দুই দশক আগে, ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ তার ইরাক আগ্রাসনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোশেশ করছিলেন- যা শেষতক অপারেশন ডেজার্ট স্ট্রম হয়ে ইরাকে হাজির হয়। সিনিয়র বুশের ইচ্ছা ছিলো সর্বসম্মত ভিত্তিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছ থেকে যুদ্ধের পক্ষে অনুমোদন আদায় করে নেয়া- ঠিক যেমন তার একদশকেরও বেশি সময় পর, ২০০২ সালে তার ছেলে জুনিয়র বুশ চাইছিলেন একই অনুমোদন, একই কায়দায়। জুনিয়র বুশ বিরোধিতার মুখে তার অবৈধ যুদ্ধের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন আদায় করতে না পেরে আর ওমুখো হননি- কিন্তু তার বিপরীতে নব্বই-এ সিনিয়র বুশ যুদ্ধের পক্ষে পরিষদ সদস্যদের রাজি করাতে মোটা অংকের ঘুষ এবং রাজনৈতিক ছাড় দিতে রাজি ছিলেন।
দুনিয়াখ্যাত পাকিস্তানী রাজনৈতিক বিশ্লেষক একবাল আহমদ যে ঘুষ ও ছাড়কে বলেছিলেন- ‘একতরফা যুদ্ধের বিনিময়ে বহুপাক্ষিক লজ্জা নিবারনী’। উল্লেখ্য ইংরেজিতে একবাল ব্যবহার করেছিলেন ‘ফিগ-লিফ’ শব্দটি। ফিগ এর সরাসরি অর্থ হলো ডুমুর গাছ। বাইবেল ভিত্তিক সাহিত্যে বলা হয় যে, শয়তানের প্ররোচনায় যখন স্বর্গ থেকে বহিস্কৃত হন প্রথম মানব ও মানবী- অ্যাডাম ও ইভ; তখন খোদা কর্তৃক অভিশপ্ত দুজন নিজেদের লজ্জাস্থান ঢাকতে ডুমুরের পাতা ব্যবহার করেছিলেন।
ওই পরিকল্পনার অংশ হিসাবে নিরাপত্তা পরিষদের গরীব ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর জন্য অর্থনৈতিক সহযোগিতা ঘোষণা করা হয়। স্বস্তায় সৌদি আরবের তেল কেনার সুযোগ দেয়া হয় ওই দেশগুলোকে। যেসব দেশে সামরিক সহযোগিতা করতে যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরে অস্বীকার করে আসছিল- সেসব দেশে অর্থ ও কৌশলগত সহযোগিতার থোক বরাদ্দ দেয়া হয়- এমনকি গৃহযুদ্ধ অথবা রাষ্ট্রের সর্বস্তরে দুর্নীতি ও নাগরিকদের ওপর দমন-নিপীড়ন চালু আছে, এমন সব দেশকেও যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করে। এই সহযোগিতার বিনিময়েই কলম্বিয়া, ইথিওপিয়া এবং জায়ার-এর সরকার যুদ্ধ প্রস্তাবে ‘হ্যাঁ’ ভোট দেয়। এয়াড়া, যুদ্ধ প্রস্তাবের প্রতি সবচেয়ে বড় হুমকি বলে যাকে বিবেচনা করা হচ্ছিল- ভেটো ক্ষমতাওয়ালা সেই চীনের সাথে ফের কূটনৈতিক সম্পর্ক পাতানো ও দেশটির উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদী সহযোগিতা করার ঘোষনা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
