধারণা ও আকাঙ্ক্ষার মিলন স্থলে পরিণত হচ্ছে।"
প্রথম পর্ব সমাপ্ত।
একটা প্রশ্নঃ স্বাধীনতার পরে ভারতীয়দের হাতে বন্দী পাকিস্তানী সেনারা পাকিস্তানে ফিরে যাবার আগে কতদিন ভারতে বন্দীজীবন কাটিয়েছেন- আপনি জানেন কি?
****
মুল লেখাঃ মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান ( 'How Pakistan Got Divided ' গ্রন্থ)
ভূমিকাঃ মুনতাসীর মামুন
(সার সংক্ষেপ ও অনুলিখনঃ শেরজা তপন)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০২৫ বিকাল ৩:২৫