ছোড় ছোড় ঢেউ তুলি পানি,
লুসাই পাহার অত্তুন লামি আই
যারগই হন্নফুলী;
ছোট ছোট ঢেউ তুলে পানি, লুসাই পাহাড় থেকে নেমে এসে
যচ্ছে চলে কর্ণফুলী...
চাটগাঁইয়া দের খুব প্রিয় গান। ছোট বেলা থেকে অনেক অনেক বার শুনেছি। কখনো এর ভেতরের মর্মার্থ খুজিনি। কখনো এইগান শুনে মনে হয় নি একবার ছুটে যাই কর্ণফুলীর মোহনার কাছে। শেষ বিকেলের সূর্য যখন রক্তিম অগ্নিগোলক হয়ে সমগ্র পশ্চিমাকাশ আর জলরাশিকে বিষন্ন করে দিয়ে সাগর সঙ্গমে মিশে যেতে থাকে, মনে পড়ে না তখন কি ভেবেছি। হয়ত বা দু-একবার ফিরে চেয়েছি, হয়ত বা না।
আজ মনের সুদূর গভীরে, হটাৎ কি-এক সূক্ষ ব্যথায় মাঝরাতে জেগে উঠি ঘুম ভেঙ্গে। মনে হয় কত দিন মা'কে দেখিনা। দেখিনা দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠের শেষ প্রান্তে হেটে যাওয়া লাঙল কাধে কৃষক। মনে পড়ে কর্ণফুলিতে নৌকা ভ্রমন। মাঝরাতে মিড়ফোর্টের পিছে বুড়িগঙ্গায় গিটারের তালে তালে গান। কিত্তনখোলায় চাদের আলোর মাতাল সুধা। রাঙামাটির শুভলংয়ের পথে সোনলী সূর্যের নরম বিকেল, রূপালী জোছনা। সুনামগঞ্জের হাওড়ে মত্ত ঢেউএর মাঝে ডেঙ্গির উম্মাদ দুলুনী।
বন্ধুরা বলে, অনলাইনেও দেখি, ঢাকা-চট্টগ্রাম অঝোর বর্ষণে টলমল করছে। এসময় অক্লান্ত রোদের পর কুসুম গরম আরাম দায়ক মজাদার বৃষ্টি, ভার্সিটি বা অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে হুড় ফেলে দেয়ে কত ভিজেছি!
আর সাগরের উম্মত্ত ঢেউ যখন পাগলা ষাড়ের মত উদ্দাম বেগে ছুটে এসে পতেঙ্গার পাথুরে শৈকতে আছড়ে পড়ে সারা গা ভিজিয়ে দিত, সিগারেটে আগুন দিতাম।
বছরের এসময় মাতামুহুরীর উজানে প্রবল বর্ষণে নদীতে বাণ ডাকে। ঘোলা পানি দু-কুল ছাপিয়ে লামা-আলিকদমের পাহাডি গাছের বড় বড় অংশ টেনে নিয়ে চলে দূর্বার বেগে। আর কিশোর কিশোরিরা দুকুল থেকে ঝাপিয়ে পড়ে উল্কার বেগে ছুটে চলে, জাপটে ধরে টেনে আনে। আমি প্যান্ট হাটু পর্যন্ত গুটিয়ে তাই দেখেছি কত।
দেখেছিলাম দূর-সস্পর্কের এক কাজিন, ১৪/১৫ বছরের গ্রাম্য কিশোরি। টকটকে লাল সিলওয়ার-কামিজ, ভিজে লপ্টে আছে সারা গায়। সবুজ ওড়না দিয়ে কষে বেধে রেখেছে তার দেহের ভাজ। রোদে পোড়া তার ফর্শা রং উজ্জল তামাটে, মুখে বৃষ্টির ফোটা, যেন হিরের টুকরো। আকাশ ঢাকা মেঘের চেয়ে কাল তার চুল, টান টান করে বাধা, বৃষ্টির ফোটা ছুয়ে ছু্য়ে পড়ছে। চোখে তার শিকারির দৃষ্টি, ভেসে আসা কোন গাছের গুড়িতে চোখ হয়তবা! দাড়িয়ে আছে পাড়ে,এক হাতে বাঁশ ধরে, নদীতে ঝুকে থাকা বাঁশ ঝাড়ের গোড়ায়। ঝাপদিতে প্রস্তুৎ সর্বাঙ্গে। যেন টান টান ধনুকের ছিলায় ছুটতে প্রস্তুৎ একটা তীর, যেন গ্রাণাইট পাথরের নিখুত ভাষ্কর্য। ঠিক যেন জাফর ইকবালের বকুলাপ্পু। নদীর পাড় ডুবে আছে, আমি তার ক-হাত পিছে, হাটু পানিতে দাড়ানো। সেদিনের সেই মুহুর্ত আমার স্মৃতিতে পাকা ছাপ রেখে গেছে।
কতদিন ভেবেছিলাম মাতামুহুরীর উজানে যাব, নৌকা নিয়ে। পাহাড়ের মাঝদিয়ে বয়ে চলা আপাত শান্ত এই নদীর বর্ষার ভয়ংকর রূদ্র রুপ, না দেখে কি কেউ ভাবতে পারে? ২/৩ মাস ছাড়া সারা বছর শান্ত, ঝিরঝির বয়ে চলা টলমলে জলের নিচে ঝকঝকে বালু দেখা যায়।
কতবার কত পরিকল্পনা ভেস্তে গেল! স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি, অফিসে কাজের চাপ... যাওয়া হয়নি। আর আজ? বুকের ভেতর পাথুরে আফগান প্রান্তরের নি:সীম হাহাকার।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া,
ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া,
একটি ধানের শিষের উপর,
একটি শিশির বিন্দু ...
ইশ। দীর্ঘশ্বাস শুধু বাজে।
এবার দেশে গেলে সব দেখব, সব।
------
মাতামুহুরীর ছবি পোষ্ট করেছিলাম কিছু, অনেক দিন আগে।
দেখুন: Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০০৮ রাত ১২:৪৪