বাকি ছিল দুই দেশ; একটি কিউবা। কিউবা যদিও ইরাক কর্তৃক কুয়েতে আগ্রাসনের বিরোধিতা করে নিরাপত্তা পরিষদের আনা সর্বসম্মত নিন্দা প্রস্তাবে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ছিল দেশটি। পরিষদে যুদ্ধ প্রস্তাবে অপর ‘না’ ভোটটি এসেছিল এসেছিল আরব বিশ্বের সবচেয়ে দারিদ্র্য পীড়িত দেশ ইয়েমেনর তরফ থেকে। দীর্ঘ দশ বছর ধরে চলা একটি নৃশংস গৃহযুদ্ধ শেষে পুনরায় একত্রিত দেশটি তখন নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিল। আমেরিকান হামলার হুমকির মুখে আরব দুনিয়া তখন বিভক্ত হয়ে পড়েছিল- সেই সময় পরিষদের একমাত্র আরব সদস্য হিসাবে নিজের অঞ্চলে আগ্রাসনের অনুমোদন দেয়ার কোনো উপায় ইয়েমেনের ছিলনা।
ইয়ামেন ‘না’ ভোট দেয়। ইয়ামেনের প্রতিনিধি আবদুল্লাহ আল-আশতাল হাত নামানোর সঙ্গে সঙ্গেই তার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন কূটনীতিক, বলেছিলেন, ‘এ পর্যন্ত পরিষদে দেয়া ‘না’ ভোটগুলোর মধ্যে এই ভোটটিই আপনাদের জন্য সবচেয়ে বেশি বিপদ ডেকে আনবে’। চালু থাকা মাইক্রোফোনে আমেরিকান দূতের এই মন্তব্য পরিষদের সবাই শুনতে পায়। পরিষদ হয়ে পুরো জাতিসংঘ সদর দফতরে সবার কানে পৌছে যায়। এবং সংবাদ মাধ্যমের সুবাদে খুব তাড়াতাড়িই এই মন্তব্য দুনিয়াজুড়ে প্রচারিত হয়। অনেক সাংবাদিক ও বিশ্লেষক যুক্তরাষ্ট্রের দূতকে ‘আনাড়ীপনা’র দায়ে দায়ী করে তাকে ভৎর্সনা করেছিলেন। তারা বলছিলেন ওই পর্যায়ের একজন কূটনীতিক হিসাবে তার অন্তত মাইক্রোফোন চালু থাকার বিষয়টি ভুলে যাওয়া উচিত ন।
কিন্তু আমরা মনে করি, আমেরিকান দূত মোটেই ‘আনাড়ী’ছিলেন না, বেখেয়াল তো নয়ই। তিনি যা করেছেন জেনেবুঝেই করেছেন, সচেতনভাবে। ইয়েমেনের দূতকে তিনি যা বলেছিলেন তার লক্ষ্য শুধু ইয়েমেন ছিল না। মূলত সারা দুনিয়াকে তিনি সেটা জানাতে চেয়েছিলেন। কাজেই মাইক্রোফোনের সাহায্য ছাড়া এই জানানোর কাজটি করা সম্ভব ছিল না। ইয়ামেন অথবা ইয়েমেনি জনগন কি চিন্তা করছে বা কি করতে যাচ্ছে তা ওই সময় ওয়াশিংটনের কেউই পাত্তা দেয়ার প্রয়োজন মনে করেন নি। যুক্তরাষ্ট্রের বার্তাটি ছিল তামাম দুনিয়াকে লক্ষ্য করে, বিশেষত ওই সমস্ত দেশ যাদেরকে নিজের সম্ভাব্য বিরোধিতাকারী মনে করতো যুক্তরাষ্ট্র। বার্তা পরিষ্কার: যদি কোনো গুরুত্বপূর্ন ইসুতে আপনি আমাদের আগে বাড়তে যান তবে তার খেসারত দিতে হবে। প্রকৃত অর্থেই, ইয়ামেনের জনগণ খুব বেশি খেসারত দিতে বাধ্য হয়েছে। ভোটাভুটির তিন দিন পরেই ওয়াশিংটন তার হুমকি কার্যকর করে এবং ইয়ামেনের জন্য বরাদ্দকৃত সব অনুদান বাতিল করে, যার পরিমাণ ছিল সাত কোটি ডলার। আজও জাতিসংঘের অনেক দূত ও কর্মকর্তা অস্বস্তির সাথে ‘ইয়েমেনি নজির’-এর বরাত দেন।
কুড়ি বছর পর ফের ইয়েমেনকে সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইয়ামেনের জন্য ৭০ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু এটা ওষুধ, বাড়ি নির্মাণ অথবা কারিগরি প্রশিক্ষনের জন্য খরচ করা হবে না। কোন আমেরিকান বিশেষজ্ঞ পানি বিশারদ, ডাক্তার কিংবা ধাত্রী আসবে না এই সহযোগিতার অংশ হিসাবে। যা হওয়ার কথা ছিলনা নব্বইর সহযোগিতায়ও। বরং এই অর্থ ব্যয় করা হবে ‘সন্ত্রাস বিরোধী’ কার্যক্রম এবং নিরাপত্তা শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে। আমেরিকানরা আসবে, তবে আসবে সামরিক প্রশিক্ষক ও নানা ধরনের বিশেষ বাহিনীর সদস্য হয়ে। যেমনটি আসার কথা ছিল নব্বই-এ।
