somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুন্দরবনের টারজান

১৯ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ১১:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জাহাজের ডেকে মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়িয়ে টুরিস্টদের উদ্দেশ্যে ইংরেজী বাংলা মিশিয়ে কথা বলছেন মি: ফারুক। সুন্দরবন নিয়ে যে প্রশ্নই তাঁকে করুন না কেন সব তাঁর জানা। সুন্দরবনের ইকো সিস্টেম, বন ভিত্তিক অর্থনীতি, সুন্দরবন থেকে অর্জিত রেভিনিউ, বনের প্রশাসনিক বিভাজন, বনে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড অথবা বন দস্যুদের রুট, নিপিড়িত বাওয়াল-মৌয়ালদের কথা, জোয়ার-ভাটার হিসেব নিকেশ, বাঘের পরিসংখ্যান, হরিণের আবাস, এবং পাখিদের প্রাপ্তি ও প্রজনন ঋতু সবই তার জানা। লোকটা যেন একটি জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া অব সুন্দরবন। আমি মনে মনে তার জন্য একটি নাম খুঁজছিলাম এবং সাথে সাথে এমন একটি প্রশ্নও খুঁজছিলাম যার জবাব তার পক্ষে দেয়া সম্ভব হবে না। ভাবতে ভাবতে আমার মাথায় একটি দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। একটি প্রশ্ন আমি পেয়ে গেলাম। আমি নিশ্চিত যে, এ প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে পারবেননা। আমি খুব কায়দা করে প্রশ্ন করলাম –
- আচ্ছা ফারুক ভাই! আপনি কতবার সুন্দরবন এসেছেন তা কি বলতে পারবেন?
- (মুচকী হেসে) অফিসিয়াল রেকর্ড আছে আঠারো হাজার বার। এর বাইরেও ছোটবেলায় বাবার সাথে অনেক বার এসেছি।
(* সংশোধনী: মূল লেখায় ভুলে আঠারো হাজার বার লেখা হয়েছে এটা ভুলক্রমে হয়েছে। এখন টারজানের সাথে কথা বলে কনফার্ম হওয়া গেছে যে সংখ্যাটি আঠারো শো-বার। অনাকাংখিত ভুলোর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। - লেখক)

অভিজ্ঞতার আলোকে বুঝে নিলাম ওনাকে ঘাটতে না যাওয়াই উত্তম। অতপর: তিনদিন তাঁর সাথে সুন্দরবনে কাটালাম। অনুভব করলাম সুন্দরবন সম্পর্কে তার ভালবাসার গভীরতা আর জ্ঞানের ব্যপকতা। বনের ভিতর তার চলাচল ও আচরণ দেখে আমার ৮ বছরের মেয়ে প্রশ্ন করলো, “বাবা আংকেল কি টারজান?” মেয়ের প্রশ্নে আমি ফারুক সাহেবের জন্য যে নামটি খুঁজছিলাম তা পেয়ে গেলাম। আমি বললাম, “হ্যা মা উনি টারজান। হি ইজ দ্যি টারজান অব সুন্দারবান।”

টারজান ১৯৮৫ সালে অফিসিয়ালী ট্যুর বিজনেস শুরু করেন। সুন্দরবন ভ্রমন বিপদ সংকুল হওয়ার কারনে শুরুর দিকে স্থানীয় পর্যটকরা ‍সুন্দরবন ঘুরতে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। বিদেশী কিছু পর্যটক যারা বোটানিস্ট ও জুয়োলজিস্ট তারা মাঝে মাঝে সুন্দরবনে আসতেন তাদের পেশাগত বা গবেষণার কাজে। এভাবেই শুরু। এরপর বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন সুন্দরবন দেখতে আগ্রহী পর্যটকদের পাঠাতেন টারজানের কাছে। শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রায় বারো হাজার বিদেশী পর্যটক ও গবেষকদের তিনি সুন্দরবন ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। দেশী বিদেশী মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাঁশ হাজার পর্যটক তার মাধ্যমে সুন্দরবনের সাথে পরিচিত হয়েছেন। পর্যটনের কাজ করতে গিয়ে তিনি বাঘের সামনেও পড়েছেন বেশ ক’য়েক বার। একবারতো একেবারেই সামনা-সামনি বাঘের মুখে। সু-সংবাদ যে, তিনি এখনো বেঁচে আছেন।

