মাথাটা ঝিম ঝিম করছে ! তার সাথে অনিলার পরিচয় বছর পাঁচেক আগে । ভার্সিটির বারান্দায় মেয়েটা একাই বসে ছিল , দূর থেকে বিষন্ন মিষ্টি একটা মেয়েকে দেখে অনি কাছে এলো । কিন্তু কথা বলার সাহস পায়নি , পরে বন্ধু রাসেলের জন্মদিনে পরিচয় হয় । অনিলা রাসেলের খালাতো বোন ।
পরিচয়ের পরদিন থেকে ক্যাম্পাসে হাই-হ্যালো ! ধীরে ধীরে ওদের মাঝের রসায়ন টা জমতে থাকলো । অনিলা মেয়েটার সারাক্ষণই মন খারাপ থাকে , এত মিষ্টি একটা মুখ কিন্তু কেন জানি সারা বেলা মেঘ জমে থাকে । একদিন অনিলাকে ঘুরতে যাবার কথা বলে অনি । অনিলা খুব শান্তভাবে মাথা নাড়ে । গাড়িতে অনি নানা রকম গল্প , জোকস বলে অনিলাকে উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা করে ! সেদিন শহুরে বাতাসের বাইরে গিয়ে অনিলার মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরতে শুরু করে ।
অনিলা বাবার পছন্দ মত বিয়ে করেছিল । প্রথম কয়েক দিন ভালোই ছিল । কিছুদিন পর টের পায় স্বামী মাদকাসক্ত । সাথে শ্বাশুড়ির নানা রকম খুনসুটি কাটা গায়ে লবণের মত লাগতো । শেষে অনেকটা বাধ্য হয়ে তালাক নিয়ে আবার পড়াশুনা শুরু করে ।
তার কাছে জীবনবোধ নিতান্তই বেঁচে থাকা । অনি ধীরে ধীরে অনিলাকে বুঝাতে সক্ষম হয় চাইলে এখনো সব ঘুচিয়ে নেয়া যায় । সাথে অর্জিত হয় বিশ্বাস টাও । একসময় বিয়ে করে ওরা । ছোট্ট একটা চাকরী করে অনি , অনিলাও । দুজনের আয়ে ভালোই চলে সংসার ।
অনি স্পশটবাদী । নিজের বিবেক , নিজস্ব চিন্তা চেতনার সাথে আপোষ করতে নারাজ । ইতিহাসের আর সাহিত্যের বই পড়ে তার অবসর সময় কাটে । অনির মতে ইতিহাস মানুষকে শেকড় চেনায় , নিজের অস্তিত্ব বুঝতে শিখায় , আর ভবিষ্যতের রাস্তাটাও অনেকটাই দেখিয়ে দেয় । তাই ইতিহাস বাদ দিয়ে , ইতিহাসের ভুল না শুধরে এক পাও আগানোর উপায় নেই । যুগ যুগ ধরে মনিষীদের বলে আসা এ কথাটা অনি খুব অনুভব করে । কিন্তু অজানা কারণে জাতী হিসেবে আমরা কেন জানি শুধু ভুল আঁকড়ে ধরে থাকি , শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে গিয়ে দু কদম সামনে গিয়ে তিন কদম পেছনে যাই । অনির রাজনৈতিক দর্শন আপোষহীন । ওর এই সচেতনতার জায়গাটা অনিলার ভালো লাগে ।
সরাসরি কোন দলের সাথে অনি জড়িত নয় । অফিস থেকে বাসায় ফিরে নানা কাজে ব্যাস্ত থাকে । আর সবার মত ওর একটা ভার্চুয়াল অস্তিত্ব আছে । দিনভর নানান ঝুট ঝামেলার পর এখানে প্রশান্তি খুজে ।ফেসবুকে ব্লগে অনি লিখে তার নিজস্ব দর্শনের কথা , তার ভাবনার নানান দিক । এভাবেই একদিন সবাই সচেতন হবে , তখন পথচলা শুভ হবে । দেশের ভালো হলে , প্রতিটা নাগরিক তার সুফল ভোগ করবে। এভাবেই ভাবতে পছন্দ করে অনি । অনির কবিতা অনিলা খুব ভালোবাসে । গল্পে , কবিতায় অনি তার চিন্তার বহিপ্রকাশ ঘটাতে চায় ।
একদিন সুখবর এলো , ঘরে নতুন অতিথি আসবে । অনির চাপে অনিলা চাকরী থেকে ছুটি নেয় । সামনের দিন গুলোর স্বপ্ন সাজাতেই চোখ ঝলমল করে । এমন সময়ে ইতিহাসের এক ঘৃন্য অপরাধী বিচার সংক্রান্ত রাজনীতির কারণে পার পেয়ে যায় । ক্ষোভে ফেটে পড়ে সচেতন একটা মহল । যার অধিকাংশই তরুন , ভার্চুয়াল অস্তিত্ব নেমে আসে রাস্তায় । সাথে যোগ দেয় একই দাবী নিয়ে একটি মতাদর্শে বিশ্বাসী একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীরা । নানা পেশার , নানা মতের লোক সবাই একাত্ব একটা দাবী নিয়ে । দাবী একটাই ইতিহাসের কলঙ্ক মোচন হোক ।
তখনই আরেকদল বোকা যারা নিজেদের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেনা , ইতিহাস দেখেও না দেখার ভান করে তারা অনিদের এই প্রচেষ্টায় বাধা দেয় প্রোগাপান্ডা ছড়িয়ে । ফলাফল আরেক টি গ্রুপের আগমন , নতুন মোড়কে । অনিরা রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝেনা । শুধু জানে অতীতের ভুল না শুধরালে সামনে আগানো যায়না ।
অনিলা অসুস্থ শরীর নিয়ে বাসায় একাই থাকে । অনির দিন রাত কাটে অফিসে আর রাজপথে । এ নিয়ে অনিলার কোন অভিযোগ নেই , সেও তাই চায় ।
বিব্রত পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার গ্রেপ্তার করে অনি সহ আরো কয়জনকে । অনিলার এখন ভীষন প্রয়োজন অনিকে । হাসপাতালে যাওয়া দরকার । অনিলা খবর দেয় তার ভাইকে । হাসপাতালে নতুন অতিথি আসে ।
অনিলা চিঠি লিখে জানিয়ে দেয় অনিকে ওরা ভালো আছে । অনি যাতে মন ছোট না করে । ওর ছেলের নাম রেখেছে সূর্য । নতুন একটি সচেতনতার প্রজন্ম দেখা দিয়েছে সূর্যের আলোর মতই । আলোক রেখাটা মিলিয়ে যাবেনা যদি অনিরা ভেঙ্গে না পড়ে । সেই আলোকরেখা ছড়িয়ে পড়বে সূর্যদের মাঝে । এবার না হোক একদিন হবেই । তাই নিজের উপর আস্থা রেখে নিশ্চিন্তে থাকতে বলেছে অনিকে । চিঠির শেষে লিখে দিয়েছে
“ আমাদের ইতিহাস কাঁদছে ! বোবাকান্না !! ”
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০১৩ সকাল ১১:২৪