বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ আঁকছিলাম তখন। রঙের প্লেটে রং গুলিয়ে তাতে তুলি ডুবিয়ে কয়েক আঁচড় দিলাম নীল ক্যানভাসে। কালচে সাদা সাথে সাথে হামলে পড়ল আকাশ জুড়ে; গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ল গলে গলে। আকাশের মন খারাপ হয়ে গেল সাথে সাথে। তারপর হুহু করে বাতাস ঢুকতে লাগল থাইগ্লাসের ফাঁকফোকর দিয়ে। জানলাগুলো বন্ধ হতে লাগল একটার পর একটা। বারান্দায় মেলে রাখা ভেজা কাপড়গুলো ঘরে ফিরে এলো খুব দ্রুত। তারপর বৃষ্টি চলেই এলো।
আমি ভাবছিলাম রবীন্দ্রনাথের কথা--ধরণীর গগনের মিলনের ছন্দে।
(অথচ আকাশকে তখন খুব বিষণ্ণ লাগছিল। আর দোতলার গ্রীলবারান্দা থেকে 'ধরণী'কে তো আর ভালো করে দেখাও যায় না!)
কিন্তু তারচেয়ে বেশি হার্বার্টের চিত্রকল্পটাই টানছিল। দিনের আলোর প্রাচীরটানা আকাশ-মর্ত্যের রাতের আঁধারে একাকার হয়ে যাওয়া।
আমার খুব ইচ্ছে করছিল রবীন্দ্রনাথকে জিতিয়ে দিই...'নবীন ঘাসে' চোখ ডুবালাম, 'ভাবনা'কেও ভাসিয়ে দিলাম 'পূব বাতাসে', হার্মোনিয়াম হাতে অন্ধকার ঘরে ঘামলামও কিছুক্ষণ উদলা গায়ে...কিন্তু পারলাম না...
আর সব বাদ দিয়ে মা হঠাৎ করে গান ধরল, "জনগণমন অধিনায়ক জয় হে..."
আমার ভীষণ অবাক লাগল! বর্ষার সাথে এই গানের কোনো অপ্রকাশিত গোপন সম্পর্ক আছে কি না তাই ভাবতে লাগলাম!
বৃষ্টির ছিটা লেগে আমার স্কাইকালারজিন্সের হাঁটুটা তখন আরেকটু বেশি গাঢ় নীলচে রঙের হয়ে উঠছিল। দূরের গাছগুলো, দূরের ল্যাম্পপোস্ট-টাওয়ার এবং আকাশের বেশ কাছাকছি বিল্ডিংগুলোকে আমি তখন আঙুল দিয়ে ঘষে ঘষে দিলাম স্কেচ করার পর। ওরা আবছা আবছা হয়ে গেল। বোবাদের অসহায় চোখের মতো।
মা কিছুতেই "গুজরাট মারাঠা" লাইনটা গাইতে পারছিল না, মাত্রা মিলছিল না। আমি অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঠিক করে দিতে পারলাম না। আমি একবার গেয়ে শোনাই, তারপর মা গায়, তারপর আমরা দুজনই হেসে উঠি খিলখিল করে...আমাদের হাসির শব্দ চাপা পড়ে যায় বৃষ্টির শব্দে...
আকাশ তখন একরঙা হয়ে গেছে...
আমি ছাদ থেকেই ডাক দিলাম, অ ড্রায়বার, রায়নগর দর্জিফারা...
ড্রাইভারটা থেমে গেল আর আমি টিশার্ট গায়ে দিয়ে, ব্যাগ ঝুলিয়ে, পকেটে চাবি-মানিব্যাগ-মোবাইল ঢুকিয়ে, বাবার স্যান্ডেলটা পায়ে দিয়ে দিলাম দৌঁড় বারান্দা থেকে নীচে।
ড্রাইভারকে ছাতা দিলাম। নিলো না। তারপর ওর নীল পানিকাপড় আমাকে আস্ত গিলে ফেলল খুব সহজে। ভিজে জবজবে হয়ে যাওয়া পেটানো শরীরের ড্রাইভারের গায়ে এসে বসল একটা কালো মহিষ, আর আমার ড্রাইভারটা অম্নি হয়ে গেল মাইকেল শুমাখার! দুর্দান্ত বেগে ছুটে চলল আমাদের ময়ূরপঙ্খী।
তারপর আমার চশমার কাচজোড়া কেবল ঝাপসা হয়েছে উত্তরোত্তর। আমিও মুছি নি। একটা দুইটা গাড়ির হেডলাইটে চোখের সামনে জলের প্রতিসরণে ইয়াব্বড় একএকটা আলোর আল্পনা দেখতে আমার ভালো লাগছিল।
জিন্দাবাজার তখন থমকে আছে। রাজাম্যানশন, মিলেনিয়াম আর ব্লু-ওয়াটারের উঠোনে তখন অনেকগুলো ভেজা চুল। অনেকদিন পর পানি জমে যাওয়া জিন্দাবাজারকে দেখলাম। রিক্সার চাকার স্পোক ভিজিয়ে দেয়ার মতো জল তখন জিন্দাবাজারের রাস্তায়। বৃষ্টিবন্দী মানুষগুলোর চোখেমুখে অপেক্ষার বিরক্তি নয়, উচ্ছাসই দেখলাম বরং। হঠাৎ একছাদে হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর কারো সাথেই কারো কথা নেই। তবু নীরব একটা রোমান্টিকতা সবার ভেতরে।
তারপর ধোপাদিঘিরপাড় ক্রস করতেই একটা সিএনজির যক্ষা হয়ে গেল। রাস্তার মাঝখানে কাশি জুড়ে দিল। আমার ভাঙাচোড়া রিক্সাটা তখন বিজয়ের হাসি হেসে ওকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল আমাদের দুজনকে নিয়ে।
সিএনজিলাশ আরেকটা দেখলাম জেইলরোড মোড়ে। একদম নিথর নিস্তব্ধ।
ততক্ষণে বৃষ্টি বেশ কমে গেছে। কিন্তু চশমার কাচ স্পষ্ট হয় নি। আলোর আল্পনা তখনও আঁকছিল কাকভেজা মোটরসাইকেলগুলো। আর আমি পিচের রাস্তায় বৃষ্টিফোঁটার ছিটকে পড়ার দৃশ্যগুলো এঁকে নিচ্ছিলাম খুব দ্রুত। বৃষ্টিফোঁটা খুব জোরে জোরে আছড়ে পড়ছিল রাস্তার উপর।
ফেরার পথে বৃষ্টি ছিল না...আর চশমাটা আমার ব্যাগ এর ভেতর...ভাঙা...
আজ নতুন একটা ফ্রেম কিনতে যাব...
১৯০৭০৯১২০৮
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০১০ রাত ২:১২