ভাড়া করা শীপ দিয়ে পর্যটনের কাজ শুরু করে বর্তমানে টারজান তিনটি নিজস্ব ভ্যাসেল দিয়ে দেশী বিদেশী পর্যটকদের সুন্দরবনে ভ্রমন সেবা প্রদান করছেন। সাথে আছে বেশ ক’টি জালি বোট (ইঞ্জিনওয়াল নৌকা) এবং টুরিস্টদের যে কোন ইমার্জেন্সি ফেস করার জন্য উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন স্পীড বোট। সুন্দরবনে ভ্রমন সেবা প্রদান করার জন্য তাঁর সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে প্রায় ১৫০ জনের একট দল কাজ করছে। প্রতি বছর তিনি বাংলাদেশ সরকারকে রেভিনিউ প্রদান করছেন ৫ থেকে ৭ লক্ষ টাকা।

এছাড়াও তিনি সুন্দরবন ভিত্তিক বিভিন্ন গবেষণায় বাংলাদেশ সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সরকারকে সহযোগিতা করেছেন বাঘের পরিসংখান ও সুন্দরবনের মৃত্তিকা গবেষণার কাজে। পরিবেশ গবেষণায় পাশে ছিলেন পরিবেশবাদীদের। সিডর এবং আইলায় তার ভ্যাসেল এবং তিনি নিয়োজিত ছিলেন দূর্গত এলাকায় ত্রাণ ও বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহের কাজে।

আন্তর্জাতিক অংগনে আমাদের টারজান পরিচিত টাইগার ম্যান হিসেবে। গত বছর তিনি বোম্বের একটি সিনেমার সুটিং-এ সহযোগিতা প্রদান করেছেন। সিনেমার নাম: রো অব টাইগার অব সুন্দরবন। পরিচালক: কামাল সানি। সিনেমাটির সম্পাদনা প্রায় শেষ, খুব শিগ্রি মুক্তি পাবে।

সুন্দরবনের বাঘ রক্ষা করার জন্য তিনি ন্যাশনাল জিওগ্রাফির ডকুমেন্ট্রি মেকিং টিমের সাথে যুদ্ধ করেছেন। বাঘের গলায় জিপিএস বেল্ট পরানোর প্রতিবাদ করেছেন। এমনকি তাদের প্রতিহত করতে তাদের ক্যামেরাও কেড়ে নিয়েছেন। ডকুমেন্ট্রি করার জন্য বাঘকে অচেতন করা ও বিশাক্ত টোপের ব্যবহার বন্ধ করানোর জন্য তিনি লন্ডন পর্যন্ত গিয়েছেন। তিনি তার টুরিস্ট টিমে সবার পেছনে থাকেন। টুরিস্টদের কেউ বনের ভেতর কিছু ফেললে তিনি নিজে তা উঠিয়ে নেন এবং ময়লা আবর্জনা ফেলার নির্দিষ্ট স্থানে এনে তা ফেলেন। টারজানের মতে সুন্দরবন আমাদের “মা”। এই বন না থাকলে আমরা বাঁচতাম না। প্রতি বছর সিডর-আইলা হতো। মা তার কোলের ভিতর আমাদের আগলে রেখেছেন। আমাদের অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন।

টারজানের সাথে তিনদিন সুন্দরবনে কাটিয়ে আমার নিজের কাছে আমি নিজে বারবার একটি প্রশ্নই করছি “টারজানের মতো করে আমরা কবে ভাবতে শিখবো, সুন্দরবন কবে আমাদেরও মা হবে?”

সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ২:৫২
১১টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×