ফারাক শুধু এই যে, নব্বই এই সহযোগিতার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল একটি আগ্রাসনের পক্ষে ইয়েমেনের সমর্থন আদায়ের জন্য টোপ হিসাবে। আর এখনকার সহযোগিতার উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অবস্থান জোরদার করা। ইতিমধ্যেই একজন যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাবেক কারাবন্দী গত বছরের বড়দিনে বিমানে ব্যর্থ হামলা চালিয়েছে, হামলা চালানোর আগে সে ইয়েমেনে এসেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য হচ্ছে, হামলাকারী মোতালেব যেহেতু ইয়েমেনে আসার পর এমন আক্রমন করতে উদ্যত হয়েছে, কাজেই সে নিশ্চয় দেশটিতে আল-কায়েদার সাথে যোগাযোগ করেছিল। মানে ইয়েমেনে আল-কায়দার উপস্থিতি আছে। অর্থাত ইয়েমেনের দক্ষিনে যে হুশি যোদ্ধাদের সাথে ও উত্তরে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী যোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধ করছে সরকার, তাদের মাঝে আল-কায়দা আছে। দেশটিতে আল-কায়দা প্রমানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট গত বুধবার আরো জানিয়েছে যে, তাদের কাছে থাকা দলিলাদি মোতাবেক দেখা যাচ্ছে গত একবছরে তাদের ছত্রিশ জন কারামুক্ত অপরাধী ইয়েমেনে এসেছে, যারা কারাগারে থাকার সময় ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছিল। এবং এই নওমুসলিমরা ইয়েমেনে এসে আল-কায়দার সাথে যোগ দিয়েছে। মানে সবমিলিয়ে ইয়েমেন এখন আল-কায়দার বিমারে আক্রান্ত।
কাজেই কুড়ি বছর আগেকার সহযোগিতার টোপ না গিললেও এখনকার সহযোগিতার দাওয়াই না খেয়ে ইয়েমেন আর কি করতে পারে? যদিও গত যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটির দাবির পরদিনই, গত বৃহস্পতিবার সেপ্টেম্বর ২৬- ইয়েমেনের একটি সরকারি সংবাদপত্র জানিয়েছে যে, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র সহ আরো কয়েকটি পশ্চিমা দেশের নাগরিকদের আর অন-অ্যারাইভাল ভিসা ইসু করবে না ইয়েমেন। ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইয়েমেনে এসে আল-কায়দা হয়ে যাওয়া’র মতো ঘটনা এড়াতেই খুব সম্ভবত এই সিদ্ধান্ত নিল দেশটি।
-------------------------------------------------------------------------
প্রাসঙ্গিক পোস্ট :
আবদুল মোতালিব কাহিনী । সাজানো গোয়েন্দা কাহীনির দুর্বলতাগুলো
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ৩:১৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




